সোমবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

লাইনেই লাইন হয়

ইকবাল খন্দকার

লাইনেই লাইন হয়

আমার এক বড়ভাই ফোন দিয়ে জানালেন, তার নাকি প্রচন্ড মন খারাপ। অনেকটা হতাশও তিনি। আমি এই মন খারাপ ও হতাশার নেপথ্য কারণ জানতে চাইলাম। বড়ভাই বললেন, কারণ বলে আর কী হবে! মন-মেজাজ এতটাই খারাপ যে, কিছু বলতেই ইচ্ছা হচ্ছে না। আমি বললাম, তবু বলতে হবে ভাই। কারণ, বললেই মন হালকা হয়। যত না বলবেন, ততই দেখবেন মনের ভার বেড়েই চলেছে। বড়ভাই কিছুক্ষণ ঝিম মেরে থেকে বললেন, কিছুদিন আগে গ্রাম থেকে একটা ড্রাইভার আনলাম। সে এখনো শহরের বাতাস ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারেনি। ফলে এমন এমন উদ্ভট কাজ করে, রীতিমতো হাস্যকর। তবে আজকে যেটা করেছে, সেটা আর হাস্যকর পর্যায়ে নেই। মেজাজ খারাপ হওয়ার পর্যায়ে চলে গেছে। আমি বললাম, কী করেছে, যদি একটু বলতেন আরকি। বড়ভাই বললেন, তুই তো জানিস আমাদের কোনো কাজই লাইন ছাড়া হয় না। তো আমি তাকে কমলাপুর পাঠালাম একটা জিনিসের জন্য। আর বললাম, লাইন ধরতে হতে পারে। অতএব লাইনে যেন দাঁড়ায়। একটু আগে একজনের মাধ্যমে জানতে পারলাম, সে নাকি কমলাপুর রেললাইনের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এখন তার সঙ্গে ফোনে কথা বলে জানলাম, লাইন বলতে সে নাকি রেললাইনকেই বোঝে। এবার চিন্তা কর, লাইনে দাঁড়াতে দাঁড়াতে জীবন তামা তামা হয়ে গেল। এই লাইন, সেই লাইন, কত লাইন! অথচ সে রেললাইন ছাড়া অন্য কোনো লাইন সম্পর্কে অবগতই না। এই বেআক্কেল লইয়া আমি কী করব? আমার এক প্রতিবেশী বললেন, ছোটবেলায় কেন যে মুরব্বিদের কথা শুনলাম না! মনে হয় তাদের বদদোয়া লেগেছে। নইলে এই অবস্থা হবে কেন? আমি বললাম, কী হয়েছে বা ছোটবেলায় মুরব্বিদের কোন কথাটা শোনেননি, একটু বিস্তারিত বলবেন? প্রতিবেশী বললেন, আমি ‘লাইন’ করি, মানে প্রেম করি, এটা মুরব্বিরা পছন্দ করতেন না। তার পরেও লাইন করেছি। মানে প্রেম করেছি। তারপর সেই যে আমাকে লাইনে ধরেছে, এই লাইন থেকে বের হওয়ার কোনো রাস্তা খুঁজে পাচ্ছি না। সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, এখন লাইন আমাকে ভালোভাবেই পেয়ে বসেছে। মোটকথা লাইন আমাকে ছাড়ছেই না। ওই তো একটু আগেও ট্রাকের পেছনে লাইন ধরে স্বল্প দামে মাল কিনে নিয়ে আসলাম। আমি বললাম, অনেক কথা শুনলাম। আর কথা না বাড়াই। এখন মরাল অব দ্য স্টোরি বলেন। প্রতিবেশী বললেন, মরাল অব দ্য স্টোরি এটাই, আমার মতো ছাত্রজীবনে তোমরা কেউ ‘লাইন’ করো না। আমার এক বন্ধু বলল, ছোটবেলায় ভূতের নাম শুনলেই ভয় পেতাম। এখন বড় হয়েছি। তবে ভয় কিন্তু কাটেনি। এখন যেটা শুনলে ভয় পাই, কলিজার পানি শুকিয়ে যায়, সেটা হচ্ছে, ‘লাইন’। আমি বললাম, ঠিকই বলেছিস। আসলে লাইনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের জীবনটা তেজপাতা হয়ে গেল। বন্ধু বলল, তুই যা ভাবছিস, তা না রে পাগলা। আমাকে লাইনে দাঁড়ানো নিয়ে আমার কোনো খারাপ অভিজ্ঞতা নেই যে, লাইনের নাম শুনলে ভয় পাব। লাইন আমাকে যন্ত্রণা দিচ্ছে অন্যভাবে। আমি জানতে চাইলাম, কীভাবে? বন্ধু বলল, কীভাবে আবার? আমার বাসার গ্যাস লাইনটা লিক করে। সব সময় অবশ্য লিক করে না। কোনো কোনো সময় লিক করে। ব্যস, যখন লিক করে তখনই আমার বউ চিৎকার করে বলে ওঠে ‘গ্যাসের লাইন’! কোনো কোনো সময় সংক্ষেপে বলে, ‘লাইন’। এখন অবস্থা এমন শোচনীয় পর্যায়ে চলে গেছে যে, ‘লাইন’ শব্দটা শুনলেই হয় আমি দৌড় শুরু করি, না হয় মোবাইল খুঁজতে শুরু করি তিতাস গ্যাসের লোকজনকে ফোন করার জন্য। মোটামুটি অস্থির অবস্থা আরকি। আমার এক ছোটভাই বলল, আমি গান-বাজনা খুব পছন্দ করি। ছোটবেলায় এলাকার বিভিন্ন মঞ্চে গান গাইতাম। তখন আমার প্রিয় একটা গান ছিল। যেটা প্রায় সব মঞ্চেই গাইতাম। কিন্তু এখন লাইনে দাঁড়াতে দাঁড়াতে এতটাই অতিষ্ঠ হয়ে গেছি যে, সেই গানটা মুখে নিতেও ভয় লাগে। আমি কিছুটা অবাক হয়ে বললাম, কোন গানটা একটু বল তো শুনি। ছোটভাই বলল, ‘আমার লাইন হয়ে যায় আঁকাবাঁকা, ভালো না হাতের লেখা’।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর