সোমবার, ২৯ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

আমাদের ভ্রমণ কাহিনি

রাফিউজ্জামান সিফাত

আমাদের ভ্রমণ কাহিনি

প্রতিবার ট্যুর মানের ভ্রমণের শুরুতে খলিল বেজায় আগ্রহ দেখায়। ও বলে, ‘ট্যুরে বন্ধুত্ব আরও পাকাপোক্ত হয়।’ সে নিজেই ট্যুর প্ল্যান তৈরি করে, লোকেশন বাছাই করে, সবাইকে ধরে ধরে রাজি করায়। তারপর অনলাইনে বাসের টিকিটের খোঁজ নেওয়া থেকে শুরু করে ফোনে হোটেল বুকিং, খাওয়া-দাওয়ার চার্ট, ঘুরে বেড়াবার দর্শনীয় স্থানগুলোর ম্যাপ, ভাড়ার তালিকা সব নিজ হাতে গুছিয়ে রওনা দেওয়ার ঠিক এক ঘণ্টা আগে শুকনো মুখে বাস কাউন্টারে এসে জানায়, ‘আমি যেতে পারছি না রে। তোদের টিকিট কাউন্টারে বুকিং করা আছে, আমার নাম বললেই দিয়ে দেবে। যা, তোরা ঘুরে আয়।’ আগে ভাবতাম আর্থিক অসুবিধার কারণে খলিল এমনটা করে। হয়তো শেষ মুহূর্তে টাকা জোগাড় করতে পারেনি সে। বন্ধুরা মিলে ওর খরচ দিতে চাইতাম, ও নিত না। বলত, যাচ্ছি না অন্য একটা কারণে। জানতে চাইতাম, ‘অন্য কারণটা কী?’ খলিল এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করত তারপর মাথা নিচু করে কাউন্টার ছেড়ে ধীরে ধীরে চলে যেত। আর  পেছনে ফিরে তাকাত না। আমরা ধারণা করতাম খলিল কান্না লুকাচ্ছে। হয়তো আর্থিক সংকটের কথাটা সে সংকোচে মুখ ফুটে বলতে পারছে না। আমরা বলতাম, ‘আহারে, বন্ধুটার কী কষ্ট!’ বাসে বসেও খলিলের জন্য আমাদের খারাপ লাগত। ট্যুরে গিয়েও আলোচনায় উঠে আসত বন্ধুটির নাম। সব প্ল্যান করল অথচ সে নিজে আসতে পারল না। আমাদের সহজ-সরল বন্ধুটি ঢাকা শহরে একা একা আছে, মনে মনে কষ্ট পাচ্ছে আর আমরা ওর প্ল্যান করা ট্যুরে মজা করছি। আমাদের ভিতরে বেশ সংকোচ বোধ হতো। এভাবে বেশ কয়েকটি ট্যুরে কাটানোর পর বাকি বন্ধুরা মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম, নাহ, এভাবে বন্ধুকে ছেড়ে আর ট্যুরে যাব না। পরেরবার খলিলকে একটা সারপ্রাইজ দিব। ও যেহেতু লজ্জায় টাকা নেবে না, আমরাই ট্যুরে যাব না। ওর সামনে সবাই বাসে চড়ব ঠিক কিন্তু খলিল বিদায় নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাস থেকে নেমে পড়ব। তারপর পেছন পেছন দৌড়ে গিয়ে ওকে জাপটে ধরে চমকে  দেব। দারুণ মজা হবে। পরে টেকনাফ ট্যুরে খলিল যখন বলল, একটা সমস্যার কারণে এবারও সে যেতে পারছে না, আমরা ভীষণ খুশি হলাম। প্ল্যান সাকসেস হতে যাচ্ছে। করুণ মুখে আমরা বাসে উঠে বসলাম। জানালা দিয়ে দেখলাম কাউন্টার ছেড়ে ক্লান্ত পায়ে খলিল চলে যাচ্ছে। আমাদের বাস ততক্ষণে ছেড়ে দিয়েছে। অল্প দূর এগোলে ড্রাইভারকে বলে-কয়ে, ম্যানেজ করে বাস থামিয়ে বন্ধুরা নেমে পড়লাম। আচমকা আমাদের দেখলে খলিল ভীষণ অবাক হয়ে যাবে! কেঁদেটেদেও দিতে পারে। তবে সেটা হবে আনন্দ অশ্রু। একজনকে দায়িত্ব দেওয়া হলো পুরো সিনটা ফেসবুকে লাইভ করতে, বন্ধুত্বের স্মৃতি হয়ে থাকবে। কাউন্টারের কাছাকাছি এসে হার্ড ব্রেক কষে থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম। সামনের দৃশ্য দেখে সবার চক্ষু চড়ক গাছ। আমাদের আলাভোলা বন্ধুটি একজন রূপসী মেয়ের গা-ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। খলিলের হাতে চিপসের প্যাকেট। সে মেয়েটিকে চিপস খাইয়ে দিতে গিয়ে নিজে খেয়ে ফেলছে। দুজনই খিল খিল করে হাসছে। সামনে দাঁড়ানো তেঁতুলিয়াগামী বাস হর্ন দিচ্ছে, এক্ষুনি ছাড়বে। ওরা খুনসুটি করতে করতে বাসের দিকে এগোচ্ছে। বন্ধুরা হা করে ওদের দিকে চেয়ে রইলাম।  টেকনাফগামী বাস ততক্ষণে আমাদের ছেড়ে বহুদূর।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর