সোমবার, ৮ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০ টা

ঊর্ধ্বগতিতে আলাপ

‘আমি এক তলার বারান্দা থেকে লাফ দিয়ে দেখেছি। লাফ দিলেই নিচে পড়ে যাই। আমার গতি যদি ঊর্ধ্বমুখী হতো, তাহলে এক তলা থেকে লাফ দিলে নিচে পড়তাম না, দোতলায় উঠে যেতে পারতাম’

ইকবাল খন্দকার

ঊর্ধ্বগতিতে আলাপ

আমার এক ছোট ভাই বলল, আমাদের গানের ভান্ডার আসলেই সমৃদ্ধ। যখন যেমন পরিস্থিতি, তখন তেমন গানই পাওয়া যায়। কোনো প্রকার গান সংকটে ভুগতে হয় না। এই যে এখন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজার, এই পরিস্থিতির জন্যও কিন্তু গান রেডি। খেয়াল করবেন ভাই, আমাদের নজর, আমাদের গন্তব্য কিন্তু ওপরের দিকে। দুয়েকটা উদাহরণ না দিলে বুঝবেন না। আমি বললাম, উদাহরণ দেওয়ার কোনো দরকার নেই। এখনকার পরিস্থিতির জন্য যে গান রেডি বললি, সেটা কোনটা, এইটা শুধু একটু বল। ছোটভাই বলল, ভাই, আইয়ুব বাচ্চুর ওই গানটা ‘আর বেশি কাঁদালে উড়াল দেবো আকাশে’। গান ঠিক আছে না ভাই? আমি বললাম, গান তো ঠিকই আছে, তবে সুর ঠিক নেই। ব্যান্ডের গান, অথচ তুই যে সুরে গাইলি, মনে হলো উচ্চাঙ্গ সংগীত। ছোটভাই বলল, ভাই, বিষয়টা কিন্তু আপনাকে বুঝতে হবে। যেহেতু উপরের ব্যাপার, মানে আকাশে উড়াল দেওয়ার ব্যাপার, এককথায় ঊর্ধ্বগতির ব্যাপার, অতএব উচ্চ উচ্চ একটা ভাব থাকতেই হবে। তাই গানটা ব্যান্ড সংগীতের আওতাভুক্ত হলেও একটু উচ্চাঙ্গ সংগীতের ফিল দিয়ে গাওয়ার চেষ্টা করলাম। চেষ্টা তো না, ক্ষুদ্র প্রয়াস। আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াসে সন্তুষ্ট হয়ে আপনি চাইলে মৃদু হাততালি দিতে পারেন। আমার এক প্রতিবেশী বললেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই বাজারে আমার নিজের মধ্যে কেমন যেন একটা ঊর্ধ্বগতি ভাব চলে এসেছে। অবশ্য এতে উপকারও পাচ্ছি। আমি বললাম, একটু বুঝিয়ে বলেন। প্রতিবেশী বললেন, আসলে হয়েছে কী, আমার বউ খালি কানের কাছে ঘ্যানর ঘ্যানর করে। এটা লাগবে, সেটা লাগবে। পিঁয়াজ লাগবে, নুন লাগবে, আদা লাগবে। মোটকথা, সে সারা দিনই আমাকে বাজারে পাঠানোর তালে থাকে। আগে ঠিকই আমি তার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে যখন-তখন বাজারে দৌড় দিতাম। কিন্তু এখন যেহেতু জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, এখন তো আর যখন-তখন বাজারে দৌড় দিলে চলে না। আবার বাসায় থাকলেও ঘ্যানর ঘ্যানর সহ্য করতে হয়। ব্যস, এই সুযোগেই আমার মধ্যে একটা উর্ধ্ব গতির ভাব চলে এলো। আমি কীভাবে কীভাবে যেন বাড়িওয়ালার কাছ থেকে ছাদের চাবিটা পেয়ে গেলাম। তো বউ ঘ্যানর ঘ্যানর শুরু করলেই করি কী, আস্তে করে ছাদে চলে যাই। এই যে আমার মধ্যে ঊর্ধ্বগতির ভাবটা চলে এলো, এতে কিন্তু আমার মান এবং কান দুটোই রক্ষা পেল। তবে একটা ব্যাপার কী জানেন, বাড়িওয়ালার কাছ থেকে ছাদের চাবি পেলেও আমাকে কিন্তু কষ্ট করে তালা খুলতে হয় না। যখনই নিজের মধ্যে ঊর্ধ্বগতির ভাব চলে আসে আর ছাদে যাই, গিয়ে দেখি গেট খোলা। আর বাড়িওয়ালা দাঁড়িয়ে আছে ছাদের কোনায়। ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না। আমি বললাম, না বোঝার কিছু নেই। আপনার বাড়িওয়ালার মধ্যেও আপনার মতোই ঊর্ধ্বগতির ভাব চলে এসেছে। খোঁজ নিয়ে দেখেন বিষয়টা।

আমার এক বড়ভাই বললেন, ঊর্ধ্বগতির এই বাজারে সবকিছুর গতিই ঊর্ধ্বমুখী। খেয়াল করলাম, একমাত্র আমিই ব্যাকডেটেড। কারণ, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার ক্ষমতা আমার নেই। কোনোদিন হবেও না। আমি বললাম, এটা মনে হয় ঠিক বললেন না। কার কখন কেমন মিলিয়ে চলার ক্ষমতা হবে, সেটা আগে থেকে বলা মুশকিল। আজকে আপনার মিলিয়ে চলার ক্ষমতা নেই বলে কোনোদিনই যে হবে না, একই গ্যারান্টি কেউ দিতে পারবে না। বড়ভাই বললেন, বেহুদা সান্ত¡না দিস না তো! এই বেডা, জিনিসপত্রের দামসহ সবকিছুর গতি ঊর্ধ্বমুখী হলেই কি আমার গতি কোনোদিন ঊর্ধ্বমুখী হবে? আমারও হবে না, তোরও হবে না। কোনো মানুষের হবে না। কারণ, আমি একতলার বারান্দা থেকে লাফ দিয়ে দেখেছি। লাফ দিলেই নিচে পড়ে যাই। আমার গতি যদি ঊর্ধ্বমুখী হতো, তাহলে একতলা থেকে লাফ দিলে নিচে পড়তাম না, দোতলায় উঠে যেতে পারতাম। বিষয়টা ক্লিয়ার? আমার এক ভাবি বললেন, জিনিসপত্রের দামের ঊর্ধ্বগতির এই বাজারে আমাদের নজরও কীভাবে কীভাবে যেন ঊর্ধ্বমুখী হয়ে গেছে। বিষয়টা আমার কাছে কাকতালীয় মনে হয়। আমি বললাম, কাকতালীয় মনে হওয়ার কিছু নেই ভাবি। এটা হচ্ছে যুগের হাওয়া। আসলে যুগের হাওয়া যেভাবে বয়, যেদিকে বয়, আমাদের নজরও সেদিকে যায়। ভাবি বললেন, এত জ্ঞানের কথা বইলেন না। আমি কোনো জ্ঞানের কথা বলিনি। আমি বলেছি সমস্যার কথা। আমাদের নজর ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার একটাই কারণ, বিল্ডিংয়ের উপরতলার লোকজন ওপর থেকে ময়লার পোঁটলা ফেলে। আর আমরা যারা নিচতলায় থাকি, তারা সবসময় নজর ঊর্ধ্বমুখী রাখি এই ভয়ে- এই বুঝি আরেকটা পোঁটলা ফেলল।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর