শুক্রবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
গল্প

মা একদিন এসেছিলেন!

শারদুল সজল

মা একদিন এসেছিলেন!

দীর্ঘদিন ধরে পাপকর্ম জীবিত থাকলে প্রকৃত আত্মা মরে যায়। মানুষ শরীরে নয়— আত্মোন্নয়ের ওপর জীবিত থাকে। লাইটটা জ্বালাও সেকান্দার, ভয় নেই— আমি তোমার মা।

আর্তনাদ কণ্ঠে মা মা বলে পুলকিত হয়ে উঠলাম। মার সুন্দর মুখাবয়বে পবিত্রতা যেন স্থির দিব্যমান হয়ে নুয়ে আছে। মাথা নিচু করে নির্দ্বিধায় বললাম, আমি যে অনেক পাপ করেছি মা।

হ্যাঁ, তা জানি। মৃত্যুর পর প্রতিটি আত্মা তার সন্তানের চার পাশে ঘোরাফেরা করে, বিশেষ করে সন্তানেরা যখন কোনো সৎ কাজ করে তখন মা-বাবার আত্মার খুশির কোনো শেষ থাকে না। ঠিক তেমনি খারাপ কাজের সময়ও আমরা বাধা দিই— কিন্তু ব্যর্থ হই এবং চিৎকার করি...

তুমি কি বুঝতে পেরেছ সেকান্দার, আমি কেন এসব কথা বলছি। লজ্জা বা ভয়ের কিছু নেই, মাথা উঁচু কর— তুমিই এখন তোমার বিচারক। ন্যায়-অন্যায় বোঝার ক্ষমতা ও বয়স দুটোই হয়েছে তোমার। অথচ এমন দিন আসবে যেদিন তোমার জীবনের নিয়ন্ত্রক তুমি থাকবে না। প্রত্যেকটি জীবন একটা নির্দিষ্ট সময় নিয়ে পৃথিবীতে আসে, বাঁচতে শিখে, দৌড়ায়... এবং সবশেষে ঘুমিয়ে পড়ে। সেদিন নিজেকে শোধরানোর আর কোনো পথ থাকে না।

সেকান্দার? মা পরপর ডাকলেন দুবার।

আমি মাথা তুললাম।

তোমার বাবার কথা মনে পড়ে?

মাথা ঝাঁকিয়ে স্বীকার করলাম, হ্যাঁ।

তিনি ভালো আছেন, তার মতো হও, সেবা কর এবং মানুষ হওয়ার চেষ্টা কর। এ কথাটি বলেই মা একটু সরে দাঁড়ালেন, যেন শূন্যের ওপর। যেন পাহাড় ভেদ করে বেড়ে উঠা সুদূর কোনো নক্ষত্রের আড়ালে এবং তার ফরসা মুখটা মুহূর্তেই ফ্যাকাশে কালো হয়ে কিছুটা লাল-রক্তিম বর্ণ ধারণ করল। রাগ হলে যেমনটি হয় আর কি। এই প্রথম যেন তিনি স্পষ্ট সুরেই বললেন— তোমার তো দেখছি চার পা গজিয়ে গেছে!

আমি ইতস্তত কণ্ঠে প্রতিবাদ করলাম, কেন তা বলছেন মা? এইতো আমার দুই পা দেখুন, আমি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে প্রমাণ করতে চাইলাম। তিনি একটু সরে দাঁড়ালেন, বললেন, সেকান্দার— প্রত্যেক মানুষের ভিতরই এ চতুষ্পদ বিষয়টি কম-বেশি থাকে, তবে ওটাকে বিভিন্ন সৎ চিন্তা ও কর্ম দিয়ে ক্রমান্বয়ে টেনে টেনে দুপায়ে উন্নতি করে নিজেকে মানুষ হয়ে উঠতে সাহায্য করতে হয়। জন্মের মধ্য দিয়ে কেউ মানুষ নয়।

তার মানে?

আমি তোমার মনুষ্য অর্জনের কথা বলছি। তুমি কি মানুষ হতে চাও না সেকান্দার?

অবশ্যই চাই মা। তবে তার জন্য তো আত্মাকে শুদ্ধ ও পবিত্র করতে হবে।

আমতা আমতা করে আমি কিছুটা বোঝানোর ব্যর্থ চেষ্টা করলাম। মা আমাকে থামিয়ে দিলেন। এবং বললেন, দেখ— মানুষের জন্মটাই কেবল সত্য নয়, এরচেয়ে বড় সত্য হচ্ছে মৃত্যু এবং তার চেয়ে বড় সত্য হচ্ছে তার কাজ। এ কাজ দিয়েই মানুষ তার জন্ম ও মৃত্যুকে অঙ্কিত করে। তোমার জন্ম হয়েছে একথা সত্যি, তোমার মৃত্যু হবে তাও সত্যি, কেবল আমি জানতে চাই তুমি কী করতে পেরেছ বা করছ?

তা তো আমি জানি না মা।

তাহলে কে জানে?

তাও জানি না।

এখন তাহলে নিজেকে জিজ্ঞাসা কর।

কী জিজ্ঞাসা করব?

তুমি কে? কী? কেন? কী করছ? কেন করছ? কী করবে?

আমি পারব না।

কেন পারবে না?

জানি না।

এখন থেকে জানবে এবং প্রতিদিন তোমাকেই তোমার সঙ্গে কথা বলতে হবে। তার জন্য ভালো কিছু কর। যাতে তোমার প্রশ্নোত্তরে তুমি খুশি থাকতে পার।

কি বলছ এসব!

হ্যাঁ, শোন, মানুষের আত্মাটা অবুঝ। এটা জন্মগত আদিরূপ। মন যখন তখন, যে কোনো জিনিস চেয়ে বসতে পারে, অন্যায় কিছু হলেও। কোনো শাসন বারণ মানতে রাজি নয় সে, মূলতই সে যা চায়... তাই চাই তার। কিন্তু তুমি তা করবে না—

একবার

দুইবার

তিনবার

তাতে দেখবে তোমার আত্মা আত্মজিজ্ঞাসার দিকে যাবে। এবং তোমার চাওয়া ও প্রাপ্তির ন্যায়-অন্যায় বিবেচনা করবে এবং তুমি যে একজন মানুষ তা নিজেকে সবসময় জানাবে বোঝাবে এবং উপলব্ধির জায়গায় দাঁড়িয়ে নিজের প্রতি প্রশ্ন ছুড়ে দেবে।

তুমি তো কারও ক্ষতি করছ না?

তুমি তো শক্তির জোরে চাচ্ছ না?

তুমি কি বিষয়টির জন্য উপযুক্ত?

কিংবা তুমিই কি বিষয়টির একমাত্র প্রাপ্য?

সত্য ও জ্ঞানকে অস্বীকার করছ না তো?

আত্মোপলব্ধির এমন জায়গায় দাঁড়িয়ে চিন্তা করবে এবং যতটা সম্ভব ত্যাগ করার অভ্যাস করবে। দেখবে ত্যাগ তোমাকে আকাশের চেয়েও প্রসারিত করে এক মহাজাগতিক আলোয় উদ্ভাসিত করছে। সুদীর্ঘ সত্যের পথ কাঁটা আর বেদনাযুক্ত থাকলেও অন্তর্নিহিত পরিতৃপ্তি তোমাকে প্রতিটি স্বর্গভোরের মতো সতেজ ও প্রাণবন্ত করে তুলবে। তুমি জেনে অবাক হবে, প্রতিদিন শেষ রাতেই এ মহাপৃথিবী মানুষের সত্য দ্বারা ধৌত হয়, পবিত্র হয়, তা না হলে সাত আসমানের গ্রহ-নক্ষত্রগুলো পুড়ে ছারখার হয়ে যেত। তোমাকে লোভ ত্যাগ করতে হবে সেকান্দার।

আমাকে তো বাঁচতে হবে মা। 

নিশ্চয় তুমি বাঁচবে, আনন্দ ও পরিতৃপ্তির সঙ্গে।

তবে তো আমার অনেক কিছু চাই।

হ্যাঁ, অবশ্যই... তবে প্রয়োজনের অতিরিক্ত নয়।

একটু বেশি হলে ক্ষতি কী?

ক্ষতি নেই। তবে ৯৯ শতাংশ মানুষ অতিরিক্ত সম্পদের ভার বহন করতে পারে না। অতিরিক্ত সম্পদের ভিতর শক্তিশালী একচক্ষু এক ভয়ঙ্কর দানব থাকে। যে স্বভাবতই হয় একরোখা, জেদি আর উচ্ছৃঙ্খল। হাজারে, নয়শত নব্বই জনকেই এ শক্তিশালী দানব তার অধীনস্থ করে ফেলে। ফলে মনুষ্যবোধ বিদ্যার ধ্বংস হয়। আর যে বাকি থাকে হাজারে ১০ জন, তারা তাদের আত্মবিশ্বাস, বোধ-বিবেচনা ও প্রজ্ঞা দিয়ে সম্পদ নামক এ ভয়ঙ্কর দানবকে মানবতার শক্তিতে রূপান্তর করে। আমি সম্পদ নয়— তোমার আত্মার শান্তি চাই।

কিন্তু মা, আমিও তো ওই ১০ জনের একজন হতে পারি, নাকি?

না, হঠাৎ করে কেউ তা পারে না, তার জন্য শান্ত, ধীর ও নিমগ্ন সাধনায় প্রস্তুত হতে হয়।

দোষগুণ নিয়েই তো মানুষ।

মানুষের জন্য এ কথাটি যথার্থ নয় সেকান্দার। এটা মানুষ শ্রেষ্ঠত্বের সান্ত্বনা হতে পারে না। যদিও মানুষ সর্বদা নিজেকে এ ভুলভ্রান্তির সমীকরণের মধ্য দিয়ে মানবাত্মার পরিতৃপ্তি খোঁজে। সান্ত্বনা পায় আবার ভুল করে, বলে— ভুল করতে করতে মানুষ একদিন শিখে ফেলবে, এমনটা ভাবা ঠিক নয়। মনে রাখেবে, মানুষ শব্দটিই পজেটিভ।

তবে পূর্ণাঙ্গ মানুষের মন্ত্র কী মা?

মানব আত্মার উন্নয়ন, লোভ-হিংসা-মিথ্যা থেকে দূরে থাকা। মানুষের চারপাশে এ কীটগুলো জলজ্যান্ত রঙিন হয়ে কিলবিল করে, সুযোগ খুঁজে, মিশে থাকতে চায় জীবনে। যা মানব আত্মার সৌন্দর্যকে ধ্বংস করে। তাই মনকে সত্য ও পবিত্র চিন্তায় পরিমার্জন করে মনস্থির মনোবল অর্জন করতে হবে।

আমি কি তা পারব মা?

অবশ্যই, অবশ্যই, তুমি পারবে। ওই শূন্যের আকাশটা দেখ— খুঁটিহীন বিশ্বাসের ওপর কেমন দাঁড়িয়ে আছে।

তুমি পাশে থাকবে তো মা?

সেকান্দার, তুমিকেই তোমাতে জাগাতে হবে। কারও আসা- যাওয়ার প্রতীক্ষায় থেক না। একমাত্র তুমিই তোমার ওপর দাঁড়িয়ে আছ এবং থাকবে। এটাই সত্য যে, তোমার আত্মার সঙ্গে, তোমার সঙ্গে নিত্য যার দেখা হয়, কথা হয় সে— তুমিই। তোমার তুমিতে মহাজাগতিক যে রহস্য সেও— তুমি। তার ভেদ, গোপনীয় রহস্যময়তা, স্মৃতি প্রবহমান গাণিতিক সমষ্টিও— তুমি। অথচ মানুষ এক প্রশান্তি পরিচয়েই তৃপ্ত।

মা আমি তো অবুঝ!

না, এটা কোনো কথা নয়। একটা বয়সে মানব সন্তানের অবুঝতা পাপ। কারণ তার শ্রেষ্ঠ অর্জন জ্ঞান। যা দিয়ে জাগতিক-মহাজাগতিক জীবন সংসারের মূর্খতা ঘোচাবে। জ্ঞানার্জন মানবজাতির কর্তব্য। 

হায় হায়! আমি চিৎকার করতে গেলে মা থামিয়ে দিলেন।

থাম। নির্বোধরাই কেবল চিৎকার করে। বরং তুমি চিন্তা করবে, ভাববে এবং কাজ করবে।

আমার তো খারাপ চিন্তা আসে মা!

এই যে তুমি যে বুঝতে শিখেছ— তোমার চিন্তাটা খারাপ, এটাই তোমার মানুষ ফরম পূরণে প্রথম বৃত্ত ভরাট।

মানে?

এখন থেকে তুমি পবিত্র ও সৎ চিন্তার নিয়মিত চর্চা করবে।

আমি আমার অতীতকে ভুলে যেতে চাই।

না, অতীতকে ভুলবে না। অতীত থেকে শিক্ষা নেবে এবং অভিজ্ঞতাগুলো কাজে লাগাবে।

তবে এত সময় লাগছে কেন মা?

অস্থির হয়ো না সেকান্দার, দীর্ঘদিনের ক্ষত একদিনে শুকায় না। তার জন্য শান্ত থাক, ভালোবাসা বিবেক দিয়ে তোমার জগেক জাগিয়ে তোল।

আমাকে আর্শীবাদ করো মা ।

অবশ্যই, তুমি আমার সন্তান। তোমার মঙ্গল কামনা করি। ওই তো প্রায় ভোর হয়ে আসছে। তার মানে তুমি চলে যাবে?

হ্যাঁ, তুমিও একদিন চলে আসবে।

তোমার জন্য আমার ভীষণ কষ্ট হয় মা।

জানি, পারলে সেই কষ্ট দ্বারা নিজেকে আরও শুদ্ধ কর, পবিত্র কর।

আমি পরিপূর্ণ শুদ্ধ হতে চাই মা।

তবে হাত পাত।

আমি ডান হাত এগিয়ে ধরলে মা বললেন, না— তোমার বাম হাত দাও।

আমি বাম হাত এগিয়ে ধরলাম। এবং চোখ বন্ধ করার কিছুক্ষণ পরই পেটের মধ্যে কী যেন একটা চেপে বসল এবং ধীরে ধীরে বিদ্যুৎ তরঙ্গবেগে আমার শিরা-উপশিরা হয়ে হৃৎপিণ্ড ঠেসে ধরল। এবং প্রচণ্ড গন্ধে! বিষ-নিঃশ্বাসে সারা ঘরের বাতাস মুহূর্তেই নীল হয়ে উঠল। আমি চেঁচিয়ে উঠলাম। দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার।

মা এই প্রথম একটু ধমক দিলেন— চুপ কর। এ নিয়েই তুমি এতদিন ছিলে। এর মধ্যে সারা শরীর হয়ে মস্তিষ্কে একটি রশ্মি প্রবাহিত হলো। আমি ভীষণরকম কাঁপতে থাকলাম। তার কিছুক্ষণ পর হাতের মধ্যে অদ্ভুতরকম কী যেন একটা এসে কামড়ে ধরল। আমি হাত থেকে ঝেড়ে ফেলার আপ্রাণ চেষ্টা করলে মা বললেন, শান্ত হও। চোখ বন্ধ রাখ এবং প্রার্থনা কর, যতক্ষণ না শেষ হয়।

আমি চোখ বন্ধ রাখলাম। সে এক দীর্ঘসময় পর আমার হাতে রাখা ঘন-আঠালো বিষগন্ধ দ্রব্যটি হাত থেকে জলীয়বাষ্পের মতো উড়তে উড়তে হালকা হতে লাগল। এবং অনুভব করলাম আমার ডান হাতের মুঠোই— সুগন্ধি নরমে ভরে উঠছে।

আমি মার উপদেশ মতো চোখ খুললাম, কেননা তিনি বলেছিলেন, হাতের মুঠোই সুগন্ধিযুক্ত কোনো কিছুর অনুভব করলেই যেন কেবল চোখ খুলি।

আমি চোখ খুললাম, দেখলাম—সদ্য প্রস্ফুটিত গোলাপ পাপড়ি, সারা ঘরে সুগন্ধিতে ভরিয়ে তুলছে। ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিতে থাকলাম। আর মাকে ডাকতে লাগলাম, কিন্তু মার কোনো সাড়াশব্দ পাচ্ছিলাম না। তবু আরও কয়েকবার মা মা বলে চিৎকার করে ডাকলাম। এর কিছুক্ষণ পরই আমার ঘুম ভেঙে গেল, বুঝতে পারলাম আমি স্বপ্ন দেখেছি।

মার মৃত্যুর তের বছর পর এই প্রথম মাকে স্বপ্নে দেখা। যেন জীবন্ত। সেরকমই উজ্জ্বল শান্ত ধীর ও প্রাণবন্ত। আমার আত্মার ভিতর কেমন যেন একটা শান্তি বয়ে গেল, যেন মাকে আমি সত্যি সত্যি দেখেছি, স্পর্শ করেছি, কথা বলেছি। আরও দুই-তিন মিনিট বিছানায় নিশ্চুপ বসে থেকে চারদিকে কী যেন খুঁজলাম। না, কিছু নেই, রুমটা সেরকমই আছে। এলোমেলো। নিঃসঙ্গ। একা মানুষের একটা রুম যেরকম হয় আর কি! জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম, পৃথিবীটা তখনো জোছনার গনগন আলোতে ভেসে যাচ্ছে। এরমধ্যে পুব কর্ণারের জাম গাছে একটি পাখি ডেকে উঠল। বুঝতে পারলাম কিছুক্ষণের মধ্যেই ভোর হবে। আমি বেরিয়ে পড়লাম (অবশ্য মাঝেমধ্যেই আমি শেষরাতে একা হাঁটতে বেরোই)।

আজও বেরোলাম, হালকা ঠাণ্ডায় জনমানবহীন রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে মনে হলো আমি কেমন যেন ভারমুক্ত হালকা-শূন্যে হয়ে গেছি। মনে হচ্ছে শরীরের কোনো ওজন নেই। আমি ধূলিমাখা পথে আমার পায়ের ছাপের খোঁজ করতে লাগলাম... তখন নদীর ওপার থেকে ভেসে আসা (ঘুমুঘুমু কণ্ঠের) আজানের সুরে রাতটি যেন দশদিগন্ত হয়ে প্রশান্তির দিকে ছুটতে থাকল...

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর