সোমবার, ১ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

এত কথা বলে রে...

ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খুলে দেন। তাইলে দেখবেন আর মুখে কোনো কথা বলবে না। সারা দিন স্ট্যাটাস, কমেন্ট, রিপ্লাই, চ্যাটিং ইত্যাদিতে ব্যস্ত থাকবে...

ইকবাল খন্দকার

আমার এক ছোট ভাই বলল, মানুষ আজকাল খুব বেপরোয়া হয়ে গেছে। নিজের জীবনের কোনো মায়া করছে না। আমি বললাম, একদম ঠিক বলেছিস। মানুষ যদি নিজের জীবনের মায়া করত, তাহলে এত স্পিডে গাড়ি চালাত না। দেখেছিস আজকাল কী স্পিডে, কী বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালায় আর কত অ্যাক্সিডেন্ট করে? নিজে তো মরেই, অন্যকেও মারে। ছোট ভাই বলল, আপনি কথাগুলো দামিই বলেছেন। কিন্তু আমি যেই প্রসঙ্গে কথাটা বলেছিলাম, এর ধারে কাছেও যেতে পারেননি। বেশি না, ওই প্রসঙ্গ থেকে দশ-পনের কিলোমিটারের মতো দূরে আছেন। আমি বললাম, তাহলে তো মোটামুটি ভালোই দূরে আছি। আচ্ছা, তুই কথাটা যেন কোন প্রসঙ্গে বলেছিলি? ছোট ভাই বলল, কোনো কিছু হলেই মানুষ যে প্রচুর কথা বলে, ওই প্রসঙ্গে। আমি অবাক হয়ে বললাম, তাহলে এই কথাটা কেন বললি, মানুষ নিজের জীবনের মায়া করছে না? ছোট ভাই বলল, শোনেননি, বেশি কথা বললে আয়ু কমে যায়? মানুষ যদি নিজের জীবনের মায়া করত মানে আয়ু কমার ভয় করত, তাহলে কি এত কথা বলত? আমি মুখে কিছু না বলে শুধু না-বোধক মাথা নাড়ালাম। দরকার কী কথা বলে আয়ু কমানোর?

আমার এক বড় ভাই বললেন, আগে ক্রিকেট খেলা হলে বেশি কথা বলত দর্শকরা। কখনো বাসার ড্রয়িংরুমে বসে, কখনো চা-স্টলের বেঞ্চে বসে। কখনো প্রশংসামূলক কথা, কখনো সমালোচনা। ক্রিকেটাররা দর্শকের এসব কথাবার্তা নিয়ে মাথা ঘামাত না। তারা শুধু চেষ্টা করত, নিজের সেরাটা দিয়ে খেলার। আর এখন ক্রিকেটাররা দর্শকের কথার রিপ্লাই কিন্তু দিচ্ছে খুব ভালোভাবে। আবার পরামর্শও দিচ্ছে। তবে এমন পরামর্শ আমিও স্ত্রীকে দিয়েছিলাম। সেই ঘটনায় একটু আলোকপাত করি। সেদিন দাওয়াত খেতে যাব তোর ভাবিকে নিয়ে। সে কোন জামা পরবে, এটা জিজ্ঞেস করতে করতে কান ঝালাপালা করে দিল। আমি ঝামেলা সামলাতে বললাম, আয়নায় নিজের মুখ দেখ গিয়ে। বিশ্বাস করবি না, এর পর থেকে তোর ভাবি আয়নার সামনে থেকে আর আসছেই না। সে আয়নায় শুধু নিজের মুখই দেখছে না, কানের দুল, গলার চেইন, হাতের ঘড়ি ইত্যাদিও দেখছে। কী মুশকিল বল দেখি!

আমার এক বন্ধু বলল, কী আজব জামানা আসল। এ রকম হলে চলবে কীভাবে? আমি বললাম, কীসের কথা বলছিস? একটু খুলে বল। নইলে তো বুঝতে পারছি না। বন্ধু বলল, না, মানে পাড়ার মাঠে খেলা হচ্ছিল। ছোট ভাইরা খেলছিল। আমার হাতে তেমন কাজ ছিল না, তাই মাঠের কোনায় বসে দেখছিলাম। তো এক ছোট ভাই একটা সহজ ক্যাচ মিস করল। কেউ কিছু বলল না। আমিও বললাম না। ভাবলাম, খেলায় এ রকম হতেই পারে। একটু পরে সে আরেকটা সহজ ক্যাচ মিস করল। আর এই মিসের কারণে খেলাটা হাতছাড়া হয়ে গেল। অতএব খুব স্বাভাবিকভাবেই তার সমালোচনা শুরু হয়ে গেল। আমি ভাবলাম সমালোচনা শুনে ছোটভাই বুঝি নিজেকে শোধরাবে। পরবর্তী ম্যাচের জন্য আরও ভালোভাবে প্রস্তুতি নেবে। কিন্তু না, সে শুরু করল পাল্টা জবাব দেওয়া। বলে কী, ক্যাচ ধরমু-ই, এ রকম নিশ্চয়তা আশা করেন কীভাবে? জানেন না, ক্রিকেট অনিশ্চয়তার খেলা? কথা তো ঠিক। সমালোচনা যা করেছিলাম সব ফিরিয়ে নিলাম। আমার এক প্রতিবেশী বললেন, আজকাল কেউ কোনোকিছুর দায় নিতে চায় না। ভুল করার পর ‘সরি’ বলবে দূরের কথা, উল্টা কথা শোনাতে চায়। যেমন গতকাল বুয়াকে বললাম ময়লার পোঁটলাটা নিচে নেমে ডাস্টবিনে ফেলে আসতে। সে করল কী, বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছুড়ে মারল। আর পড়ল গিয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া একজনের মাথার ওপর। আমি মনে করেছিলাম বুয়া বুঝি ভুল স্বীকার করবে। ক্ষমা চাইবে। কিন্তু না। সে বলে কী, আইজ কাইল কত মানুষ মারা যাইতাছে ঠাডা পইড়া! এই লোকটার ওপর ঠাডা তো আর পড়ে নাই। ময়লার পোঁটলা পড়ছে। ময়লার পোঁটলা পড়লে মানুষ মারা যায়? তাইলে সমস্যা কী? আমার এক ভাবি বললেন, ছেলে মেয়েরা খুব বেশি কথা বলে। কী করি বলেন তো? আমি বললাম, ‘কী আর করবেন। ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খুলে দেন। তাইলে দেখবেন আর মুখে কোনো কথা বলবে না। সারা দিন স্ট্যাটাস, কমেন্ট, রিপ্লাই, চ্যাটিং ইত্যাদিতে ব্যস্ত থাকবে। ল্যাপটপের ওপর দিয়ে একটু চাপ গেলেও আপনার কানের পর্দা থাকবে চাপমুক্ত।’ অবশ্য কম কথা বললেও যে সব সমস্যার সমাধান হবে বিষয়টা এমন নয়। যেমন, আমার স্ত্রী রেগে গেলে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। এমনই এক দিনের ঘটনা। স্ত্রীর কথা বন্ধ। তার রাগ ভাঙানোর জন্য অনেক কথা বলে ফেললাম। যেমন, চলো, আজকে বাইরে খাব। তোমাকে শপিংয়ে নিয়ে যাব। চলো, সিনেমা দেখে আসি। নাহ, তবু স্ত্রীর মুখে কথা নেই। রাগ ভাঙাতে না পেরে ফিরে আসব, এমন সময় সে বলে উঠল, ‘জানো না, মৌনতা সম্মতির লক্ষণ?’ কথা তো ঠিক। এবার সেরেছে...

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর