শুক্রবার, ৩১ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা

উপস্থাপকের মুখ

ফরিদুর রেজা সাগর

উপস্থাপকের মুখ

অলঙ্ককরণ : শাকীর

ঈদে আমাদের চ্যানেল আই-তে সাবিনা ইয়াসমীনের একটি অন্য ধরনের গানের অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করা হলো।

প্রথমবারের মতো শিল্পী সাবিনা ইয়াসমীনের কণ্ঠে লালনগীতি পরিবেশনা। তার অসাধারণ গলায় গাওয়া লালনগীতি শ্রোতা-দর্শকদের জন্য প্রচার করা হবে। অনুষ্ঠানের শুরুতে কারও উপস্থাপনা দরকার।

অনুষ্ঠানের প্রযোজক শহিদুল আলম সাচ্চু।

সাচ্চু বলল, ‘যেহেতু সাবিনা আপার প্রথম লালনগীতি পরিবেশনা আমরা প্রচার করছি, সেহেতু অনুষ্ঠানের উপস্থাপনায় আনা উচিত দামি কোনো ব্যক্তিত্বকে। সেইরকম ভারী কাউকে দিয়ে উপস্থাপনাটা দরকার।’

আর দশটি অনুষ্ঠানের বাইরে এমন এক অনুষ্ঠান সাধারণ মানে প্রযোজনা হওয়াও উচিত হবে না।

যুক্তি অকাট্য।

মিটিংয়ে সাচ্চুর এই অভিমতকে সাপোর্ট করল উপস্থিত সদস্যরা।

প্রস্তাবে বেশ কয়েকজনের নাম এসে গেল। ইমদাদুল হক মিলন। আফজাল হোসেনসহ আরও অনেকের নাম এদিক-ওদিক থেকে উচ্চারিত হলো। এরা প্রত্যেকেই কিন্তু দর্শকপ্রিয় নাম।

কিন্তু শহিদুল আলম সাচ্চুর চাই অন্যরকম একটা নাম। যে নামের মানুষটি ভিন্ন ধারায় অনুষ্ঠানটির রং দেবে।

যুতসই একটা মানুষ চাই প্রযোজকের।

সাচ্চু বলল, ‘আমার মনে হয় একজন বড়মাপের শিল্পীকে এখানে হাজির করতে পারলে ভালো।’

সাচ্চুর মন ভরছে না। তাই আমীরুল ইসলাম বলল, ‘ঠিক আছে তবে তুমি রুনা লায়লাকে ভাবতে পার। রুনা লায়লাকে তবে নিয়ে আসো।’

রুনা লায়লা অনুষ্ঠানের ইন্ট্রোডাকশন দিলে দারুণ হবে।

মাথা নাড়ল সাচ্চু, ‘না। রুনা লায়লাকে তো আনা সম্ভব না। আমরা বরং আরও এক দুজনের নাম এক্ষেত্রে ভাবতে পারি। সেই মানের কোনো শিল্পী?

রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার কথা ভাবা যায়। একবাক্যে সবার সম্মতি পাওয়া গেল।

বন্যা তখন কলকাতায়। তাকে ফোনে ধরা হলো। বলা হলো, ‘অমুক তারিখে সাবিনা ইয়াসমিনের একটা গানের অনুষ্ঠানে আপনাকে ইন্ট্রোডাকশন দিতে হবে। ঠিক আছে?’

বন্যা সানন্দে রাজি হলেন।

সাচ্চু জানে, আমীরুলও জানে, বন্যা খুব সুন্দর ভাষায় চমৎকার ভঙ্গিতে উপস্থাপনটাও করেন। যতটা ভালো গান করেন, উপস্থাপনটাও সেই মাত্রায় ভালো।

ফেরদৌসী রহমান একসময় যেমন ‘এসো গান শিখি’র পরিচালনা আর উপস্থাপনা দিয়ে দর্শক মুগ্ধ করতেন, বন্যার উপস্থিতি হয়ে থাকে তেমনই। বাংলাদেশ টেলিভিশনে বন্যার প্রাঞ্জল উপস্থাপনাও দর্শকমহলে ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে।

অনেক সময় দেখা যায়, বন্যা গাইতে গাইতে বাংলা আর ইংরেজিতে বর্ণনা দেন। রবীন্দ্রনাথ কোন প্রেক্ষাপটে, কোন ভাবধারায় তার গানগুলো রচনা করেছেন বন্যা সহজ-সরল ভঙ্গিমায় সেসব তথ্য শ্রোতা-দর্শককে উপহার দেন।

এই রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে আজ থেকে অনেক বছর আগে বাংলাদেশ টেলিভিশনে যখন উপস্থাপনা করতেই প্রথম ডাকা হলো, তিনি হাজির হলেন। পঁচিশে বৈশাখ উপলক্ষে ছোটদের একটা অনুষ্ঠান ছিল। অনুষ্ঠানটির পরিকল্পক-প্রযোজক তার সঙ্গে কথা বললেন।

বন্যা সবে তখন শান্তিনিকেতন থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়ে স্বদেশ ফিরেছেন। আমিনুল ইসলাম নিঝুর সঙ্গে দ্বৈতসংগীত ‘তোমার হলো শুরু, আমার হলো সারা’ গানটি পরিবেশন করে সারাদেশে সাড়া ফেলে দিয়েছেন। এবং সবাই বুঝে ফেলেছেন, এদেশটিতে বড়মাপের একজন কণ্ঠশিল্পী যুক্ত হয়েছে।

প্রযোজক-পরিকল্পক বিটিভি থেকে ফোন করে বন্যাকে আহ্বান জানালেন। বরাবরই বিনয়ী-ভদ্র বন্যা। মনোযোগ দিয়ে প্রস্তাবনাটা শুনলেন তিনি।

তারপর বললেন, ‘আপনারা হয়তো নতুন মুখ ভেবে আমাকে উপস্থাপনার জন্য ডেকেছেন। আমি কিন্তু গান করি মূলত। উপস্থাপিকা নই। বোধহয়— একটু ভুল হচ্ছে।’

পরিকল্পক-প্রযোজক উত্তরে জানালেন, ‘না। তা তো না।’ আমরা তো জেনে-বুঝেই আপনাকে আহ্বান জানিয়েছি। অনুষ্ঠানটি এভাবে করবেন, আশা করছি আমরা।’

বন্যা বললেন, ‘কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে আরেক জায়গায়। আমি তো একদমই উপস্থাপনা করতে পারি না।’

একথা শুনে প্রযোজক বললেন, ‘ঠিক আছে। তাহলে একটা দিন আপনি ভাবেন। তারপর আসেন। আপনি সম্মতি দিলে আমরা অনুষ্ঠানটির পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে পারি। কারণ, আমরা বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করেছি। পরিকল্পনা করেছি। পাণ্ডুলিপি তৈরি হয়েছে। ওভাবেই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রস্তাবনা রাখা হয়েছে। আপনি একটা দিন ভেবে আমাদের জানান। এখনই নাকচ করে দিয়েন না।’

সেই বন্যা যখন গান পরিবেশনা ও উপস্থাপনা সমান উচ্চতা রেখে করেন, ভাবতে বসে অনেকেরই অবাক লাগে। আর রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা সংস্কৃতি অঙ্গনের নানামুখী কার্যক্রমের জন্য দেশ-বিদেশের অনেক পুরস্কারের মধ্যে দেশের সর্বোচ্চ স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছেন।

উপস্থাপনা প্রসঙ্গ ওঠায় আবদুন নূর তুষারের কথায় আসি।

তুষার প্রথম এসেছিলেন একটা ধাঁধার অনুষ্ঠানে অংশ নিতে। মেডিকেলে পড়েন। বিজ্ঞানের ছাত্র। বিজ্ঞানবিষয়ক অনুষ্ঠান।

ধাঁধার সেই অনুষ্ঠানে প্রথম পর্ব রেকর্ডিংয়ে গিয়ে যে উপস্থাপক ছিলেন তার সঙ্গে শুরুতেই মতানৈক্য হলো।

মতানৈক্য হওয়াতে আমরা খানিক চিন্তিত হলাম। কৃষিবিষয়ক অনুষ্ঠানের সফল উপস্থাপক শাইখ সিরাজ তখন বিষয়টির সমাধানে এগিয়ে এলো। যে প্রতিষ্ঠান থেকে ধাঁধার অনুষ্ঠানটি প্রযোজিত হচ্ছে সেই প্রতিষ্ঠান প্রধান মোসাদ্দেক সাহেবও এগিয়ে এলেন।

তুষার অনুষ্ঠানের তখনো অংশগ্রহণকারী। উপস্থাপক নয়।

উপস্থাপনা ছাড়াই রেকর্ড করা অনুষ্ঠানটি দেখা হলো। বারবার দেখে সিদ্ধান্ত হলো, পরিকল্পনামাফিক যেসব অংশে উপস্থাপনার ব্যাপার ছিল, পরবর্তী পর্বে এ পার্টগুলো তুষারের কাছে ছেড়ে দেওয়া হবে। সে নিজেই উপস্থাপন করবে। পরবর্তী পর্ব থেকে তুষারই হবে উপস্থাপক।

তুষার তখনো খুব আত্মবিশ্বাসী নয়। সময়ও তার স্বল্প। জানালো তুষার, ‘আমি ডাক্তারি পড়ি। অনেক বেশি পড়ার চাপ। আমার পক্ষে এতটা ইনভলমেন্ট থাকা কি সম্ভব? জানেনই তো ডাক্তারিতে প্রচুর পড়াশোনা করতে হয়।’

তখন আমি জোর দিয়ে বললাম, ‘অনুষ্ঠানটি দাঁড়াক জনপ্রিয় হোক। ততদিন তোমার উপস্থাপনা আর পড়াশোনা দুটোই কষ্ট করে করতে হবে।’

তারপর এভাবেই দেশ পেয়ে গেল একজন সপ্রতিভ আর প্রাণবন্ত উপস্থাপককে। আবদুন নূর তুষার এখন একজন ডাক্তার তো বটেই কিন্তু তিনি টেলিভিশনের প্রধান কর্ণধার হিসেবে অনেক নতুন উপস্থাপককে উপহার দিয়ে যাচ্ছেন।

আসি তারানা হালিমের কথায়।

তারানা হালিম প্রথম এসেছিল নাটকের এক আলো ছড়ানো অভিনেত্রী হিসেবে। তার আগে নতুন কুঁড়ির পুরস্কার পাওয়া শিল্পী হিসেবে তার পরিচিতি।

নাটকের শিল্পী মানে বড়দের পরিপক্ব কোনো অভিনেত্রী নয়। নাটকের শিল্পী মানে উদয়ন বিদ্যালয়ের ক্লাস টু-তে পড়া এক শিশু পারফরমার। ওকে টিভিতে নিয়ে যান বেগম মমতাজ হোসেন। উদয়নের প্রধান শিক্ষিকা। পরবর্তীতে ‘সকাল সন্ধ্যা’ ধারাবাহিকের বিখ্যাত নাট্যকার। ‘পিঁপড়া ও একটি পাতা’ নামে একটি নাটকে মেয়েটি অভিনয় করতে এসে ওর স্পষ্ট উচ্চারণে বলা সংলাপ আর জড়তাহীন সাহসী অভিনয় করে চমকে দিল সবাইকে। আমি ওই নাটকের নাট্যরূপকার। চমকে গিয়েছিলাম সেদিন আমিও একজন খুদে শিল্পীর কাজ দেখে।

আমাদেরকে এ শিশু অভিনেত্রী এতটাই বিমোহিত করল, তার পরপরই নতুন কুঁড়ি আর অন্য কয়েকটি ছোটদের অনুষ্ঠানের উপস্থাপনায় ওকে আমরা যুক্ত করে ফেলি।

তারপর?

নিয়মিত হয়ে যাওয়া সেই উপস্থাপিকা এখনো সাফল্যের সঙ্গে তার ইমেজ অটুট রেখেছে। নিয়মিতভাবে এ কর্মসাধনটি করে যাচ্ছে সে।

এ সফল উপস্থাপিকা এখন একজন সফল মন্ত্রীও।

মন্ত্রীর গুরু দায়িত্ব পাওয়ার পরেও এখনো তিনি প্রচণ্ড ব্যস্ততার ফাঁকে অনুষ্ঠান উপস্থাপনা থেকে নিজেকে বিযুক্ত করেননি।

শাইখ সিরাজ।

তিনি যখন বিটিভিতে যাওয়া-আসা করতেন, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন সবসময়ে।

মাঝে মধ্যে কিছু কিছু অনুষ্ঠান উপস্থাপনায়ও সংযুক্ত হতেন।

তখন বিটিভিতে নানা ধরনের অনুষ্ঠান প্রযোজিত হতো। সংকট ছিল ভালো উপস্থাপকের। খেলাধুলা। শিল্পসাহিত্য। সংগীত। শিশুতোষ। হরেকরকম। ওই অনুষ্ঠানগুলোতে সপ্রতিভ উপস্থাপকের সংকট হলে শাইখ সিরাজের ডাক পড়ত। হুট করে বলা হতো ‘তুমি অমুক অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করে দাও।’

কখনো কখনো পাইলট প্রোগ্রামে ডাকা হতো তাকে।

শাইখ সিরাজ প্রত্যাখ্যান করেনি।

অবশেষে একটি অনুষ্ঠানে নিয়মিত হয়ে গেলেন সিরাজ। ‘শিউলি মালা’ নামের ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান। যে অনুষ্ঠানে গান পরিবেশন করেছেন কুমার বিশ্বজিৎ, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা প্রমুখ। আরও বেশ কয়েকজন শিল্পী। যারা এ অনুষ্ঠান থেকেই ক্যারিয়ার গড়ে তুলেছেন। দর্শক-শ্রোতা মহলে আবির্ভাব ঘটেছে তাদের। প্রযোজক ছিলেন আল মনসুর। তিনি নতুন প্রতিভা অন্বেষণ করতে ভালোবাসতেন। সেই বিবেচনায় উপস্থাপক শাইখ সিরাজকে বেছে নিয়েছিলেন।

সেই শাইখ সিরাজ পরবর্তী পর্যায়ে ধীরে ধীরে নিজেকে শুধু কৃষিভিত্তিক অনুষ্ঠানে মনোনিবেশ করে ফেললেন।

‘মাটি ও মানুষ’। আর কৃষি অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতে গিয়ে সিরাজ বুঝে গেলেন এটাতেই মানুষের প্রবল আকর্ষণ। কৃষিই মানুষের মূল শক্তি। কৃষি আর কৃষকের স্বপ্নজালের অধ্যায়ে যুক্ত হয়ে শাইখ সিরাজ হলেন জাতীয় উপস্থাপক। আর বহু বিদেশি সম্মানজনক পুরস্কার পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশেরও সর্বোচ্চ পুরস্কার পেয়েছেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর