শুক্রবার, ১৮ এপ্রিল, ২০১৪ ০০:০০ টা
শ্রদ্ধাঞ্জলি

অমর কথাশিল্পী অদ্বৈত মল্লবর্মণ

হাসানুুল কায়সার

অমর কথাশিল্পী অদ্বৈত মল্লবর্মণ

কালজয়ী ঔপন্যাসিক অদ্বৈত মল্লবর্মণ কবিতা ভালোবেসে সাহিত্যের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তার সাহিত্যচর্চা শুরু পঞ্চম শ্রেণীতে অধ্যয়নকালে। ছাত্রজীবনে কবিতা লিখতেন বেশি। তার জন্ম ১ জানুয়ারি ১৯১৩, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গোকর্ণঘাট গ্রামে। শৈশবে পিতৃ-মাতৃহীন অদ্বৈত গ্রামের মালোদের চাঁদার টাকায় লেখাপড়া করেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অন্নদা উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় থেকে ১৯৩৩ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন, কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজে কিছুদিন আই.এ ক্লাসে অধ্যয়ন করেন। কিন্তু মেধাবী ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও আর্থিক সংকটের কারণে তার পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৩৪ সালে কলেজের পড়া ছেড়ে দিয়ে শুধু অর্থ উপার্জন ও জীবিকা নির্বাহের উদ্দেশ্যে কলকাতায় চলে যান। সেখানে মাসিক 'ত্রিপুরা' পত্রিকার সাংবাদিক হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু। এরপর ১৯৩৬ সালে ক্যাপ্টেন নরেন দত্ত পরিচালিত 'নবশক্তি' পত্রিকায় যোগ দেন তিনি। পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র আর অদ্বৈত ছিলেন সহ-সম্পাদক। নবশক্তি'র প্রকাশনা বন্ধ হয়ে গেলে তিনি মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ'র 'মাসিক মোহাম্মদী' এবং একই সঙ্গে 'দৈনিক আজাদ' পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন। এছাড়া নবযুগ, কৃষক ও যুগান্তর পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

গ্রামের পাশ ঘেঁষে বয়েচলা প্রাণচঞ্চল নদী, নদীপাড়ের জেলেজীবন, জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত, নদীভাঙনের ফলে কিভাবে অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়, অন্যের সংস্কৃতি ঢুকে পড়ে সরল জীবনে- এসব বিষয়-আশয় নিয়ে রচনা করেন 'তিতাস একটি নদীর নাম'। উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যে সমাদৃত হলেও অন্তরালেই পড়ে রইলেন এর স্রষ্টা। শ্রমজীবী মানুষ ও তাদের দর্শনের প্রতি অদ্বৈতের যে দায়বদ্ধতা, তা কেবল মুগ্ধই করে না, পাঠককেও করে তোলে দায়িত্বশীল। জীবন ও সত্যকে এই শিল্পী ভালোবেসেছেন দুঃসাহসী মন নিয়ে। জীবনঘনিষ্ঠ রূপের স্বরূপ ও অসংখ্য বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠা অদ্বৈত মল্লবর্মণ সাহিত্যে যোগ করেন নতুন মাত্রা। নিম্নবিত্ত জেলেজীবন, পুরনো সমাজের ভাঙন, মূল্যবোধের ক্ষয় প্রভৃতির যথাযথ চেহারাও লেখকের দৃষ্টি এড়ায়নি। সমাজব্যবস্থার বিভিন্ন স্তর, সেসব স্তরে রাজনৈতিক প্রভাব, অর্থনৈতিক বাস্তবতা ইত্যাদি চমৎকারভাবে চিত্রিত করেন উপন্যাসে। স্বল্পকালীন জীবনে অদ্বৈত মল্লবর্মণ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করে গেছেন। এছাড়াও তিনি বহু শিশুপাঠ্য কবিতাও রচনা করেছেন। তার রচনার মধ্যে উপন্যাস : 'তিতাস একটি নদীর নাম' ও 'সাদা হাওয়া', গদ্য: 'এক পয়সায় একটি', 'সাগরতীর্থে', 'নাটকীয় কাহিনী', 'রাঙামাটি', গল্পগ্রন্থ : 'দল বেঁধে' ও অনুবাদগ্রন্থ: 'জীবনতৃষ্ণা' উল্লেখযোগ্য।

বাংলা সাহিত্যের লেখকদের মধ্যে যারা আমাদের সমাজের তথাকথিত ভদ্রলোকদের ভণ্ডামির মুখোশ খুলে দিয়েছেন, সমাজব্যবস্থার অর্থনৈতিক শোষণের চরিত্রটি বিশ্লেষণ করেছেন অদ্বৈত মল্লবর্মণ তাদের অন্যতম। 'তিতাস একটি নদীর নাম'-এর জন্য তিনি অর্জন করেন বিশ্বখ্যাতি। প্রতিকূল সংঘাতে ক্রমশ মুছে-আসা মৎস্যজীবী যে মানুষদের কাহিনী এই উপন্যাসে বর্ণিত হয়েছে তিনি সেই 'মালো' সমপ্রদায়েরই লোক ছিলেন। উপন্যাসটি একাধিক ভাষায় অনূদিত হয়েছে, হয়েছে দুই বাংলার যৌথ উদ্যোগে চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেন খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার ঋতি্বক ঘটক। অকৃতদার নিঃসঙ্গ অদ্বৈত মল্লবর্মণ আমৃত্যু হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেছেন। নিদারুণ অর্থকষ্টের মধ্যেও যথাসম্ভব বই কিনেছেন তিনি। আর্থিক সঙ্গতি কম থাকা স্বত্ত্বেও কলকাতার মালোপাড়ার শিশু-কিশোরদের ঘরোয়া বিদ্যালয় পরিচালনায় নিয়োজিত উপেন্দ্রবাবুর স্বল্পশিক্ষিত বিধবা প্রফুল্লকে নিয়মিতভাবে আর্থিক সাহায্য করতেন। মাত্র ৩৭ বছর বয়সে তিনি যক্ষায় আক্রান্ত হয়ে কলকাতার নারকেলডাঙ্গার ষষ্ঠীপাড়ার নিজ বাড়িতে ১৬ এপ্রিল ১৯৫১ সালে মারা যান।

 

সর্বশেষ খবর