শুক্রবার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

মিলনের নিষ্ঠা

রশীদ হায়দার

মিলনের নিষ্ঠা

নির্দ্বিধায় বলতে পারি, মিলন আশি, নব্বই, এক শ বছরেও এখন যে রকম তরুণ ও প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর, তখনো তা-ই থাকবে। কারণ লেখাটা মিলন যতটা পেশা হিসেবে নিয়েছে, তার চেয়ে বেশি নেশা হিসেবে। নেশায় বুঁদ না হলে একটা মানুষ কী করে শত রকম ব্যস্ততার মধ্যেও লেখার সময়টা ঠিক বের করে নেয়, কাজে লাগায় এবং সৃষ্টিটা ঠিকই করে যায়।

১৯৬১ সালে আমি সিনেমা পত্রিকা সাপ্তাহিক ‘চিত্রালী’র সঙ্গে যুক্ত হই; পার্টটাইম চাকরি করি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। নিজের এই পরিচয়টা দেওয়ার একটা কারণ আছে। ১৯৬২ সালের শেষ দিকে চিত্রালী কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে প্রতি সপ্তাহে একটি গল্প ছাপা হবে। এ বিষয়ের মূল সম্পাদক কবি-কথাশিল্পী সৈয়দ শামসুল হক। হক সাহেব চিত্রালীতে শুধু চাকরিই করতেন না, চলচ্চিত্রের কাজেও লাহোর ও করাচিতেও যেতেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে চিত্রালীতে গল্প দেখার দায়িত্ব আমিও কিছুটা পালন করেছি। না, তখন মিলনকে নবীন গল্পকার হিসেবে পাইনি, তবে ১৯৬৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে যাওয়ার বেশ কিছু পর ইমদাদুল হক মিলন নামে এক তরুণ গল্পকারের গল্প চোখে পড়তে শুরু করে। নির্মেদ, ঝরঝরে ভাষায় গল্প লিখে যায়, যেন কলমই ওকে দিয়ে লিখিয়ে নেয়।

আমি এই লেখাকে বলি অনায়াস লিখন। জানি, অনায়াসে সৃষ্টিকার্য হয় না। এর জন্য শ্রম দিতে হয়, ঘাম ঝরাতে হয়, নির্ঘুম রাতও কাটাতে হয়, লিখতে না পারার কষ্টও সইতে হয়, লেখা ভালো না লাগলে পাঠকের মন-ঝামটাও কপালে জোটে। শুনতে হয় কানে, দেখতে হয় লিখিত মন্তব্যে। আমি কিন্তু প্রতিটি মন্তব্যই মাথার মণি মনে করি, কারণ আমি লিখেছি বলেই না পাঠকের প্রতিক্রিয়া লাভ হলো।

মোহ নেই কার? ছাপার অক্ষরে নাম দেখলে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ যেখানে খুশি হতেন, সেখানে মিলনের চেয়ে আমি চৌদ্দ বছরের বড় হলেও ছাপার অক্ষরে নিজের নাম বারবার দেখি—দেখি আর মনে হয়, এই নামটি আমার? নার্সিসাস প্রেম আর কি!

মিলনকে নিয়ে আমার সবচেয়ে বড় বিস্ময় হচ্ছে, ও এত লেখা লেখে কখন, কিভাবে? সাহিত্যচর্চা তো আছেই, আছে আড্ডাবাজি, তরল আড্ডা, সাহিত্যসভায় অংশগ্রহণ, ভ্রমণ; শুনেছি, কিশোরকালে নিয়মিত কাঁচাবাজার করলেও এখন আর সে রকম যাওয়া হয় না। না যাওয়ার বাস্তবতা হচ্ছে বিশেষ ব্যস্ততা। সেটা কিসে? সাংবাদিকতা। এখন একটি জনপ্রিয় দৈনিকের সম্পাদক। একটি দায়িত্বশীল দৈনিক পত্রিকার সব দায়দায়িত্ব সম্পাদককেই বহন করতে হয়; এই দায়ভার মাথায় নিয়েই প্রধানত সৃজনশীল লেখায় এতটা নিমগ্ন হয়, সেটাই এক বিস্ময়।

এখানেই নিষ্ঠার কথাটা আসে জোরালোভাবে। মিলন অনেক লেখা লিখেছে হালকাভাবে, তরল মেজাজে। সেটা লেখকের নিজস্ব ব্যাপার, তাঁর সৃষ্টি তিনি কিভাবে উপস্থাপন করবেন, সেটা তাঁর ব্যাপার। কিন্তু আমার কাছে মূল বিষয়টি হচ্ছে মিলনের নিষ্ঠা। লিখছে একনিষ্ঠভাবে। ওর বইয়ের সংখ্যা হয়তো এরই মধ্যে ২০০ ছাড়িয়ে গেছে। মোটকথা, লিখেছে প্রচুর এবং আরো লিখবে অজস্র। ক’টা লিখলে অমরত্ব পাবে সে প্রশ্ন অবান্তর, কিন্তু যেটা একান্তভাবেই বলা প্রয়োজন—দুজন লেখক বাংলাদেশের পাঠককুলকে যে স্বদেশমুখী করেছে, তাদের একজন হুমায়ূন আহমেদ, আরেকজন অবশ্যই ইমদাদুল হক মিলন।

বাংলাদেশের সাহিত্যে যে দুটি বড় ব্যাপার ঘটে গেছে, তার একটি হচ্ছে ভাষা আন্দোলন, আরেকটি মুক্তিযুদ্ধ। মরহুম হুমায়ূন এবং এখনো প্রবলভাবে কর্মব্যস্ত মিলন এ দুই ঘটনারই যে প্রত্যক্ষ ফসল, তা কোনোক্রমেই অস্বীকার করা যাবে না। হুমায়ূন প্রসঙ্গ যাক; মিলনের কথাই বলি, মিলন তরুণ প্রজন্মকে সাহিত্যমুখী করেছে, লিখতে প্রেরণা জুগিয়ে যাচ্ছে, ফলে হাতের তালুর মতো ছোট্ট এই দেশটাতে অসংখ্য পত্রপত্রিকার নিয়মিত লেখক কারা? তরুণ এবং নবীন প্রজন্ম। প্রেরণা ও উৎসাহদাতা হিসেবে এ দুই প্রজন্মের সামনে আছেন অবশ্যই হুমায়ূন ও মিলন। বাস্তবতায় হুমায়ূন নেই, আছে তাঁর সৃষ্টি; অন্যদিকে মিলন অবিরত ক্লান্তিহীনভাবে কাজ করে জানিয়ে যাচ্ছে, সৃষ্টিশীল কাজে বিশ্রামের সুযোগ নেই।

বলা হয়, গদ্য রচনা শাবল দিয়ে পাথুরে মাটি কোপানো। বিশ্বাস করি সে কথা। যেকোনো সৃজনশীল সাহিত্যকর্মই পাথুরে শক্ত মাটি কেটে এগিয়ে চলা, কিন্তু বিশেষ করে গদ্য সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে যে শারীরিক শ্রম দিতে হয়, তার তুল্যমূল্য কিছুটা বেশিই। এ ক্ষেত্রে মিলনের ব্যাপারে একটা উদাহরণই দেব।

 

আমি তখন বাংলা একাডেমিতে সাহিত্য পত্রিকা ‘উত্তরাধিকার’-এর নির্বাহী সম্পাদক। একদিন মিলনকে পেয়ে বললাম, তোমার উত্তরাধিকারের জন্য একটা উপন্যাস দিতে হবে। আমি হতবাক হয়ে দেখি, পরদিনই মিলন সম্পূর্ণ আঞ্চলিক ভাষায় লিখিত ‘কালাকাল’ নামের একটি উপন্যাস এনে হাজির। আমার হতবাক হওয়া আরো বাকি ছিল। যখন শুনলাম, মিলন উপন্যাসটি লিখেছে এক বসায়, সারা রাত জেগে। সারা রাত জাগা অথচ চোখে-মুখে রাত জাগা ও শ্রমের চিহ্নমাত্র নেই। লেখা ও লেখাটি সম্পূর্ণ করার আনন্দই ওকে উজ্জীবিত রেখেছে। সৃষ্টির আনন্দই এখানে। ‘কালাকাল’ মিলনের অবশ্য উল্লেখ্যযোগ্য উপন্যাসের একটি। অবশ্য উল্লেখযোগ্য কথাসাহিত্যের মধ্যে ‘ভূমিপুত্র’, ‘মাটি ও মানুষের উপাখ্যান’, ‘১৯৭১’, ‘সাড়ে তিন হাত ভূমি’, ‘নিরন্নের কাল’, ‘নেতা যে রাতে নিহত হলেন’, ‘নূরজাহান’ ইত্যাদি সত্য সত্যই মাটি ও মানুষের কথা বলেছে বেশি; বায়বীয় বিষয় বা প্রেম নয়, সত্যিকার অর্থেই ভূমিসন্তানরা উঠে এসেছে বারবার।

একজন লেখক ইতিহাসমুখিন না হলে কোন ভিত্তির ওপর কাজ করবেন? আগেই উল্লেখ করেছি বায়ান্ন ও একাত্তর আমাদের জাতীয় জীবনকে কতটা প্রভাবিত করেছিল। মিলন তো ওই দুই সালেরই উত্তরসূরি। ঘটনার ভেতর দিয়ে অগ্রসর হলে যে বোধ ক্রমে দানা বাঁধে, সেই বোধই প্রকৃত লেখককে মানুষ চিত্রায়ণে সহায়তা করে। মানুষের রূপকার ‘নূরজাহান’কে মিলন দেখেছে গভীর মমতায়, ভালোবাসায়। আমাদের জানা আছে, আমাদের অন্ধ ও বিবেচনাহীন সমাজব্যবস্থায় মেয়েদের অবস্থান কোথায় এবং তারা কোন পরিস্থিতির শিকার। নূরজাহান তেমনই একটি মেয়ে, যে নির্যাতিত হওয়ার সময় সমাজের মুখে থুতু ছিটায়, মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত পদাঘাত করে যায়, ঘৃণা প্রকাশ করে।

প্রকৃত সমালোচকরা এই চিত্র বুঝতে ভুল করেন না। সংবেদনশীল পাঠককে নূরজাহানের সামনে নতজানু হয়ে ক্ষমা ভিক্ষা করতে হয়।

সৃজনশীল শিল্পী মানুষ এবং মনুষ্যত্ব সম্পর্কে সেই প্রশ্নটাই জাগায়, যেটা মিলন জাগাতে পেরেছে। মিলনের বেশ কিছু লেখায় চটুলভাব আছে, গভীরতাহীন প্রেমের গল্প-উপন্যাসও আছে; থাকুক, কিন্তু আমি যে বিশেষ কয়েকটি বইয়ের কথা বলেছি, তার মধ্যেই মিলন প্রবলভাবে বেঁচে থাকবে, থাকবেই। কারণ সেখানে ‘মানুষ’ আছে, ইতিহাস আছে, দেশ আছে, আছে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু।

সর্বশেষ খবর