শুক্রবার, ৫ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

বাঙালির জয় কবিতার জয়

মুহাম্মদ সামাদ

বাঙালির জয় কবিতার জয়

প্রতি বছর জাতীয় কবিতা উৎসব সমসাময়িক কালকে ধারণ করে কণ্ঠে তুলে নেয় তার মর্মবার্তা। এ পর্যন্ত, আমাদের তেত্রিশটি উৎসবের মর্মবাণীতে বাংলাদেশের জনসমাজকে আমরা যেসব আহ্বান জানিয়েছি- তা আমাদের আমন্ত্রণপত্রে, স্যুভেনিরে মুদ্রিত ও পোস্টারে খচিত হয়ে আছে। এবারের উৎসবের মর্মবার্তা- বাঙালির জয় কবিতার জয়।

প্রাচীন কাল থেকে বাঙালির আত্মপরিচয় এবং জীবনধারা বিকাশের সংগ্রামে কবি আর কবিতার ভূমিকা নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ। বাঙালি জাতি তার সর্বকালের শ্রেষ্ঠ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে রক্ত দিয়ে, জীবন দিয়ে, সম্ভ্রম দিয়ে হাজার বছরের সংগ্রাম ও সাফল্যের ধারাবাহিকতায় অর্জন করেছে এই স¦াধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। এই মহৎ অর্জনের স্তরে-স্তরে বাঙালি জাতিকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন ও ঘুম জাগানিয়া গান শুনিয়েছেন বাঙালি কবিরা।

বাঙালির আত্মপরিচয়ের সন্ধানে চর্যাপদের কবিদের কণ্ঠে উচ্চারিত হয় : ‘ভুসুকু আজি বাঙ্গালী ভইলা’। আবার ধর্ম-অধর্মের ভেদ-বিভেদ ঘুচিয়ে দিয়ে সম্প্রীতিময় মানবিক সমাজের আকাক্সক্ষায় চ-ীদাস উচ্চারণ করেন : সবার উপরে মানুষ সত্য/তাহার উপরে নাই; গাজীর গানে গীত হয়: নানান বরণ গাভীরে ভাই একই বরণ দুধ/জগত ভরমিয়া দেখলাম একই মায়ের পুত। জাত-পাতের বৈষম্যবিষে দংশিত মহাত্মা লালন ফকির একতারা হাতে নৃত্য করে গান ধরেন : জাত গেল জাত গেল বলে/একি আজব কারখানা...যখন তুমি ভবে এলে/তখন তুমি কী জাত ছিলে/যাবার বেলায় কী জাত নিলে/এ কথাটি বলো না কিংবা সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে/লালন বলে জাতের কি রূপ/দেখলাম না এই নজরে। বাংলার নিস্তরঙ্গ কৃষি সমাজে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের জন্য আনন্দময় ও সুখী জীবনের প্রার্থনায় ভারত চন্দ্রের কণ্ঠে উচ্চারিত হতে দেখি : আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে। আবার আত্মস্বার্থে সমাজের কোনো গোষ্ঠী যখন পরধনহরণের লোভে মত্ত হয়ে বিলাস-ব্যসনের স্বপ্নে বিভোর হয়, তখন রামপ্রসাদের হৃদয়মথিত কবিতা সুখে-দুঃখে, ত্যাগের দর্শনে আমাদের মহিমান্বিত করে : চাই না মাগো রাজা হতে/রাজা হবার সাধ নাই মাগো/দু’বেলা যেন পাই মা খেতে/আমার মাটির ঘরে বাঁশে খুটি মা/পাই যেন তায় মা খড় জোগাতে মা।

এভাবে কালের পরিক্রমায় বাঙালি জাতির রাজনৈতিক জীবনও নানা উত্থান-পতন ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়। দেশমাতৃকাকে মুক্ত করার ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামে ভারতের অগ্নিপুত্র ও অগ্নিকন্যারা যখন জেল-জুলুম-নির্যাতন অকাতরে সহ্য করে ফাঁসির মঞ্চে নিজেদের উৎসর্গিত করেন, তখন বাঙালি কবি তাঁর অগ্নিপুত্র বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসুর  কণ্ঠে তুলে দেন অঙ্গীকারে দৃঢ় মর্মস্পর্শী গান: একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি।/হাসি হাসি পরব ফাঁসি দেখবে ভারতবাসী (মুকুন্দ দাস)। কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কণ্ঠে ধ্বনিত হয় : লাথি মার, ভাঙরে তালা! যত সব বন্দীশালায়-/আগুন-জ্বালা, আগুন-জ্বালা,/ফেল উপাড়ি। সুকান্ত ভট্টাচার্যের ক্ষুব্ধকণ্ঠে উচ্চারিত হয় : বেজে উঠল কি সময়ের ঘড়ি?/এসো তবে আজ বিদ্রোহ করি। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রিটিশরাজের ‘নাইট’ উপাধি প্রত্যাখ্যান করে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে নতুন মাত্রা যুক্ত করেন।

এভাবে সশস্ত্র ও অহিংস আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ শাসন-ত্রাসন থেকে ভারতবর্ষ মুক্ত হয়। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি দ্বিজাতিতত্ত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে থাকে আগের মতোই। অচিরেই নতুন সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হয় বাঙালি জাতিকে। এ সংগ্রামে প্রথমেই আঘাত আসে বাঙালির মাতৃভাষার ওপর। মাতৃভাষা রক্ষার সংগ্রামে বাঙালির সহযাত্রী হয়ে কবিতা জেগে ওঠে এক শাণিত হাতিয়ার রূপে। কবিরা ক্ষুব্ধকণ্ঠে উচ্চারণ করেন : কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি (মাহবুব উল আলম চৌধুরী); স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তোমার? ভয় কি বন্ধু, আমরা এখনো/চারকোটি পরিবার/খাড়া রয়েছি তো! (আলাউদ্দিন আল আজাদ); আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি (আবদুুল গাফ্ফার চৌধুরী)। এসব কবিতার মিলিত সংগ্রাম বাঙালির জয়কে ত্বরান্বিত করে এবং সূচিত হয় বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রাম। সেই সংগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ- আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি। এখানে আমাদের কবিতা দেশের অকুতোভয় রাজনৈতিক নেতা ও মৃত্যুপণে বলীয়ান মুক্তিযোদ্ধাদের মনে জোগায় দেশপ্রেম; নির্ভয় বুকে ও সবল বাহুতে আনে অমিততেজ শক্তিমত্তা। যেমন, আমাদের রাজনীতির মহান কবি বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে সাতই মার্চ ধ্বনিত হয়: এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম; পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে জ্বলন্ত/ঘোষণার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে,/নতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগি¦দিক/এই বাংলায়/তোমাকে আসতেই হবে, হে স্বাধীনতা (শামসুর রাহমান)। আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)।

মাতৃভূমির স্বাধীনতার আনন্দহিল্লোলের মধ্যে উনিশশ পঁচাত্তরে হারিয়ে ফেলি আমাদের প্রিয় নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। একাত্তরের স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তি বাংলাদেশকে পাকিস্তানি ধারায় ফিরিয়ে নেয়ার অপপ্রয়াসে লিপ্ত হয়। সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর প্রতিবাদে কবিতায় জেগে ওঠে বাংলাদেশ : আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসি নি/...আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি/(নির্মলেন্দু গুণ); আবার তাঁর অমর কীর্তির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদিত হয় কবিকণ্ঠে : যতকাল রবে পদ্মা যমুনা/গৌরী মেঘনা বহমান/ততকাল রবে কীর্তি তোমার/শেখ মুজিবুর বহমান! (অন্নদাশঙ্কর রায়)।                

সমরতন্ত্রের উন্মাদনায় আর ভ্রষ্ট রাজনীতিবিদদের প্রবল আত্মস্বার্থ ও ভোগের লিপ্সায় বাংলাদেশ পতিত হয় সাধক লালন ফকিরের ‘কানার হাট বাজার’-এ। সামরিক জান্তা জেনারেল জিয়া ঘোষণা দিয়ে রাজনীতিকদের জন্য রাজনীতি দুরূহ করে তোলেন। সামরিক স্বৈরাচার এরশাদ দীর্ঘ সময় গণতন্ত্র ধ্বংসের সংকটকে আরও তীব্র এবং ভয়াবহ করে তোলেন। প্রতিবাদে ছাত্র-জনতা গড়ে তোলে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের তুমুল আন্দোলন। এক পর্যায়ে রাজনৈতিক আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে। এরশাদের হিংস্র থাবা বিস্তৃত হয় আবহমান বাংলার চিরায়ত সংস্কৃতি ও কবিতার দিকে। বাঙালির সকল জয়ের শিল্পিত ও সুন্দর সহযোদ্ধা কবিতার ওপর এরশাদের সামরিক দুঃশাসনের নগ্ন আঘাতের প্রতিবাদে বাংলাদেশের কবিরা বিক্ষোভে রাজপথে নেমে আসতে বাধ্য হয়। তখন ‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্যে কবিতা’- এই বাণীকে কণ্ঠে ধারণ করে, বাংলাদেশের নবীন-প্রবীণ কবিরা জাতীয় কবিতা উৎসব আয়োজন করে আন্দোলনে নতুন গতির সঞ্চার করে। কবিতাউৎসবমঞ্চ হয়ে ওঠে রাজনীতিক, সাংবাদিক, শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতিকর্মীসহ সব মানুষের উজ্জ্বল উদ্ধারের বাতিঘর।

এমনকি সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার যখন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে কারারুদ্ধ করে, তখন কবিতার নৈবেদ্য সাজিয়ে তার মুক্তির জন্যে এগিয়ে আসেন বাংলা ভাষার শুভবাদী কবিরা। প্রসঙ্গত একটি কথা না বললেই নয় যে, পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকান্ডের পর সমরতন্ত্রের ছোবলে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে, তখন থেকে কবি-শিল্পী-সংস্কৃতিকর্মী-বুদ্ধিজীবীরা প্রতিবাদে সংশপ্তকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে; লোভী ও ভ্রষ্ট রাজনীতিকদের পলায়নপর তৎপরতার কারণেই এমনটি হয়েছে; ব্যতিক্রম শুধু দৃঢ়চেতা নেত্রী শেখ হাসিনা। তাই, তার নামেও রচিত হয়েছে কবিতা: শেখ হাসিনা,  জনগণমননন্দিত নেত্রী/আমাদের শাশ্বত ফিনিক্স পাখি তুমি/অগ্নিস্নœানে শুচি হয়ে বারবার আসো/তুমি ভূমিকন্যা- তুমি প্রিয় মাতৃভূমি।’

বাংলার মাটিতে বঙ্গবন্ধু হত্যার, জেলহত্যার এবং একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে জাতি কলঙ্কমুক্ত হয়। বাংলাদেশ অনুন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উঠে আসে। দুই হাজার আঠারোর ডিসেম্বরে আসে আরেক যুদ্ধ, নির্বাচনের যুদ্ধ। এ যুদ্ধের সম্মুখসমরে অবতীর্ণ হতে ভয় পেয়ে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় দেশে ও বিদেশের মাটিতে। বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে বঙ্গবন্ধুকন্যার আহ্বানে দেশের কবি-শিল্পী-কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-শিক্ষক-নারীকর্মী-অভিনয়শিল্পী-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিকর্মীসহ সর্বস্তরের মানুষ লক্ষ শহীদের রক্তে রঞ্জিত স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হয়। তারা ছিনিয়ে আনে বিজয়। জাতির দীর্ঘ পথপরিক্রমায় এ এক নতুন বিজয় বাঙালির, নতুন বিজয় কবি ও কবিতার। বাংলাদেশে আর কোনো দিন যেন মুজিববিরোধী, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অন্ধকারের শক্তি মাথা তুলতে না পারে- এখন আমাদের সেই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়ার সময়। তাই, তেত্রিশতম জাতীয় কবিতা উৎসবের মর্মবার্তা আমরা ঘোষণা করেছি- বাঙালির জয়, কবিতার জয়। আসুন, বাংলার কবি ও বাংলা কবিতার হাজার বছরের দায়বদ্ধতাকে আমরা সেই লক্ষ্যে আরও শাণিত ও আরও প্রাণিত করে তুলি। জয় বাংলার, জয় কবিতার।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর