শুক্রবার, ৩১ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা

একটি বোকা রাজাকার

ইমদাদুল হক মিলন

একটি বোকা রাজাকার

রাজাকার বাহিনী তৈরি হয়েছিল একাত্তর সালে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়। রাজাকাররা ছিল পাকিস্তানিদের দোসর। পাকিস্তানি মিলিটারিদের সাহায্য সহযোগিতা করত। তাদের হয়ে আমাদের এই দেশের সাধারণ মানুষের ওপর, নিরীহ মানুষের ওপর নানারকম অত্যাচার করত। পাকিস্তানি সৈনিকদের মতো রাজাকাররাও আমাদের দেশের বহুমানুষ গুলি করে মেরেছে। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরেছে। পাকিস্তানিদের হাতে মুক্তিযোদ্ধাদের ধরিয়ে দিয়েছে। মানুষের বাড়িঘরে আগুন দিয়েছে, মানুষ পুড়িয়ে মেরেছে, লুটপাট করেছে। শিশুরাও তাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি।

পাকিস্তানি মিলিটারিদের আমরা বলতাম ‘নরপশু’। রাজাকাররাও আসলে নরপশুই।

একাত্তর সালে ভারত আমাদের খুবই সাহায্য সহযোগিতা করেছে। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ট্রেনিং নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হয়েছেন। গেরিলা কায়দায় এবং সামনাসামনি যুদ্ধে পাকিস্তানিদের হত্যা করেছেন। সুযোগ পেলে রাজাকারদেরও হত্যা করতেন। এদেশের এক কোটি মানুষ উদ্ধাস্তু হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে একত্রিত হয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী একটি যৌথবাহিনী গঠন করে। একাত্তর সালের ষোলই ডিসেম্বর ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পাকিস্তানিরা যৌথবাহিনীর কাছে সারেন্ডার করে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যায়।

বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যাচ্ছে টের পেয়েই রাজাকাররা এদিক-ওদিক পালাতে শুরু করেছিল। মুক্তিযোদ্ধারা খুঁজে খুঁজে তাদের বের করত। গুলি করে মারত। অর্থাৎ রাজাকাররা আমাদের মানুষগুলোকে যেমন করে মেরেছে সেই হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নিতেন মুক্তিযোদ্ধারা। দেশের আনাচে-কানাচে লুকিয়ে থাকা রাজাকারদের ধরে ধরে নিয়ে আসতেন।

এরকম তিনজন রাজাকার ধরা পড়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের নিয়ে এসেছে ছোট্ট একটা নদীর ধারে। লাইন ধরে দাঁড় করিয়েছে। একজন একজন করে গুলি করে মারবে।

এই নদীর তীরে দাঁড় করিয়ে এক সময় রাজাকাররা আমাদের বহু মানুষ গুলি করে মেরেছে। তাদের লাশ পড়ে গেছে নদীতে। আজ সেই হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নেওয়া হচ্ছে।

মুক্তিযোদ্ধাদের যিনি কমান্ডার তাঁর নাম নাসির। নাসির খুবই রসিক ধরনের মানুষ। হাসি আনন্দ ঠাট্টা মজা করতে পছন্দ করেন। রাজাকার তিনটিকে নিয়েও তিনি মজা করতে লাগলেন। তাদের দিকে রাইফেল তাক করে বললেন, আমি গুলি করার পরও, গায়ে যদি গুলি না লাগে, বা আহত হয়ে কেউ যদি নদীতে পড়ে যায়, নদীতে পড়ে যদি সাঁতরে উপরে গিয়ে উঠতে পারে তাহলে তাকে মাফ করে দেওয়া হবে।

অন্য মুক্তিযোদ্ধারা হাসাহাসি করছেন। রাজাকার তিনটির মুখ শুকনা। গুলি খাওয়ার ভয়ে তারা যেন মরেই আছে। দাঁড়িয়ে আছে  ঠিকই কিন্তু ধড়ে যেন প্রাণ নেই।

নাসির কমান্ডার প্রথম রাজাকারটিকে গুলি করলেন। ইচ্ছা করেই গুলিটা তিনি এমনভাবে করলেন যেন রাজাকারটির গায়ে না লাগে। গুলি যেন ফসকে যায়।

তাই হলো কিন্তু রাজাকারটি ভাবল সে মারা গেছে। কলাগাছের মতো ঝুপুস করে পড়ল নদীতে। নদীতে পড়ার পর বুঝল, আরে সে তো মরেনি। বেঁচে আছে! তার গায়ে তো গুলিই লাগেনি!

রাজাকারটি প্রাণপণে সাঁতরে নদী পার হয়ে গেল। বেঁচে গেল।

মুক্তিযোদ্ধারা প্রাণখুলে হাসছেন।

এবার দ্বিতীয় রাজাকারটিকে গুলি করার পালা। নাসির কমান্ডার রাইফেল তাক করলেন। ইচ্ছা করেই রাজাকারটির ডানপা বরাবর গুলি করলেন। এমনভাবে গুলিটা করলেন, যেন পায়ের চামড়া কিছুটা ছিন্নভিন্ন করে গুলিটা বেরিয়ে যায়। পায়ের যেন তেমন ক্ষতি না হয়। মারা যাওয়া তো দূরের কথা।

হলোও তাই। গুলি খেয়ে, ‘বাবা রে মরছি রে’ বলে এই রাজাকারটিও পড়ে গেল নদীতে। ওই সামান্য ক্ষত হওয়া পা নিয়েই প্রাণপণে সাঁতরাতে লাগল। নদীর ওপারে গিয়ে দৌড়ে পালাল।

এবার তৃতীয় রাজাকারের পালা। লোকটার চেহারা খুবই নিরীহ, বোকাসোকা টাইপের। সে বারবার ঢোক গিলছিল। তার দুই রাজাকার বন্ধু বেঁচে গেছে দেখে তার ধড়ে প্রাণটা যেন ফিরেছে। আশায় আছে, হয়তো সেও বেঁচে যাবে।

মুক্তিযোদ্ধাদের হাসিমজা চলছে।

নাসির কমান্ডার রাইফেল তুললেন। তাক করলেন তৃতীয় রাজাকারটির দিকে। এক্ষুণি গুলি করবেন...

রাজাকারটি মাফ চাওয়ার ভঙ্গিতে হাত জোড় করল বুকের কাছে। অতি বিনয়ের গলায় বলল, কমান্ডার হুজুর, আমারে গুলিটা একটু আস্তে কইরেন।

আমি সাঁতার জানি না।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর