শুক্রবার, ২ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা

কবিকুলের এক পণ্যবীথি

শামীম আজাদ

কবিকুলের এক পণ্যবীথি

শামীম আজাদ

ঈশ্বর গুপ্ত লিখেছেন,

‘শিলা জলে ভাসি যায়

বানরে সংগীত গায়,

দেখিলেও না করিও প্রত্যয়।’

বিদেশ ঘুরে মাত্র এসেছি গতকাল। এখনো মগজের মোড়ে মোড়ে গ্রিক লাবণ্যগাঁথা বাজছে। কথায় কথায় মুখে চলে আসছে ‘এফখেরিস্তো’, ‘বারাকালা’। এমন উত্তেজনার কারণ পরে বলছি। আগে বলি জুনের জমাট বৃষ্টিপাত যখন একটু একটু করে বিলেতের বালিতে ভেঙে ভেঙে পড়ছে তখনই আমি ফিরেছি। বিশাল বপু আমাদের দালানের। দেড় শতাধিক ফ্ল্যাটের ঝাড়। সবগুলোর তুলে সমান জল দেওয়ার জন্য একটি দল আছে। আছে একটি স্থাপত্য ও সাদা অর্কিডে সাজানো বিশাল অভ্যর্থনা কক্ষ। প্রবেশ করতেই রিসেপশন ডেস্কে শুনলাম একটি পার্শেল আছে! সই করে হাতে নিয়ে বইজাতীয় কিছু হবে ভাবি- কিন্তু বেশ ভারী। প্রেরক বাংলাদেশ প্রতিদিন! বোঝা মাত্রই এক মুহূর্ত দেরি না করে কন্সিয়ার্জের সামনেই প্যাকেট খুলে ফেলি। লাফিয়ে পড়ে নতুন বইয়ের সুঘ্রাণ। আহ, কি চমৎকার একখানা পুরু ও পরিপূর্ণ একটি ঈদসংখ্যা! ডাকে আসা ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’ এর এই বিশাল উপহার পেয়ে আমি এমনই আপ্লুত হয়ে গেলাম যে আনন্দে অভ্যর্থনা ডেস্কের কর্মীর গালে চুমুই দিয়ে দিলাম। সে হতভম্ব।

মানে কি? তাহলে স্নেহভাজন মেহেদী যে ই-মেইলে আমার ডাক-ঠিকানা চেয়েছিল তা এর জন্য? আমি আব্দুর শাকুর শাহ-এর করা ফুলেল ও মসৃণ মলাটে হাত বোলাতে বোলাতে ভাবি, বিলেতে আমার প্রায় ৩০ বছর হয়ে এলো কিন্তু এতগুলো বছর গেলেও এবং দেশের পত্রপত্রিকার সাধারণ থেকে বিশেষ সংখ্যায় নিয়মিত ও নিরন্তর লিখে গেলেও এর আগে কেউ ডাকে আমাকে কোনো ঈদসংখ্যা পাঠায়নি। তিন-চার মাস পর দেশে গেলে পেতাম, বা কখনো পেতামই না। আহা আমি যে লিখে লিখে নিজ দেশের মানুষের হাতে হাতে ঈদের আগে পৌঁছাই এরই ভিতরে আছে সেই অত্যাশ্চর্য মধু। এতে পাব আমার দেশের নতুন কারা লিখছেন, পুরনোদের বন্ধুদের কি লেখা আছে? আমার বন্ধুদের সর্বশেষ উচ্চারণ কি? আর আছে আমার ‘বিগম’স স্টোরি’ নামের অদ্ভুত একটি অর্ধ সত্য গল্প। যেখানে গ্রিস পুরাণ সাঁতরে পৌঁছে গেছি মাইল্যান্ড মানসিক হাসপাতাল অবধি। এ সূত্রে বাংলাদেশ প্রতিদিন-এর সম্পাদক নঈম নিজামকে অভিনন্দন জানাই। তার যোগ্য নেতৃত্বে পত্রিকাটি বাংলাদেশের পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করেছে। ঈদসংখ্যা হাতে নিয়ে ফ্ল্যাটে প্রবেশ করে চা বানিয়ে চুমুক দিতেই মনে পড়লো এথেন্সের ‘কবিকুলের এক পণ্যবীথির’ কাছ থেকে কবি হিসেবে তাদের আবাসিক কবির পদ লাভ করাটাও ছিল এমনি চমক। কিন্তু প্রত্যয় না করে উপায় ছিল না। কম্পিউটারের পর্দায় পরিষ্কার ফুটে উঠেছিল ই-মেইলটি। অ জবংরফবহপু রহ চড়বঃৎু ধঃ চড়বঃ’ং ধমড়ৎধ, চষধশধ, অঃযবহং!

 

সেদিন লন্ডনে ভোর ছিল। আমার লেখার টেবিলের কাচের ফুলদানির তিনটি টিউলিপ ছাড়িয়ে দৃষ্টি চলে গিয়েছিল বাইরে, আবছা আলোতে। যেখানে বাগানের ঝোপের মাথাগুলো বাংলাদেশের কচি আমপাতার মতো লাল হয়েছিল। আর আমি বার বার ই-মেইল পড়ে ওই ইটলাল কিশলয় দেখে মনে মনে বলছিলাম ঐ বাংলাদেশ, আমার অভিজ্ঞান, আমার ঠিকুজী। সাহিত্য বিষয়ে এত বড় পাওয়া আমাকে বিহ্বল করে ফেলে। শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সভ্যতা, বিজ্ঞান ও স্থাপত্য, রাজনীতি ও গণিতের অন্যতম জন্মভূমি ঐতিহাসিক গ্রিস থেকে পাওয়া এ জাতীয় একটি অনন্যসাধারণ সম্মানীয় আবাসিকত্ব! ভাবা যায়? কিন্তু ভাবা শুধু গেল না করাও গেল।

পুরো মে মাস আমার আবাস হলো এথেন্সের ঐতিহাসিক অংশ প্লাকার ১৮০১ সালে নির্মিত নিওক্ল্যাসিকাল একটি দ্বিতল বাড়ির দোতলায়। বাড়িটিও ঐতিহাসিক, কারণ সামরিক জান্তার রোষানল থেকে বাঁচতে অনেক স্বাধীনচেতা শিল্পী-সাহিত্যিক এখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। বাইরে রাস্তায় যখন মিলিটারি জান্তা গোটা শহরের কৌমার্য হরণ করে যাচ্ছে তখন এর অন্ধকার বেইসমেন্টেই কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী জর্জ মারিনোসের শুরু হয় ক্যারিয়ার। এখান থেকেই পলি পনোভ গলা নামিয়ে মৃদু গুঞ্জনে গেয়েছেন তার গান। বাতি নিভিয়ে ফায়ার প্লেস ঘিরে বসে অ্যাটিভিস্টরা লিখেছেন গোপন ইশতেহার। এরকম সব অবিশ্বাস্য তথ্য জানার পর এ বাড়ি নিয়েই লিখতে লিখতে কতদিন ঘুমিয়ে পড়েছি আর জেগে ছাদে অটোম্যান সময়ের কারুকাজের দিকে বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে থেকেছি! বাথরুম থেকে ফিরে বেইসমেন্টের কাঠের সিঁড়ির অন্ধকারে তাকিয়ে তাদের ফিসফাস শুনেছি! হয়তো পরদিন রোমান আমলের পাথুরে অ্যাগোরায় ঘোরাঘুরি করে বা খ্যাতনামা লেখক আলিশা ই স্টার্লিং কিংবা কবি অর্ফিয়ূস অ্যাপার্গিস-এর সঙ্গে মতবিনিময় করে বাড়ি ফিরে বেলকুনিতে চা হাতে নিয়ে অদূরেই দেখেছি অবিশ্বাস্য বাস্তব- সোনার পাহাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে আছে পার্থেনিন। এক অপার্থিব সৌন্দর্য! শেষ রাতে বিছানা ছেড়ে দৌড়ে বেলকুনিতে দেখতে গেছি সন্ধ্যায় যা দেখেছিলাম তা এখনো আছে কিনা? তা সত্যি না ঘোর। লিখতে লিখতে জানালা দিয়ে গ্রিসের গরম হাওয়ায় ভেসে এসেছে বাইরের ওই ৫০ বছরের পুরনো প্লেইনন্ট্রি গাছের নিচ থেকে গিটার ও বৃদ্ধ গায়কের করুণগাঁথা।

আবাসিকত্বের মাত্রিকতা বা লক্ষ্য ছিল তিনটি। এক, আমি ওদের সম্মানিত অতিথি। তাই অ্যা পোয়েটস অ্যাগোরারই সৌজন্যে দিতে হবে দুটি বক্তৃতা। নৈশভোজসহ নানানভাবে পরিচিতি ও সংযোগ ঘটবে গ্রিসের সম্মানিত কবিকুলের সঙ্গে। দুই, ঐ আবাসিকত্ব আমাকে আমার চিন্তা-চেতনার, লেখালেখির একটি ভাবনাবিহীন নির্জন সুযোগ দেবে। জানতে পারব গ্রিস সাহিত্যের ইতিহাসসহ তার সমসাময়িক অবস্থান। তিন, ঐ সুযোগে আমাকে লিখতে হবে কিছু ইংরেজি কবিতা, যার ভাষান্তর হবে তাদের ভাষায়। প্রকাশিত হবে অ চড়বঃং অমড়ৎধ’র প্রকাশনীতে। আমি তার সব সফলভাবে করে বিলেতে ফিরেছিলাম। কিন্তু দেশের একটি ঈদসংখ্যা পেয়ে মনে হলো এর মিষ্টত্ব তারচেয়ে কোনো কম নয়। আমার হাতে আমার মুঠোয় ময়নামতি!

আসলে কি জানেন? দেশ থেকে এত দূরে আছি, দেশের অনেক সাহিত্যিক সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলেও আমার এই দীর্ঘ তিন দশকে এদেশে যা প্রাপ্তি হয়েছে তার কিছুই হতো না আমার বাংলাদেশের পাঠকের মায়া-মমতা আর প্রণোদনা না পেলে। তাই ভাগ্য মানি এ সম্মান আর সুযোগ পওয়ার জন্য, নমিত আমার পাঠকদের কাছে। ধন্যবাদ হে ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’। ধন্যবাদ তোমার বদান্যতা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর