বাড়িওয়ালা আমার জুতা হেঁচড়িয়ে হাঁটাটা পছন্দ করে না। তাই অনেকবার বলেছে আমি যেন জুতা হেঁচড়িয়ে না হাঁটি। আমি প্রতিশ্রুতি দিয়েছি এবং দিচ্ছি আর এভাবে হাঁটব না। কিন্তু হাঁটছি...
আমার এক বড় ভাই প্রচুর কথা বলেন। তার অতিকথনে বিরক্ত এলাকার সবাই। সেই বড় ভাই-ই কিনা হঠাৎ করে এক দিন বলতে শুরু করলেন, কর্মই জীবন। জীবনে প্রচুর কাজ করতে হবে। কাজ না করলে জীবন অর্থহীন। আমি অবাক হয়ে বললাম, আপনার মধ্যে এমন পরিবর্তন কীভাবে এলো ভাই? কীভাবে সম্ভব এটা? আপনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করেন শুধু কথা বলে, অথচ এখন কিনা বলছেন কাজ করতে হবে। তা আপনি আদৌ কোনো কাজের পরিকল্পনা করেছেন কি? বড় ভাই বললেন, আরে আমি তো অলটাইম পরিকল্পনার মধ্যেই আছি এবং ছিলাম। আর অবশ্যই ছিলাম কাজের মধ্যে। আমি বললাম, কিন্তু কীভাবে? আপনি তো শুধু কথা বলেন। আরও বাজে ব্যাপার হচ্ছে প্রতিশ্রুতি দেন হুদাই। বড় ভাই এবার প্রায় লাফিয়ে উঠে বললেন, এই তো আসল জায়গায় হাত দিয়েছিস। আমি প্রতিশ্রুতি দিই। জি, এটাও একটা কাজ। তার মানে আমি কাজের মধ্যেই আছি। বিশ্বাস না হলে বাংলা ব্যাকরণ ঘেঁটে দেখতে পারিস, ‘দেওয়া’ ‘নেওয়া’ ইত্যাদি কিন্তু ক্রিয়া পদ। ক্রিয়া মানে কাজ। তার মানে পাবলিককে প্রতিশ্রুতি দেওয়ার মধ্য দিয়ে আমি মূলত কাজই করে যাচ্ছি। আমি স্থানত্যাগ করলাম। আমার এক চাচার কথা বলি। একবার তিনি পাড়ার ছেলেদের ডেকে এনে কথা দিলেন, যারা পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করবে, তাদের সবাইকে পাঁচশ টাকা করে পুরস্কার দেবেন। তার এই প্রতিশ্রুতি পেয়ে সবার মধ্যে উৎসাহ বেড়ে গেল। তারা মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া শুরু করল। এরপর পরীক্ষা হলো। দুর্দান্ত রেজাল্ট করল অনেকেই। এবার চাচাকে ধরা হলো পুরস্কারের জন্য। কিন্তু চাচা শুরু করলেন গড়িমসি। তার গড়িমসিকে পাত্তা না দিয়ে পাড়ার ছেলেরা আলটিমেটাম দিল, প্রতিশ্রুতি যেহেতু দিয়েছেন, অতএব পুরস্কার দিতেই হবে। নইলে খবর আছে। চাচা এবার আমতা আমতা করে বললেন, তোমরা কিন্তু বিষয়টা বুঝতেছ না। এই যে আমার প্রতিশ্রুতি শুইনা সবাই ভালো কইরা লেখাপড়া কইরা ভালো রেজাল্ট করেছ, এইটার মইধ্যে একটা খারাপ দিক আছে। সবার রেজাল্টই ভালো। এইটা কোনো ভালো জিনিস? কেন ভালো না জান? কারণ, কবি বলেছেন- ‘বেশি ভালো ভালো না।’ এবার সমস্বরে প্রশ্ন করা হলো, এইটা কোন কবি বলেছেন? চাচা প্রতিশ্রুতি দিলেন আবারও, কোন কবি বলেছেন, সেটা আমি ভালোভাবে জেনে পরবর্তীতে জানাব। না, চাচা আর জানাননি। মানে এখানেও প্রতিশ্রুতির বরখেলাপ। আমার এক ছোট ভাই বলল, মানুষ যে কী অবলীলায় প্রতিশ্রুতি দিতে পারে আর কী অবলীলায় বরখেলাপ করতে পারে, তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে আমার বাড়িওয়ালা। সে প্রতি মাসেই প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাচ্ছে সামনের মাসে বাসাটার সংস্কার কাজ করিয়ে দেবে। বিশেষ করে রংটং। কিন্তু মাসের পর মাস যাচ্ছে। সংস্কার আর হচ্ছে না। আমি বললাম, খুবই বাজে ব্যাপার। ছোট ভাই বলল, বাজে ব্যাপার তো অবশ্যই। তাই বলে কষ্ট পাওয়ার কিছু নেই। কারণ, সে যেমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা পালন করছে না, আমিও তাকে একটা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, বাট পালন করছি না। আমি জানতে চাইলাম, প্রতিশ্রুতিটা কী? ছোট ভাই বলল, হাঁটা। মানে বাড়িওয়ালা আমার জুতা হেঁচড়িয়ে হাঁটাটা পছন্দ করে না। তাই অনেকবার বলেছে আমি যেন জুতা হেঁচড়িয়ে না হাঁটি। আমি প্রতিশ্রুতি দিয়েছি এবং দিচ্ছি আর এভাবে হাঁটব না। কিন্তু হাঁটছি। এখন এমন হয়েছে যে, আমার জুতার ঘষায় বাসার টাইলসের কালারের বারোটা বেজে গেছে।