শুক্রবার, ১৩ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

চাঁদে পাওয়া

গল্প ♦ বিপ্রদাশ বড়ুয়া

চাঁদে পাওয়া

দেখা পাওয়ার আগে থেকেই মোবাইলে ওদের ‘এই ছেলেটা’ ‘এই মেয়েটা’ সম্পর্ক। আজকাল এসব পিচ্ছিল সুদুর্ঘটনা। মানতেই হয়। বন্ধুত্ব হয়েই গেছে প্রথম আলাপ থেকে। এখন আর যুক্তি-টুক্তি নেই। বেশ করেছি এরকম জঙ্গিভাব। অথবা জঙ্গিভাবটাই ওদের পেয়ে বসেছে।

দূরত্ব কিন্তু তাদের মধ্যে দুর্ভাগ্যবশত একটি ব্যাপারে বেশ বেশি। মেয়েটি থাকে পঞ্চগড়ে, ছেলেটি নাফ নদের মোহনার কাছাকাছি। উড়ে যাওয়া সহজ নয়, আবার হেঁটেও। বাসে গেলে দুদিন এক রাতের ধাক্কা। আপাতত ওরা তাই মোবাইলেই ধ্যানজ্ঞান করে আবেগ ও ঐশ্বর্য ঝেড়ে নেয়। কখনো কথা বলে, কখনোবা এসএমএস করে। কখনো স্বপ্ন দেওয়া-নেওয়া।

মেয়েটি মাধ্যমিক দিয়েছে, ছেলেটি কী করে পরে জানা খুবই সম্ভব। তবে কথাবার্তায় বোঝা যাবে ছেলেটির পড়াশোনা আছে, এমনকি লেখাও মকশো করে নিয়েছে মনে হয়। মেয়েটি মাধ্যমিকের হলেও উচ্চতর স্তরে বিচরণ করে। আর এক মফস্বলে বসে অন্য এক মফস্বলকে পরস্পর টেক্কা দিতে পারবে না! তা কি হয়!

এসএমএসে ঝড় বয়ে যায়। দক্ষতা থাকলেও পড়ার টেবিলে বসে এসব করা কোনো ব্যাপারই নয়। রাজধানী ও মফস্বলে এ ব্যাপারে বিশেষ ফারাক নেই বোধহয়। থাকলেও কারও কিছু যায় আসে না। ওরা ডিজিটাল যুগধর্মী। চঞ্চল, অদ্ভুত, উচ্ছল। প্রেম ও অপ্রেমেও জীবনধর্মী। কৌতূহলেও।

শুরু করেছিল গান নিয়ে। মেয়েটি দেশের টিভি-সিনেমার সর্বশেষ গানগুলো ভাজতে পারে। ছেলেটি বিখ্যাত গানগুলোর খবর রাখে। গাইতেও পারে ওরা নিজেদের মতো। ছেলেটি দেশীয় সিনেমা-টিভির বিশেষ ধার ধারে না। প্রয়োজনের অতিরিক্ত নয়।

একদিন লেগে গেল শীতল যুদ্ধ। গানে গানে লড়াকু এসএমএস। মিত্রতাধর্মী।

ছেলে লিখল, ‘লোকে বলে আমার ঘরে নাকি চাঁদ উঠেছে...।’

মেয়ে এমন একটি হালনাগাদ গান লিখে দিল, যা ছেলেটি জানে না বা শুনলেও দাগ কাটেনি বলে ধরতে পারল না। আসলে ও তখন মেঘমল্লার ভাবছিল।

ও মেয়ে লিখল, ‘চাঁদনি পসরে কে গো আমায় স্মরণ করে, কে আইসা খাড়াইছে আমার দুয়ারে।’ ছেলেটি জানে না গানটি কার। তাই গানটির গূঢ় রসপ্রতিপত্তি তো ধরতে পারল না। সে তো টেলিভিশনে এসবের পোকামাকড় নয়। সে দেখে অ্যানিম্যাল প্লানেট, ন্যাশনাল জিওগ্রাফি, ক্রিকেট, ক্লাসিক ভ‚তের ছবি বা সামুরাই-কুংফু। হাতে সময় করে নিয়ে বসে টেস্ট ক্রিকেটে ধৈর্যে যা তাকে উপন্যাস লেখার চর্চায় নিমগ্ন করে। তবুও মেয়েটি তাকে হিমায়িত করে।

‘বৃহস্পতি এখন আমার তুঙ্গে’ ছেলেটি লেখে।

‘ডাকে পাখি খোলো আঁখি দেখো সোনালি আকাশ’ মেয়েটি লেখে।

নেটওয়ার্কের গোলমালবশত ওরা খেই হারিয়ে বসল।  ওই এসএমএস ধ্যান।

মেয়েটি পুরনো সূত্র ধরে লিখল, আচ্ছা, তুমি তো বঙ্গোপসাগরের কূলে থাকো, তোমার বান্ধবী নেপালে। কী করে এমন হয়!

কাঠমান্ডুতে গিয়েছিলাম। স্বয়ম্ভু তীর্থে ওর সঙ্গে পরিচয় ফাল্গ–নী পূর্ণিমার মত্ত চাঁদনি-ভাসা রাতে। হিমালয়ের উপর দিয়ে চাঁদ হেঁটে আসছে- একবার ভাব। ক্লাসিক-রোমান্টিসিজম আলিঙ্গনাবদ্ধ। কাঞ্চনজঙ্ঘা উম্নুক্ত। তুষার বক্ষ উন্নত...

তারপর, তারপর!

সেই থেকে আমার বন্ধু। ওর শরীরের রংও তপ্ত কাঞ্চনের মতো আবেদনময়...

তাহলে! কী হবে! ওর তরল সোনার অঙ্গ! তোমার সঙ্গ...

কেন? তোমার বিশাল চাহনি! তুমি পড়ছ, পাস করবে...

কচুও বড় হয়। আমি যদি কোথাও চলে যাই!

কোথায়!

আমার কোনো বন্ধুর আঞ্জামে, কক্সবাজার-মহেশখালী-রামুতে!

কক্সবাজারে এমন কী আছে যে সারা জীবন তাকে দিয়ে দিতে হবে!

বঙ্গোপসাগর। স্বপ্ন জাগরণ ঢেউয়ের বাসর-সুন্দর হর্ম্য।

তার ঢেউয়ের সুগন্ধ!

সেন্টমার্টিন যাব স্ফটিক স্বচ্ছ জলসম্পদ ও প্রবাল খুঁজতে।

একঘেয়েমি এলে! একই সাগর প্রতিদিন ভালোবাসবে! প্রতিদিন...!

নীল ঢেউ গুনব। সুস্বপ্ন কোনো দিন প্রবীণ হয় না।

ঢেউ গোনা শেষ হলে! ক্লান্তি এলে!

ঢেউয়ের একটি শিশু ধরে বড় করে তুলব!

সেও বড় হয়ে গেলে!

স্মৃতি কুড়োব। ঢেউ জমাব আঁটি বেঁধে।

ক্লান্তি এলে তাতে!

বাসনাকে বড় করে তুলব মাখামাখি ছুঁয়ে ছুঁয়ে। মাথিন-এর কুয়ো আছে। বাসনাও ব্যবহারে ব্যবহারে জীর্ণ হয়ে যায়।

চুমো খেয়ে দুর্দান্ত হয়ে উঠব।

তারপর শুঁটকি, ইলিশ, রূপচাঁদা, রুপোলি...

জগৎজুড়ে শুঁটকি-পাগল মানুষ রয়েছে। ওকে বলে রুপোলি সোনা। প্রত্ন নেশা।

তুমি তো উত্তরবঙ্গীয় শর্ষের ভক্ত। তোমার রক্তে মেশা।

রক্তও নষ্ট হয়ে গেলে পাল্টানো যায়। ঘাটতি পড়লে ভরানো। বাড়তি হলে...

এখানে সামুদ্রিক ঝড় মরণ ছোবল পিপাসু।

মাটিতে জম্ন যার কী ভয় তার!

ওটা গান হতে পারে। সমুদ্রের গান ভয়াবহ থেকেও ভয়াবহ। মরণ নৃত্যতুল্য ঢেউয়ের ফণায় চড়ে মরণ সাগর পেরিয়ে যাব... সাগরে মৃত্যুশয্যা আরামপ্রদ। ঢেউয়ের ফণা যে ভেঙে পড়ে, এ জন্যই তো। ভেঙে না পড়লে ভেসে যাওয়া এমন কী! আসলে তুমি একটা ত্রিভুজের মতো ভীতুর ডিম্ব। তুমি সাগরের কাছের বাসিন্দা হয়েও কি শোনোনি যে মরা ঢেউ জেগে ওঠে নতুন গল্প নিয়ে... জীবনের গল্প...

আমি মার খেয়ে খেয়ে মরে পড়ে আছি হাঙর শুঁটকি হয়ে যদিও হাঙরের পাখনা খুব দামি।

আমি না মরে বাঁচতে আসব। মেয়েটি লিখল সঙ্গে সঙ্গে।

ওই সে চাঁদটা, ওই সে উঠছে পূর্ণিমার চাঁদ, পৃথিবী ও আকাশের ঠোঁট স্ফীত করে, চুমো খাচ্ছে যেন চাঁদকে... ও চুমোরই যোগ্য, ওকে ধরা দরকার। আকাশে ওঠার সুগন্ধ সময়ে... ভালোবাসার সুযোগ্য সময়ে।

পারবে! ঢেউয়ের আঁটি মতো...। মেয়েটি এসএমএসে খিলখিল হাসিও পাঠিয়ে দিল।

আমি স্বপ্ন সমুদ্রে দেখেছি ধরা যায়। সেখানে বনদেবীরাও আছে।

কি রকম!

...তৃতীয়া তিথির এক ফালি চাঁদ পশ্চিম বঙ্গোপসাগরের ওপর। মনে হলো সে-ই সব গোলমালের মূল। সবাইকে সে দোলা দেবে কিন্তু নিজে দুলবে না। ওই দুষ্টুটার জন্য আমি একটা বিশাল জাল বুনে নেব। জেলেরা জাল পেতে বিশাল সাগরে মাছ ধরে, তেমনি আমি আকাশের সবচেয়ে কাছের চাঁদ মাছটিকে ধরে নেব, নেব। একটা মারাÍক ঐতিহাসিক তোলপাড় পড়ে যাবে তাতে। তুমিও তখন আমার দিকে অবাক নজর দেবে নতুন করে।

ভালোই হবে তো! একখানা কাজের কাজ হবে। সেই জাল বুনে নেওয়ার ব্যবস্থা করেছ কি! আষাঢ়ের আকাশ-জোড়া বিশাল মেঘের মতো জামদানি কারুকাজে ভরা, তাতে আকাশ ও জমিনের সব দৃশ্য ফুটে উঠবে ইচ্ছে হয়ে...

চাঁদ ধরার মতো মজবুত জাল হবে তো! নাকি নরম-নকল সুতোর জাল! ওটা হতে হবে মননজাত জাল। বাস্তব জাল থেকে যা অনেক বেশি শক্ত, মনোবেড়ির মতো।

মজবুত তো করতেই হবে। শুধু মজবুত নয়, খুউব খুউব কঠিন ও চৌকস। কারণ তুমি আর আমি ওই তৃতীয়ার চাঁদের দোলনায় বসব তাকে ধরার পর। আর আমি তোমার দিকের জালের অংশটা খুব মজা করে একটু নরম করে বুনে দেব...

কেন কেন ...!

তাতে তুমি জাল ছিঁড়ে টুক করে পড়ে যাবে। চাঁদ থেকে আকাশ বেয়ে... পড়ে যাচ্ছ, পড়ে যাচ্ছ... চাঁদের পালকি থেকে।

হুম। একটা কেলেঙ্কারি কাণ্ড হয়ে যাবে, তাতে এমনকি মৃত্যুও হতে পারে।

মেয়েটি তখন হাসি রাশি খুলে বলল, তুমি আমার কথায় রাগ করলে? ভয় পেয়েছ? খুব ভাবছ বা নাস্তানাবুদ। ওটা তো কল্পনার চাঁদের কথা! বাস্তব চাঁদের জাল হবে খুব মজবুত।

ছেলেটি বলল, চন্দ্রদেবী সেলিনির কিন্তু অন্য রকম ভালোবাসা। গ্রিক উপকথার বিখ্যাত সুন্দরী সেলিনি। সূর্যদেবতা হেলিওস তার সহোদর। সেলিনি ভালোবেসে ফেলে মর্ত্যমানব এন্ডিমিয়নকে। এন্ডিমিয়ন থাকে মর্ত্য, সেলিনি স্বর্গে। মর্ত্যরে সবচেয়ে সুপুরুষ মানব এন্ডিমিয়ন। এই দূরত্বের জন্য সেলিনি খুব চিন্তিত। ভয় এন্ডিমিয়ন যদি মর্তের অন্য কোনো রূপসীকে ভালোবেসে ফেলে! তাই সেলিনি দেবরাজ জিউসকে ভয়ঙ্কর অনুরোধ করে বসল। ভাই জিউসও অনুরোধ মতো এন্ডিমিয়নকে চিরকালের জন্য ঘুম পাড়িয়ে দেয় যাতে সে কারও দিকে নজর দিতে বা যেতে না পারে। সেলিনি তখন প্রতি রাতে নিশ্চিন্তে স্বর্গ থেকে নেমে এন্ডিমিয়নের সঙ্গে ভালোবাসা করতে আসে। সারা রাত আনন্দ-রসে কাটিয়ে ভোরের আগে ঘুম পাড়িয়ে চলে আসত।

অদ্ভুত, স্ট্রেঞ্জ! এর নাম কি গভীর গভীরতম ভালোবাসা, নাকি ঈর্ষা, হিংসা!

গ-ভী-র গ-ভী-র ভালোবাসা। তার যত গভীরে যাওয়া যায় তত মধু।

তাও ঠিক। মর্ত্যরে রাজকন্যা স্বপ্নে দেখা করতে না পারলেও এসএমএসে তো দেখা দেয়। ধরো আমি যে এসএমএস দিচ্ছি এটাই তো স্বপ্ন। আর ইচ্ছে করলেই কি বাস্তব স্বপ্ন দেখা যায়! আবার সত্যিকার স্বপ্ন এসে গেলে ইচ্ছা করলেই তাতে এসএমএসটাও পুরে দেওয়া যায়। স্বপ্নে অনেক কিছু ভরে দেওয়া যায়। এমনকি সুসিদ্ধ নিষিদ্ধ কিছুও।

রাজকন্যে সেদিন সত্যিই ঘুমে বিভোর ছিল। তাই সে রাতে ওদের চন্দ্রভ্রমণ আর হয়ে ওঠেনি। পরদিন সকালে লিখল, তুমি কি অপেক্ষা করেছিলে এতই? বঙ্গোপসাগরের তীরে! টেকনাফ বা সেন্টমার্টিনে। তোমাকে উত্তর দেওয়া হয়নি। বঙ্গোপসাগরের মতো দুঃখিত জেনো।

ছিলাম। নতুন বোনা সূ² রেয়ন সুতোর জাল বুনতে বুনতে। এক জীবনেও ছিঁড়বে না। আরেক জীবনে আরও মজবুত হয়ে যায় তেমন। বহু জীবনের জন্য তৈরি প্রসন্ন ফাঁদ।

রাজকন্যে নিয়ে এলো চতুর্মাত্রিক সূ² জাল, যা দেখা যায় না, আবার না দেখতে পাওয়াও কঠিন। ওরা জাল নিয়ে উঠে গেল তৃতীয়ার চাঁদের তরণীর কোলে। পা ঝুলিয়ে বসল দোলনায় যেমন বসে। চুমো খেল জীবনের আনাড়িপনা দিয়ে। দুরু দুরু কাঁপল নিচ থেকে মা-বাবা কেউ দেখে ফেলবে বলে। সেই ফাঁকে চাঁদকে ভুলিয়ে রেখে জাল দিয়ে পাকড়াও করে নিল। অমনি তারাদের উৎসব শুরু হলো, বঙ্গোপসাগর দুলে দুলে উঠল। হাওয়ার মাতামাতিও। আর কী প্রসন্ন ওরা! আর তখনই ছেলেটি জাল ছিঁড়ে পড়তে থাকে। যে জালের এক অংশ মেয়েটি নরম করে বুনেছিল কৌতুক করে। মেয়েটি তখন এই মর্মভেদী যন্ত্রণার ছিটেফোঁটাও ভাবতে পারেনি, এসএমএস যে খেলাচ্ছলে আণবিক শক্তিধর একটুও বোঝেনি। এখন সংহার মূর্তি দেখে কী করবে ভেবে না পেয়ে সম্ভ্রান্ত ওড়নাটা ছুড়ে দিয়ে বলে, তুমি পড়ে গিয়ে না মরে থাকলে এই ওড়নার ফাঁসে ঝুলে পড়ো। ছেলেটি এও কৌতুক মনে করল। সে আবার তার চুম্বন স্বাদ খুঁজে নিল আস্বাদিত অনুভবে। তাতে সে শক্তি পেল। ওড়না দুটি প্রান্তকে ইচ্ছে-পাখা করে নিয়ে উড়তে শুরু করল। আগুনে পাখির মতো, মৃত্যুর চেয়ে জীবন অনেক বড় অনুভবের মতো।

মেয়েটি তৃতীয়া তিথির চাঁদের ওপর বসেই রইল মূঢ়ের মতো। ওর কি মনে হলো যে জনমানবের সামনে নামার সময় ওড়নাটা যে তার নেই সে ভাবনা! ছেলেটাও  কি উড়তে উড়তে তৃতীয়া তিথির চাঁদের গৌরবের কাছে যাবে না। ততক্ষণে চাঁদ বঙ্গোপসাগর ও আকাশের ওষ্ঠপুটের প্রাচুর্যে মরতে বসেছে অনাস্বাদিত সুখস্বপ্নে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর