শুক্রবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা
গল্প

মজনু

শাহ্নাজ মুন্নী

মজনু

আষাঢ়ের মলিন বিকাল। আকাশজুড়ে জলবতী মেঘদের আয়েশী আনাগোনা। বৃষ্টি এই আসে, এই আসে ভাব। আলাউদ্দিন ডাক্তার বিশ্বরোডের পাশে, প্রতিদিনের মতোই, তার ‘আরোগ্য নিকেতন’ নামের হোমিওপ্যাথি ওষুধের দোকানে ঝাঁপ খুলে বসে আছেন রোগীর অপেক্ষায়, এই সময় সাধারণত সর্দি-জ্বরের রোগী আসে। মাঝে মধ্যে অবশ্য চুলকানি, ডায়রিয়া, আমাশয়ের রোগীও পাওয়া যায়। তিনি ওষুধের দাম-দর নিয়ে তেমন কথাবার্তা বলেন না। দশ, বিশ, তিরিশ টাকা যে যেমন দিতে পারে তেমন টাকা রেখে ওষুধের পুরিয়া দিয়ে দেন। গ্রামের লোক ঠাট্টা করে তাকে ‘গরিবের ডাক্তার’ বলে ডাকে। তাতে মন খারাপ করে না আলাউদ্দিন। কায়ক্লেশে দিন তো চলেই যায়। তবে কোনো কোনো রোগী আছে এমনই হতদরিদ্র যে এই সামান্য টাকাটা দেওয়ারও ক্ষমতা রাখে না, যেমন ঋষিপাড়ার লোকগুলো, হাতে একটা লাউ, নয়তো দুইটা মুরগির ডিম নিয়ে এসে চিকিৎসার জন্য বসে থাকবে। ওষুধের পুরিয়া বানাতে বানাতে তাদের একটু বকাঝকা করে আলাউদ্দিন—

‘আমি কি এখানে দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্র খুলে বসেছি? আরে আমার ভিজিট না হয় নাই দিলি, নিদেনপক্ষে ওষুধের দামটা তো দিবি...’

তো ঋষিপাড়ার লোকগুলো তাদের কালো মুখের মধ্যে জোর করে সাদা দাঁতগুলো মেলে ধরে, হে হে, হে হে করে হাসার চেষ্টা করে, আর বলে—

‘ডাক্তার বাবু তু আমাদের নারায়ণ আছিস, দেবতা আছিস, তু না দেখলে আমাদের কে দেখবে বল? টিকা পয়সা কুতথেকে দেবো...’

আলাউদ্দিনের তখন আর কিছু বলার থাকে না, গজগজ করতে করতে বিনা পয়সাতেই ওষুধ দিয়ে দেয়। আজকে ওই ঋষি-চামারদেরও দেখা নেই। দেশে কী রোগব্যাধি কমে গেল নাকি? আলাউদ্দিন হাই তোলে, তারপর হাত বাড়িয়ে টেবিলের উপর থেকে বহুজীর্ণ হোমিওপ্যাথি মেটেরিয়া মেডিকা বইটা তুলে নিয়ে পাতা উল্টায়। কিন্তু বইয়ের পাতায় মন বসে না তার। মনে হয়, এই জীবন-সংসারের লোহার খাঁচায় বন্দী হয়ে হাসন রাজার মতোই তার প্রাণ ছটফট করছে, কোথাও যেন মুক্তি মিলছে না। সব কিছু অসার, সব কিছু অনিত্য, সব কিছু অর্থহীন। এই ডাক্তারি, এই আরোগ্য নিকেতন, এই যে রোগীর অপেক্ষায় বসে থাকা, কি মানে এই সবের? আলাউদ্দিন ডাক্তার নিজের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা বোধ করে আর তখনই টিনের চালে ঝুম করে বৃষ্টি নামে। আষাঢ় মাস তো বৃষ্টিরই মাস। বৃষ্টি তার যাবতীয় লীলা-খেলা আর রঙ্গরসিকতা দেখাতে শুরু করে এই মাসে, আলাউদ্দিন মেটেরিয়া মেডিকার পাতা থেকে চোখ সরিয়ে অস্থির মন নিয়ে ভেজা রাস্তার দিকে তাকায় আর তখনই কয়েকজন লোক আকস্মিক বৃষ্টির ঝাপটা থেকে বাঁচতে দৌড়ে এসে তার দোকানে ঢোকে। লোকগুলোর পরনে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি, মুখে সুন্নতি দাড়ি, মাথায় টুপি, পায়ে কালো স্যান্ডেল, বৃষ্টি তাদের প্রায় অনেকখানিই ভিজিয়ে ফেলেছে।

‘ভাই একটু বইলাম, আপনের দোকানো..’

আলাউদ্দিনের টেবিলের সামনে রোগীদের জন্য পেতে রাখা বেঞ্চের উপর বসে পড়ে লোকগুলো। আলাউদ্দিন এবার ভালো করে ওদের চেহারা দেখতে পায়। ওরা মোট চারজন, বয়স কারো বাইশ, কারো আবার ত্রিশ/পঁয়ত্রিশ হবে। তারা বৃষ্টির দিকে পেছন ফিরে বসে  নিজেদের মধ্যে উত্তেজিত ভঙ্গিতে আলাপ করে, আলাউদ্দিন ওদের কথাবার্তা শুনে বুঝতে পারে, কিছুদিন আগে কাশিমপুরী পীর আর চন্দ্রবাড়ির পীরের সাগরেদদের মধ্যে যে বিরাট মারপিট হয়ে গেল তাই নিয়ে ওদের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে, ওরা নিশ্চয়ই কোনো এক পীরের সাগরেদ হবে, আলাউদ্দিন আন্দাজ করে। 

‘টেঁটাডা এক্কেরে খোকা মিয়ার গলাতে গিয়া বিনছিল, ইশ্ হাসপাতালে নিয়াও কাম হইল না, বড় কষ্ট পাইয়া মরছে বেচারা...’ 

‘আর, ফারুকের পেটে যে বল্লমটা ঢুকছে, একদিক দিয়া ঢুইক্যা আরেকদিক দিয়া বাইর হইছে। হে তো জাগাত-ই শেষ।’

একজন হুংকার দিয়ে উঠে—

‘আরেকবার যদি সুযোগ পাই একটারেও ছাড়তাম না, কত্ত বড় সাহস, আমরার পীরের মাছালার উপরে দিয়া কথা কয়...’

‘বেশি কথা কইলে জিহ্বা টাইন্যা ছিঁড়া ফালামু না...’ আরেকজন তাকে তাল দিয়ে বলে। 

তাদের এ ধরনের  হিংস্র কথাবার্তা হয়তো আরও অনেকক্ষণ চলতো কিন্তু ঠিক এই সময় আলাউদ্দিন ডাক্তারের দোকানে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে আরেকজন লোক এসে ঢোকে। এর চেহারা ছুরুত, বেশ-ভূষা অন্যরকম। মাথায় লম্বা চুল, মুখে দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল, পরনে চটের ছালা, শীর্ণ দীর্ঘ শরীর। সে দোকানের ভিতরে ঢুকেই জ্বলন্ত চোখে বেঞ্চি দখল করে বসে থাকা লোকগুলোকে চিৎকার করে গালাগালি করতে থাকে— 

‘ওরে, বজ্জাতের দল, মূর্খের জাত, বেয়াকুফ, নালায়েক, নাফরমান, বেইমান, কুচক্রীর গোষ্টি, বেআক্কেলের দল কবে তোদের বুদ্ধি হবে? কবে তোদের অন্ধ চোখ খুলবে? কবে তোরা আসল নকল চিনবি?...’

আলাউদ্দিন ভাবলো, খাইছে আমারে, এমন গালাগাল, এখনই না আবার আরেকটা টেঁটাযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়! নিজের ওষুধের আলমারি আর নড়বড়ে চেয়ার টেবিলের নিরাপত্তার কথা ভেবে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে সে। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার! উত্তেজিত লোকগুলো গালি খেয়েও কোনো উত্তর তো দিলই না বরং চুপ মেরে মাথা নিচু করে বসে রইল। যেন জোঁকের মুখে নুনের ছিঁটা পড়েছে। কোনো গালাগালের পাল্টা উত্তর নেই। 

চটের ছালা পরিধানকারী আরও কিছুক্ষণ উচ্চস্বরে বিশ্রী সব গালাগাল করে যেমন হঠাৎ এসেছিল, তেমনি হঠাৎ বৃষ্টির মধ্যেই হন্ হন্ করে বেরিয়ে গেল।

আলাউদ্দিন এই দৃশ্য দেখে খানিকটা অবাক।

‘ভাইজান, আপনেরা কিছু কইলাইন না, পাগলে আপনেরারে এমুন গালি-গালাজ করলো!’

লোকগুলো এবার একে অন্যের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। তারপর বলে—

‘সবার মুখের উপরে জবাব দেওয়া যায় না। কিছু আদব-কায়দা মানতে হয়। আসলে উনি একজন বিখ্যাত আলেম ছিলেন তো, তার মুখের উপরে কথা বলা আমাদের শোভা পায় না।’

‘আলেম?’ এবার আলাউদ্দিন অবাক হয়। আলেমের এমন জীর্ণ পাগল দশা!   

‘জি হ্যাঁ, তিনি বুজুর্গ আলেম। বর্তমানে উনি মজনু দশায় আছেন, উনাকে বিরক্ত করা ঠিক হইতো না ...’

বৃষ্টি কমে আসায় লোকগুলো চলে যাওয়ার উদ্যোগ নেয়।

‘মজনু দশা? ব্যাপারটা বুঝলাম না...’ আলাউদ্দিন বলে।

‘ভাই, এইগুলি মারেফতি কথা। সবাই বুঝে না। আশেকের জন্য মাশুক যেমন পাগল, লাইলির জন্য মজনু যেমন পাগল, সৃষ্টিকর্তার প্রেমে ওই আলেম তেমন পাগল। এমন মজনু পাগলের কথার উত্তর দেওন ঠিক না। উনি বর্তমানে নিজের মইধ্যে নাই, অইন্য জগতে আছেন!’

আলাউদ্দিন চমত্কৃত হয়। ছালা পরিধানকারীর সম্পর্কে তার মনে প্রবল কৌতূহল ও আগ্রহ জন্ম নেয়। কিন্তু সেদিনের পর থেকে আর কোথাও ওই লোকের দেখা পায় না আলাউদ্দিন। যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে লোকটা। আষাঢ় যায়, শ্রাবণ যায়, ভাদ্র-আশ্বিন পেরিয়ে কার্তিকের এক সন্ধ্যায় মাইজপাড়ায় এক অসুস্থ মা ও তার নবজাতককে দেখে ফেরার সময় হঠাৎ আলাউদ্দিনের চোখে পড়ে, উঁচু সড়ক থেকে একটু ভিতরে, গ্রামের এক পরিত্যক্ত ভাঙা দালান বাড়ির বাঁধানো চত্বরে জঙ্গল আর হালকা কুয়াশার মধ্যে একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে একাকী বসে আছে সেই ছালা পরিধানকারী, রহস্যময় মজনু, একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে তার সামনে মোমের জ্বলন্ত শিখার দিকে, আশপাশ থেকে পতঙ্গরা উড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ছে সেই তীব্র অগ্নিশিখায়, পুড়ে যাচ্ছে নিমেষে। আলাউদ্দিন চুপি চুপি এসে মজনুর সামনে বসলেও তার মধ্যে কোনো ভাবান্তর ঘটে না।

আলাউদ্দিন একবার খুক্ করে কেশে তার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে।

‘কি চাস?’ ছালা পরিধানকারী আগুনের দিকে তাকিয়েই বলে।

‘আপনের এই হাল কেন হইলো, কীভাবে হইলো জানতে চাই। আপনে এই বেশ কেন ধরছেন?’ আলাউদ্দিন এক নিঃশ্বাসে তিনটা প্রশ্ন করে।

এইবার ছালা পরিধানকারী মজনু মাথা দুলিয়ে নিঃশব্দে খানিকক্ষণ হাসে। তারপর বলে—

‘আরে বোকা, এইসব তো ভেক। আমি ভেক ধরছি, চারদিকে দুর্গন্ধ, আবর্জনা, মরা মানুষের হাহাকার, ভেক না ধরলে চলে না।’ লোকটা নিঃশব্দে হাসতেই থাকে।

আলাউদ্দিন খানিকটা হতাশ বোধ করে থমকে যায়। প্রেম-ভক্তি কিছুই না, এসব তাহলে ভণ্ডামি। ভেক ধরা। ছদ্মবেশ।

লোকটা এবার বলে, ‘মন খারাপ করলি কেন? ভেক ধরা খারাপ না, এতে মনের মুক্তি আসে, নিজের ভিতরে চন্দ্র-সূর্য উদিত হয়, হৃদয় জাগ্রত হয়।’

তখনই আলাউদ্দিনের কেন যেন হঠাৎ মনে হয় এই লোকটা অন্যরকম। এর সঙ্গ তাকে এক নতুন ও অজানা যাত্রায় প্রবেশের সুযোগ করে দেবে, সে আলোকপ্রাপ্ত হবে, মুক্তি পাবে। আলাউদ্দিনের আর স্ত্রী-পুত্র-পরিজনের কথা মনে থাকে না। আগ-পিছ কিছুই আর বিবেচনায় আসে না। যেন এক অদ্ভুত সম্মোহনে আকুল হয়ে সে বলে, ‘আমি আপনের সাথে যাইতে চাই। হৃদয় জাগ্রত করতে চাই।’

মোমবাতিটা ততক্ষণে জ্বলে জ্বলে প্রায় নিঃশেষ হয়ে এসেছিল, উত্তুরে বাতাসের জোরালো এক ঝাপটায় তা এবার পুরোপুরি নিভে যায়। মৃদু আলোকময় জায়গাটি এক্ষণে অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।

‘যাবি? তবে চল।’

অন্ধকারে ছালা পরিধানকারীর ভরাট গলা শোনা যায়। বোঝা যায়, সে উঠে দাঁড়িয়েছে। হঠাৎ কি হয়, যেন ঘুম ভেঙে সজাগ হয়ে উঠে আলাউদ্দিন, তার হাজেরার কথা মনে পড়ে, দুই বছর বয়সী ছেলে ইয়াসিনের হাসি মুখটা চোখে ভাসে। আলাউদ্দিনের গলা কেঁপে উঠে,

‘এ-এক্ষুনি যাওন লাগবো? মাত্র দুইটা দিন সময় দেন। ঘর-বাড়ির একটা ব্যবস্থা কইরা তারপরে বাইর হই।’

অন্ধকারে কারো হাসির উচ্চ শব্দ ভেসে আসে।

‘গেলে অক্ষণ-ই, নাইলে কোনো দিনই না।’

আলাউদ্দিনের হঠাৎ যেন জবান বন্ধ হয়ে গেছে। সে আর কিছুই বলতে পারে না।  

‘ওরে বেভুলা বেটা, এই পথ তোর না, তুই গৃহী, গৃহেই থাক। মানুষের রোগের নিদান দে। নিজের মধ্যে নিজের আশ্রয় নির্মাণ কর।’

অন্ধকারে আলাউদ্দিন দীর্ঘ পা ফেলে মজনুর চলে যাওয়ার শব্দ শুনতে পায়।  

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর