শুক্রবার, ১৬ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা

পুরস্কার

হোসেন আবদুল মান্নান

পুরস্কার

কী আশ্চর্য! এর কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। চার দশকের অধিক সময় পরে সম্প্রতি হঠাৎ এটি পেয়ে যাই। গ্রামের বাড়িতে পূর্বপুরুষের কিছু আসবাবপত্র যেমন আলমিরা, সিন্দুক, কাঠের বাক্স ইত্যাদি নাড়াচাড়া করতে গিয়ে অতি পুরনো কাগজপত্র, পত্রিকা ও ছোট ছোট পুস্তিকার ভিতরে পড়েছিল এটি। এর আয়তন এতই ক্ষুদ্র যে আকস্মিকভাবে কারও নজরে না পড়ারই কথা। প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয় মালপত্র সরিয়ে নতুন ঘরে উঠানোর দায়িত্বে থাকা দুজন কাজের লোকের মধ্যে একজনের নাম নজু। সে একটি বড় ছালার বস্তায় ঢুকিয়ে আবর্জনা হিসেবে এসব বাইরে ফেলে দিতে যাওয়ার পথে বুদ্ধিমানের মতো আমাকে জানালো-

ভাইজান,

এইতা সব ফালাইয়া দেই,

পুরান, কোন কাজে লাগবো না

আমি বললাম, না, তুই বুঝবি না,

বই জাতীয় কিছু থাকলে আমাকে দেখাবি, মনে রাখিস কিন্তু-

নজু তা’ই করলো।

একটু পরে সে আমাকে পুরো ছালার বস্তাটি দেখাতে নিয়ে এলো। যেই আমি বলতে গেলাম যা ফেলে দিয়ে আস, এমনি হঠাৎ প্রায় ছেঁড়া একটি পত্রিকার ভিতর থেকে দেখতে পেলাম বিন্দুর মতো লেখা। তাৎক্ষণিকভাবে বললাম, ওই লাল ছোট্ট বইটি দে তো। নজু আমার হাতে বইটি তুলে দিতেই চমকে উঠি। আমি বিস্মিত। চোখ কপালে উঠে গেল। কোথায় ছিল এটি জিজ্ঞেস করলাম নজুকে। সে সাদাসিধে উত্তর দেয়, বড় সিন্দুকের একদম তলে পইড়াছিল ভাইজান।

বইটির পৃষ্ঠাগুলো কেমন যেন হলদে বর্ণের হয়ে গেছে। বেশ কিছু পৃষ্ঠা জমাট বেঁধে আছে। আমি ধীরে ধীরে উল্টানোর চেষ্টা করলাম। আমার স্মৃতি বিজড়িত এমন বইটি পেয়ে সহসা যেন দারুণ নস্টালজিক অনুভব করছি। নজু আমার দিকে তাকিয়ে কি যেন বলছে। সে হয়তো ভাবছে, এমন পিচ্ছি একটি বই পেয়ে ভাইজান এতো খুশি হইলো কেন? কত বড় বড় বই ওনার ঘরে পইড়া আছে ইত্যাদি।

সাহস করে নজু বলেই ফেলে-

ভাইজান এই বইটা কি কামের নাকি,

বইটা আপনে খুব যতœ করতাছুন যে

হয় এটা অনেক দরকারি বই। বুঝতে পারছিস-

আমার স্কুল জীবনের প্রথম পুরস্কার পাওয়া বই।

কোন দিন ভাবিনি এই বইটা আবার আমার হাতে আসবে।

নজু, বলেন কী ভাইজান!

আমি তো ফালাইয়াই দিছিলাম।

আল্লাহর রহমত ভাইজান,

আপনি সামনে না থাকলে তো জিজ্ঞাসই করতাম না। সোজা ধান খেতের কোনায় ফালাইয়া দিয়া আসতাম।

কী উপায় অইতো ভাইজান?

আমি নজুকে অন্যত্র চলে যেতে বলি। এবার আমি বইটির ভিতরে প্রবেশ করি। প্রথম কভার পৃষ্ঠা উল্টাতেই দেখি নিজের হাতে লিখা আমার নাম, চাতল বাগহাটা হাই স্কুল, নবম শ্রেণি, রোল নং-০১।

মোলায়েম হাতে ভিতরের পৃষ্ঠাগুলো খুলতে থাকি। দেখলাম সব ক’টি পৃষ্ঠা একত্রে লেগে নিই। কিছু কিছু খোলা আছে। পৃষ্ঠা সংখ্যা খুবই কম। মোট ষাট পৃষ্ঠার মতো। তবু এটি একটি জনপ্রিয় উপন্যাস। উপন্যাসও যেনতেন কোনো লেখকের নয়। বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তি অমর কথাশিল্পী, সর্বকালের জনপ্রিয় লেখক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘বিন্দুর ছেলে’।

চোখের সামনে স্পষ্ট মনে পড়ছে, চাতল বাগহাটা হাই স্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় স্কুল কর্তৃপক্ষ মহান বিজয় দিবস উদযাপন করেছিলেন। সত্তর দশকের শেষদিকে ময়মনসিংহ জেলার গ্রামীণ একটি হাই স্কুলের সামর্থ্য অনুযায়ী যতটুকু সম্ভব তেমনি ছিল সেদিনের সে অনুষ্ঠানের মান ও সাজসজ্জা। মাঠের প্রান্তে সবুজ ঘাসের উপর একটি ছোট মঞ্চ করে অপরাহ্ণে হামদ-নাত, কবিতা, গান, কৌতুক, যেমন খুশি তেমন সাজো ইত্যাদি উপস্থাপন করা হয়েছিল। তখনকার বেশ কিছু ছাত্রছাত্রী এসবে স্বতঃস্ফূর্ত অংশ নিয়েছিল। সন্ধ্যায় পুরস্কার বিতরণের পালা। তবে সকালের খেলাধুলার ইভেন্টে দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে আমি দু’বার প্রথম ও দ্বিতীয় স্থান পেয়ে কাঠের তৈরি বিজয় মঞ্চে দাঁড়িয়েছিলাম। এর জন্য দুটো হলুদ তোয়ালে পুরস্কার পেয়ে ভীষণ আনন্দিত হয়েছিলাম। তবে বিকালের পর্বে আমি কোন কিছুতে অংশ না নিলেও পুরস্কার বিতরণকালে আমার নামও ঘোষণা করা হয়। মঞ্চে গিয়ে পুরস্কার গ্রহণ করার সময় প্রধান শিক্ষক প্রয়াত শাহ্ শামছুদ্দিন স্যার বললেন, এটি তোকে দেওয়া হলো ক্লাসের ফার্স্ট বয় হিসেবে। আমি সানন্দে স্যারের হাত থেকে বইটি গ্রহণ করেছিলাম। রঙিন পাতলা কাগজে মোড়ানো ছোট এ বইখানা পেয়ে সেদিন আমি তেমন কোনো বাড়তি উৎসাহ প্রদর্শন করিনি। স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথেই মলাট উন্মোচন করে দেখি নাম ‘বিন্দুর ছেলে’। পাঠ্যবইয়ের বাইরে তখনো খুব একটা বেশি কিছু পড়া হয়নি। নিজের হাতে পাওয়া বা অর্জিত এ শরৎ কাহিনিই প্রথম। সেদিন বিন্দুর ছেলেকে বাড়িতে নিয়ে এসে স্কুলের পাঠ্যবইয়ের পাশে অনেকটা অবজ্ঞায় রেখে দিয়েছিলাম। মনে পড়ছে, তখন বা এসএসসির পর দু’য়েকবার হয়তো পড়া হয়েছিল। তবে সে সময় গভীর আবেগ তাড়িত হয়ে অশ্রু বিসর্জনের মাধ্যমে পড়েছিলাম অন্য এক কাহিনি যা এক সময় প্রায় সব শিক্ষিত বাঙালি মুসলমানকে অনায়াসেই কাঁদিয়েছিল। মীর মশাররফ হোসেনের অমর সৃষ্টি ‘বিষাদ সিন্ধু’ যা আমাকেও অনেকবার কাঁদিয়েছিল। সেকালে বাড়িতে দু’একবার আমার মাকেও পড়ে শুনিয়েছিলাম। মাঝে মধ্যে এ কাহিনি আমার মাও অন্য মহিলাদের পাঠ করে শোনাতেন।

প্রায় চার দশক পরে বইটি হাতে পেয়ে জায়গায় বসেই পড়তে শুরু করি। কোনো পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই পড়া। এদিক ওদিক কোথাও তাকাচ্ছি না। আসলে গল্পের ভিতরে প্রবেশ না করলে প্রকৃত অর্থে পড়া হয়ে উঠে না। তাই শতভাগ মনোনিবেশ। ছুটির দিন তাও গ্রামের বাড়ি এসে বকুলের সবুজ শাখার ছায়ায় বসে বইয়ের পাতায় আমার দৃষ্টি। সচরাচর এমন পাঠাভ্যাস আমার নেই। তবু এগিয়ে যাচ্ছি। ভাবছি, স্কুলজীবনে কিছুটা পড়লেও কাহিনিটি মনে পড়ছে না। আরও ভিতরে যাচ্ছি। মাঝে মধ্যে নজু সামনে দিয়ে আসা যাওয়া করলেও আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করে পাঠে ব্যাঘাত ঘটানোর মতো দুঃসাহস তার নেই। দেখছি, গল্পটিতে চার-পাঁচ পৃষ্ঠা পরপর পর্ব ক্রমিক দেওয়া রয়েছে। এতে পাঠকের সুবিধা হয়। মোট নয়টি পর্বে বিভক্ত বিন্দুর ছেলে। আমার সর্বোচ্চ সময় লেগেছে দুই ঘণ্টা। পড়া শেষ করে বইটি হাতে নিয়েই ভাবছি শরৎ বাবুর বেশ কিছু তো পড়েছি, বিশেষ করে ছাত্রাবস্থায় পাঠ্যসূচির কারণে বিলাসী, মহেশ, সমুদ্রে সাইক্লোন, বামুনের মেয়ে, পথের দাবী বা কালজয়ী শ্রীকান্তের কথা তো বলাই বাহুল্য এর অন্য পর্বগুলোও পড়েছি। অথচ প্রথম জীবনে পাওয়া এমন মহামূল্যবান উপহারটির কথা বেমালুম ভুলে ছিলাম কীভাবে!

কাহিনিতে অসাধারণ এক পারিবারিক জীবনগাঁথা বর্ণিত হয়েছে। বস্তুত, এমনটিই ছিল তৎকালীন বাংলা এবং বাঙালির সমাজচিত্র। যাদব মুখুয্যে এবং মাধব মুখুয্যে দু’ভাই। তারা সহোদর না হয়েও কী অসীম মানবিকতা দিয়ে বড়দা ছোট ভাইকে উচ্চশিক্ষিত করে বড় উকিল বানিয়েছেন। নিজের ছোট চাকরি এবং সংসারের অনেক স্বাদ-আহ্লাদ সবকিছু বিসর্জন দিয়ে ছোট ভাই মাধবকে নামকরা লয়ার বানিয়ে বিত্তশালীর কন্যাকে তার বউ হিসেবে ঘরে আনেন। সুন্দরী বিন্দুবাসিনীর সঙ্গে দশ হাজার টাকাও গ্রহণ করা হয়। যার মাধ্যমে সমাজে যাদবের পারিবারিক অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন আসে। এদিকে বিন্দুবাসিনীকে ছোট বৌঠান করে ঘরে আনলেও অনেক দিন তার কোনো সন্তান হচ্ছে না। বড় বৌ অন্নপূর্ণা ছোট বৌঠানকে আদর যত্ন করে সারাক্ষণ আগলে রাখলো। এমন কি নিজের সন্তানকে তুলে দিয়ে লালন পালন করার সুযোগ করে দিল। বড় বৌঠান তার দেড় বছরের ছেলে অমূল্যচরণকে ছোট বৌ বিন্দুর কোলে তুলে দিয়ে একত্রে বোনের মতো সংসার যাপন করছে। যেন অন্নপূর্ণা নয়, ছোট মা বিন্দুবাসিনীই অমূল্যের প্রকৃত মা। কাহিনি শেষ করে রবি ঠাকুরের বিখ্যাত ‘দেবতার গ্রাস’ কবিতাটির কথা মনে পড়ল। ওই যে নাবালক ছেলে রাখালের অন্নদা মাসির মতো। মা’র চেয়ে মাসিই যেন সব। বাঙালি জীবনে এ চিত্র সর্বত্রই ছিল। আজো এ দেশে এর ছিটেফোঁটাও যে নেই তা বলা যাবে না। কাহিনি হলো বিন্দুর ছেলে বিন্দুর নয়, বড় বৌঠান অন্নপূর্ণার।

পড়া শেষ করে বই হাতে নিয়েই বাড়ির ভিতরে যাই। সবাই মধ্যাহ্নভোজের জন্য অপেক্ষমাণ। ডাইনিং টেবিলে বসে আমার স্ত্রী জেবুকে সেই স্কুলে প্রাইজ পাওয়া বিন্দুর ছেলের কাহিনি বলি। সেও অবাক হয়ে, জিজ্ঞেস করেÑ

এতদিন কোথায় ছিল এটি?

বললাম, বাবার পুরোনো সিন্দুকের নিচে।

তা হলে এতক্ষণ কি তুমি এটিই পড়ছিলে?

হ্যাঁ, তা’ই।

বললাম, শোন, বইটি সযত্নে ঢাকার বাসায় নিয়ে যাব।

সেখানে আমার শেলফে রক্ষিত বৃহদাকার শরৎ রচনাবলী’র দু’খ-ের সঙ্গে একেও থাকতে দেব।

জেবু বলে উঠল- আর কত বই জমাবে? যেখানে বই পাও সঙ্গে করে নাও, বই তোমাকে ছাড়বে না।

শত শত বই বাসায়, এগুলো সব কী পড়তে পারবে কোন দিন?

আমি বলি, সব হয়তো পড়তে পারব না, তবে মনে রেখ,

বইগুলো সামনে থাকলে বা দেখলেই আমার মন ভালো থাকে।

কী আর করার আছে বল।

জেবু বলে, মনে আছে, ক’দিন আগে না আমরা আজিমপুরে একজন অধ্যাপকের বাসায় গিয়েছিলাম, তুমি নিশ্চয় লক্ষ্য করেছ- তার বাসার শেলফে চার-পাঁচটি বইও দেখিনি।

অথচ তুমি একজন সরকারি কর্মচারী, তোমার এত বই জমানোর দরকার কী?

বললাম, রাখ এসব, ঢাকায় কখন রওনা হবে? ইদানীং বিকাল হলেই কালবৈশাখী ধেয়ে আসে কিন্তু-

সন্ধ্যার আগেই রওনা হওয়া উচিত।

জেবু বলে, ঠিক আছে, মাগরিব পড়ে যাত্রা করব। আগামীকাল ছুটির দিন। একটু রাত হলেই ক্ষতি কী?

ঠিক আছে তাই হোক, সেদিন মধ্যরাতে সোনালী অতীত ফিরে পাওয়ার মতো ক্ষুদ্র অবয়বের এ বিন্দুর ছেলেকে সঙ্গে নিয়েই ঢাকায় ফিরে আসি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর