শুক্রবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

সাদা কফিন

বিপ্রদাশ বড়ুয়া

সাদা কফিন

এতক্ষণ নীরব-নিস্তব্ধ ছিল সমস্ত শহর। রাস্তায় রাস্তায় প্রতিরোধ, লোকজন নেই বললেই চলে, গাড়ি চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ। কচিৎ একটা সাইকেল রিকশা ঝড়ের বেগে ছুটে হয়তো বেরিয়ে গেল, শুধু বাতাস-কাটা আর পিচের সঙ্গে চাকা ঘর্ষণের শব্দ, হয়তো রিকশায় কিছু মালপত্র বোঝাই আছে কিংবা খালি, কিন্তু কোথাও একটা গাড়ির দেখা নেই। মাইল, আধমাইল দূরে দূরে ইট, ড্রাম, উল্টানো গাড়ি ইত্যাদি হাতের কাছে যা পাওয়া গেছে তাতেই রাস্তায় প্রতিরোধ সৃষ্টি করা হয়েছে। ছায়া ছায়া রাস্তা, বড় বড় মেহগনি ও বৃষ্টি শিরীষ গাছ রাস্তাগুলো আরও নির্জন ও নিবিড় করে তুলেছে। জনমানবের গন্ধ নেই রাস্তায়। মনে হঠাৎ এমনও অবান্তর প্রশ্ন জাগে, অবরোধ টিকবে তো? দূর থেকে সেই অবরোধ পাহারা দিচ্ছে মুক্তিপাগল মানুষ... বারুদের মুখে আগুন লাগল বলে! পরিবেশটা তেমনি বিস্ফোরণমুখী। জাতীয় সংগীত না বাজিয়ে ঢাকা বেতারের তৃতীয় অধিবেশন বন্ধ হয়ে গেছে। আমি হন্যে হয়ে একটা রিকশার কথা ভাবছি। অন্য কোনো গাড়ি তো পাওয়ার সুযোগ নেই, প্রতিরোধ ডিঙিয়ে তবুও কোনোমতে রিকশাকে টেনে নিয়ে যাওয়া যাবে। আমাকে অনেক দূরে, মতিঝিল পেরিয়ে বাসাবো অবধি যেতে হবে। অদূর হেঁটে যাওয়া, কিংবা হেঁটে যেতে ভয় করছে। লোকগুলো সব মরে গেল নাকি এক নিমিষে!

 

আমি অনবরত চিন্তা করছি হেঁটে যাওয়া যাবে কিনা। বন্ধু-বান্ধব সবাই আজ গেল কোথায়? প্রেস ক্লাব কি বন্ধ? সেখানে যাব কিনা আবার ভেবে নিলাম। কয়েক মিনিট। কিন্তু যেন কয়েক লক্ষ সেকেন্ড এরই মধ্যে পার হয়ে গেছে। এভাবে যেন অনন্ত সময়ের হনন চলল; রাস্তার নিস্তব্ধতায়, তারাঘন আকাশে, নিরিবিলি এবং নীরব পত্রগুচ্ছে, রাস্তার অন্ধকার লাইটপোস্টে, গির্জার চূড়ার ক্রুশে রাত্রিপাত হচ্ছে প্রবল বেগে; রাত্রিপাত হচ্ছে ঢাকায় সামরিক রাজনৈতিক উত্থানের নিরবচ্ছিন্ন এক যোগসাজশে।

গত দু’দিন কাজের চাপে বাসামুখো হতে পারিনি, অফিসে রাত কাটিয়েছি, আজ একটা কিছু ঘটতে চলেছে এরকম ইঙ্গিত বেতার অনুষ্ঠানের সমাপ্তিতে ছিল। এখন সেসব এলোমেলো চিন্তার পর্বত-প্রমাণ এক বোঝা নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাসামুখো চলছি, সারি সারি ইমারত ফেলে, বন্ধ রেস্তোরাঁ, হ্যাপি মটরিং-এর ছবি, বাসে ওঠার শূন্য কিউ হাইকোর্ট ভবনকে মনে হচ্ছে রূপকথার হাজার দুয়ারী রহস্যময় প্রাসাদ। সহসা একটা সাইকেল-রিকশা দ্রুতবেগে আমাকে কাটিয়ে চলে যাচ্ছে দেখে আমি চিৎকার করে তার পেছনে ধাওয়া করলাম। সে আরও বেগে, আরও দ্রুত ছুটল। কিন্তু আমার যে তাকে ধরতেই হবে! এভাবে আমাকে পাগলের মতো ছুটতে দেখে সে কী ভেবে হয়তো কিছু না ভেবেই থামল। বলল, শহরে সৈন্য নেমেছে সাব, সরে পড়ুন, এক্ষুনি এদিকে এসে পড়বে। তাদের আছে কামান, বন্দুক, ট্যাঙ্ক, আরও কত কী...

বলো কী? সৈন্য নেমেছে? কোথায়? কত দূরে? আমার মাথা ঘুরে গেল। তুমি কোন দিকে যাবে ভাই, জলদি আমাকে নিয়ে চলো!

না, পারব না সাব। আমাকে এক্ষুনি যেতে হবে, পথে পথে বাধা, আপনাকে নিয়ে যাব কী করে! না, আমি নিতে পারব না হাঁপাতে হাঁপাতে রিকশাঅলা কথাগুলো বলে ফেলল। বললাম, তুমি যেখানে যাও ভাই আমাকে নিয়ে চলো, তোমার সঙ্গেই থাকব আমি। বাধা ডিঙিয়ে দুজনে রিকশা টেনে নেব। তোপখানা, পল্টন সড়ক, মতিঝিল, কমলাপুর ছাড়িয়ে বাসাবো...

এতসব কথা সংক্ষিপ্ততম সময়েই শেষ হয়েছে। রিকশাঅলা আমাকে নাছোড়বান্দা দেখে কিংবা করুণাবশত হোক, তুলে নিল; তখন আশ্চর্য তেজোদীপ্ত সেই অচেনা রিকশাঅলার গামছা-বাঁধা মাথাটি আমার সামনে এক দৃপ্ত বিজয়ীর মতো উন্নত এবং উদ্যত। কিন্তু কিছুদূর গিয়েই বাধা। আর পেছনে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার দিকে গাড়ির ঘর্ঘর শব্দ রাতের নিস্তব্ধতাকে খান খান করে দিল। তক্ষুনি সে রিকশা ফেলে দৌড় দিল, আমার সঙ্গে একটা কথা বলা কিংবা একবার ফিরেও তাকাল না। নিশ্চল রিকশা, অপসৃত রিকশাঅলা, ভৌতিক শহর, সৈন্য, রাস্তার ধারের সারি সারি অট্টালিকা, প্রত্যেকে প্রত্যেকের কাজ করল। আমিও দৌড়ে প্রেস ক্লাবের চত্বরে আশ্রয় নিলাম। ভরসা, সেখানে যদি কাউকে পাই! কিন্তু কোনো সাড়া নেই। কিছুক্ষণ পর অনেক খোঁজাখুঁজিতে চেনা দারোয়ানকে পাওয়া গেল, কিন্তু কোনো খবরই সে দিতে পারল না, শুধু এটুকু জিজ্ঞেস করল, আপনি কোথায় যাবেন? এখন তো কেউ নেই। দরজা খুলে দেব? বরং পালিয়ে যান...। কেউই নেই! কিন্তু যাব কোথায়? গাড়ি, সামরিক ট্রাক ও কনভয়ের শব্দ একদম এগিয়ে আসছে, ওই বুঝি দেখা যায়, আর যদি আসেই। এখানে আশ্রয় নিলাম, পরে যা হওয়ার হবে, আপাতত এখান থেকে নড়ছি না বুকের ভিতর দুরু দুরু কম্পমান একটি বল যেন অবিশ্রাম লাফাচ্ছে, অবিরাম একটি নৌকো ঢেউয়ের আঘাতে কাঁপছে। আমার কী যেন হয়ে গেল, দারোয়ান দরজা খুলে দিয়ে কী যেন বলে গেল কিছুই শুনিনি। আমার সামনে পেছনে একটি মাত্র শব্দ শুনছি আশ্রয়! প্রেস ক্লাবে সাময়িক আশ্রয় নেওয়া ভালো মনে করলাম। রাস্তায় যে কোনো সময় যা-কিছু একটা ঘটে যেতে পারে বলে মনে হচ্ছে, তাই মাথা গোঁজার একটু আশ্রয় দরকার। অন্ধকার দরজার দিকে তাকিয়ে কিছু ভাবার আগেই দুটো মিলিটারি কনভয় শব্দ করে প্রেস ক্লাবমুখো হয়ে থেমে গেল। আমি একটু মাত্র দেরি না করে, ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ না করে সোজা দোতলায় উঠে গেলাম। জানালার ফাঁক দিয়ে হেডলাইটের তীব্র আলোতে রাস্তা দেখলাম। তোপখানা সড়ক ধু-ধু এবং ম্রিয়মাণ।

কনভয় ইউসিসের সামনে। সমস্ত এলাকাটা অন্ধকার, শুধু ইউসিস আর ব্রিটিশ ইনফরমেশন সার্ভিসেসের কয়েকটি আলো ছাড়া।

খটখট শব্দে কয়েকজন ক্রুর সৈন্য নামল। হাতে তাদের স্বয়ংক্রিয় মেশিনগান। ওরা খানিক ভেবে ইউসিস থেকে একটা তার নিয়ে রাস্ততারা লাইট পোস্টের বাল্বের সঙ্গে যোগ করে দিল। সমস্ত রাস্তা আলোকিত হয়ে গেল।

সৈন্যদের গতিবিধি সন্ধানী। প্রেস ক্লাবের দিকেই তাদের দৃষ্টি, তারপর আরও দুটো বড় কনভয়! ট্যাঙ্ক...

বাপসা। এবার সব গুঁড়িয়ে দেবে। আর নয়। আমি জানালা ছেড়ে ঘরের ভিতর চললাম, বিপদ ঘনিয়ে এলো বলে। চারদিকে বিদঘুটে অন্ধকার, অন্ধকার হাতড়ে চেনা দেয়াল-দরজা ইত্যাদি অনুমান করে বাথরুমের দিকে পৌঁছার আগেই দুনিয়া-কাঁপানো শব্দ হলো গুড়ম-গুড়ম বুমবুম বুমবুম। পলকে একরাশ বাতাস তাড়িয়ে বালি-ইট-প্লাস্টারের গুঁড়োর ঝড় বয়ে গেল, সমস্ত ঘরটি কেঁপে রাতের নিস্তব্ধতাকে আরেকবার ভেঙে চুরমার করে আবার শব্দহীনতায় উধাও হয়ে গেল। ভয় জড়ানো চোখের ফাঁকে দেখলাম উত্তরের দেয়াল ভেদ করে কামানের গোলা পূর্ব দেয়ালে বাধা খেয়ে ছাদ ফুটো করে চলে গেছে। বিরাট গহ্বর আমার পাশে মূর্তিমান হয়ে আমার দিকে চেয়ে রইল, আমিও চোখ খুলে তাকিয়ে রইলাম আকাশের দিকে। দুই কান রইল নতুন শব্দের অনাকাক্সিক্ষত প্রত্যাশায়। পায়ের কাছে মেঝেতে স্তূপ, জঞ্জাল। অন্ধকারে অনুমান করলাম সারা ঘরের দৃশ্য, বুকের ভিতরে করোটির খাঁজে খাঁজে শিরশির বোধ। তাড়াতাড়ি আবার গোলাবর্ষণের আগে ভয়ে ভয়ে সিঁড়ি ভেঙে নিচের তলায় নেমে যাওয়া ঠিক করলাম। নেমে যাচ্ছি। সিঁড়ির হাতল মাঝে মাঝে গেছে উড়ে; অন্ধকারে, ভয়ে ভয়ে, আন্দাজে, নামতে নামতে যেন পাতালে নেমে যাচ্ছি। আমি একা মৃত্যুর রাজ্যে চুপিসারে ঢুকে-পড়া একটি প্রাণী। নিঃশব্দে ঘোরাঘুরি করছি আর অন্ধকারপুরীর দেয়াল, আসবাবপত্র, দরজা-জানালা, লোহার শিক আমার শরীরে মৃত্যুর নিঃশ্বাস ফেলছে; কাঁপা কাঁপা পায়ে যেন সাপের ঠাণ্ডা স্পর্শ অন্ধকারে মৃত্যুর মহড়া শুরু হয়ে গেছে।

নেমে যেতে যেতে নিচের হলঘরে যখন পৌঁছলাম, দেখি খোলা দরজার সামনে সেই দুরন্ত এবং অগ্নিক্ষরা প্ল্যাকার্ডগুলো ভূতের মতো নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে। যেসব ফেস্টুন দুদিন আগেও মিছিলে ব্যবহৃত হয়েছে, ব্যবহারের পর দরজার সামনের বারান্দায় দেয়ালের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে, সেসব ফেস্টুনের মূর্তিমান বিভীষিকা আমার চোখে পড়ল। রাস্তার স্বল্পালোকে চোখে পড়ল দুজন মানুষ একজন আহতকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে, নিচে লেখা : আমার ভাইয়ের তাজা রক্তের বদলা আমি নেবই নেব আমিও আমার লাশের ছবি দেখলাম। আরও কয়েকটি আছে, আমি সব প্ল্যাকার্ড সরিয়ে নেওয়ার কথা ভাবলাম। সরিয়ে নিলে সৈন্যদের চোখে পড়বে না, তারা এদিকে আসবে না, আমি বাঁচব আমি বাঁচতে চাই, মৃত্যুর গুহা ছেড়ে আমাকে বাসাবো যেতেই হবে। আবার ভাবলাম, না, যেমন আছে তেমনটি থাক, কাজ নেই ঝামেলা করে, ওরা যদি দেখে ফেলে? বরং এখানে কেউ নেই ভেবে তারা ঢুকবে না, তাহলে আমিও নিরাপদ। এভাবে কতক্ষণ সময় কেটেছে জানি না, বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে অবিশ্রাম গোলাবর্ষণ হচ্ছে, পল্টন ময়দানের দিকে দূরে কোথায় শব্দ হচ্ছে, তারপর ভাবলাম কোন দিকে যাব, কোথায় আশ্রয় মিলবে একটা আশ্রয়, একটু নিভৃত আশ্রয়, যেখানে কোলাহল নেই, মৃত্যুর ডাক এত পৈশাচিক নয়, যেখানে একটু নিঃশব্দে বসে নিজেকে ও নিজের অন্তরঙ্গ মুহূর্তগুলো একান্ত আপন করে ধরা যায় সেই একটুকু আশ্রয়। আমি আবার চিন্তা করে দেখলাম কোথায় যাওয়া যায়, আমি আরেকবার আগাগোড়া ভেবে নিলাম। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যেমন ভাবা যায়, চারদিকে গোলাগুলির শব্দে একজন মানুষ যতটুকু দ্রুত ভাবতে পারে যে বন্দুকের সামান্য একটি গুলি একজনের পক্ষে যথেষ্ট তার আওতায় বসে সেই ভাবনার মুহূর্তে, দুর্বলতার অতল স্রোতে ডুবে, স্বজন-বান্ধবহীন নিঃসঙ্গ অবস্থায় আমি একটি সঠিক কর্মসূচি তৈরি করতে চেষ্টা করলাম। দশ রকম চিন্তা-ভাবনা নয়, একটি স্থির ভাবনা লাফিয়ে মস্তিষ্কে খেলা শুরু করে দিল, পেছনের দিকে সংলগ্ন বাথরুমে যাও, মাথা গুঁজে নিজেকে বাঁচাও। বিশ্বব্রহ্মান্ডের কোনো বড় চিন্তা-ভাবনাও নয়, এমনকি সৈন্যদের বিরুদ্ধে তীব্র রোষও নয়, শুধু নিজেকে বাঁচাও! একটি নির্নিমেষ ভাবনায়, একটি স্থির সিদ্ধান্তের পরও আমি ফেস্টুন-প্ল্যাকার্ডগুলো টানতে গেলাম অমনি গর্জন, তখনই বুম বুম বুম। মাথা নিচু করে দু’কানে হাত দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম মেঝেতে, তারপর সন্তর্পণে প্লেগরোগে আক্রান্ত ইঁদুরের মতো নিজেকে টেনে একদম বাথরুমের দরজায়, বাঁ-হাত ও কাঁধের নিচটায় কী যেন জ্বলে উঠল, সে কথা সম্পূর্ণ ভাবার আগে সবচেয়ে জরুরি কর্মসূচির মতো চোখে পড়ল দুটো গভীর এবং বড় গর্ত হাঁ করে আছে পশ্চিম দিকের দেয়ালে, অন্য আরেকটি বাথরুমের খানিক পুবে গর্তের উপরে এক অপার শূন্যতায় হা হা করে নিঃশব্দে চিৎকার করছে। আমার পায়ের কাছে, সারা মেঝেয় সুরকি-চুনবালির সাম্রাজ্য খেলা করেছে, বাতাস বারুদের গন্ধে ভারী হয়ে উঠেছে, কপালে শির শির করে ঘাম দিচ্ছে, সারা শরীরে তরল স্রোত বয়ে চলেছে, যেন আমার সামনে থেমে গেছে এক নিঃশব্দ মিছিল... প্রতিবাদহীন প্রেস ক্লাব, সেক্রেটারিয়েট চুপ করে আছে, চার দেয়াল করোটি বের করে আছে, একেকটি ইট খসে মাটির তলায় জমা পড়ছে, কে জানে আর কত দিনে ঢাকা শহর মহাস্থানগড় ও ময়নামতিতে রূপান্তরিত হবে...!

অনেকক্ষণ বাইরের দিক থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে বুকের নিচে কনুই সক্রিয় করে, হাঁটু জোড়া টেনে উঠতে গেলাম। বাঁ-হাত যে নিঃসার এতক্ষণে খেয়াল করিনি। দাঁড়ালাম। বাথরুমের দরজার কপাট উড়ে গেছে, অন্ধকারে আন্দাজে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাজ সারলাম, কতক্ষণ আগে সেরেছিলাম মনে নেই, প্যান্টের যথাস্থানে ভেজা ভেজা! এতক্ষণে ভালো করে খবর পেলাম আমি এখনো বেঁচে আছি, শৌচাগারের গন্ধে একাত্মতা অনুভব করলাম, আন্ডারওয়্যার প্রায় ভিজে গেছে, পিঠেও কাপড় নেই। চটচটে রক্তের ধার নিচে নেমে গেছে, কিন্তু মোটা গেঞ্জির কতটুকু রক্তে ভিজেছে এ মুহূর্তে তা খতিয়ে দেখার চেয়ে বেরিয়ে যাওয়াই দরকার। তারপর সেই চিরপরিচিত অথচ নিঃসঙ্গ প্রেস ক্লাব ছেড়ে পেছনের উঠোনে গিয়ে গাছের নিচে আড়ালে দাঁড়ালাম। ততক্ষণে কনভয় এবং ট্যাঙ্ক ঘর্ঘর শব্দে বহু দূর চলে গেছে। আমি শুকনো গলায় ভয়ে ভয়ে ডাকলাম, কুতুব!

কুতুব প্রেস ক্লাবের অত্যন্ত চেনা একজন দারোয়ান। আমার ডাক শুনে সে ছায়ান্ধকার গাছপালার ভিতর দিয়ে ছুটে এলো। বলল, এ্যাঁ, আপনার গায়ে রক্ত। হ্যাঁ, রক্ত। তাই তোমাকে ডাকছি। পারলে ব্যান্ডেজ-জাতীয় একটা কিছু দাও। বাঁধি। এক গ্লাস পানি।

কুতুব এক দৌড়ে ছুটে গেল। দূরের একটা বাল্ব থেকে আলোর রেখাপাতার আড়াল ভেদ করে পায়ের কাছে আবছা ছড়িয়ে আছে; কুতুবকে দেখলাম উঠোনের দক্ষিণ প্রান্তে তাদের থাকার ঘরে ঢুকতে। এক, তিন, পাঁচ, সাত মিনিট...। কুতুব আসে না। কুতুব ঘর থেকে আর বের হয় না। ওর দেরি দেখে ভয় ও ভাবনা আবার আমাকে জাপটে ধরল। কী করব কিছু ভাবতে পারার আগে বসে পড়লাম। রক্ত! আগের সমস্ত ঘটনা একের পিঠে এক জড়ো হলো। পৃথিবীটা একবার প্রলয় দোলায় আমার শরীরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কিন্তু জ্ঞান হারাবার আগে কুতুব এসে আমার কাঁধে হাত রেখে চোখে-মুখে জল ছিটিয়ে দিল। এক আঁজলা দিল খেতে, হাতে ব্যান্ডেজ করে দিল ডেটল দিয়ে, পিঠেও লাগাল। আমি বসে বসে কুতুবের দিকে তাকালাম, কুতুবও তাকাল। আমি তার হাত ধরে দাঁড়ালাম। অসার। কিন্তু পালাবার এই উপযুক্ত সময়, সৈন্যরা আবার আসতে পারে! আমি ভাবনা-চিন্তা ফেলে ভাবনা-চিন্তার চেয়ে দ্রুত ছুটতে লাগলাম। ছুটতে ছুটতে অন্ধকারে কোথায় থামলাম বোঝা গেল না। ভাবলাম সেগুনবাগানের কাছাকাছি কোনো গলিতে আছি। সেগুনবাগানে আলী রেজা থাকে, শান্তিনগর সুপ্রকাশ, চামেলিবাগে মালভী আর বায়েজিদ থাকে। আমি কার কাছে যাব? বাসাবো যাওয়া একান্তই প্রয়োজন। আবুল হাসান এখন কোথায় কার সঙ্গে আছে কে জানে? চারদিকে অবিশ্রাম বৃষ্টির ছাঁচে গোলাবর্ষণ হচ্ছে, কামান কিংবা মর্টারের শব্দ অবিরাম শুনছি, একটি যুদ্ধক্ষেত্রের মাঝখানে আমি অবকাশহীন ভাবনায় ভাসছি চতুর্দিকে আগুনের হালকা, আকাশটা ফরসা হয়ে গেছে, পথঘাট পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, স্বল্প-পরিচিত গলিও এখন চিনতে আর কষ্ট নেই। সৈন্যদের পরিষ্কার করা রাস্তায় আবার অবরোধ তৈরি হচ্ছে। পাড়ার কতক দামাল ছেলে আবার ব্যারিকেড তুলছে। বড় রাস্তা জনশূন্য।

হঠাৎ বাতাসে শব্দ তুলে কনভয়গুলো আবার এগিয়ে আসছে মনে হলো। বড় রাস্তা ফেলে তার আগেই আমি ছুটে গেলাম। এবার গির্জায় : প্রভু যিশু, তুমি যুগে যুগে যেমন দুঃখীদের কোলে তুলে নিয়েছ, তুমি নিজেও যেমন অত্যাচারিত, দুঃখী তুমি আমাকে তুলে নাও প্রভু! ক্রুশের একেবারে কাছে গিয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ালাম, গির্জার দরজায় বিরাট তালা ঝুলছে। হাসান, সুপ্রকাশ, গুণ, মালতী কিংবা আর কারও কাছে যাওয়া হলো না  প্রভু আমাকে তুলে নাও। আবার ঝড়ের বেগে গোলা ছুটল, ইতিমধ্যে হাতের ব্যান্ডেজ রক্তে ভিজে একাকার হয়ে গেছে, পিঠের ক্ষতস্থান ঘামে ভেজা দুপুরের ত্বকের মতো থিকথিকে হয়ে গেছে, কামানের গর্জনও সেই মুহূর্তে রাষ্ট্র করল নিজেকে। আরও কিছু শব্দ, ধুলো, বালি, ছাই শরীরে মেখে পাগলের মতো একটা ঘরে ঢুকলাম। বুম করে শব্দ হলো আকাশে। আকাশ থেকে পড়ে আমি হঠাৎ খুলে যাওয়া হাট-করা দরজা দিয়ে গির্জায় ঢুকলাম, একটা কাঠের পাটাতন স্পর্শ করলাম, সেই স্পর্শে হাত বেয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত শরীরে প্রবেশ করতেই আরামের নিঃশ্বাস বেরিয়ে গেল; স্পর্শটি পরিচিত, একান্ত এবং মনে হলো আমার বহু জšে§র পরিচিত বন্ধু। মালতী, বায়জিদ, হাসান, গুণদের প্রবল পরাক্রান্ত বন্ধুত্বের কথা মনে পড়ল, আরও নিবিড় করে ওদের বুকে টানলাম, বাইরে লক্ষ-কোটি রাউন্ড গুলির সুচির ঝড় বইছে, টলছে ঢাকা শহরের বক্ষ এবং হৃদয়, বাসাবোর একটি কক্ষের একটি কর্কশ, কলিং বেল মিষ্টি সুরে অনবরত বাজছে, আমি আস্তে আস্তে ওই কাঠের বাক্সের আরও কাছে গেলাম, নিবিড় হাত পাতলাম তার গায়ে, কোনো বঞ্চনা নেই, কোনো রকম প্রতিবাদ না করে কাঠের বাক্সটি আমাকে মায়াবী হাতছানি দিয়ে ডাকল, অন্ধকারে সেই আহ্বান সুরভিত হয়ে আমাকে বিহ্বল করে দিল, আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো ধীরে ধীরে ওই কাঠের বাক্সে চিৎপাত শুয়ে পড়লাম, লম্বমান মসৃণ কাঠের ঠাণ্ডা স্পর্শে মনে হলো একটি কফিনে আমি শুয়ে আছি, তারপর নিবিড় এক অনুভূতির মতো কফিনের ঢাকনি মৃদু সংগীতের তালে তালে বন্ধ হয়ে গেল, নাকে লাগল হাজার বছরের প্রাচীন কোনো এক কাঠবাক্সের সুগন্ধ, গোলাপ আর চন্দনের মধুর সুরভি অতিক্রম করে গেল আগের গন্ধকে, যেমন এক বাগান থেকে অন্য বাগানে ফুলের গন্ধ প্রবেশ করে তেমনি প্রাচীনকালের কোনো এক অজানা অনামা গন্ধ সমস্ত চেতনাকে আচ্ছন্ন করে দিতে লাগল, চারদিকে আর গোলাবারুদ-যুদ্ধ-হত্যা-ধর্ষণের কোনো চিত্র নেই এবং শব্দও নেই, আছে অনুচ্চকিত মধুর এক সংগীত, মধুরতম সমাপ্তি-সংগীত গাইছে পৃথিবী, বালক বয়সের জয়ের আনন্দের মতো সমস্ত শরীর-মন পুলকিত, কৈশোরের স্বপ্নের মতো একটি কুঁড়ি ফুল ফোটাতে ব্যস্ত, যৌবনের স্পর্শের মতো বিভোর এক ঘুম সমস্ত চৈতন্যকে প্লাবিত করে দিচ্ছে, একজন মালতী ভালোবেসে চুমুতে চুমুতে খলখল করে ছুঁয়ে চলছে, একটি বকনদী গ্রাম চোখের সুমুখে ফুলের সুবাস ছড়িয়ে বুকে লুটিয়ে পড়ছে, ইছামতি নদীর স্বচ্ছ স্রোত আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ধুয়ে দিচ্ছে সমস্ত গ্লানি, সেই মধুরতম সংগীতের আবহে কয়েকশ সৈনিক গির্জায় ঢুকে সামরিক কায়দায় অভিনন্দন জানিয়ে আমার সাদা কফিনটি কাঁধে তুলে নিল।

সাদা কফিনের মিছিল চলছে শহরের প্রধান প্রধান সড়ক ধরে।

রাস্তার দু’পাশের সারিবদ্ধ অট্টালিকা-ইমারত আধুনিক স্থাপত্যবিদ্যায় নবরূপ ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে, কখনো তিন দেয়ালে, আবার কখনো সমস্ত দেয়ালে যেন বায়ুপ্রবাহের সুবিধানুযায়ী অসংখ্য ছোট-বড় ছিদ্র, কখনো ইমারতের চূড়াগুলো মসৃণ না হয়ে থ্যাবড়া, কোথাওবা শুধু কয়েকটি স্তম্ভ দন্ডায়মান, ছাদহীন অট্টালিকা জ্যোৎস্না-রৌদ্রের অপরূপ স্বপ্নখেলায় বিভোর-আর কিছুক্ষণ আগের সেই মারমুখো মেশিনগান এবং কামানের মুখগুলো সাদা কফিনের সম্মানার্থে অবনত, সৈন্যরা অভিবাদন জানিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, দু’পাশের অসংখ্য গাছ লাল লাল থোকা থোকা পলাশ ও পারিজাত ছড়াচ্ছে। একটি রাত্রির নিস্তব্ধতা বেয়ে ভেসে চলেছে একটি সাদা কফিন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর