শুক্রবার, ২ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা

শিল্পী নিয়ে বিড়ম্বনা বিস্ময় আর অঘটন

ফরিদুর রেজা সাগর

শিল্পী নিয়ে বিড়ম্বনা বিস্ময় আর অঘটন

শিল্পীদের খেয়ালখুশির নানান গল্প আছে। সেসব গল্প এক কান দুই কান হয়ে আমাদের কানেও আসে। একেকজন শিল্পীর একেকরকম বৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্ট্য শিল্পীদের পরিচিতি উপস্থাপন করে আমাদের কাছে। এই বৈশিষ্ট্য নানারকমভাবে আমাদের কাছে ভিন্নমাত্রা তৈরি করে। আমাদের একজন বিশিষ্ট নাট্যকার রয়েছেন, বিখ্যাত নাট্যকার, তিনি তার নাটক যখনই লেখেন কখনোই সেই লেখা কলম দিয়ে লেখেন না। লিখতে পারেন না। তাকে যত দামি কলমই দেওয়া হোক সেটি তিনি দূরে সরিয়ে রাখেন কিংবা যত্ন করে ড্রয়ারে রেখে দেন।

পেন্সিল ছাড়া কখনোই তিনি একটি অক্ষরও লেখেন না।

পেন্সিলেই তার স্বাচ্ছন্দ্য।

পেন্সিল পেলেই এক মনে তিনি লেখেন। কাঠপেন্সিল আঙ্গুলে ধরলে তরতর করে তার লেখা এগোতে থাকে। আর থেমে থাকার দরকার হয় না। এক বসাতে লেখা অনেকখানি এগিয়ে যায়।

হুমায়ূন আহমেদ কিংবা ইমদাদুল হক মিলনের প্রসঙ্গে আসা যাক। তারা তাদের বেশির ভাগ লেখা লিখেছেন ভোরবেলায়। যখন চারদিকটায় একটু একটু করে আলো ফুটে ওঠে, চারপাশ থাকে নিরিবিলি, পৃথিবীর মানুষ ঘুমে প্রায় অচেতন, তখন তাদের কলম চলে। কাগজের পর কাগজ কালি-কলমের আঁচড়ে ভরপুর হতে থাকে।

ভোরবেলা ছাড়া তারা লিখতেই পারতেন না।

এবং হুমায়ূন আহমেদ অনেক ক্ষেত্রে চেয়ার-টেবিলে না বসে মেঝেতে বসে লিখেছেন। লেখার টেবিলের বদলে ব্যবহার করতেন লেখার টুল। জলচৌকি।

কথাশিল্পী রাবেয়া খাতুন লিখতে বসে তার পছন্দের চরিত্রগুলোর মুখোমুখি বসতেন। গান লেখা হোক, কি গল্প-উপন্যাস রচনা হোক, তার চরিত্রগুলোকে সামনে নিয়ে এলে তার লেখা আসত তরতরিয়ে। তার প্রিয় চরিত্রগুলো তার ভাবনায় এসে উপস্থিত হয়ে যেত। তার প্রিয় চরিত্রগুলো সমৃদ্ধ হতো তার লেখনিতে।

এমন অনেক লেখকের ক্ষেত্রে অনেক কিছু ঘটে!

আমি আবার এমনো সাংবাদিক-লেখকের কথা জানি, যেমন একজন, তার নাম হলো পিটু। পিটু তার নাম। বেশিরভাগ লোক তা মনে করেন। কিন্তু সত্যিকারভাবে পিটু নামটি ধারণ করছে একটি দৈনিক কাগজের চাকরির সূত্রে। দৈনিক পত্রিকায় দ্বিতীয় পাতায় যেসব লেখা ছাপা হতো- নানা খবর আর অনুষ্ঠানসূচি, সেসব লেখার সে সংগ্রাহক ছিল। ছিল জোগাড়দাতা। ছিল লেখক ও সাংবাদিক। অর্থাৎ পেজ টু’তে সে সাংবাদিকতা করেছে বলে শেষ পর্যন্ত ডাকাডাকি শুরু হয় পি-টু নামে।

সম্পাদক খুঁজতেন, ‘এই পিটু কোথায়?’

ওই ডাকাডাকির সূত্র হয়ে শেষতম নাম হয়ে গেল ওর পিটু।

আরেক সংগীতশিল্পীর কথা বলি। যিনি আমাদের সঙ্গে বিদেশ সফরে যান। শহর থেকে এয়ারপোর্ট প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূর। আর যে হোটেলে ছিলাম, তার থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরত্ব। ফেরার পথে সবাই এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেল। টাইম ধরে প্লেন ছাড়বে। বোর্ডিং পাস নিয়ে সবাই রেডি। শিল্পীটি আর পৌঁছান না। মাইকে ঘোষণা হচ্ছে। তাড়াহুড়া করে শিল্পী হাজির হলেন। লাগেজ দেওয়া হলো। তখনকার সময়ে নানারকম ফর্মালিটি। ট্যাক্স দেওয়া হলো নানারকম। চেক ইন করার জন্য লাইনে দাঁড়ালেন শিল্পী, পাসপোর্ট চাইতে শিল্পী বড় বড় চোখ করে আমার দিকে তাকালেন। ফিসফিসিয়ে আমাকে বললেন, ‘আমাকে বকা দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ আমি শিল্পী। শিল্পীদের ভুলোমন। আমার এরকম ভুল হতেই পারে।’

প্রশ্ন করলাম, ‘সেটা কেমন?’

শিল্পী অকপটে, নির্দ্বিধান্বিত গলায় বললেন, ‘পাসপোর্টটা আমি হোটেলের ড্রয়ারে ফেলে এসেছি।’

অবস্থাটা বোঝার চেষ্টা করলাম। নতুন করে ভিসা নিয়ে নতুন কোনো ফ্লাইটে ফিরতে হবে। অন্তত সেই চেষ্টাটুকু করতে হবে। কারণ, ৫০ কিলোমিটার ড্রাইভ করে হোটেলে ফিরে আবার এয়ারপোর্টে হাজির হতে হবে!

এ নিয়ে শিল্পীর কোনো উৎকণ্ঠা নেই। নির্বিকার গলায় শিল্পী তার পাসপোর্ট হোটেলে রেখে আমায় তথ্য দিলেন। এবং শিল্পীদের ক্ষেত্রে এটা হতেই পারে বলে জানান দিলেন।

আরেক খ্যাতিমান শিল্পী তপন চৌধুরী। মন্ট্রিলে থাকেন। মন্ট্রিল থেকে অনেকটা দূরেই তার আবাস। কানাডায় গেছি আমরা। তপন সেটা জেনে বললেন, আপনারা যখন মন্ট্রিল যাবেন, আমার বাড়িতে আগে যাবেন। সেখান থেকে ঘুরে মন্ট্রিল ফিরে নির্ধারিত বাড়িতে উঠে যাবেন।’

আমরা আমাদের দায়িত্বে টরেন্টো থেকে মন্ট্রিল রওনা হলাম। যা হয়, আমরা খাওয়া দাওয়া সেরে, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা মেরে যখন সময় ঘনাল, তপন বলল, আমাদের বাড়ি বেড়ানো শেষ। এখন বলুন কোথায় আপনাদের নামিয়ে দিতে হবে। মন্ট্রিলের কোন জায়গায় যাবেন বলুন, সে পর্যন্ত সঙ্গে যাই।

প্রায় আকাশ থেকে পড়লাম আমরা। সন্ধ্যা ৬টা থেকে বলছিলাম, চলো রওনা দেই। রাত হয়ে যাবে। এই যাই, এই যাই করে অনেক রাত হলো।

‘থাকেন আজ। কাল সকালে যাবেন।’ তপনের আবদার।

জানালাম, ‘না, না, কাল সকালেই ... মিটিং আছে।’

রাত ১টার দিকে তপন গাড়ি নিয়ে বের হলো। বলল, ‘গাড়িতে তো গ্যাস নেই।’ গ্যাস ভরা হলো কয়েক জায়গা ঘুরে। বেজে গেল রাত আড়াইটা। ভোর ৪টায় তপন যখন মন্ট্রিলে পৌঁছাল, জিজ্ঞেস করল, আপনাদের বাড়িটা কোথায়? ঠিকানা বলুন। আমার আবার এদিকটা বিশেষ চেনা নেই! জায়গাটা কোথায়?’

আমি শুকনো গলায় বললাম, ‘সেটা কোথায় আমি কী করে বলব। আমি তো চিনি না।’

তপন চৌধুরী শিল্পী। তারও নির্বিকার উত্তর। ‘আমি তো শহরে থাকি না। থাকি প্রায় মফঃস্বলে। আমি তো মন্ট্রিল পর্যন্ত আপনাদের নিয়ে এসেছি। ঠিকানা তো আমারও বিশেষ জানা নেই।’ ভোরের আলোতে চারপাশ নিঝুম। নিরিবিলি, সবাই ঘুমাচ্ছে। রাস্তাঘাট সুনসান। কাউকে জিজ্ঞেস করব উপায় নেই। দোকানপাট খোলা থাকলে জিজ্ঞেস করা সম্ভব!

কি বুদ্ধি করে শিল্পী তপন নিয়ে এলো মন্ট্রিল শহরে! সকাল পর্যন্ত গাড়িতে বসে ঝিমুলো। শহর জেগে ওঠার অপেক্ষা।

ক্ষিপ্ত হওয়ার উপায় নেই। শিল্পী বলে কথা! এরকম বিড়ম্বনা পদে পদে, তার ফিরিস্তি দেওয়া প্রায় অসম্ভব।

সর্বশেষ খবর