শুক্রবার, ৫ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

সাদা আলমারি

মেহযেব রহমান চৌধুরী

এক সময় এটি ছিল একটি পারিবারিক নিবাস। আলোকিত। জীবন্ত। এখন শুধু চূর্ণ ধ্বংসস্তূপ। কিছু সময়ের জন্য কাভেহ? ধ্বংসাবশেষের দিকে তাকিয়ে রইল। হঠাৎ মনে পড়ে গেল বাবা-মায়ের সঙ্গে সকালের নাশতার সেই আনন্দময় মুহূর্তগুলোর কথা। মা-বাবা ছিলেন আদর্শময় এক সুখী দম্পতি। বলা যায়, একে অপরের জন্য তৈরি। পারিবারিক সময় কাটতো হাসি-ঠাট্টায়। বাবা মাখনের আগে টোস্টে লাগাতেন জ্যাম। অদ্ভুত এক ব্যাপার। মা নিজের কফিতে দিতেন আশি শতাংশের বেশি দুধ আর বাকিটা চিনি। মনে হয় না কফির কোনো স্বাদ বাকি থাকত। তিনি পুরনো বইয়ের প্রথম সংস্করণ সংকলন করতেন। প্রতিটি বইয়ের দু’পাশে পিসবোর্ড দিয়ে তারপর প্লাস্টিকের মধ্যে আবৃত করে একটি সাদা আলমারিতে তুলে রাখতেন। কাউকে খুলতে বা ধরতে দিতেন না। ছোটবেলায় কাভেহ প্রায়ই জিজ্ঞেস করত, ‘যদি আমরা পড়তেই না পারি, তাহলে কেনার প্রয়োজন কি ছিল?’ মা হাসতেন। কাঁধে হাত রেখে বলতেন, ‘তুমি যখন বড় হবে, তখন বুঝতে পারবে।’

পটভূমিতে উচ্চরব বিস্ফোরণ। কাভেহ চমকে উঠল। হুমা রাইফেল হাতে দৌড়ে এলো তার কাছে। চেঁচিয়ে বলল, ‘বোম্ব’!। মাটিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল কাভেহ। আলোর উজ্জ্বল ঝলকানি। তারপর কর্কশ, চূরমার করা আওয়াজ। ঝাঁকুনি দেওয়া ক্যান থেকে যেমন কোমল পানীয় ছলকে পড়ে, ঠিক সেভাবেই যেন স্রাপ্লেল ও গর্দা ছিটকে পড়ল চারদিকে। মেশিনগান ফায়ার। চেঁচামেচি। তারপর আকস্মিক নীরবতা।

অগ্নিদগ্ধ একটি গাড়ির নিচে আশ্রয় নিল কাভেহ। কর্দমাক্ত পানিতে নিজেকে দেখে মনঃক্ষুণœ হলো। তার মুখের বাম পাশে একটি বিবর্ণ মেটাল প্লেট। ভিতরে অস্বস্তিকরভাবে বসে আছে কাচের চোখ। ঠোঁটের নিচ থেকে চোয়াল পর্যন্ত একটি বীভৎস দাগ। স্থলমাইন বিস্ফোরণে মাথার খুলির এক অংশ কুগঠিত। কি কদাকার আমি, সে ভাবল। হুমা তার ধাতুর তৈরি হাত দিয়ে গাড়ির নিচ থেকে টেনে উঠাল। রাগ করে বলল, ‘তুমি কি করছ! আমাদের এখন যেতে হবে!’

‘আমাকে উঠতে সাহায্য কর,’ ডান হাত বাড়িয়ে বলল কাভেহ।

হুমা তাকে টেনে তুলল। ‘এটা নাও,’ বলে একটি রাইফেল ধরিয়ে দিল। আঙ্গুল দিয়ে দেখাল থেমে থাকা একটি মিলিটারি হাম্ভি। গাড়ির দিকে এগোতে শুরু করল দুজন। আবার আরম্ভ হলো গুলিবর্ষণ। কোনোমতে ড্রাইভার সিটে উঠে বসলো হুমা। ইঞ্জিন গর্জে উঠল চাবি ঘুরানোর সঙ্গে সঙ্গে। বুলেট-প্রতিরোধী হওয়া সত্ত্বেও, কামানের তুমুল আঘাতে ফাটতে শুরু করল সামনের ও বাম পাশের কাচ।

‘আমার গ্রেনেড লঞ্চারটা নাও’, বলল হুমা। ‘ওদের উড়িয়ে দাও!’

কাভেহ হাম্ভির ছাদে আসন গ্রহণ করল। অস্ত্রটা ডান কাঁধের উপর রেখে তাক করল। উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সির একটি শব্দ ক্রমবর্ধমানভাবে উচ্চতর হয়ে ওঠল। মুহূর্তের মধ্যে একটি বুলেট তার ডান কাঁধে আঘাত হানলো। মৃতদেহের মতো সে পড়ে গেল যানটির ভিতর।

হুমা চিৎকার করে উঠল, ‘কাভেহ!’

তুমুল গুলিবর্ষণ। চোখ বন্ধ করে থাকলে সহজেই কল্পনা করা যেত কালবৈশাখী ঝড় হচ্ছে। কাভেহ গ্রেনেড লঞ্চারটি আবার উত্তোলন করতে চেষ্টা করল, কিন্তু মাত্র দশ সেকেন্ডেই যেন এর ওজন তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আরেকটি সমস্যা। টার্গেটিং স্কোপ এখন তার বাম পাশে। ওপাশের চোখ তো কাজ করে না। সে নেত্রচ্ছদ বন্ধ করল। আনুমানিকভাবে অস্ত্র তাক করে ট্রিগারে চাপ দিল। একটি পলাতক মাছির মতো উড়ে গেল গ্রেনেডটি। ফলস্বরূপ বিস্ফোরণ ছিল মাটি কাঁপানো। তারপর, সব শান্ত। শুধু চলন্ত ইঞ্জিনের শব্দ।

কাপড়ের পুতুলের মতো হাত-পা ছেড়ে হাম্ভির মেঝেতে পড়ে গেল কাভেহ। হুমা যানের গতি বৃদ্ধি করল। উভয় পাশের জানালা এখন খোলা। হুমার ঘন বেগুনি চুল বাতাসে ভাসতে শুরু করল। সূর্যাস্তের সুবর্ণ আলোকিকতায়, সে এক দেখার মতো দৃশ্য। দুই পৃথিবীর বাসিন্দা ছিল তারা। কিন্তু মাত্র কয়েক মাসেই বন্ধন হয়েছে অটুট। যুদ্ধের আগে কাভেহ ছিল ব্যাংক টেলার আর হুমা একজন বিখ্যাত অভিনেত্রী। সবচেয়ে অপ্রত্যাশিত জুড়ি। যদি কোনো ডেটিং অ্যাপে তাদের প্রোফাইল থাকতো হয়তো মিলের সম্ভাবনা হতো দশেরও কম শতাংশ। কিন্তু, পরিস্থিতির শিকারে গড়ে ওঠে অকাট্য বন্ধুত্ব। অটল অংশীদারিত্ব।

কাভেহ তাকিয়ে দেখলো তার কাঁধ থেকে তীব্র রক্তপাত হচ্ছে। ধীরে ধীরে ভারসাম্য হারাতে শুরু করল সে। কম্পিত হাত দিয়ে সেই সাদা আলমারিটি স্পর্শ করল। মায়ের নিজ হাতে আঁকা ফুলসজ্জা দেখে তার চোখে পানি। সেই আলমারিটি পুনরুদ্ধারের জন্য সে বিপন্ন করেছে সবকিছু। ছিটকিনিটা খুলতেই বেরিয়ে এলো কয়েক ডজন বই। দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিল কাভেহ। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো মা পাশেই বসে আছেন।

‘কাভেহ, তুমি কি ঠিক আছো?’ জিজ্ঞেস করল হুমা। কিন্তু কাভেহ তো হারিয়ে গেছে স্মৃতির মায়াজালে।

নিকটতম বইটি কুড়িয়ে নিল সে। এক যুগ আগে যেমন দেখেছিল ঠিক তেমনটিই আছে। কয়েক ফোঁটা রক্ত ঝরে পড়ল বইটির ওপর। প্লাস্টিকে সংরক্ষিত থাকায় একটি চিহ্নও লাগল না। কাভেহ হাসল। গাল দিয়ে একবিন্দু অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। বুকের উপর শক্ত করে চেপে ধরল বইটি।

ধীরে ধীরে অচৈতন্য হতে লাগল। হাম্ভির খোলা ছাদের দিকে নজর দিয়ে নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মা, আমি বুঝতে পারছি ...’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর