শুক্রবার, ২৫ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

আয়না

গল্প ♦ হাবীবুল্লাহ সিরাজী

আয়না

আয়না, কোথায় তোমার ছায়া পড়িয়াছে? আগুন লকলক করিলে, বায়ুর গতি বদল হইলে, জমিনের শরীরে বৃক্ষ ঢলিয়া পড়িলে, জল তাহার নিশানায় পৌঁছিলে কিংবা আকাশ অধর মেলিলে তুমি কি চিত্তে চাঞ্চল্য অনুভব কর না? যত কিছুই ঘটিবে না, রটিবে না কোনো নাম; তবুও তো ধাম বিবেচিত হইবে, সময় শঙ্খ বাজাইবে সূর্যসম্মানে। আমাদের চিত্রসমূহ প্রতিচিত্র হইয়া পাহারা দেবে বয়ঃসন্ধিকাল ও নব অন্তরাল।

আমি তোমাতে কী ছিলাম তাহা আজিও বুঝি না, তুমি আমাতে কী রচিয়াছিলে তাহারও চিহ্ন অজ্ঞাত। খণ্ড আয়নার একপ্রস্থ আলো মুখমণ্ডলে প্রতিফলিত হইয়াছিল। এবং তাহার বিচ্ছুরণে অন্তরে যে মৃদু কম্পন জাগিয়াছিল, সেই রেশ এখনো বিদ্যমান বলিয়া মানি। টানাটানির প্রহরগুলি কি নিঃশর্তভাবে বিভাজন করিতে পারিয়াছিল আলো ও অন্ধকার? বুঝিবা দিবস ও রজনীর অভিন্ন প্রান্তরই সৃষ্টি হয় নাই। যাই বল, নির্বাক স্ফূর্তিদণ্ডে কেবল খেলা করিয়াছে বাল্যজাল।

আয়না, কেউ তো সম্পূর্ণ ফুরায় না। জগত্সংসার ধারণ করে মহামায়া। তোমার মান যখন অভিমানের দরজায় প্রবেশ করিত, আমি তখন অফুরান বাষ্পরাজিকে জলবিন্দুতে পরিণত করিবার পন্থা উদ্ভাবনের চেষ্টায় রত থাকিতাম। ভাবিতাম, পরবর্তী দর্শনে নিশ্চয়ই লাঘব হইবে সুতাদূরত্বের এই ব্যবধান। টিনের চালে হিম নামিয়াছে, বৃষ্টি ঝাঁপাইয়াছে কাঁঠালপাতায় ও গাজরমূলে, রৌদ্রালোকে ঝলসাইয়াছে আঙ্গিনার টেড়া চাপকল। তুমি নড়িয়াছ, সরিয়াছ, ভর করিয়াছ চাঞ্চল্যসমুদয়ে; আর তাই  তো অনুরাগ ও বিরাগ যুগপৎ তোমাকে আবিষ্কার করিয়াছে। প্রতিফলনে তোমার প্রত্যয় এবং প্রতিসরণে তোমার প্রাবল্য দিয়াছে মিশ্রমিলন। পরাজয় তোমাকে বারবার জয়ের হাতছানি দিয়াছে।

অষ্টম শ্রেণিতে জুনিয়র বৃত্তির চল হইল সেই উনিশ শত একষট্টি সালে। তাহা যখন জুটিয়া গেল, তখন ভাবই আলাদা। প্রভাত বুঝিবার জন্য ঘড়ির প্রয়োজন, পুষ্করিণীতে ঝাঁপাইয়া পড়া হইতে ভাতের প্রথম নলা মুখে তোলা পর্যন্ত সময় ধরিবার জন্য ঘড়ি জরুরি, কাক উড়িয়া গেলে কতক্ষণে কোকিল তাহার বাসার দখল লইবে তাহা মাপিবার জন্য ঘড়ি আবশ্যক। ঘড়ি চলিতে-ফিরিতে, ঘড়ি ভূগোলে-ব্যাকরণে। কোথায় নাই ঘড়ি-ব্যবহার, সময়-সৎকার? নিদ্রায়? শৌচাগারে? প্রণয়ে? প্লাবনে? মোদ্দাকথা, সর্ব অবস্থায় সর্ব পন্থায় ঘড়ি চাই। তা হাতঘড়ি হউক বা পকেটঘড়ি, টেবিলঘড়ি হউক বা দেওয়ালঘড়ি! বর্তমানের মতো তো আর সর্বচিত্রে ঘড়ির সাক্ষাৎ মিলিত না। স্থানগত এবং অর্থনৈতিক উভয় প্রেক্ষিত বিবেচনা করিয়া টেবিলঘড়ি ক্রয়ের সিদ্ধান্ত হইল। বৃত্তির প্রথম কিস্তির টাকা পাইলেই প্রকল্প বাস্তবায়িত হইবে।

ঘড়ি আসিল, ঘড়ি বসিল। শুরু হইল সময়ের সঙ্গে পাল্লা, অনন্তের অন্তরে দম দেওয়া না দেওয়ার খেলা। আকাশ ভরিয়া যত কায়া ছিল, ছায়া ছিল না তাহার জমিনে। যে শ্রী আয়না ধরিবে, যে শোভা মল্লিকায় ফুটিবে, যে চরণে বাজিবে মঞ্জরি; ছিল না তাহার প্রস্তুতি। বালিকা দহন অনুভব করে নাই যে শুদ্ধ হইবার প্রণালী জানিবে। কৈশোরিক চাঞ্চল্যের গর্ভে যে আশা অঙ্কুরিত হয়, তাহার উন্মোচন দাবি করে বেদনার নীল প্রহর। রজ্জুর প্রান্ত স্পর্শ করিয়া তারুণ্যের প্রসার উপলব্ধির জন্য চাই মুক্ত মত ও যুক্ত পথ। তাহার যে সেই অভিসারের ঘণ্টা-মিনিট চালু হয় নাই। বুঝিয়া বা না বুঝিয়া এলার্ম বাজাইয়া দেয়। চমকায়, শিহরিত হয় অস্ফুট চাহনি।

টেবিলঘড়ির উপকারিতা বহুবিধ। সময়সংঘের পাশাপাশি তাহাকে ঘুরাইয়া টেড়ি কাটা যায়। আয়নায় রূপান্তরিত করিয়া নিরীক্ষণ করা যায় কেশ-উদগম। গৃহে চোর প্রবেশিলে রেডিয়ামে রজনীর বয়স বোঝার সুবাদে মস্তক তাক করিবার অভিপ্রায় মেলে। আমি কি মূল হইতে সরিয়া যাইতেছি? তাইবা কি করিয়া সম্ভব? চন্দ্র উঠিতেছে। প্রশস্ত আঙ্গিনায় ইঁদুর ধরিবার জন্য বিড়াল ওত পাতিয়া বসিয়া আছে। নিকটে কোথায়ও তক্ষক ডাকিতেই ভয়ে বালিশে ঢুকিয়া গেল মুখমণ্ডল। আয়না তো চক্ষু মুদিয়াও ধরিতে পারে নিঃশ্বাসবার্তা।

নবম পার হইয়া দশমে পড়িল। আমার ঘড়িযাপন এবং আয়নাপালন যুগপৎ চলিতে লাগিল। নিত্যদিন সময়দর্শনের সহিত মুখ অবলোকনের একটি অলিখিত চুক্তি সম্পাদিত হইয়া আছে। পিতা পশ্চাতের বাগিচায় আমলকীর চারা পরিচর্যায় ব্যস্ত, মাতা তাতানো তেলে কাতলের লেজ ছাড়িয়া মুখের শ্বেতবিন্দু আঁচলে মুছিতেছেন এবং আমি তখন আয়নাভাষায় বুঝিতে চেষ্টা করিতেছি লাবণ্যের কতটুকু গভীরে স্থিত হয় ওষ্ঠের অবগাহন। মুষ্টিবদ্ধ হাতের কাছে কতখানি নত হয় কাষ্ঠনির্মিত দরজা কিংবা ইষ্টকনির্মিত প্রাচীর।

ফরিদপুর জিলা স্কুলের পশ্চাতের মাঠ হুমড়ি খাইয়া পড়িয়া আছে রেলস্টেশনের পদপ্রান্তে। যাত্রীগণের অবতরণকে স্বাগত জানাইয়া মধ্যবর্তী সড়ক ঈষৎ কোমর বাঁকাইয়া উত্তর হইতে দক্ষিণে গেলেই প্রথমে বামপার্শ্বের হাই স্কুল আমার ষষ্ঠ শ্রেণি ধরিয়া টানিয়াছিল। এক বৎসর পূর্বের পুকুর পরবর্তী বৎসরেই পশ্চিমের সহিত ভাগ হইয়া গেলে আমাকে মাধ্যমিকের বোঝা নামাইতে হইয়াছে লাল ইটের বিদ্যায়তনে। শামসুদ্দীন স্যারের ইংরাজির সহিত হালদার স্যারের অঙ্ক দড়িকাছা বাঁধিয়া আলীপুর পার করিয়া চৌরঙ্গী পৌঁছাইয়াছে। গুহ লক্ষ্মীপুরে আসিয়া মোহাম্মদ হোসেন স্যারের পদপ্রান্তে লুটাইয়াছে পদার্থবিজ্ঞান। আরোরা টকিজের মাইক্রোফোনে বাজিতেছিল ‘মা আমার সাধ না মিটিল আশা না পুরিল...’। সাধ মিটিল কিনা বুঝিলাম না, তবে আশা তো পুরিল। ঘড়ি-আয়নায় চকচক করিয়া ফুটিয়া উঠল উত্তীর্ণ হইবার প্রথম বিভাগ। প্রশংসা হিসেবে মিলিল কতিপয় পত্র। বোর্ডের তালিকায় পাঁচ নম্বরে থাকিয়া আখতার স্কুলের নাম রৌশন করিল।

যুদ্ধ বাধিল ভারত-পাকিস্তানে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান রহিল উদলা ময়দান। তারপরও জোশে ইন্তেকামে ‘পাখি তার দুটি ডানা আকাশে মেলে’ খেমকারান সেক্টরে ঝাঁপাইয়া পড়িল। আমরা উতালা করিলাম লাল টালির ছাউনি দেওয়া কমনরুম। উচ্চ মাধ্যমিকে রাজেন্দ্র কলেজের বিজ্ঞানমন্দিরে ওড়না দিয়া রচিত হইয়াছিল ষড়ভুজ। আর রচয়িত্রীগণ অধ্যাপকের পশ্চাতে শোলের পোনার মতো ভুড়ভুড়ি দিতে দিতে পাঠকক্ষে আসিত। বসিবার স্থানও ছিল সংরক্ষিত। কোনো আপত্তি নাই, বিপত্তি কেবল ডিনামিক্স ক্লাসে ঘোষ মহাশয়ের টেনিস বল নিক্ষেপ লইয়া। যেই মুহূর্তে মস্তক রক্ষা করিয়া বলটিকে খাতায় সাঁটিতে যাইতাম সেই মুহূর্তে খুক করিয়া কাশিয়া উঠিত পূর্ব খাবাসপুর। অপরপক্ষে, লাব্রাডার স্রোত যখন ভূগোল ক্লাসের গ্লোব ভিজাইয়া দিত, তখন চরভদ্রাসনও যাইত ভাসিয়া। এখানেই ইতি নহে। ‘জয়টা নিউট্রন তয়টা প্রোটন’-এর শরীরে ফাঁসিয়া গ্যালারি কক্ষ তছনছ হইয়া গেলে রসায়ন খাতা ঝিলটুলিতে জমা পড়িত। ঈশ্বর গুপ্তও বসিয়া থাকেন নাই। ‘তপসে মাছ’ রান্না করিয়া দাদার ক্যান্টিনে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করিয়াছেন। সকলকিছু গ্রাস করিয়া মোজাম্মেল ও সাজ্জাদ কলেজের বার্ষিক এবং টেস্ট পরীক্ষায় প্রথম-দ্বিতীয়/দ্বিতীয়-প্রথম তকমা আঁটিয়া ফেলিল। আর ফাইনালে একটি খাড়া দাগ লইয়া আমি মহিউদ্দিন স্যারের ‘সাইলাস মার্নার’ বিদায় করিলাম।

ফরিদপুরের পাট চুকিল। সিনা টান করিয়া ডাক দিল ঢাকা। আব্বা বিছানা গোছাইতে বসিলেন। লম্বালম্বি ভাঁজ করা খয়েরি-সবুজ শতরঞ্জি সযত্নে পাতিয়া তাহার উপর জুত্মতো সিঙ্গেল তোষক ফেলিলেন। ইহার পর এক প্রান্তে ধবধবা বালিশ জুড়িয়া আনকোরা গুলটেক্সের চাদর রাখিলেন। চাদরটি দেখিয়া আমি যারপরনাই পুলক বোধ করিলাম। সেই জীবনে ইহাকে অনেক বড় প্রাপ্তি বলিয়া মানিলাম। আব্বার মুখের দিকে তাকাইলাম, তিনি তখন শতরঞ্জি দিয়া সবকিছু মোড়াইয়া পাটের দড়িতে বাঁধিতেছেন। আরে, আমাদের তো একটি হোল্ডঅল ছিল? বিষয়টি গিলিয়া ফেলিলাম। এইবার স্যুটকেসের পালা। চব্বিশ ইঞ্চি চামড়ার স্যুটকেস কিনিয়া তাহাতে খাকি কাপড়ের ঢাকনা পরানো হইয়াছে। নতুন শার্ট-প্যান্ট-লুঙ্গি-গেঞ্জি-জাঙ্গিয়া-মোজা-স্যান্ডেল তুলিয়া তোয়ালে দিয়া ঢাকিয়া দিলেন। কাগজের ঠোঙ্গার মধ্যে পেস্ট-টুথব্রাশ-জুতার কালি-সাবান-চিরুনি ভরিয়া চব্বিশ ইঞ্চি চামড়ার স্যুটকেসে তুলিলেন। ভাবিয়াছিলাম আয়না-ঘড়িটি বাদ পড়িবে। না, তাহাও চলিল আমার সহিত। ইহার কি আর প্রয়োজন আছে? আছে। আয়নার প্রয়োজন হয়তো সেই অর্থে আব্বায় পশে নাই; তবে, ঘড়ি তো আর ফুরায় নাই।

২.

আমি আয়না। কাহারও আয়না-ঘড়ি নহি। নহি লাল জবাফুল, সময়-মাসুল। তবু আমাকে লইয়া তাহার যে কী ছিল, তাহা তো ধরি নাই। কিংবা আমি তাহাকে সম্মুখে রাখিয়া কী দেখিতে চাহিতাম, তাহাও জানি না। হালিমা গার্লস স্কুল ছুটি হইলে দুই আনার কামরাঙা দাঁতের তলে ফেলিয়া টক বুঝিতে চেষ্টা করিতাম। স্কন্ধের পুস্তকেরা কখনো হাসিয়া কথা বলিত, আবার কখনো কখনো ক্রন্দন করিয়া বুক ভাসাইত। কৌতূহলের মাছরাঙা চক্কর দিলেও সময়মতো ঝাঁপ দিত না পানিতে। যা দেখিবার জন্য আকুল থাকিতাম তাহা মুহূর্তেই মিলাইয়া যাইত। মিনিটের কাঁটা যে নাড়াচাড়া করিব, সে উপায়ও ছিল না। ভাই বলিতে মাসুদ, অসম্ভবের তালিকায়। পিতার চাকরি, মাতার মৌলিন্য কিংবা বসতবাটির নিরাপত্তা, কিছুই ছিল না। এক ভাড়াটিয়া-কন্যার আয়না-দৌড় তাই কতদূর আর যাইতে পারে? চাঁদমারী খাঁ খাঁ করিত। স্টেডিয়ামে আইয়ুব খাঁর গলাবাজির কোনো মানেই বুঝি নাই। জেলখানার পিছনের কাঁটাতারে যে ছিন্ন বস্ত্র ঝুলিত, তাহার উৎস খুঁজিয়া বেড়াইতাম। আসলে আমি কোন আদলে আমার আয়নায় ছিলাম, আবার কোন কারণেই বা কিশোরী ডিঙ্গাইয়া তরুণী হইতে চাহিতেছিলাম, তাহা ছিল বোধের বাহিরে। অন্তরালে একজন দেখা দিত, ধরিতে চাহিতাম তার মিলন-চাহনি। মিলিত না। ইহাতে জিদ বাড়িত। খেপিয়া উঠিতাম। খাতা ছিঁড়িতাম, চিরুনি ভাঙ্গিতাম, বালিশ ফুটা করিয়া তুলা উড়াইয়া দিতাম। কাহাকেও যেমন বলা যাইত না, আবার সহ্য হইত না অনাদরের দোয়াত-কলম। কান মলিতে চাহিলে নাক বাড়াইয়া দিত ইঁদুর-কাল। নিজেই পিষ্ট হইয়া অশ্রু ঝরাইতাম।

একদিন জননীকে শুধাইলাম : আম্মা, আয়নার পিছনটা মুছে দিলে কি হয়? আমার দিকে কটাক্ষ করিয়া তিনি চাউল হইতে কঙ্কর সরাইতে মন দিলেন। পিছনের পারদ তুলিয়া ফেলিলে আয়না পরিণত হয় কাচে। কাচ ভাঙে কাচের খণ্ডে, কাগজ প্রস্তুত হয় বংশমণ্ডে। তুলাদণ্ডের কোনো সায় নাই। দেখিলাম, ফেরিওয়ালা পুরানা বোতলের সহিতই বাতিল খাতা রাখিতেছে। হয়তো নষ্ট তালা এবং ছেঁড়া মালাও জুড়িয়া দিয়া হাঁক দিবে : নুন বদলাই। নুনের কথাই যখন আসিল তখন পুলিশের বউয়ের নুন-মরিচ ডলিয়া ভাত খাইবার কথা মনে পড়িল। লাইনে পোস্টিং। রেশন মিলিলেও আনাজ-আমিষ জুটাইতে হিমশিম খাইতে হয়। দুইজনেই এই, পেট বাঁধিলে খবর আছে। ছিঃ, কীসে যে মন নাচায়, তল্লাশে দায়! টিক, টিক, ঠিক...

স্কুলমাঠে দফতরির ছাগল চরিতেছে। ঘণ্টা বাজান এবং বড় আপার হুকুম তামিলের ফাঁকে ফাঁকে খাদিজা খালা ছাগলের ওপর নজর রাখিতেছে। একমাস পরই শালুক ফুটিবে খালের পানিতে, আর এক ছাগল সন্তনাদি মিলাইয়া তিন কিংবা চারে পরিণত হইবে। ছাগদুগ্ধ বড়ই উপকারী। অজান্তেই চক্ষু চলিয়া গেল বুকের ওড়নায়। ‘মাগো তামশা দেখ, নাক টিপলে এখনো দুধ বাইরায়, আর সেই কীনা পোলার মায়’। জয়নবের কথা মনে পড়িল। আমাদের বাসায় ঠিকা কাজ করিত। বারান্দায় নড়িল ননীবাবুর ধুতি, জ্যামিতি-বক্স খুলিয়া স্কেল ও পেনসিল বাহির করিলাম। শাদা পাতায় কি সরলরেখা ছুটিল? বুঝিতে চাহি না রেখাযাত্রা; যদি হামলাইয়া পড়ে এ-র ও-র মাত্রা। বৃত্তকে মুছিলেও তাহা বিন্দু হইয়া ঘুরপাক খায়। তিন দিন ধরিয়া শশীর তলপেট ব্যথা করিতেছে। বমি বমি ভাব, খাওয়ায় অরুচি। আয়নার সকল ছবি শশীর চেনা। ওকে ফরিদ শাহর দরগায় লইয়া যাইতে হইবে। হুজুরের পানিপড়ায় বেজায় তেজ। ছোট খালা সাতক্ষীরা হইতে আসিয়া একরাত্রি থাকিয়া পরদিন সকালেই ঢাকা রওয়ানা হইয়া গেল। আমাকে দেখিয়াই হাঁউমাউ করিয়া উঠিল :

কীরে, মাংসে ঝোল বেশি না ঝাল?

বুঝলাম না।

তা বুঝবি ক্যান? হাঁসের মতো ডুবসাঁতারে আছস?

কী যে বলো না খালা!

ডুব দিস দোষ নাই। ময়লা পাইলেই ডাঙায় উইঠা ঝাড়া দিস।

ওষ্ঠের প্রান্তে হাসি লটকাইয়া খালা হাতব্যাগের চেইনে টান দিল।

আয়না, তুমি বধির হইয়া যাও। তালা পড়ুক মুখে। চক্ষুতে ঠুলি পরিয়া লক্ষণরেখায় স্থির হও।

ছায়া ছোট হইতে থাকে। সূর্য আগাইয়া আসিতেছে। ভয় পাই, কখন নিজেকে হারাই। তাহার চোখে চোখ না রাখি, নাকে নাক না ঘষি, ওষ্ঠের কিনারায় জিহ্বা স্পর্শ না করি, দুই দণ্ড কি আপন ছায়ায় তাহার মায়া ধরিতে পারিব না? পারিব না প্রতিবিম্ব হইয়া টেবিলঘড়িতে ফুটিতে? কাঁসার থালায় পানির মধ্যে সূর্যের ছায়া ভাসিতেছে। গ্রহণ লাগিয়াছে। দাউ দাউ চুল্লিতে বলকাইতেছে ভাত। কড়াই মাতিয়াছে টেংরা মাছের ঝোলে। সম্পন্ন হইলে মাদুরে থালা পড়িবে। গ্রহণকালে কি অন্নগ্রহণ সিদ্ধ? ডাক দিল ক্লাস নাইন। ফাইন। আমরাও তো হইতে পারিতাম একই ছাতার তলে রৌদ্র ও বৃষ্টি।

৩.

পাতা উল্টাইয়া পিছনে তাকাইতে খণ্ড কাচে প্রতিফলিত হইল একফালি প্রভাতের আকাশ। বুঝিতে চাহিলাম, মানসাঙ্কের তহবিল-খরচ কী পরিমাণ উঠিয়াছিল গৌণ ভূমিকার জন্য বিয়োগ চিহ্নগুলি ক্রমান্বয়ে মুছিয়া যাইতে থাকে। রাহুৎপাড়া ফ্রি প্রাইমারি স্কুলের দৃশ্যপট তাই আয়নাকাননে অস্বচ্ছ। চাপিলা ভাজিবার জন্য আর পেঁয়াজের প্রয়োজন নাই। সুজি ভুরিয়া বুজিও যে পাটিসাপটা মুখে তুলিয়াছিল তাহার কোনো দায় ধরা বাতুলতা। মেয়ে পালকিতে উঠিয়া বধূ হইয়া যাইতেছে। পার্শ্বে ছাতা মাথায় আইল ভাঙিতেছে নওশা।

আয়নাকে সযত্নে সাজাইয়া নৈশভোজে আহ্বান করিবার সাহস এখনো পর্যন্ত অজ্ঞাত।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর