শুক্রবার, ২৩ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা

৭৮ বার প্রত্যাখ্যাত মার্লন জেমস বুকার জিতেছেন

ভূমিকা ও অনুবাদ

আন্দালিব রাশদী

৭৮ বার প্রত্যাখ্যাত মার্লন জেমস বুকার জিতেছেন

জ্যামাইকার ঔপন্যাসিক মার্শাল জেমস-এর প্রথম উপন্যাস ‘জন ক্রোস ডেভিল’-এর পাণ্ডুলিপি একে একে ৭৮ জন প্রকাশক প্রত্যাখ্যান করেছেন। হত্যোদ্যম জেমস তার পাণ্ডুলিপির মুদ্রিত কপির প্রতিটি পৃষ্ঠা ধ্বংস করেছেন। জেমস এখন অবশ্য মনে করেন ধ্বংসের কাজটা অতি নাটকীয় ধরনের ছিল। ভাগ্য ভালো ঘটনাটি একালের। পাণ্ডুলিপি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি। একটি পুরনো আই-ম্যাক কম্পিউটারের মেইলে আউটবক্সের সংযুক্তিতে ‘জন ক্রোদের শয়তান’ রয়ে গিয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত আমেরিকার এক ছোট প্রকাশক ২০০৫ সালে বইটি ছাপে। এক সময় তার মনে হয়েছিল তিনি যা লিখে চলেছেন মানুষ তা পড়তে চায় না। সুতরাং লেখালেখি থেকে হাত গুটিয়ে নিতে চেয়েছেন। কিন্তু ৭৯তম প্রচেষ্টায় যখন বইটি বের হলো, মার্লন জেমস যে ভিন্ন স্বাদের লেখক তা বুঝতে সমালোচকরা দেরি করেননি। জ্যামাইকার কলুষিত সমাজে, গভীর গ্রামাঞ্চলে নগর থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ‘গিবেহ’ নামের একটি গ্রামে ভালো ও মন্দের লড়াই, খুন, ধর্ষণ, শিশু নির‌্যাতন, মানবিকতা, মাতৃহত্যা, ধর্মীয় শোষণ, হেক্টর ব্লাই নামক একজন মাতাল ধর্মযাজকের উৎপীড়ন ও স্বৈরশাসন এবং আধ্যাÍত্নিক দ্বন্দ্ব নিয়ে রচিত ‘জন ক্রোদের শয়তান’ একজন পাপিষ্ট শয়তান সন্ত’র ভ‚মিকায় তাকে ধর্মশালা থেকে অপসারণ করে অপর যাজক আত্নার পরিশোধনের জন্য ঈশ্বরের জন্য সহিংসতার ডাক দেয়। জন ক্রোরা হচ্ছে শকুন, তারা দুর্ভাগ্যের সংবাদ নিয়ে আসে।

উপন্যাসটি লেখককে নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। ৪ বছর পর ২০০৯-এ প্রকাশিত হয় ‘দ্য বুক অব নাইট ওমেন।’ অষ্টাদশ শতকে জ্যামাইকার ইক্ষু শ্রমিক হিসেবে নিয়োজিত ক্রীতদাসদের জীবনালেখ্য এই ‘নিশি রমণীদের

গ্রন্থ’ ক্রীতদাস রমণীরা রাতের বেলা অসংগঠিত হতে থাকে এবং লিলিথ নামের এক তরুণীকে সঙ্গে নিয়ে বিদ্রোহ করে। সহিংসতা, সন্ত্রাস, নির‌্যাতন ও প্রতিশোধের শিউরে উঠা বর্ণনা ও জমাটবাঁধা কাহিনী নিয়ে এ উপন্যাস। লিলিথের ভিতর জেগে উঠে ‘সত্যিকারের অন্ধকার ও সত্যিকারের নারীত্ব  ভালোবাসা তাকে গ্রাস করে। লিলিথ সরে আসে তার বিপ্লবী ভগ্নিদের সান্নিধ্য থেকে। ইতিহাস ও মনুষত্ব ভালোবাসা ও ঘৃণার সংশ্লেষণ এই গ্রন্থ।

মার্লন জেমসের তৃতীয় উপন্যাস ‘এ ব্রিফ হিস্ট্রি অব সেভেন কিলিংস’ সাত খুনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তাকে এনে দিয়েছে মান বুকার ২০১৫ সাহিত্য পুরস্কার। ১৯৭৬-এর ডিসেম্বরে পিস কনসার্টের আগে সংগীতশিল্পী বব মার্লে হত্যা প্রচেষ্টা জেমসকে এ উপন্যাসের রসদ জোগায়। শুরুটা এখান থেকে, তারপর তিন দশক ধরে ড্রাগ মাফিয়া, সংসদ সদস্য, পুলিশ, গানম্যান, বিউটি কুইন, সাংবাদিক, সিআইএ সবাইকে জড়িয়ে কাহিনীটি বুনেছেন। যারা জ্যামাইকাকে জানেন তাদের অনেকের কণ্ঠেই মার্লন জেমস প্রতিধ্বনিত এটাই সত্যিকারের জ্যামাইকা। আহত বব মার্লে দ্রুত দেশ ছাড়লেন এবং ঘোষণা করলেন, তার দেশ একটা ভেঙে যাওয়া পচা ডিম, একে জোড়া দেওয়ার আর কোনো উপায় নেই। এই আক্রমণকে বললেন আমার জীবনে এর চেয়ে ভালো কিছু আর ঘটতে পারত না এই ঘটনাই তাকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছে, তারপরই জীবনে প্রথম অনুভব করলেন তিনি স্বাধীন।

মার্লন জেমসের বেলায়ও এর চেয়ে ব্যতিক্রমী কিছু ঘটেনি। তিনিও দেশ ছাড়েন কারণ ‘আমি জানতাম আমাকেও দেশ ছাড়তে হবে কফিনে শুয়েই হোক কি উড়োজাহাজে চড়ে’। স্বদেশের কালো দিকটা ফাঁস করে দেওয়া ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা কাঠামোতে গুরুত্ব স্তম্ভ যারা তাদের পছন্দ হয়নি ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫ মার্লন জেমসকে নিন্দা জানাতে ২০ হাজার লোক কিঙ্গস্টোনে জমায়েত হয়েছে। ‘এতদিন বইপত্রে যে জ্যামাইকাকে পাওয়া যায়নি, উপন্যাসে তো নয়ই আমি সেই জ্যামাইকার ছবিই তুলে ধরছি।’ কলম্বাস এ অঞ্চলে পৌঁছেন ১৪৯৪ সালে, ১৫০৯ থেকে স্পেনিশরা জ্যামাইকাকে উপনিবেশে রূপান্তরিত করতে শুরু করে। আফ্রিকার ক্রীতদাস শ্রমিকদের প্রথম আগমন ঘটে ১৬৪০-এ। ১৬৭০-এ ব্রিটিশরা স্পেনিশদের হটিয়ে দিয়ে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়, দাস আমদানি জমজমাট হয়ে উঠে। ১৯৬২-তে ব্রিটিশরা হাত গুটিয়ে নেয় এবং স্বাধীন জ্যামাইকার অভ্যুদয় ঘটে। কিন্তু কার্যত দেশ একই চরিত্রের বিদেশি শাসকের হাত থেকে দেশি শাসকের হাতে চলে আসে। ঘটনাটি যত না স্বাধীনতার, তার চেয়ে বেশি হাত বদলের। মার্লন জেমস হাত বদল পরবর্তী স্বাধীন দেশের ভয়াবহতা নিয়েই লিখেছেন। সবচেয়ে বেশি মনুষ্যভীতির দেশ জ্যামাইকা আতঙ্ক প্রকট আমাদেরও, কিন্তু আমাদের কোনো মার্লন জেমস নেই।

 

২০১৫ মান বুকার হ্রস তালিকার ছটি উপন্যাস : ‘টম ম্যাকার্থি (ব্রিটিশ)’র ‘স্যাটিন আয়ল্যান্ড’; সুঞ্জিব সাহোতা (নাইজেরিয়া)’র ‘দ্য ইয়ার অব দ্য রানওয়েজ’; অ্যান টাইলার (মার্কিনী)’র ‘এ স্পুল অব ব্ল– থ্রেড’; হ্যানিয়া ইয়ানা গিহায়া (মার্কিনী)’র ‘এ লিটল লাইফ’; চিগোজি ও বিওমা (নাইজেরিয়ান)-এর ‘দ্য ফিশারম্যান’; মার্লন জেমস (জ্যামাইকা)-এর ‘এ ব্রিফ হিস্ট্রি অব সেভেন কিলিংস’।

মার্লন জেমস-এর জম্ন১৯৭০-এ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যাপনা করেন। তিনি জানালেন, তার বইয়ের কারণে অনেকেই তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আতঙ্কিত বোধ করেন। তার কয়েকটি সাক্ষাৎকারেরই একাংশ অনূদিত হলো : প্রায় ৭০০ পৃষ্ঠার ‘এ ব্রিফ হিস্ট্রি অব সেভেন কিলিংস’ প্রকাশনার পর কিমা জোন্স মার্লন জেমসের যে সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন তার একাংশ :

কিমা জোন্স : আপনার নতুন উপন্যাটিতে আপনি মৃতদের জ্ঞান দিয়ে এবং কখনো জীবিতদের যে দায়িত্ব দেন তাও মৃতদের দিয়ে তাদের ক্ষমতায়ন করেন। এই সিদ্ধান্ত সম্পর্কে বলুন।

মার্লন জেমস : আমি মনে করি বৃহত্তর পটভ‚মিতে জামাইকান এবং আফ্রিকান গল্প বলার যে কৌশল এটা তারই অংশ পূর্বপুরুষ, প্রাচীন পরামর্শদাতা, ঘুরে বেড়ানো পূর্ব পুরুষের আত্না জীবিত মানুষের জীবনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে বিজড়িত। মুখে মুখে গল্প বলার যে ঐতিহ্য এ বিষয়টি তাতেই প্রোথিত, আফ্রিকান ফিকশন, কিংবা জ্যামাইকার লোককথা কিংবা গ্যাব্রিয়েল নার্সিয়া মার্কেজের ‘শতবর্ষের নির্জনতা’ সবটাতেই জীবিত ও মৃত অত্যন্ত সহজভাবে সহাবস্থান করতে পারে।

পূর্বপুরুষরা যে সব সময়ই বিরাজমান, মৃত্যুর সঙ্গেই তাদের দায়িত্ব পালনের সমাপ্তি ঘটে না, তা একেবারে শুরু থেকেই সাহিত্য, মুখে বলা গল্প এবং সংগীত সংস্কৃতির অংশ হিসেবে রয়েছে গেছে। এ উপন্যাসে আমি যে মোচড়টি দিয়েছি তাতে কেউই আর প্রেতাত্নার কথা শুনতে পাচ্ছে না এবং কেউ শুনছেও নাÑ এটাই যন্ত্রণার এক উৎস। এমনকি জ্যেষ্ঠের কথা যদি জ্ঞানসমৃদ্ধ হয়, তবুও শুনছে না, আর এ কারণে বারবার একই ভুল করছে। এই বইয়ের একটি চরিত্র আর্থার জেনিংসের সহিংস মৃত্যু ঘটে। সেও তার চারপাশে মানুষের সহিংস মৃত্যু দেখতে থাকে সাতটি সহিংস মৃত্যু, তারপর আরও এবং আরও মৃত্যু। এমনকি যদি তাদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা কিংবা তারা যদি জানে তারা কোন ভ্রান্তির শিকার এ তথ্য তাদের দেওয়ার মতো, কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমরা তা নিচ্ছি। আমার এসব প্রত্যাখ্যান করছি কারণ এসবে আমাদের আর বিশ্বাস নেই। যদি কিছু হয়ে যাকে তাহলে এই উপন্যাসটি প্রেতাত্না ও আত্নার সঙ্গে জীবিতের সম্পর্ক সূত্র ছিন্ন করা নিয়ে রচিত। এ সম্পর্ক সূত্রের অবর্তমানে সবকিছু খান খান হয়ে ভেঙে পড়ে।

জোন্স : আপনার শোনা সবচেয়ে আতঙ্কের গল্প কোনটি; এ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইলই কি আপনার বলার মতো সবচে ভয়াবহ গল্প?

জেমস : ভয়ঙ্কর গল্প আমাকে সত্যিই আতঙ্কিত করে না। আমার দেখা সবচেয়ে ভীতিকর ব্যাপারটি ঘটেছে সাইকোতে। হিচকক আমাকে হরর গল্পের চেয়েও বেশি সন্ত্রস্ত করে। ‘টেক্সাস চেইন-স ম্যাসাকার’ ভয়াবহ রক্তাক্ত কাহিনী, অন্য যে কোনো কাহিনীর চেয়ে ভয়ঙ্কর। তবে সাইকো মুভিটি দেখেই আমি সবচেয়ে বেশি ভয় পেয়েছিলাম। ছবির মাঝামাঝি পর্বে এসে হিচকক প্রধান চরিত্রটিকে মেরে ফেলেন, আপনাকে চিন্তার মধ্যে আটকে দেয়, আপনি ভাবতে থাকেন। তারপর কী হবে? এক ভীষণ অনিশ্চয়তা  যে কোনো কিছু ঘটতে পারে- আপনাকে সন্ত্রস্ত রাখে। অনেক সমালোচক মনে করেন ‘এ ব্রিফ হিস্টি অব সেভেন কিলিংস’ একটি ভীতিকর গ্রন্থ, আমি তা মনে করি না। আমি মনে করি না উপন্যাসের চরিত্রগুলো ভাবছে তারা আতঙ্কের পরিবেশে বাস করছে। এ রকম পরিস্থিতিতে যাদের বাস, আরও ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিও তাদের জন্য স্বাভাবিক ব্যাপার। অনেক দিক থেকে বিবেচনা করলে দেখা যাবে এটা আমার লেখা একটি মজার বই  এটা অত্যন্ত সরস, অত্যন্ত হাস্যকর এবং সবচেয়ে বেশি পরীক্ষামূলক। আতঙ্কের কথা বলতে পারব না কিন্তু এতে সহিংসতা নির্মমতা রয়েছে। উপন্যাসের শুরু একটি মৃত মানুষ নিয়ে, ওদিকে মৃত্যু ও আতঙ্ক পাশ্চাত্যের একটি অনুষঙ্গ। প্রাচ্যে ব্যাপারটি মোটেও এরকম নয়।

জোন্স : এ ব্রিফ হিস্ট্রি অব সেভেন কিলিংস-এ আপনি জ্যামাইকার পুলিশকে কঠোরভাবে অভিযুক্ত করেছেন, পুলিশের নির্মমতাÑ বিশেষ করে জনসম্মুখে পুলিশ নির্মমতার চিত্র তুলে ধরেছেন। পুলিশকে এভাবে দোষী সাব্যস্ত করার কারণ সম্পর্কে কিছু বলবেন।

জেমস : ১৯৭৬-এ জ্যামাইকা ছিল একটি পুলিশ রাষ্ট্র। কারফিউ জারি করে জ্যামাইকা শাসন করা হয়েছে। মানুষকে আটকে রাখা হয়েছে। গ্রেফতার করলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল করতে হবে। কিন্তু আটকে রাখলে চিরদিন এভাবে আটকে রাখা যাবে। এক বছরেরও বেশি সময় কেউ কেউ আটক ছিল। রাস্তা থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য শিশুদের এনে আটকে রাখা হয়েছে। এটা জ্যামাইকায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। একে সমর্থন করেছে দেশের অপরাধ দমন আইন। পুলিশ শূন্যের মধ্যে দুর্নীতি করতে পারে না তার দুর্নীতিকে সমর্থন দিতে একটি পদ্ধতির প্রয়োজন হয়।

 

নাদজা বঙ্কর-এর নেওয়া সাক্ষাৎকার থেকে

প্রশ্ন : আপনি যখন ‘এ ব্রিফ হিস্ট্রি অব সেভেন কিলিংস’ লিখছিলেন ১৯৭৬-এ বব মার্লের হত্যা প্রচেষ্টাকে কেন উপন্যাসের বিষয় করে নিলেন?

জেমস : বব মার্লের ঘটনাটি আমার বইয়ে সংঘটিত ঘটনাসমূহের শেষদিকের একটি। এটিই সব কাহিনীর বন্ধন হিসেবে কাজ করে। ১৯৭৬-এ জ্যামাইকা একটি চাতুরিময় ও গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে ছিল। কেননা নির্বাচনের বছর হওয়ার জন্য নয়। আশঙ্কা বিরাজ করছিল এটি কমিউনিস্ট দেশে রূপান্তরিত হতে যাচ্ছে। এ কারণে দেশটি শীতল যুদ্ধের দিকে গড়ায়। একই সময় সৃজনশীলতারও বিস্ফোরণ ঘটে আমি মনে করি এমনটা আর আগে কখনো হয়নি। সংগীতে তো অবশ্যই চিত্রশিল্প ও চলচ্চিত্রে সেসবের ব্যাপক বিকাশ ঘটে।

প্রশ্ন : আপনি বলেছেন বেড়ে উঠার সময় বব মার্লের সংগীতে আপনি যে প্রভাবিত হয়েছেন এমন নয় এবং আপনি তা বুঝতেনও না।

জেমস : আমি বুঝতাম না, কারণ তখন আমার বয়স ছিল মাত্র ছয় বছর। রূপকালঙ্কার কিংবা দ্বৈত অর্থ তখন আমার বোঝার কথা নয়। মার্লে খুব ধূর্ত একজন গীতিকার ছিলেন, এ সম্পর্কে অবশ্য কেউ তেমন কিছু বলে না। অন্যদের মেধা কিংবা সহজাত বুদ্ধির ঘাটতি আছে এমন নয়  তাতে কারও ববের সেই রসবোধ নেই। সে কারণেই কোনো দ্বিতীয় বব মার্লে নেই। যখন তার ‘আমবুশ ইন দ্য নাইট’ শোনা যায়, প্রথম দুই অনুচ্ছেদেই তার চারপাশেই সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে পড়ে, তার উত্থান প্রায় অনিবার্য হয়ে দেখা দেয়।

 

ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারের একাংশ

প্রশ্ন : ১৯৭৬-এ বব মার্লে হত্যা প্রচেষ্টার কতটুকু আপনার মনে আছে? তখন আপনি কোথায় ছিলেন?

মার্লন : আমি তখন স্কুলে, জ্যামাইকান ধরনের কিন্ডার গার্টেন থেকে কেবল বেরোচ্ছি। ডিসেম্বর মাস হওয়ার কথা, আমি কেবল ছ বছরে পড়েছি। ছ বছর পেরিয়ে টেনেটুনে এক সপ্তাহ গড়িয়েছে। একটি শিশু যেভাবে মনে রাখে আমার মনে রাখার ধরনটা সে রকমই। এই ঘটনার কোনো সরাসরি প্রভাব আমার ওপর আদৌ পড়েছিল বলে আমার মনে পড়ছে না। আমার মা কাজ করত পুলিশের গোয়েন্দা বাহিনীতে। বড়দের আলাপ থেকে আমি যেমনটা শুনেছি ঘটনাটা খবরে এসেছিল। সবার আগে  আমার মনে হয়েছে ‘বব মার্লে কি এখানে।’ কারণ তখন তো বব মার্লে দেশের বাইরে অনেক বড় তারকা... তখন এটা মনে হতে পারে বব মার্লেকে গুলি করতে পারলে যে কেউ গুলিবদ্ধ হতে পারে।

প্রশ্ন : এই হত্যা প্রচেষ্টা নিয়ে নন-ফিকশন না লিখে উপন্যাস লিখতে গেলেন কেন? এখানে এমন কিছু আছে কি যা উপন্যাসেই বলা সম্ভব নন-ফিকশনে নয়?

মার্লন : এ ক্ষেত্রে আমার মনে হয় প্রশ্নটি উত্তর হ্যাঁ। নন-ফিকশনে এমন কিছু থাকে যা কখনো কারও জানা হয় না। অন্তত এ মুহূর্তে জানা সম্ভব নয়। আমি যখন তাদের ওপর বিশেষ করে যে লোকটি হত্যা প্রচেষ্টা চালিয়েছে তার ওপর আলোকসম্পাত করতে চেয়েছি আমি সমস্যায় পড়েছি। উপন্যাসটি বেশ ক’বার চ‚ড়ান্ত সমাপনীতে পৌঁছেছে, কারণ গল্প সেই ঘটনাকে ছাড়িয়ে যায়নি... কাজেই গল্পের অন্তঃস্থলে পৌঁছা এক রকম অসম্ভব ব্যাপার। এক্ষেত্রে নন-ফিকশন দিয়ে কাজ হতো কিনা আমি নিশ্চিত নই।

প্রশ্ন : আপনার চরিত্র ‘সিঙ্গার’-এর নাম কোথাও আসেনি। কিন্তু তিনি যে বব মার্লে এটা স্পষ্ট। উপন্যাসে এ চরিত্রটির কোনো সুনির্দিষ্ট নাম কেন দেননি?

মার্লন : লেখার সময় অনেক জায়গায় তার নাম দিয়েছিলাম। কিন্তু যে কোনো কারণেই হোক তাতে লাভ হতো না, কারণ ঘটনার অনেক আগে ১৯৭৬ থেকেই মার্লে মূলত একটি প্রতীকী নাম হয়ে ওঠে। তিনি তখন অনেক কিছুর প্রতীক দারিদ্র্য থেকে উত্তরণের প্রতীক, নির্বাক মানুষের কণ্ঠস্বরের প্রতীক, অনেকের কাছে জাতীয় বিব্রতকর অবস্থার প্রতীক। কারণ তখন এই রাস্তা ফারিয়ানকে দেখা হতো কালোদের লড়াইয়ের কণ্ঠস্বর হিসেবে; তিনি শিক্ষিত ছিলেন না, কখনো কালোদের শিল্প আন্দোলনে অংশ নেননি এবং তিনি কোনো বুদ্ধিজীবীও ছিলেন না। আমি মনে করি তিনি এখনো তাই আছেন... তাছাড়া বব মার্লেকে যেখানেই রাখবেন তার ঔজ্জ্বল্যের কাছে তা ম্লান হয়ে যাবে। কোনো চেষ্টা ছাড়াই তিনি দখল করে নেন।

প্রশ্ন : আপনার বাবা কী করতেন?

মার্লন : ২০১২-তে আমার বাবার মৃত্যু হয়। বাবা পুলিশ ছিলেন। আমার বাবা ও মা দুজনই পুলিশ। মা চলে যায় গোয়েন্দা বিভাগে, বাবা আর সেখানে রইল না, ১৯৭৩-এ চাকরি ছেড়ে দিয়ে ওকালতি শুরু করেন। জীবনের অধিকাংশ সময় তার ওকালতিতে কেটে গেছে, পরে জজ হয়েছিলেন। মা কিছুকাল গোয়েন্দা বাহিনীতে থেকে আগেভাগে অবসর নেন। মা ছিলেন ফৌজদারি গোয়েন্দা বিভাগে... তারা কাজ করত কিঙ্গস্টনে, আমরা পোর্টমোরে। পোর্টমোর এমন নিয়ত পরিবর্তনশীল ছিল না  আমার বেড়ে উঠা মধ্যবিত্ত পরিবারে, বলা চলে অনেকটা একঘেয়ে জীবন।

 

আমার হিরো টনি মরিসন : মার্লন জেমস

২০০১ সালে আমি প্রথম টনি মরিসনের লেখা পড়ি। আমার লেখার একটি প্রাথমিক খসড়া এলিজাবেথ নুনেজকে দেখিয়েছিলাম। পড়ার পর তিনি যেভাবে সাড়া দিলেন তা হচ্ছে ‘তুমি একজন ভালো লেখক, কিন্তু মেয়েদের সম্পর্কে তুমি কিছুই জান না।’ আমি একটা ধাক্কা খেলাম। বাড়িতে আমার একজন প্রতাপশালী মা, নারীবেষ্টিত একটি বাড়িতে আমি বেড়ে উঠি, এলিজাবেথ কী বলতে চান? তিনি ব্যক্তিগতভাবে কোনো নারীকে চেনার কথা বলেননি বরং সাহিত্যের পরিসরে নারীকে বোঝার কথা বলেছেন। তিনি বলেন, বহুসংখ্যক পুরুষ মানুষকে জিজ্ঞাসা করে জেনে নাও তারা ক’জন নারীর লেখা পড়েছে? আমাকে স্বীকার করতে হবে ভিক্টোরীয় যুগের কিছু মৃত নারীর রচনা ছাড়া আমি সত্যিই আর কারও লেখা পড়িনি।

‘সঙ্গ অব সলোমন’ এবং ‘সুলা’ ভিন্ন ভিন্নভাবে আমার জীবন বদলে দিয়েছে। সালমান রুশদীর ‘শেইম’ এবং গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ‘ওয়ান হানড্রেড ইয়ার্স অব সলিচিউড-এর মতো ‘সঙ্গ অব সলোমন’ অবিশ্বাস্য রকম উদ্দীপক একটি গ্রন্থ। এ বইটি আমার ভেতর লেখার তাড়না সৃষ্টি করেছে। এটি টনি মরিসনের হালকা বাধনের একটি উপন্যাস; অসাধারণভাবে অকার্যকর একটি কালো পরিবারের মহাকাব্য। এটা প্রায় জাদুবাস্তব হয়ে উঠেছেÑ আমি যত বই পড়েছি এর মতো যুক্তিসঙ্গত অতি প্রাকৃতিক উপসংহার আর কোথাও পাইনিÑ আমিও উড়ে চলেছি ভাবতে ভাবতে উপন্যাসটি শেষ করি। সুলা প্রভাব বিস্তারকারী উপন্যাস, আমি নিজের সম্পর্কে যেভাবে ভাবি এ বই তা বদলে দিয়েছে। আমি বিবাহিত নই, আমার বাচ্চাকাচ্চা নেই। স্বাভাবিক জীবনের যেসব মাইলস্টোন আমি অনেকগুলো না পেরিয়ে এসেছি। এ রকম একটি পর‌্যায়ে আমি যখন উপন্যাসটি পড়ি, এরকম মাইলস্টোনে পৌঁছানো এবং অর্জনের জীবনের দিকে তাকিয়ে আমিও প্রশ্ন করতে থাকি। উপন্যাসের প্রধান চরিত্রগুলো বহু ঝুঁকিবহুল ও ভয়ানক কাজ করে বসেÑ এর মধ্যে একটি হচ্ছে তার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু নেল-এর স্বামীর সঙ্গে ঘুমানো। অন্যরা কি ভাবছে তা নিয়ে সুলার কোনো চিন্তা নেই। উপন্যাসের শেষে এক বন্ধু তাকে জিজ্ঞাসা করে ‘জীবনে কি করেছে তার দেখাবার মতো কি আছে?’ যখন এই কথোপকথন পড়ি, তার উত্তরটি আদৌ পড়তে চেয়েছিলাম কিনা আমি নিশ্চিত নই, কিন্তু তা আমার জন্য খুব প্রাসঙ্গিক ছিল। সুলা শুধু বলল, ‘দেখাব? কাকে?’ সাহিত্য পাঠে চেয়ার থেকে পড়ে যাওয়ার মতো মুহূর্ত হামেশাই আসে না। কিন্তু আমার জন্য সেটাই ছিল এমন এক মুহূর্ত। এটা আমাকে বুঝিয়ে দিল কারও কাছে প্রমাণ করার মতো আমার কিছু নেই।

 

সাত খুনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস থেকে

সমাজতন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর সর্বশেষ কাজ হচ্ছে পলায়নবাদ। আমি অবশ্যই জ্যামাইকার একমাত্র মহিলা যে প্রধানমন্ত্রীকে বলতে শোনেনি; যারা চলে যেতে চায় তাদের জন্য মায়ামিগামী পাঁচটি ফ্লাইট রাখা আছে। আরও ভালো অবশ্যই ঘটবে? চার বছর আগেই তো আরও ভালো ঘটার কথা ছিল। এখন আমাদের এই বাদ আর সেই বাদ আর বাবা তো রাজনীতির কথা বলতে ভালোবাসত। সে সময়ই বাবা চেয়েছে তার ছেলে না থাকুক। কারণ পুরুষ মানুষকেই দেশের নিয়তি নিয়ে ভাবতে হবে, বিউটি কুইন হয়ে নয়। আমি রাজনীতি ঘৃণা করি। কারণ আমি এখানে বাস করি বলেই আমাকে রাজনীতি নিয়ে থাকতে হবে, এ কারণে। এখানে কারও কিছু করার নেই। কেউ যদি রাজনীতি নিয়ে না থাকে তাহলে রাজনীতি তাকে নিয়ে থাকবে।

এ বইটিকে শ্রেষ্ঠ ফিকশনের মর‌্যাদা দিয়ে পুরস্কৃত করার সময় জুরি বোর্ডের প্রধান বলেছেন, এটি একটি অপরাধ উপন্যাস যা অপরাধ বিশ্বের বাইরে আমাদের সাম্প্রতিক ইতিহাসের গভীরে নিয়ে যায়, যে ইতিহাস সম্পর্কে আমরা খুব সামান্যই জানি। এর কাহিনী এগোয় ভয়াবহ গতিতে এবং এটিকে আমাদের সময়ে ধ্র“পদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে দেখা যাবে।

 

সর্বশেষ খবর