শিরোনাম
শুক্রবার, ৯ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা

চকোলেট শপে ডারেথির প্রস্তাব

মঈনুল সুলতান

চকোলেট শপে ডারেথির প্রস্তাব

পায়োনিয়ার ভ্যালির ফ্রি বাস

যুক্তরাষ্ট্রের পায়োনিয়ার ভ্যালিতে বাসে চড়ে শপিং অথবা অত্র এলাকার কোনো কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে যেতে পয়সাকড়ি কিংবা টিকিট-ফিকিটের প্রয়োজন পড়ে না। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, দরিদ্র হালতে দিন গোজরান করি, তাই ফ্রি বাসেই আমাকে যাতায়াত করতে হতো। এরকম একদিন সামার সিজনের দুপুর বেলা আমহার্স্ট শহরের বাসস্টপে দাঁড়িয়ে থাকা একটি বাসে বসে হ্যাম্পশেয়ার গেজেট বলে স্থানীয় পত্রিকা পড়তে শুরু করেছি। লাঞ্চের সময়- তাই বাসে প্যাসিনজার একেবারেই নেই, শুধু এক কোণে এক হোমলেস মহিলা পলিথিনের বৃহৎ ব্যাগে সংসারের টুকিটাকি বিস্তর মালসামান নিয়ে চুপচাপ স্ট্রো দিয়ে ডায়েট কোক খাচ্ছেন। আচমকা কে যেন আমাকে জিজ্ঞেস করে, ‘হাই, হাউ আর ইউ ডুয়িং টুডে?’ পত্রিকা থেকে চোখ তুলে তাকাই।

খুব সস্তা স্কার্টের সঙ্গে মলিন ব্লাউজ-টপ পরা একটি অল্পবয়সী মেয়ে আমার পাশে বসে আমার চোখে সরাসরি চোখ রেখে বলে, ‘ম্যান, ইউ লুক সো হ্যাপি অ্যান্ড পিসফুল, হোয়াই আই ক্যান্ট বি হ্যাপি লাইক ইউ?’ জবাব দিতে গিয়ে একটু চিন্তা করি। হয়তো এ মেয়েকে আগে কখনো এ বাসে চড়তে দেখেছি। শ্বেতাঙ্গিনী এ মেয়েটি হোমলেস নয়, তবে সে যে খুব দরিদ্র তাতে কোনো সন্দেহ থাকে না। তার লাল চুলে অনেকদিন ধরে শ্যাম্পু ও কন্ডিশনারের ছোঁয়া পড়েনি। তার দৃষ্টির অস্থিরতা আমাকে অবাক করে। কোনো মানসিক ব্যাধিতে সে কি আচ্ছন্ন হয়ে আছে? তারপরও শালীনতা বজায় রেখে জানতে চাই, ‘তা তুমি কেমন আছ আজ?’ ‘নো, নট রিয়েলি হেভিং অ্যা গুড ডে। আই অ্যাম ফিলিং ভেরি স্যাড,’ বলে সে আমার দিকে বুঝি খানিক সিমপ্যাথির জন্য দুচোখ ভারি করুণ করে তাকায়। না, সুশ্রী সে নয় একেবারেই, উপরন্তু তার অত্যন্ত অগোছালো শরীরে পোশাকের জীর্ণতায় স্পষ্টত অস্বাভাবিকতার ছাপ। বাসে প্যাসিনজার তেমন নেই, এ সুযোগে সে খুব খোলামেলা ভাবে তার নিজের কথা বলতে শুরু করে। ‘ইউ নো, ইয়েসটারডে ওয়াজ মাই বার্থডে, কিন্তু আমার কোনো চাকরি-বাকরি নেই তো, তাই আমার স্টেপ ফাদার কোনোভাবেই আমাকে বার্থডে সেলিব্রেট করতে দেবে না। আমার স্টেপ সিস্টারের বার্থডেতে কত কেক কত মোমবাতি... ... আই অ্যাম ফিলিং লাইক রিয়েলি স্যাড।’ আমাদের বাসটি কে-মার্ট বলে শপিংচেইনের একটি দোকানের সামনে এসে দাঁড়ায়। মেয়েটি আবার কথা বলে, ‘আই অ্যাম সো স্যাড, বাট, ইউ নো, টুডে আই অ্যাম অ্যাপ্লাইয়িং ফর অ্যা জব অ্যাট দ্য কে-মার্ট,’ বলে সে বিষণ্ন মুখে নেমে যায় বাস থেকে।

মাস খানেক পর আমি কে-মার্টে একদিন আসি, সস্তায় সেলস থেকে জিন্স আর স্নিকার্স কিনতে। বিল পে করার সময় কাউন্টারে তার সঙ্গে আবার দেখা হয়। ইউনিফর্ম পরে টেলার মেশিনে সে ভাঙতি পয়সা গুনছিল। তার টপে কালো স্টিকারে নামটি লেখাÑডারোথি। সে আমাকে চিনতে পেরে টেলার ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসে কথা বলার জন্য। আমি তাকে উৎসাহ দিয়ে মন্তব্য করি, ‘ওকে, ডারোথি, ইউ হ্যাভ অ্যা নাইস লিটিল জব নাউ, আর ইউ হ্যাপি?’ আমার এ প্রশ্নের জবাবে সে ভিন্নভাবে উত্তর দেয়, ‘নট রিয়েলি, সমস্যা হচ্ছে, আমার বয়সী মেয়েদের সবার বয়ফ্রেন্ড আছে, আমি বেশ কয়েকটা ছেলেকে প্রপোজও করেছি, তারা মনে করে... আই অ্যাম লাইক রিয়েলি আগলি। সো এগেইন আই অ্যাম ফিলিং ভেরি স্যাড’। আমি তাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে বলি, ‘আই ডোন্ট থিংক ইউ আর আগলি অ্যাট অল, ডারোথি। দেখতে তো তুমি বেশ ভালোই।’ বিষণœভাবে তাকিয়ে, ‘ম্যান, ইউ আর সো নাইস, টু নাইস, কেউ তো আমাকে এরকম করে কিছু বলে না কখনো,’ বলে সে আমার হাত চেপে ধরে দুচোখ করুণ করে বলে, ‘ক্যান আই আস্ক ইউ অ্যা ভেরি স্মল ফেভার?’ আমি জবাব দেই, ‘সার্টেনলি ডারোথি, গো এহেড।’ সে খানিক ইতস্তত করে বলে, ‘প্লিজ... ডোন্ট সে নো ম্যান... প্লিজ, আস্ক মি ফর অ্যা ডেট। শুধু একদিন। আমাকে গাড়িতে করে জয়-রাইড দেবে, তারপর ফোর সিজনস রেস্টুরেন্টে আমরা জ্যাজ মিউজিক শুনতে শুনতে ডিনার করব।’ আমি সাবধান হয়ে একটু চিন্তা করি। তার মৃদুস্বরে জানাই, ‘রিয়েলি স্যরি ডারোথি, আই অ্যাম সো স্যরি, দেয়ার ইজ অ্যা প্রবলেম, আমার তো গাড়ি ফাড়ি কিছু নেই, তোমাকে জয়-রাইড দেবো কী ভাবে? তারপর ফোর সিজন রেস্টুরেন্টে যেতে যে অনেক খায়-খরচা আছে?  প্লিজ বিলিভ মি... আমার তেমন কোনো আয়-ইনকাম নেই, কি করবো বলো, স্যরি, তুমি কিছু মনে করো না প্লিজ।’

কাস্টমাররা লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে, আর ডারোথি ডিউটি না করে আমার সঙ্গে কথা বলে চলছে, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে এ রকমের আচরণ সঠিক না, তাই কে-মার্টের একজন সিনিয়র কর্মচারী এসে ডারোথিকে ডেকে ম্যানেজারের রুমে নিয়ে যান। মেয়েটিকে হয়তো ম্যানেজার রূঢ়ভাবে বকবে, এমন কি চাকরি নট করার ওয়ার্নিংও দিতে পারে। তার ওয়ার্ক আওয়ারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খমোকা কথা বলার জন্য নিজেকে দোষারোপ করি।

আবার কিছুদিন পর তার সঙ্গে আরেক দফা দেখা হয় সান্ডারল্যান্ড শহরের এক বনেদি চকোলেটের ফ্যাক্টরিতে। আমি সুগারহীন কাজুবাদাম চূর্ণের প্রলেপ দেওয়া ডার্ক চকোলেটের সন্ধানে শেলফগুলোর চারদিকে খোঁজাখুঁজি করছিলাম। দেখি, দোকানের শোকেসের সামনে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে চকোলেট বার দেখছে আমার এক চায়নিজ-আমেরিকান ক্লাসমেট। মেয়েটি দর্শনে সিগ্ধ ও বাচনে সদালাপি। আমি দাঁড়িয়ে পড়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করি। সে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে ‘হাই দেয়ার’ বলে চকোলেটের দাম পে করার জন্য হেঁটে যায় ক্যাশ কাউন্টারের দিকে। কেন জানি বিব্রত হয়ে চলে আসি দোকানের পেছনের দিকে। দেখি, একটি বড়সড়ো টেবিলে আরও দুটি প্রতিবন্ধী মেয়ের সঙ্গে বসে ডারোথি গভীর মনোযোগের সঙ্গে লিকুইড চকোলেট সসে তাজা স্ট্রবেরি চুবাচ্ছে। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই সে এপ্রোনে হাত মুছে কথা বলার জন্য উঠে আসে। জানতে পারি, হ্যাঁ, কে-মার্টে প্রথমে তাকে ওয়ার্নিং দেওয়া হয় কাস্টমারদের সঙ্গে অযথা কথাবার্তা বলার জন্য। তারপর একদিন তাকে ফায়ার করা হয় কাজ থেকে। খানিক খোঁজাখুঁজি করে সে অবশেষে এ চকোলেটের ফ্যাক্টরিতে কাজ পেয়েছে। কথা বলতে বলতে তার চোখে এমন এক বিষাদময় এক্সপ্রেশন ফুটে ওঠে যে, আমার মনে হতে থাকে, সে ডিপ্রেশন কিংবা ডাউন সিনড্রোমে ভুগছে। অথবা হতেও পারে যে- বয়সানুযায়ী তার বুদ্ধিবৃত্তির সম্পূর্ণ বিকাশ হয়নি। আমি তাকে কাজে ফিরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করি। কিন্তু সে চুপচাপ নতমুখী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। চোখের টলমলে জল টপের আস্তিনে মুছে অতঃপর সে আমার হাত চেপে ধরে অনুনয় করে বলে, ‘ম্যান, নেক্সট উইকে ভেলেন্টাইন ডে, সব মেয়ে তাদের বয়ফ্রেন্ডের কাছ থেকে উপহার হিসেবে পাবে ফ্যান্সি চকোলেট বার আর গ্রিটিংস কার্ড। লুক, আমার তো কেউ নেই, কেউ আমাকে কিচ্ছু দেবে না। কুড ইউ বি নাইস অ্যান্ড কাইন্ড ফর ওয়ান ডে?’ বলেই সে এপ্রোনের নিচ থেকে বের করে পিংক রিবনে মোড়া একটি চকোলেটের প্যাকেট। তা আমার হাতে তুলে দিয়ে বলে, ‘লিসেন, আই ডিডন্ট স্টিল ইট, ভেলেন্টাইন ডে উপলক্ষে কর্মচারীদের সবাইকে এক প্যাকেট করে ফ্রি চকোলেট বার দেওয়া হয়েছে। প্যাকেটের সঙ্গে একটি কার্ডও এটাচড করা আছে। তোমাকে পয়সা খরচ করে চকোলেট কিনতে হবে না, শুধু কার্ডে সুন্দর দুটি শব্দ লিখে আমার হাতে দিয়ে দিলেই হবে। আই নো ইউ উইল ডু ইট ফর দিস ভেরি পুওর.. ভেরি স্যাড গার্ল।’ বলেই ডারোথি এপ্রোনে হাত মুছতে মুছতে ফিরে যায় কাজে।

ফ্যাক্টরির একজন সিনিয়র গোছের কর্মচারী উঁকি দিয়ে দেখেন, ডারোথি কার সঙ্গে এত কি কথা বলছে? সে ততোক্ষণে কাজে ফিরে গিয়ে চকোলেট সসে স্ট্রবেরি চুবাতে লেগে গেছে। যাক, ডারোথি খানিক চালাক হয়ে উঠেছে দেখে খুশি হয়ে ফ্যাক্টরি থেকে বেরিয়ে আসি। পায়োনিয়ার ভ্যালির ফ্রি বাসের জন্য অপেক্ষা করতে করতে ভাবি, তাকে ভেলেন্টাইনের দিনে চকোলেট উপহার দিলে সে যদি আরও বড় ধরনের সম্পর্কের ইঙ্গিত হিসেবে তা গ্রহণ করে, তাহলে তো মুশকিলই হবে। বাসে বসে - কার্ডে সুন্দর করে কিছু লিখে দেয়াতেও খানিক যে রিস্ক আছে, তা নিয়ে ভাবি, কিন্তু তাকে যদি চকোলেট উপহার না দেই, তাহলে কী একটু নিষ্ঠুরতা হয়ে যায় না?

সর্বশেষ খবর