সোমবার, ১৬ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

শুরু হলো পড়াশোনা

আফরীন

শুরু হলো পড়াশোনা

আমরা ঠিক করলাম দেলু মিয়াকে পড়াশোনা শেখাব। স্কুল বয়সী একটা ছেলেকে ঘরের টুকিটাকি কাজে আটকে রাখার কোনো মানে হয় না। ঠিক করলাম আগে বাসায় বসে হাতেখড়িটা দেব। উপযুক্ত হয়ে উঠলে কোনো এক সময় স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেওয়া যাবে। দেলু মিয়াকে বিষয়টা বলতেই মনে হলো জোঁকের গায়ে লবণ পড়েছে। ভীষণ মোচড়া-মুচড়ি শুরু করল। সে জগতের সমস্ত কাজ করতে রাজি আছে, কিন্তু পড়াশোনা করবে না। “আপা, আমি খাটের তলা পরিষ্কার কইরা মুইচ্ছা দিমু কিন্তুক পড়তাম না আপা।” “খাটের তলা তোর মুছতে হবে না। পড়াশোনা খাটের তলা মোছার চাইতে অনেক সহজ।” “আপা, আমার বাপে কইছে পড়ালেহা করলে মাইনষে গাড়ি চাপা পইরা মইরা যায়। আমি গড়ি চাপা পইরা মরারে অনেক ডরাই।” আমি হেসে ফেললাম। মিথ্যা কথা বলায় ভালোই এক্সপার্ট দেখছি! বললাম, “আমি তো অনেক পড়াশোনা করেছি। আমি কি মরে গেছি?” “আপনে তো বড় মানুষ।” ‘আমি তোর চেয়ে অনেক ছোট বয়সে পড়াশোনা শুরু করেছি।” দেলু মিয়ার গড়িমসি চলল সপ্তাহখানেক। বোঝালাম পড়াশোনা করলে ও ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, পাইলট, নাবিক, যা খুশি হতে পারবে। কিন্তু দেলু মিয়া এসবের কোনো কিছুই হতে চায় না। অনেক কথা বলে বের হলো রেলের টিকিট চেকারের কাজটি তার ভীষণ পছন্দের। কিছু যদি হতে হয় তাহলে সে রেলের টিটি হবে। শেষ পর্যন্ত ঠিক হলো শুধু রেলের টিটি হওয়ার জন্য যতটুকু পড়াশোনা দরকার সে ততটুকু করবে। এর বেশি একটুও করবে না। আমরা এতেই খুশি। রাজি তো করানো গেল। কিন্তু প্রতিদিন পড়তে বসানো সে আরেক যুদ্ধ। “দেলু বই-খাতা নিয়ে আয়।” দেলু টিভি দেখতে দেখতে উত্তর দেয় “আপা আমার প্যাট মোচড়াইতাছে।” পেট মোচড়ানোর কথা বলে বাথরুমে গিয়ে বসে থাকে। ছুটির কথা না শোনা পর্যন্ত আর বের হয় না। পরের দিন জিজ্ঞেস করি “দেলু তোর লেখা কই?” “আপা, ডাইন হাত বিষ্যে ফাইট্যা যাইতাছে। হাত লাড়তে পারি না।” অথচ সন্ধ্যা বেলায়ও সে দিব্যি সব মোছামুছি করেছে। এই রকম চলতেই থাকে। দুই একদিন কড়া ধমক দিয়ে বসাই। পড়াশোনা নিয়ে এত ভয় তার কোত্থেকে এসেছে কে জানে? এগারো দিন চেষ্টা করে স্বর-অ, স্বর-আ, হ্রস-ই এই তিন অক্ষর শিখিয়েছি। তাও কোনটা আগে কোনটা পরে গুলিয়ে ফেলে। লেখার অবস্থা যাচ্ছেতাই। স্বর-অ, দেখতে হয় চিতল মাছের মতো। স্বর-আ এর আকার কখনই আ এর সঙ্গে থাকে না। আধহাত দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, তাও কাত হয়ে। হ্রস-ই এর কথা আর কী বলব। হেসেই বাঁচি না। গতকাল বললাম পরীক্ষা নেব। প্র্যাকটিস অনেক হয়েছে। পরদিন সব কাজ সকাল সকাল শেষ করে বিকালে খাতা রেডি করে দেলু মিয়াকে ডাকলাম। দেলু মিয়ার সাড়াশব্দ নেই। উঠে দেখতে গেলাম। ঘরের কোথাও নেই। বাথরুমেও না। গেল কোথায়? বাইরেও যেতে দেখিনি। তবু দারোয়ান চাচাকে জিজ্ঞেস করলাম। না যায়নি কোথাও। তাহলে, ঘরেই আছে। আধা ঘণ্টা খোঁজাখুঁজি করে খাটের তলায় পাওয়া গেল দেলু মিয়াকে। বললাম, ‘‘খাটের তলায় কী করিস? পরীক্ষা দিবি না?’’ দেলু মিয়ার সহজ জবাব, ‘‘খাটটা তো ঘুণে খাইয়া ফেলাইতেছে। আমি না দেখলে তো খাট ভাইঙা পড়বেন। কোমরটা ভাঙবেন। আপনেই কন, কোমরটা ভাঙবেন নাকি আগে আমার পরীক্ষা নেবেন?’’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর