শিরোনাম
শুক্রবার, ৯ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

পীর মামুনুর রশীদের কবিতা

মুস্তাফা জামান আব্বাসী

পীর মামুনুর রশীদের কবিতা

পীর সাহেবরা কবি বা সাহিত্যিক হন না। কোনোদিন শুনিনি। তারা অন্য পথের পথিক। আবার রুমি, হাফিজ, মুঈনুদ্দিন চিশতি, ইবন, আরাবি, এরা সবাই পীর সাহেব অর্থাৎ গুরু। সবাই বড় কবি। আমার পরিচিত পীর সাহেবরা পৃথিবীতে নেই। যার কথা আজ বলতে বসেছি তিনি কম বয়সে আমাদের ছেড়ে চলে যান। যদি তার সম্বন্ধে লিখি তাহলে কতটুকুই বা লিখতে পারব। যা জানি তা তো গোপন, গোপন কথা বলা যাবে না, থাকবে গোপনে। যা প্রকাশ্য দীর্ঘবাদনে বাজিয়ে যেতে পারব, কয়েক পৃষ্ঠাতেও শেষ হবে না। বললেন, আব্বাসী ভাই, সারাদিন সাহিত্য সাধনা করেন। সাহিত্যের কতটুকু বোঝেন? তারপরে বললেন :

‘একটি মানুষ দেখ ঐ হেঁটে যায়

নতদৃষ্টি খোলা চোখ, জনারণ্যে ট্রাফিকের জামে

একটুও বিব্রত নয়

সহজ অভ্যস্ত ছন্দে সবকিছু পার হয়ে যায়

ক্বচিৎ কখনো চায় এদিকে ওদিকে

দৃষ্টি বড় অচপল, বোঝা দায় আসলে সে

কোন দিকে কতোক্ষণ চায়।’

উনি আমাকে কি বলতে চেয়েছেন মুহূর্তে বুঝতে পারলাম। কখন যে অন্ত থেকে অন্তহীনতায় প্রবেশ করেছি, জানি না। সাধারণের মতো ঘুুরি, বেড়াই, কথা বলি মাঝে মাঝে মনে করি, আমি এই পৃথিবীর কেউ নই। এখানে বেড়াতে এসেছি, টিকিট কেনা আছে। টিকিটটি কোথায় রেখেছি মনে নেই। প্লেনের, না বাসের, না ট্রেনের, তাও ভুলে গেছি। গন্তব্য জেনে গেছি। স্টেশনটির নাম মনে নেই। শুধু মনে গেঁথে রেখেছি, আমি একজন সামান্য কবি, সামান্য লেখক, সামান্য গায়ক। সবার মাঝে আছি, সবাই আমাকে ভালোবাসে। এ ভালোবাসার আনন্দ থেকে যে কোনো সময় আমার বিদায় হবে। পীর সাহেবের কবিতা পড়ে আমি অন্য মানুষে রূপান্তরিত। তার ভাবনায় আক্রান্ত হলাম। তাহলে গোলাপ কি? গোলাপের কাছে যাই কেন? গোলাপ আমাকে কি দেবে? আমার গোলাপ যে অন্য গোলাপ। দূর সফরে আমার গোলাপের প্রয়োজন কি?

আমি কখন কবি হলাম, তা শুধু আমার জানা। আর কেউ নয়। যে মুহূর্তে কবিতা আমাকে ছুঁয়ে দেয়, তখন আমি অন্য মানুষ। সাধারণ থেকে আলাদা। মাঠে যে রং প্রত্যক্ষ করি, তা অন্য রং। যেমনটি পীর সাহেব বলছেন :

‘মাঠে জ্বলে কমলা আগুন

পিঙ্গলাভ হেমন্তের বিষাদিত হাসি

অবেলায় বাড়ায় পরিধি

ফসলবিচ্ছেদী মাঠে, নাড়ার অনলে।’

হেমন্ত ঋতু আমাকে বিচ্ছেদের অনলে দগ্ধ করে। কেন করে? বিচ্ছেদি গান গাই বলে? তা তো হতে পারে না। এ গান তো আরও সবাই গায়। কারণ খুঁজে পেয়েছি। তা হলো: আমি এক অচিন স্বদেশের সংবাদ পেয়েছি। সেখানে কোকিল আছে, কোকিলের কুহু স্বর আছে, বাঁশি আছে, বাঁশির বেদনা আছে, আছে বেদনাহত হওয়া। এটাই কবিতা। আমি যেদিন চিহ্নহীন হব, সেদিনও বাংলার মাঠের রংগুলো আমার চেনা রং থাকবে। জীবনানন্দ ক্ষণিকের তরে হলেও এ রংগুলোকে খুঁজে পেয়েছেন, তাই হেমন্তের আকাশ তাকে বিষণ্ন করেছে। যেভাবে লিখে চলেছি তাতে এ প্রবন্ধ হবে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর। তবু পীর সাহেবকে খুঁজে পাওয়া যাবে না, ক্রমশ তিনি হবেন দূর থেকে দূরবর্তী। তার চেয়ে চলে যাই একজনের কাছে, যিনি কবিতার হীরকখণ্ড চিনেছেন অনেক বেশি। তার নাম: সৈয়দ আলী আহসান। তিনি লিখছেন:

‘মানুষের জীবনের আশ্বাস প্রয়োজন। আশ্বাসে আশ্বস্তি জাগে এবং নিশ্চিন্ততা তৈরি হয়। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় আমরা প্রশান্তি পেয়েছি এবং আশ্বাস পেয়েছি। অনেকটা সুফিদের মতো। সুফিরা মানব হিতার্থে কল্যাণের পথ নির্দেশ করেছেন। কবিতায় অথবা গজলে এ নির্দেশনা পাওয়া যায়। যিনি আমাদের বড় আশ্রয় তার কাছে মাথা নত করার প্রবৃত্তি তৈরি হয়।’

‘আমাদের দেশে যারা কবি বলে খ্যাত তারা কেউ বা নাগরিক জীবনের চঞ্চলতা, কেউ বা গ্রামীণ জীবনের প্রশান্তি তাদের কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন। কিন্তু যেটা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, সেটা মানুষের জন্য আশ্বাস এবং সম্পূর্ণতা। বর্তমানকালে বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে নাগরিকবৃত্তি এবং রাজনৈতিক ভাবপ্রকল্পই প্রাধান্য লাভ করেছে। কবিতার জন্য নতুন কোনো কেন্দ্রবিন্দু তৈরি হচ্ছে না, এর মধ্যে হঠাৎ যদি আশ্রয় এবং আশ্বাসের কথা পাওয়া যায় তাহলে আমাদের চিত্তে কল্যাণবোধ জাগবে। আমি যেসব কবিকে চিনি এবং সবাই যাদের প্রশান্তি নির্মাণ করেছে তাদের কবিতায় পৃথিবীর কথা প্রবলভাবে এসেছে। কিন্তু পৃথিবী যিনি নির্মাণ করেছেন এবং আশ্রিতজনের জন্য যিনি সজীবতা দান করেছেন তার কথা কবিতায় আসে না। কবিতা বর্তমানে পৃথিবীর মানুষের বক্তব্যে আচ্ছন্ন। এটা সত্য যে, সাহিত্য মানুষের জন্য, কবিতাও সাহিত্যের অঙ্গীভূত এবং মানুষের মঙ্গলাকাঙ্ক্ষা সাহিত্যে রূপ পেতে পারে। আমাদের দেশের কবিতায় একান্তভাবে নারী এসেছে, প্রেম এসেছে এবং কচিৎ সংকল্পের কথা এসেছে। কিন্তু আধুনিক কবিতার মধ্যে বিধাতার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন আসেনি। আমি আছি- এ কথায় তখনই আমরা আশ্বস্ত হই যখন অনুভব করি, আমাদের জীবনের একজন নিয়ামক আছেন, তাকে সন্ধান করতে হবে এবং অনুভব করতে হবে। কখনো প্রকৃতিতে, কখনো আমাদের কর্মপন্থায়।’

“কবি কীটস তার একটি কবিতায় বলেছেন, তিনি আছেন ঘাসের সবুজে আছেন, মৃত্তিকায় আলগ্ন হয়ে আছেন এবং বাতাসের আবেশে আছেন, তাকে সন্ধান কর তাহলে তাকে পাবে। তাকে পাওয়াার জন্য একটি আকুল প্রত্যাশা থাকতে হবে। যেহেতু তিনি সর্বত্রই আছেন এবং সর্ব মুহূর্তেই আছেন। আন্তরিক অনুসন্ধান করলে তাকে অবশ্যই পাওয়া যায়। কয়েক বছর আগে আমার বাসায় ফজল মাহমুদ নামক একজন লেখক কয়েকটি কবিতার বই নিয়ে এসেছিলেন। সেই কবির নাম আমি আগে কখনো শুনিনি। তার কোনো কবিতাও আগে পড়িনি। কবির পরিচয় সূত্রে যেটা জানলাম তার নাম মোহাম্মদ মামুনুর রশীদ। অনেকগুলো কবিতার বই তার রয়েছে। সেগুলো যে খুব প্রচার লাভ করেছে তা নয়। আমি কবিতার বইয়ের পাতা উল্টাতে লাগলাম এবং অকস্মাৎ চমকিত হলাম। তার কবিতার মধ্যে বিনম্র আশ্বাসের কথা আছে এবং প্রতিকূল অবস্থায় জীবনের চৈতন্যোদয়ের কথা আছে। উদার আকাশের কথা আছে যেখানে বিহঙ্গ বাধাহীনভাবে উড়ে বেড়ায়, কোনো নিষেধাজ্ঞা মানে না। সে একজনেরই থাকে চিরকাল। মানুষ বাধার মধ্যে বাস করে চিরকাল। কোনো মুহূর্তেই তার নিশ্চিন্ততা নেই। কিন্তু মেঘলোকে এবং আকাশে যে বিহঙ্গ ঘুরে বেড়ায় তার কোনো বন্ধন নেই। সে সজীবতায় নিষ্কলুষ এবং বাধা-বন্ধনহীন। মামুনুর রশীদের কবিতা পড়ে আমি অভিভূত হলাম। ফজল মাহমুদ তার বইয়ের প্রকাশনা উৎসবে আমাকে যেতে বলল এবং বলল যে, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রে তার একসঙ্গে চারটি বইয়ের প্রকাশনা উৎসব হবে। আমি সময় মতো জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের প্রবেশ দরজায় উপস্থিত হলাম। সেখানেই মামুনুর রশীদের সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ। লম্বা কোর্তা গায়ে, পায়ের গোড়ালি ছুঁই ছুঁই এবং মাথায় একটি সাদা টুপি। আপাদমস্তক দৃষ্টি দিতে গিয়ে আমার চোখ তাঁর চোখের মধ্যে হঠাৎ যেন আটকে গেল- শান্ত চোখ, কিন্তু কেমন তীক্ষধার। আমি চোখ নামিয়ে নিলাম। আলোচনার মুহূর্তে তিনি জীবনের বিস্ময়ের কথা বললেন এবং সঙ্গে সঙ্গে আনন্দের কথা বললেন। তিনি আরও বললেন যে জীবন অস্থির নয়, অনাদৃত নয়, জীবন হচ্ছে নিপুণভাবে পরস্ফুিট পুষ্পের মতো। সুতরাং যিনি পুষ্পের মতো এই জীবন সৃষ্টি করেছেন তার প্রতি সর্বক্ষণ কৃতজ্ঞ থাকা আমাদের কর্তব্য। আমি লক্ষ করলাম যে, তিনি রবীন্দ্রনাথ ব্যাপকভাবে পড়েছেন, নজরুল ইসলাম পড়েছেন এবং ফররুখ আহমদের প্রতি তার সম্ভ্রমবোধ আছে। এক পর্যায়ে তিনি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কথাও বললেন। তার বক্তব্য অত্যন্ত সুস্পষ্ট এবং সুতীক্ষ ছিল। আজকের প্রবন্ধটি যেহেতু আমার, সৈয়দ আলী আহসানকে আর সুযোগ দিলাম না। এবার আমার কথা বলি। আমি জীবনে কখনো এরকম পীর সাহেব পাইনি। একজনও নয়। উনি একজন আপাদমস্তক কবি। তার সঙ্গে কাব্যালোচনায় বেশিদূর এগুতে পারিনি। বললেন, সবচেয়ে সুন্দর কে? নিশ্চয়ই আল্লাহ। তাকে কতটুকু উপলব্ধি করেছেন? কতক্ষণ তার সঙ্গে কথা বলেছেন? কত দিন? বলে কী পেয়েছেন? স্বীকার করলাম। কচিৎ দেখা হয়েছে। উপলব্ধি খুবই সামান্য। বললেন, তাহলে কবিতাও সামান্যই পাবেন, সৌন্দর্য উপলব্ধিও সামান্যই পাবেন। বললাম, কী করে পাব? বললেন, বলুন ‘আল-হামদুলিল্লাহ্’। বললাম। উনি বললেন, কতটুকু পেলেন?

এবার বুঝলাম। যতটুকু প্রশংসা আমার করার তা দিয়ে হৃদয় ভরে দিলাম। আমার সব অন্তআত্মা কেঁপে উঠল। আমার হৃদয়ে শুধু ধ্বনিত হলো, ওগো প্রভু তুমি আমার, শুধু আমার, আর কারও নও। আমার চোখ পানিতে ভরে গেল। বললাম, আমি তোমার ক্রীতদাস। আমার দিকে তাকাও। আমার দেহের সব অনু-পরমাণু তোমার প্রতি দাসত্বে বিলীন। এবার কি আমি বোঝাতে পেরেছি, তুমি কত সুন্দর, আমাকে কত সুন্দর করে তৈরি করেছিলে, আর আমি তা রাখতে পারলাম না।

দুজনের মধ্যে কথা হয়েছে অনেক। কথাগুলো কবিতার চেয়ে সুন্দর, পৃথিবীর সব সৌন্দর্যকে তা আত্মস্থ করে। সৈয়দ আলি আহসান যেমনটি বলেছেন। রবীন্দ্রনাথকে তিনি পরিপূর্ণভাবে অধ্যয়ন করেছেন। প্রতিটি অক্ষর, প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি পদ, তার দৃষ্টি এড়ায়নি। সুন্দরকে অবলোকন করেছেন বলেই সুন্দর তার কাছে দেখা দিয়েছে। নজরুলের প্রতিটি কবিতা তিনি পাঠ করেছেন। আর সবচেয়ে আনন্দের কথা আমার জন্য যে আমাকে তিনি অনেক বেশি মূল্য দিয়েছেন। বলেছেন, আপনার গান বা কবিতা তাঁর কাছে পৌঁছে গেছে। আমি তার প্রমাণ। এর পরে আমি ভয় পেয়ে গেছি। কারণ আমার রয়েছে শয়তানের সঙ্গে গোপন কারচুপি। কবির তা নয়, তিনি সর্ব মুহূর্তে প্রভুর কাছে সম্পূর্ণ অবনত। শয়তান তার ধারে-কাছেও আসতে পারেনি।

তাকে একদিন জিজ্ঞেস করলাম, আপনি বিদেশে গিয়ে একজন বিদেশিনীকে বিয়ে করেছেন। এ সম্পর্কে কিছু বলুন। বললেন, গিয়েছি ধর্ম প্রচারে। নতুন স্ত্রীর মাধ্যমে সেখানে হাজার হাজার মহিলাকে মুসলমান বানিয়েছি। ওই দেশে আমার চিহ্ন রেখে এসেছি। কোথায় ভুল করলাম? সমস্ত পৃথিবী আমার জন্য উন্মুক্ত। আজ সারা বাংলাদেশ মুসলমানদের করায়ত্ব। বাবা শাহজালাল ও তার তিনশ ষাটজন সহযোগীর মাধ্যমে। তারা কোথায় ভুল করলেন? তারাই ইসলামকে এ দেশে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। খানকা বানিয়েছেন, গরিবদের সঙ্গে মিশেছেন, উচ্চ নীচের ভেদাভেদ মানেননি, সবাইকে বুকে তুলে নিয়েছেন। তাই তারা জয় করেছে হিন্দুদের হৃদয়। এটি বাহুবলের বিজয় নয়। এই কবির নাম : মোহাম্মদ মামুনুর রশীদ ১৯৫০ সালের ৭ মার্চ, দিনাজপুরের পলাশবাড়ি গ্রামে তার জন্ম। তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা: ষাট। কাব্য সংখ্যা: সাতটি। আমরা যারা প্রতিদিন দুর্যোগের সম্মুখীন তাদের কাছ থেকে একেকটি কবিতা হবে একেকটি দিকদর্শন। শুধু কবিতা নয়, আরও কিছু।

সর্বশেষ খবর