সোমবার, ৮ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

একদিন ট্রেনে...

তানভীর আহমেদ

একদিন ট্রেনে...

ট্রেনে নানা ধরনের যাত্রী ওঠেন। কেউ ওঠে প্রথমে অন্য যাত্রীর মাথায় ব্যাগ বা লাগেজের বাড়ি লাগান। কেউ সিটে বসেই জানালা খোলা বা বন্ধ করার জন্য সিটকানি ধরে টানাটানি শুরু করেন। কেউ সিট খুঁজতে খুঁজতে এক বগি থেকে অন্য বগিতে যেতে যেতে পুরো ট্রেন দুবার চক্কর দেন। কেউ উঠেই ট্রেনের দরজায় বসে পড়েন। কেউ সিটে বসেই খাওয়ার অর্ডার দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কেউ আবার বাসা থেকেই নানা পদের খাবার নিয়ে আসেন। ট্রেনে উঠেই শুরু করেন খাওয়া। কেউ শুরু করেন মোবাইলে সিনেমা দেখা, গান শোনা। উপরে উল্লেখিত যাত্রীদের তালিকায় আমি নেই। আমি আছি ‘ঘুমানি’ যাত্রীদের তালিকায়। আমার সিটে বসেই ঘুম দিই। আমার মতো যাত্রীদের কাছে ট্রেনে লম্বা ভ্রমণের সবচেয়ে আনন্দদায়ক বিষয় হচ্ছে ফ্রেস একটা ঘুম। এক ঘুমে পুরো রেলপথ পাড়ি দিতে না পাড়ার একটা দুঃখ অনেকের মতো আমারও আছে। সেই দুঃখ কাটানোর পরিকল্পনা নিয়ে ট্রেনে উঠেছিলাম। ইচ্ছা করেই আগের রাতে ভালো মতো ঘুমাইনি। ট্রেনে উঠে দেখি পাশের সিট খালি। জানালার পাশের সিটে বসে ঘুমানোর পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে সবে চোখটা বন্ধ করেছি, তখনই এক ভদ্রলোক হাজির। ‘ভাই, সিটটা ছাড়েন।’ এ ধরনের প্রশ্ন শোনার পর যেটা করতে হয় সেটাই করলাম। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকার অভিনয় করলাম। অভিনয় যে কেমন পারি তা কিছুক্ষণ পরেই টের পেলাম। ভদ্রলোক পাশের সিটে বসেই বলল, ‘কই যাবেন?’ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থেকে যেন হঠাৎ জেগে ওঠলাম। চোখ কচলাতে কচলাতে উত্তর দিলাম। বাইরে তাকিয়ে দেখি ট্রেন এখনো ছাড়েইনি। ভদ্রলোক কোন ধরনের যাত্রী বোঝার চেষ্টা করছি। আধা ঘণ্টার মধ্যেই টের পেলাম, এই লোক গল্পবাজ মানে ‘কথা বলইন্না লোক’। ট্রেনে ওঠার পর থেকেই আশপাশে সবার সঙ্গে তার পরিচয় আদান-প্রদান, খোঁজখবর নেওয়া শেষ। তার মামাতো ভাইয়ের শ্বশুরবাড়ির লোকজনও তিনি বের করে ফেলেছেন। আরেক লোকের শালা নাকি তার বাড়ি থেকে একটু দূরে মানে পাশের জেলাতেই চাকরি করেন, এটাও জানা গেল। আশপাশে সবার সঙ্গে আড্ডা শেষে আমাকে ধরলেন। কথা প্রসঙ্গে জানতে পারলেন আমি আসলে তেমন কিছুই জানি না। আন্দাজে হু, হা করি। তাই যে কোনো কিছু বোঝানোর জন্য তিনি মোবাইল ফোন বের করেন। তারপর গুগল, ইউটিউব, ফেসবুক থেকে সেটা দেখান। বুঝিয়ে দেন। তবে আমি কোনো ধরনের বোঝাবুঝির মধ্যে নাই। আমার টার্গেট এক ঘুমে রেলপথ পাড়ি দেওয়া। সেটা হচ্ছে না। চোখ বন্ধ করলেই লোকটি পেটে খোঁচা মেরে জিজ্ঞেস করেন, ‘ঘুমাচ্ছেন নাকি? শোনেন...।’ শুনতে শুনতে বিশ্বের জলবায়ু সমস্যা, ধূমপান কীভাবে ফুসফুসের ক্ষতি করে, ফেসবুকের আসল উদ্দেশ্য কী ইত্যাদি জানা শেষ। ‘চাঁদে নাকি মানুষ জমি কিনছে, সেখানে ফুচকার দোকানও দিয়েছে’, এ গুরুত্বপূর্ণ খবরটি তিনি আমাকে শোনানোর জন্য মোবাইল বের করে চোখের সামনে ধরলেন। ট্রেন তখন প্ল্যাটফরমে দাঁড়িয়ে। জানালা দিয়ে ছোঁ মেরে কে যেন মোবাইলটা নিয়ে হাওয়া। দুর্ঘটনার আকস্মিকতায় দুজনেই হতভম্ব। লোকটি মন খারাপ করে চুপ হয়ে রইল। কথাবার্তা বন্ধ। এ সুযোগে আমি মনে মনে ঘুমানোর প্ল্যান নিয়ে চোখটা বন্ধ করতে যাব, তখনই লোকটি পেটে খোঁচা মেরে বলে ওঠলেন, ‘ঘুমাচ্ছেন নাকি? শোনেন। এর আগেও একবার ট্রেন থেকে আমার মোবাইল চুরি হইছিল।  সেই ঘটনাটা বলি...।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর