শুক্রবার, ২০ জুলাই, ২০১৮ ০০:০০ টা

আত্মদর্শনের কবিতা

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

আত্মদর্শনের কবিতা

সাবির আহমেদ চৌধুরী

সাবির আহমেদ চৌধুরী একজন খ্যাতিমান প্রকৌশলী, কিন্তু দেশের প্রগতিশীল সামাজিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনে নিবিড়ভাবে জড়িত ছিলেন তিনি। মহান ভাষা আন্দোলনে তার ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ভাষা আন্দোলনের একজন কর্মী হিসেবে তিনি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। রাস্তায় মিছিল করেছেন। তার অন্য সহকর্মীদের নিয়ে ছাত্র হত্যার বিচার চেয়েছেন। পরবর্তী পর্যায়ে দেশের স্বাধিকার আন্দোলনে তিনি নিবেদিত ছিলেন। নিজের যাপিত জীবনে তিনি নিয়মিত কাব্যচর্চা করেছেন। একাধিক গবেষণামূলক প্রবন্ধ ও গবেষণাগ্রন্থ রচনা করেছেন। তার কাব্যচর্চার মূল ধারা মরমি। তিনি মরমিবাদের চর্চা করেছেন। তার সাম্যবাদী চিন্তার মাধ্যমে মানুষের ঐক্য, পরস্পর শান্তি চেয়েছেন। তার কবিতার মূল সুর মানবতা। তার অন্যান্য গবেষণাগ্রন্থেও একই চিন্তার প্রতিফলন ঘটেছে। মরমি কবি সাবির আহমেদ চৌধুরীর রচনা নিয়ে উচ্চতর গবেষণাও হয়েছে।

‘এই কথা সেই সুর’ কাব্যগ্রন্থের ভূমিকায় সাবির আহমেদ চৌধুরী লিখেছেন, তার স্বভাবসুলভ বিনয়ী ভঙ্গিতে, ‘এ গ্রন্থটি পাঠ করে কারো মনে যদি আত্মোপলব্ধিকে জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ লক্ষ্য বলে কিঞ্চিৎ প্রত্যয়-জন্মে, অনিত্য এই মানবজীবন এবং দুদিনের এই সংসার জেনে সকল প্রকার হিংসা-বিদ্বেষ ও লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে থেকে কেউ যদি মানব-মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে ধর্ম ও কর্মের সমন্বয়ে পরম করুণাময়ের সান্নিধ্য লাভে সচেষ্ট হয় তবেই আমার এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা সার্থক বলে মনে করব।’

আমাদের এই তামস-শাসিত সময়ে কোনো পাঠক এতটা গভীরভাবে কবিতা পড়েন কিনা অথবা পড়লেও কবিতার অন্তর্গত ভাব ও অনুভূতিগুলোকে হৃদয়ে ধারণ করতে সক্ষম হন কিনা সেটি বিতর্কের বিষয় কিন্তু সাবির আহমেদ চৌধুরীর এ প্রত্যাশার পেছনে তার নিজস্ব দর্শনের বিষয়গুলো নিহিত রয়েছে। পাঠকের কাছে তার যে প্রত্যাশা, তার চাইতে তার কবিতার কাছে তার নিজের প্রত্যাশাটাই এখানে বড় হয়ে ওঠে। আর অন্য একটি অর্থে, তার কবিতার বিষয়-আশয়, তার নানা জিজ্ঞাসা এবং অনুসন্ধানের একটি তালিকাও প্রকাশ হয়ে পড়ে একটি পঙিক্ততে। আত্মোপলব্ধি বস্তুতই এ কথা সেই সুর-এর একটি মৌলিক বিবেচনা, তবে এ উপলব্ধিতে পৌঁছানোর সক্রিয় মাধ্যমটি ব্যক্তি নিজে হলেও তাতে গভীরভাবে সম্পর্কিত ঈশ্বরচেতনা, তার রূপান্বেষণ, সৃষ্টির উদ্দেশ্য এবং এর নানা প্রকাশকে অন্বেষণ এবং দেহের রহস্যের সঙ্গে সঙ্গে আত্মার অবিনশ্বরতার বিভিন্ন অনুষঙ্গ উন্মোচন। যে জীবন ক্রমশ প্রধান অন্বিষ্ট হয়ে দাঁড়াচ্ছে মানবের, তা একান্তই  বস্তুকেন্দ্রিক, এক জীবনকালের ক্ষুদ্র পরিসরে বাঁধা। এ জীবন যে অনিত্য, এ জীবনের সঙ্গে যে এক মহাজীবনের রয়েছে অবিচ্ছেদ সম্পর্ক, তা বিস্মৃত হলে মানবের প্রাপ্য থাকে শুধু হতাশা, ক্ষোভ ও বঞ্চনার অনুভূতি; বিদ্বেষ, হিংসা, লোভ ও আত্মপ্রেম। সাবির আহমেদ চৌধুরী এ ভয়ানক চক্র থেকে মানুষকে উদ্ধারের উপায় হিসেবে ব্যবহার করেছেন তার কবিতাকে। কবিতার শক্তি ও সামর্থ্যের ওপর তার প্রচুর আস্থা।

‘এই কথা সেই সুর’ কাব্যগ্রন্থটি যেহেতু আমি মনোযোগ দিয়ে পড়েছি, এতে সংকলিত কবিতাগুলোর ওপর ভিত্তি করেই সাবির আহমেদ চৌধুরীকে আমি মূল্যায়ন করব। দি ‘সেলেস্টিয়াল লাইট’ নামে একটি ইংরেজি কাব্যগ্রন্থ আমি পড়েছি, তবে এ গ্রন্থের কবিতাগুলোতে এই কথা সেই সুর-এর ভাবনা ও অনুভূতিগুলোই ফুটে উঠেছে। তাছাড়া যে মরমি ধারার কবি সাবির আহমেদ চৌধুরী, তা একান্ত বঙ্গদেশীয়, এর ঐতিহ্য নিহিত আমাদের মাটিতে এবং মানুষের জীবনে। সে জন্য ইংরেজি ভাষায় তার প্রকাশে সেই স্ফূর্তি, সেই স্বাভাবিকত্ব এবং সেই নৈকট্য অনুভব করা যায় না, যা বাংলা ভাষার লেখা কবিতাগুলোতে পাওয়া যায়।

প্রথমেই সাবির আহমেদ চৌধুরীকে চিহ্নিত করা যায় একজন মরমি কবি হিসেবে, তার প্রধান সাধনা হচ্ছে আত্মদর্শনের মাধ্যমে ঈশ্বর দর্শন, অথবা ঈশ্বর দর্শনের মধ্য দিয়ে আত্মদর্শন। এ পথটি সহজ নয়, কারণ এটি হচ্ছে চূড়ান্ত ত্যাগের পথ, বৈরাগ্যের পথ। তবে সাবির আহমেদ চৌধুরী সংসারের প্রতি উদাসীন নন, বস্তুত সংসারের বাঁধন, নানা পার্থিব কর্তব্যের বাঁধন এগুলোর মধ্য দিয়েই তিনি তার অন্বেষণের পথে এগিয়ে যান। এ বিষয়টি সাবির আহমেদ চৌধুরীকে বিশিষ্টতা দিয়েছে। তিনি লিখেছেন, তিনি কখনো ক্ষ্যাপা বাউল; কখনো পথ তাকে অধিকার করে ফেলে; পথে পথে ঘুরে আমি/ পথ পেলাম না খুঁজে। অথবা তিনি ভাবেন, তার মনের মানুষের (শেষ বিচারে ঈশ্বর) খোঁজে তিনি পাগল হয়েছেন— এমনকি সৃষ্টিকর্তাকেও তিনি কথাটা জানাচ্ছেন—আমি ছাড়া সত্তা তোমার/ নেই যে পাগল কোথাও আর...

কিন্তু এতকিছুর পর পৃথিবীর চেনা পথেই তিনি পৌঁছে যাচ্ছেন তার আরাধনার কেন্দ্রে। তার সব অন্বেষণের শেষ বিন্দুতে অবস্থান করে সৃষ্টিকর্তার অপার করুণা। সেই করুণার তিনি প্রত্যাশী।

কিন্তু পথ যেহেতু কঠিন, তিনি গুরুর দ্বারস্থও হন। গুরুভক্তিকে তিনি দেখেন পথ খুঁজে পাওয়ার সঙ্গে সমার্থক হিসেবে। এ গুরুভক্তি এবং গুরুসঙ্গ তাকে পবিত্র করে, তবে গুরু তাকে পথের সন্ধান দেন, একটা দূরত্ব পর্যন্ত পৌঁছে দেন। বাকিটা তাকে নিজেকে খুঁজে নিতে হয়।

মরমি কবি হিসেবে ঈশ্বরকে তিনি একক একটি সত্তায় আসীন দেখতে চান। ঈশ্বরকে তিনি মুসলমান হিসেবে আল্লাহ বলেই ডাকেন কিন্তু দৃঢ় প্রত্যয়ে তিনি ঘোষণা করেন, ঈশ্বর তার সব পরিচয়েই তিনি বিরাজমান, তাকে নিয়ে বিভাজনের কোনো উপায় নেই। সর্বজনের আশ্রয় মেলে তার পদতলে— এ সর্বমানবিক বোধটি সক্রিয় সাবির আহমেদ চৌধুরীর ঈশ্বর চিন্তার পেছনে।

তিনি বিশ্বাস করেন, ঈশ্বরের দৃষ্টিতে রয়েছে তার ছায়া এবং এ দৃষ্টি মানবের জন্য। ঈশ্বরকে পাওয়ার পথ অনেক, যেমন—

কেউ ঘাটে যায় কলসি হাতে

কেউ বা মোশক ভাণ্ড সাথে

যে যার মতন পথ চলে সে

পায় যে নদীর কূল-কিনার।

কিন্তু একটি উত্কৃষ্ট পথ হচ্ছে নিজেকে জানা এবং রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘সেই জানারই সঙ্গে সঙ্গে তোমায় চেনা।’ সাবির আহমেদ চৌধুরী বারে বারে এ আত্মদর্শনের গুরুত্ব তুলে ধরেন। ঈশ্বর হচ্ছেন চূড়ান্ত আরাধ্য রূপ, কিন্তু সেই রূপের কিছুটা ছায়া পড়ে মানুষের অন্তরে। যদি কেউ ‘অন্তর দিয়ে অন্তর দেখে’ তাহলে সেই রূপ প্রতিভাত হবে তার কাছে।

সাবির আহমেদ চৌধুরীর কবিতায় দেহতত্ত্বের একটি বড় ভূমিকা আছে। দেহের রহস্যকে তিনি এক পুলক-মিশ্রিত বিস্ময় দিয়ে ব্যাখ্যা করতে চান। কখনো এক অবাক মোটরগাড়ির নির্মাণ কৌশল, কখনো আজব কোনো কারখানার তুলনা-উেপ্রক্ষায় দেহতত্তের গূঢ় বিষয়গুলো ধরা পড়ে। তবে এ বিস্ময় বোধের বিপরীতে সাবির আহমেদ চৌধুরী বিন্যস্ত করেন নানা জাগতিক বিষয়। এ জগতের বেচাকেনার বিষয়টি, যা একান্তই সময়কেন্দ্রিক এবং ক্ষণস্থায়ী, তাকে বিচলিত করে। তিনি এ বেচাকেনার জগৎ থেকে ছুটি চান—মহাজনের পুঁজি লইয়া/ আইলাম আমি ভবের বাজারে/ বেচাকেনা করার পরে/ হিসাব দেখি শুধুই দেনারে।

দেনা জাগতিক। তার বিপরীতে পূর্ণতা ঐশ্বরিক। সেই পূর্ণতা তিনি পান রূপের সন্ধানে নেমে। কখনো রূপ-অরূপের খেলা, কখনো রূপের মাঝে অরূপ-ধরা পড়ে তার চোখে এবং তিনি আনন্দের সঙ্গে একটা গোপন অতৃপ্তিতেও তাড়িন হন।

নয়ন ভরা রূপ দেখে তাঁর

নয়ন ভরে না

দৃষ্টি দিয়ে দৃষ্টি হারাই

দৃষ্টি ফিরে না।

শেষ পর্যন্ত ঈশ্বর প্রেমে তিনি সন্ধান পান মুক্তির, যা মিলায় জগতের সব হিসাব। আর এ মুক্তি যে দেহেরও মুক্তি, তা ভেবে তিনি এ জীবনের কথা স্মরণ করেন, কারণ এর পরের যাত্রা তো অনিশ্চিত।            

তবে তিনি তো জানেন, তার মরমি সত্তার নিশ্চয়তা দিয়ে, যে ‘একদিন এ দেহ মাটির সঙ্গে মিশে যাবে’, আর খাঁচার পাখিও খাঁচা ছেড়ে যাবে ‘নিয়ে ঋণ সীমাহীন।’

এ চূড়ান্ত মুক্তির লক্ষ্যে নিবেদিত কবিতাগুচ্ছে সাবির আহমেদ চৌধুরী যে জীবনদর্শনের কথা বলেন, তা খুবই সমৃদ্ধ একটি চিন্তার ফসল সন্দেহ নেই।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর