শুক্রবার, ৩ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

রুম নম্বর বত্রিশ

মাজহারুল ইসলাম

রুম নম্বর বত্রিশ

শীতের রাত। সাড়ে নটা বাজে। নাজু আর তার বন্ধু মফিজ শুয়ে আছে লেপ মুড়ি দিয়ে। বাতি নেভানো। রুমে আর কেউ নেই। দরজার ছিটকিনিটা বিশেষ কৌশলে লাগানো। কেউ এলে বাইরে থেকে খুলতে পারবে।

দেয়ালে একটা টিকটিকি আপন মনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নাজুর অবশ্য টিকটিকিতে ভয় নেই, তবে এই মুহূর্তে টিক টিক শব্দটা বিরক্তি লাগছে। তার ভয় মাকড়সায়। প্রায়ই ঘুমের মধ্যে দেখে তার বিছানায় শত শত মাকড়সা ঘুরছে। ভয়ে তার ঘুম ভেঙে যায়। সে-রাতে আর ঠিকমতো ঘুমাতে পারে না সে।

মিছিলের শব্দ চারতলা পর্যন্ত আসছে। ক্যাম্পাসে মিছিল হয় দিনে আর হলে রাতে। প্রথমদিকে নাজুর কাছে খুব বিরক্তি লাগত। রসায়ন ক্লাসে রহমত আলী স্যার যখন পরমাণুতত্ত্ব বোঝাচ্ছেন ঠিক তখনই দেখা গেল গলা ফাটানো স্লোগানে ডিপার্টমেন্টের করিডর দিয়ে মিছিল যাচ্ছে।

‘জ্বালো জ্বালো আগুন জ্বালো। স্বৈরাচারের গদিতে আগুন জ্বালো একসাথে।’

অথবা ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক গণতন্ত্র মুক্তি পাক।’

আবার রাতে হয়তো পড়তে বসেছে মাত্র, পরেরদিন টিউটোরিয়াল পরীক্ষা, ঠিক তখনই শুরু হয়ে গেল মিছিল। নাজুর কাছে মনে হয়, ঠিক উল্টোটা হলে কেমন হতো? রাতে ক্যাম্পাসে এবং দিনে হলে মিছিল হবে। যাদের শোনার প্রয়োজন তারা যথাস্থানে গিয়ে স্লোগান শুনে আসবে। নাজু জানে এই উদ্ভট চিন্তার কোনো মূল্য নেই। তারপরও তার মাথায় এসব উদ্ভট চিন্তা ঘুরপাক খায়।

ডিসেম্বর মাস। এবার মনে হচ্ছে শীতের প্রকোপ গতবারের চেয়ে খানিকটা বেশি। লেপ গায়ে দেওয়ার পরও শরীর গরম হচ্ছে না। চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করছে মফিজ। তবু ঘুম আসছে না। আর আসবেই বা কীভাবে? রাত বারোটা-একটার আগে তো ঘুমানোর অভ্যাস নেই। মশিউর ভাইয়ের হাত থেকে বাঁচার জন্য আজ নটা বাজতেই ঘুমানোর এই ব্যর্থ চেষ্টা।

নাজু রসায়নের ছাত্র আর মফিজ প্রাণিবিদ্যার। দুজনেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র। তিন মাসের কিছু বেশি সময় হলো ক্লাস শুরু হয়েছে। হলে এখনো সিট পায়নি কেউই। পাশের গ্রামের সিনিয়র এক ভাইয়ের সঙ্গে নাজু এক বিছানায় ডাব্লিং করা শুরু করেছিল। মফিজ আসার পর সেই সিনিয়র ভাই অন্য একজনের সঙ্গে ডাব্লিং করছেন। নাজুর সঙ্গে এক বিছানায় জায়গা হয়েছে মফিজের। শহীদুল্লাহ হল এক্সটেনশন-এক। রুম নম্বর বত্রিশ।

মফিজের প্রথম রাতের অভিজ্ঞতা খুব মজার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর তার কলেজের বন্ধু মোস্তফার সঙ্গে বুয়েটের শহীদ স্মৃতি হলে ওঠে সে। দুসপ্তাহ যেতে না যেতেই মোস্তফার রুমমেট বলে ওঠে, রুমে কোনো গেস্ট থাকতে পারবে না। অগত্যা মফিজ তার এক খালাতো ভাইয়ের মাধ্যমে মধুর ক্যান্টিনে দেখা করে মশিউর ভাইয়ের সঙ্গে। তিনি এক বামদলের শীর্ষ নেতা।

মশিউর ভাই কোনো কিছু জিজ্ঞেস না করে হাতে একটা চিরকুট ধরিয়ে দিয়ে বললেন, শহীদুল্লাহ হলের এক্সটেনশন এক-এ বত্রিশ নম্বর রুমে গোলাপের সঙ্গে দেখা কর। সে তোমার থাকার ব্যবস্থা করে দিবে।

মফিজ খুশিতে নাচতে নাচতে চিরকুটটা নিয়ে মধুর ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে আসে। কিছুদূর আসার পর চিরকুট খুলে দেখে ছোট ছোট অক্ষরে লেখা-

গোলাপ,

ছেলেটা আমাদের দলের সমর্থক। ওর থাকার ব্যবস্থা কোরো।

মশিউর ভাই

চিরকুট পড়ে মফিজ খানিকটা হকচকিয়ে যায়। সে তো কখনো রাজনীতি করেনি। তাহলে দলের সমর্থক বললেন কেন তিনি? ততক্ষণে মফিজ মধুর ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে সেন্ট্রাল লাইব্রেরির কাছে চলে এসেছে। একবার মনে হলো ফিরে গিয়ে মশিউর ভাইকে জিজ্ঞেস করবে কথাটা। তার সঙ্গে ছিল শহীদ স্মৃতি হলের সেই বন্ধু মোস্তফা। সে বলল, শোন, হলে সিট পেতে হলে কোনো না কোনো দলে নাম লেখাতে হয়। এত কিছু ভাবার দরকার নেই। তাদের দরকার মিছিলে কর্মী বাড়ানো, তোর দরকার মাথা গোঁজার জন্য হলের একটা সিট। ব্যস ঝামেলা শেষ। কথা না বাড়িয়ে কালই তুই গোলাপ ভাইয়ের সঙ্গে দেখা কর।

 

মফিজ পরদিন সকালে চলে এলো শহীদুল্লাহ হলের বত্রিশ নম্বর রুমে। সকাল এগারোটা বাজে। দরজায় কড়া নাড়তেই ভিতর থেকে একজন বলল, ভিতরে আসুন।

দরজা খোলাই ছিল। মফিজ ভিতরে ঢুকে দেখে স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে লুঙ্গি পরা এক লোক বিছানায় আধা শোয়া অবস্থায় পেপার পড়ছে। ডান হাতের দুই আঙ্গুলের মাঝে জ্বলন্ত সিগারেট। টেবিলে রাখা চায়ের কাপে ধোঁয়া উড়ছে। তিনি বললেন, কার কাছে এসেছেন?

মফিজ বলল, গোলাপ ভাইয়ের কাছে এসেছিলাম। মশিউর ভাই পাঠিয়েছেন।

তিনি বললেন, আমিই গোলাপ।

মফিজ সালাম দিয়ে চিরকুটটা তাঁর হাতে দিলে তিনি একটা চেয়ার দেখিয়ে বসতে বললেন। চেয়ারের ওপর একগাদা ময়লা কাপড় রাখা। রুমে আর কেউ নেই। চার বেডের রুম। সবাই হয়তো ক্লাসে গেছে। চিরকুটটা পড়ে তিনি বললেন, একেবারে চলে এসেছেন?

মফিজ বলল, না।

তিনি বললেন, আজই উঠবেন?

মফিজ বলল, জি, আজই উঠতে চাই।

সিগারেটে একটা টান দিয়ে গোলাপ ভাই বললেন, বিছানাপত্র নিয়ে চলে আসেন।

মফিজ আনন্দে আরেকবার সালাম দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। এত সহজে হলে সিট পাওয়া যাবে চিন্তাও করতে পারেনি সে। প্রায় লাফাতে লাফাতে চারতলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে আসছে। দোতলায় আসার পর মনে হলো, কোন বেডে থাকবে সে তা তো জিজ্ঞেস করা হলো না! সব বেডেই মনে হলো কেউ না কেউ আছে। তাহলে কি অন্য কারও সঙ্গে ডাব্লিং করতে হবে? মফিজের এই এক সমস্যা- তাৎক্ষণিকভাবে অনেক কিছু মাথায় আসে না। কিছুক্ষণ পরে মনে হয়। কী আর করা! হলে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে এটাই তো অনেক।

বিকালে শহীদ স্মৃতি হল থেকে তার ট্রাঙ্ক ও বিছানাপত্র হোল্ডোলে ভরে নিয়ে চলে এল। দরজা খোলাই ছিল। রিকশাওয়ালার মাথায় ট্রাঙ্ক। মফিজের হাতে হোল্ডোল। ভিতরে ঢুকতেই দেখল ডানদিকের বেডে চারজন তাস খেলছে। তার মধ্যে গোলাপ ভাই নেই। মফিজ কিছুটা ঘাবড়ে গেল। তাকে দেখে একজন বলল, তোমার কথা গোলাপ ভাই বলেছেন।

মফিজ বলল, আমার বেড কোনটা?

তিনি বললেন, সেটা তো বলতে পারব না। এখন যে কোনো বেডে বসতে পারো। রাতে গোলাপ ভাই এলে ঠিক করে দেবেন।

মফিজ তার বিছানাপত্র ও ছাই রঙের ট্রাঙ্কটা রুমে রেখে বেরিয়ে এলো। শহীদবাগে বড়ভাইয়ের শ্বশুরবাড়িতে রাতের খাবার খেয়ে একসময় হলে ফিরল। রাত তখন সাড়ে এগারোটা বাজে। রুমে ঢুকে তো মফিজের আক্কেল গুড়ুম। ট্রাঙ্ক যথাস্থানে থাকলেও হোন্ডোল খোলা। কে একজন তার বিছানাপত্র ফ্লোরে বিছিয়ে ঘুমিয়ে আছে। সব বেডেই একজন দুজন করে শুয়ে বসে আছে। কেউ আড্ডা মারছে। কেউ আবার এরমধ্যেই পড়ার টেবিলে পাঠমগ্ন। গোলাপ ভাই রুমে নেই। কী করবে সে বুঝতে পারছে না। এক বড়ভাইকে বিষয়টি বলতেই তিনি বললেন, গোলাপ ভাই তোমার কথা বলেছে। এরপর একটা বেড দেখিয়ে তিনি আবার বললেন, ওই বেডে তুমি ডাব্লিং করবে।

নাজুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে তিনি আবার বললেন, তোমরা দুজন একসঙ্গে থাকবে। আমি অন্য কোথাও থাকব। সেই থেকে নাজু হয়ে গেল মফিজের বেড পার্টনার।

খুব ভোরে মফিজের ঘুম ভেঙে যায়। কোনো জানালাতেই পর্দা নেই। সূর্যের আলো ঘরে ঢুকলেই সে আর ঘুমাতে পারে না। চোখ ডলতে ডলতে বিছানায় ওঠে বসে মফিজ এবং বিস্মিত হয়ে দেখে, প্রত্যেক বেডে দুজন করে আটজন এবং ফ্লোরে কমপক্ষে আরও আটজন শুয়ে আছে। ফ্লোরে এক ইঞ্চি জায়গাও খালি নেই। রুম থেকে বেরিয়ে বাথরুমে যাবে সেই উপায় নেই। বের হতে হলে কারও না কারও গায়ের ওপর দিয়ে যেতে হবে। মফিজ কী করবে বুঝতে পারছে না। বাথরুমে যাওয়ার বেগ এত বেশি, যে কোনো মুহূর্তে কাপড় নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এরমধ্যে গোলাপ ভাইয়ের ভরাট গলার আওয়াজ কানে এল। কী খবর মফিজ? এত ভোরে ঘুম ভেঙে গেল?

মফিজ এদিক-ওদিক তাকাল। কোথাও গোলাপ ভাইকে দেখা যাচ্ছে না। সবাই ঘুমাচ্ছে। কেউ তো জেগে নেই। তাহলে এ আওয়াজ কোথা থেকে এল? এটা তো অবিকল গোলাপ ভাইয়ের গলা। মফিজ কিছুটা ভয় পেয়ে গেল। এরপর গোলাপ ভাই বলল, বত্রিশ নম্বর রুমের অবস্থা এরকমই। একটু কষ্ট করে থাকতে হবে।

মফিজ এতক্ষণে গোলাপ ভাইকে খুঁজে পেল। আসলে সবাই লেপ বা কাঁথা মুড়ি দিয়ে এমনভাবে শুয়ে আছে কারও মুখ দেখা যাচ্ছিল না। পশ্চিম দিকের বেডের পাশে ফ্লোরে শুয়ে আছেন তিনি। গোলাপ ভাই এই রুমে সবচেয়ে সিনিয়র। তিনি শুয়ে আছেন ফ্লোরে! মফিজ খুবই অবাক হলো।

অন্ধকারে শুয়ে এসব কথা মনে পড়ছিল মফিজের। ফিসফিস করে নাজুকে সে বলল, আজ মনে হয় মশিউর ভাই আসবে না।

নাজু প্রায় ঘুমিয়েই পড়েছিল। মফিজের কথায় বিরক্ত হয়ে বলল, আমি কীভাবে বলব?

নাজুর কথা শেষ হওয়ার আগেই রুমের বাইরে থেকে কারও পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাইরে থেকে সুতা টান দিয়ে কে যেন দরজার ছিটকিনি খুলে ভিতরে ঢোকে। নাজু কানের কাছে মুখটা এনে বলে, মশিউর ভাই ঢুকছে। চোখ বন্ধ করে রাখ।

মশিউর ভাই রুমে ঢুকেই বাতি জ্বালান। এরপর বেডের কাছে এসে খানিকটা লেপ সরিয়ে বলেন, মফিজ-নাজু, উঠে আসো। তোমরা জোর করে ঘুমানোর চেষ্টা করছ কেন? নিচে সবাই অপেক্ষা করছে। দ্রুত উঠে আসো।

মফিজ ও নাজু মুহূর্তের মধ্যে ওঠে কাপড় বদলে মশিউর ভাইয়ের সঙ্গে নিচে নেমে এল। আগামীকাল হরতাল। তাই সারা রাত পার্টি অফিসে থাকতে হবে। সকাল থেকে পিকেটিং করতে হবে। এর আগে মফিজ ও নাজু অন্যদের সঙ্গে দুই রাত পার্টি অফিসে ছিল। সারা রাত ঘুম নেই। মশার কামড় খেয়ে পরদিন সকাল থেকে রাস্তায় মিছিল ও পিকেটিং। খুবই কষ্টকর কাজ। প্রতিবারই মশিউর ভাই বলেছেন, খুব ভোরে নেতা আসবেন মিছিলে নেতৃত্ব দিতে। আমাদের সঙ্গে নিয়ে পিকেটিং করবেন। কিন্তু কীসের কী! প্রতিবারই নেতা এসেছেন হরতাল শেষ হওয়ার দশ কিংবা পনের মিনিট আগে। আয়রন করা ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি গায়ে। মিছিলের সামনে থেকে কিছুটা পথ হেঁটে পল্টনের মোড়ে দাঁড়িয়ে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিলেন। পরবর্তী সময়ে আরও কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে বলে গাড়িতে উঠে চলে গেলেন। আর মফিজদের মতো আমজনতারা সারা রাত জেগে মশার কামড় খেয়ে সকালে একটা কলা ও শুকনো বন রুটি দিয়ে নাস্তা করে দুপুর পর্যন্ত মিছিল পিকেটিং করে পায়ে হেঁটে হলে ফিরে এসেছে। তাই নাজু ও মফিজ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আজ রাতে তারা দুজন পার্টি অফিসে যাবে না। কিন্তু মশিউর ভাই সামনে এসে দাঁড়ালে তারা আর না করতে পারে না। অগত্যা খুবই বিরক্তিসহ আজও যেতে হলো। মফিজের প্রশ্ন হলো, খুব ভোরে হল থেকে গিয়েও তো মিছিল ও পিকেটিংয়ে অংশ নেওয়া যায়। এর জন্য আগের রাতে কেন সেখানে থাকতে হবে?

মফিজ অনেককে বলাবলি করতে শুনেছে, হরতালের আগের রাতে পার্টি অফিস পাহারা দেওয়ার জন্য তাদের নিয়ে যাওয়া হয়। কারণ কিছুদিন আগে সরকারি দলের ক্যাডাররা রাতের অন্ধকারে পার্টি অফিসে হামলা করেছিল।

মফিজ সাদাসিধা ও নির্ভেজাল জীবনযাপন করতে পছন্দ করে। শুধু হলে সিট পাওয়ার জন্য তাকে ছাত্রসংগঠনে নাম লেখাতে হয়েছে।

বত্রিশ নম্বর রুমে মফিজ ও নাজু ছাড়া সবাই তাদের সিনিয়র। পরাগ ভাই ও আরমান ভাই মাস্টার্স পরীক্ষা দেবে। অন্যরা কেউ সেকেন্ড ইয়ার, কেউ থার্ড ইয়ারে পড়ে। গোলাপ ভাই এমফিল করছেন।

এক রাতে বন্ধুদের সঙ্গে মফিজ ও নাজু গিয়েছিল মধুমিতা হলে সিনেমা দেখতে। রাত এগারোটায় হলে ফিরে দেখে অনেক মানুষের জটলা। একজন দৌড়ে এসে বলল, তাড়াতাড়ি রুমে গিয়ে দেখো তোমাদের জিনিসপত্র ঠিকঠাক আছে কিনা! কিছুক্ষণ আগে সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের ক্যাডাররা তিনটা রুমে হামলা চালিয়েছিল। এরমধ্যে বত্রিশ নম্বর রুমও আছে।

মফিজ ও নাজু দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে রুমে গিয়ে তো হতভম্ব। দরজা খোলা। পুরো রুমই ল ভ  হয়ে আছে। জিনিসপত্র সব ছড়ানো-ছিটানো। বিছানা বালিশ কিছুই নেই। হলের সামনের পুকুরে নাকি সব ফেলেছে। বইপত্র কাপড়চোপড় ফ্লোরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। পরাগ ভাই আর অনার্স থার্ড ইয়ারের লোকমান ভাই জিনিসপত্র গোছানোর চেষ্টা করছেন। মফিজের চোখে পানি চলে এল। নাজুর মন খারাপ। কারণ তার টেবিলফ্যানটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে।

হলে কোনো ফ্যানের ব্যবস্থা নেই। ব্যক্তিগতভাবে কেউ কেউ টেবিলফ্যান ব্যবহার করে থাকে। কিছুদিন আগে তার এক মামা এসে টেবিলফ্যানটা কিনে দিয়েছেন।

বত্রিশ নম্বর রুমে হামলার বিষয়টি টক অব দ্য হল হয়ে গেল। কারণ এই রুমকে বলা হয় ‘হারমোনিয়াম পার্টির রুম’। এই রুমে কেন হামলা হবে? অনেকের ধারণা ক্যাডাররা রুম নম্বর ভুল করেছে।

এরমধ্যে প্রভোস্ট ও হাউজ টিউটর খবর পেয়ে চলে এসেছেন। তারা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে পরাগ ভাইকে জিজ্ঞেস করলেন, কেউ আহত হয়েছে কিনা? মশিউর ভাইয়েরও খোঁজ করলেন। পরাগ ভাই বললেন, হামলার সময় রুমে কেউ ছিল না। উপরের তলার রুমে ভাঙচুর শুরু হলে ভয়ে সবাই রুম থেকে বাইরে চলে যায়। গোলাপ ভাই আজ সকালে বাড়ি গেছেন।

এরপর আর কিছু না বলে প্রভোস্ট ও হাউস টিউটর চলে গেলেন।

হঠাৎ করেই নাজুর মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন। আগের মতোই এখনো সে মাঝে মাঝে হরতালের আগের রাতে পার্টি অফিসে যায়। তবে এখন আর মশিউর ভাইকে ডাকতে আসতে হয় না। বরং নাজুই অনেকটা মশিউর ভাইয়ের দায়িত্ব পালন করছে। মফিজকে নিয়ে যাওয়ার জন্য নানাভাবে পীড়াপীড়ি করে। কিন্তু মফিজ পরিষ্কার বলে দিয়েছে, প্রয়োজনে সে হল ছেড়ে চলে যাবে তবুও আর কখনো রাত জেগে পার্টি অফিস পাহারা দিতে পারবে না। সারা রাত জাগতে তার খুব কষ্ট হয়। বত্রিশ নম্বরে থাকার মাশুল হিসেবে সে মাঝেমধ্যে সকালে গিয়ে পিকেটিং-মিছিল এগুলোতে অংশ নেবে। এর চেয়ে বেশি কিছু করা তার পক্ষে সম্ভব নয়।

নাজুর সঙ্গে মশিউর ভাইয়ের ঘনিষ্ঠতা মফিজের চোখে পড়ে। প্রায়ই সে গোলাপ ভাইয়ের সঙ্গে হোসনী দালান রোডে যাতায়াত করে। রাত করে হলে ফিরে সে। গোলাপ ভাই শহীদুল্লাহ হল শাখার সভাপতি। প্রথমদিকে নাজু তাকে সহ্যই করতে পারত না। এখন তার সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। হলের মিছিলে নাজু স্লোগানের নেতৃত্ব দেয়। ক্লাস বাদ দিয়ে প্রায়ই মধুর ক্যান্টিনে চলে যায়।

নাজুর এই পরিবর্তনের কারণ মফিজ উদ্ধার করেছে। মশিউর ভাইয়ের মাধ্যমে সে সোভিয়েত ইউনিয়নের স্কলারশিপ পাওয়ার চেষ্টা করছে। নাজু এসএসসিতে রাজশাহীতে বোর্ড থেকে স্ট্যান্ড করা। এইচএসসিতেও তার রেজাল্ট ভালো। মশিউর ভাই বলেছে তার স্কলারশিপ হয়ে যাবে।

এক রাতে মফিজ চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। হঠাৎ পরাগ ভাইয়ের সঙ্গে নাজুর এ বিষয় নিয়ে কিছু কথাবার্তা তার কানে আসে। নাজু যেহেতু নিজে থেকে তাকে কিছু বলেনি তাই সে-ও নাজুকে এ বিষয়ে কখনো কোনো প্রশ্ন করে না।

একদিন মফিজ হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করল, কিরে আমাদের ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাবি না তো?

নাজু বলল, কী যা তা বলিস! তোদের ছেড়ে আবার কোথায় যাব? আর যদি যেতেই হয় তবে একেবারে সব ছেড়েছুড়ে আকাশের তারা হয়ে যাব।

এ ধরনের কথা মফিজের একদম পছন্দ না। বিরক্ত হয়ে বলল, আজেবাজে কথা বলবি না। তা ছাড়া এসব কথা মুখে আনাও পাপ।

তিন মাস পরের ঘটনা। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সারা দেশে টালমাটাল অবস্থা। ১৯৮৫ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি রাতে মিছিলের মধ্যে রাউফুন বসুনিয়াকে গুলি করে হত্যা করে সরকারি দলের ছাত্রসংগঠনের ক্যাডাররা। পরদিন সকালে শহীদ বসুনিয়ার লাশ নিয়ে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে বিশাল মিছিল শুরু হয়। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা শেষ করে মিছিল পুরান ঢাকার দিকে যেতে থাকলে পুলিশের সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষ বেধে যায়। এতে অনেক ছাত্র-ছাত্রী ও সাধারণ জনতা আহত হয়।

নাজু এ মিছিলে ছিল। আহত হয়েছে সে-ও। আঘাতটা বেশ মারাত্মক। অন্যদের সঙ্গে তাকেও ঢাকা মেডিকেলের ইমার্জেন্সিতে নিয়ে আসা হয়েছে। সারা শরীরে আঘাতের চিহ্ন। ব্যথায় কাতরাচ্ছে নাজু। কপালের বামদিকে কেটে গেছে অনেকখানি। রক্ত বন্ধ করার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। মাথায় আঘাত পেয়েছে বেশি। এরমধ্যে দুবার বমি করেছে। ঠিকমতো কথা বলতে পারছে না। অস্পষ্ট জড়ানো কথা। কিছু একটা বলতে চাচ্ছে কিন্তু বলতে পারছে না। নাজুর শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকলে দ্রুত আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয় তাকে। খবর পেয়ে মফিজ, পরাগ, গোলাপসহ বত্রিশ নম্বর রুমের প্রায় সবাই ছুটে এসেছে হাসপাতালে। পরাগ ভাই নাজুর বাবাকে টেলিগ্রাম করার জন্য গুলিস্তান গেছেন।

আইসিইউর সামনে প্রচ- ভিড়। নাজুর ক্লাসের বন্ধুরা অনেকে খবর পেয়ে চলে এসেছে। দলের কর্মীরা তো আছেই। মশিউর ভাইও চলে এসেছেন। হল থেকে হাউস টিউটর এসে জানালেন, প্রভোস্ট স্যার কিছুক্ষণের মধ্যেই আসবেন। উপস্থিত সবার চোখই অশ্রুসজল।

মফিজ কিছুক্ষণ পর পর চোখের পানি মুছছে। সকালে মিছিলে যাওয়ার সময় নাজু মফিজকেও তার সঙ্গে যেতে বলেছিল। মফিজ টিউটোরিয়াল পরীক্ষার অজুহাত দেখিয়ে যায়নি। নাজু মন খারাপ করে একাই চলে যায়। যাওয়ার সময় বলেছিল, দেখিস আজ স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়েই ছাড়ব। কাল দেখবি সব পত্রিকার শিরোনাম হবে।

নাজু স্বৈরাচারের পতন ঘটাতে পারেনি। বরং নিজেই শিরোনাম হয়ে হাসপাতালের বেডে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে। বারবার কথাগুলো মফিজের মনে পড়ছে আর সবার আড়ালে গিয়ে চোখের পানি মুছছে।

একটু পর পর ডাক্তাররা এসে আপডেট জানাচ্ছেন। সেইসঙ্গে একটার পর একটা তালিকা দিয়ে যাচ্ছেন ওষুধপত্রের। গোলাপ ভাই নিজে ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে আনছেন।

রাত পেরিয়ে ভোর হয়ে গেল। সকালে ডাক্তাররা জানালেন সিটি স্ক্যান রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, নাজু মাথায় আঘাত পেয়েছে। ইন্টারনাল ব্লিডিং হয়েছে। কয়েক জায়গায় রক্ত জমাট বেঁধে আছে। সার্জারি করতে হবে। কিন্তু সেটা বাহাত্তর ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর। এর আগে তারা কিছুই বলতে পারবেন না।

গোলাপ ভাই মফিজকে হলে গিয়ে বিশ্রাম নিয়ে আসতে বলেন। কিন্তু মফিজ কোনোভাবেই নাজুকে আইসিইউতে রেখে কোথাও যাবে না। মশিউর ভাই পর্যন্ত মফিজকে এক মুহূর্তের জন্য হাসপাতাল থেকে হলে পাঠাতে পারেননি।

তিন দিন জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে নাজু চলে গেল সবকিছুর ঊর্ধ্বে। আর কখনো সে মিছিলে যাবে না। পার্টি অফিসে রাত জেগে অপেক্ষা করবে না পরের দিন ভোর থেকে পিকেটিং করার জন্য।

ভোর পাঁচটায় ডাক্তার নাজুর মৃত্যু সংবাদ জানালে নাজুর বাবা চিৎকার করে কেঁদে ওঠেন। দুই হাত দিয়ে বুক চাপড়ে মাতম করতে লাগলেন-‘আমার ছেলেকে তো পড়ালেখা করতে ঢাকায় পাঠিয়েছিলাম। আমি তো মিছিল করতে পাঠাইনি। আমার নাজুকে আপনারা ফিরিয়ে দিন। আমার নাজুকে...।’ তার আহাজারিতে হাসপাতালের পরিবেশ ভারি হয়ে উঠল।

মশিউর ভাই নাজুর বাবাকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। গোলাপ ভাই খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে চোখের পানি মুছছেন। শোকাহত স্বজন ও বন্ধুদের উপস্থিতি বাড়তে থাকে।

মফিজ এক ফাঁকে আইসিইউতে ঢুকে পড়ে। ধবধবে সাদা চাদরে ঢাকা নাজুর নিস্তব্ধ নিথর দেহটা পড়ে আছে। মনে হলো মিছিল-মিটিং করে ক্লান্ত হয়ে যাওয়ায় ঘুমিয়ে আছে। একটু পরই ঘুম থেকে ওঠে পড়বে। মফিজ একবার নাজুর হাতটা ধরতে গিয়ে আবার পিছিয়ে পড়ল যদি ঘুম ভেঙে যায় সেই ভয়ে। এরমধ্যে নাজুকে নিয়ে গেল পোস্টমর্টেম রুমে।

অন্যদের সঙ্গে মফিজও নাজুর ডেডবডির সঙ্গে তার গ্রামের বাড়ি যাবে। তিন দিন তিন রাত কোনো ঘুম নেই, ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া নেই। শরীর প্রচ- দুর্বল হয়ে পড়েছে। এক কাপড়ে সার্বক্ষণিক আইসিইউয়ের সামনে বসে ছিল সে। হলে এসেছে নাজুর জিনিসপত্র গোছাতে এবং ফ্রেশ হয়ে জামাকাপড় বদলে দ্রুত চলে যাবে হাসপাতালে। সেখান থেকে নাজুর সঙ্গে ফরিদপুর।

বত্রিশ নম্বর রুমে ঢুকে মফিজের বুকের মধ্যে হাহাকার করে উঠল। চারদিকে বিশাল শূন্যতা। নাজুর জিনিসপত্র গোছাতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ল সে। আরও দুই রুমমেট তাকে সহযোগিতা করছে। হঠাৎ টেবিলের ওপর একটা খামের দিকে মফিজের নজর পড়ল। সোভিয়েত ইউনিয়নের স্ট্যাম্প লাগানো খাম। মুহূর্তের মধ্যে সে খামটা খুলে ফেলল। নাজুর স্কলারশিপের চিঠি। চিঠিটা হাতে নিয়ে মফিজ পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। দূরাগত স্লোগানের শব্দ তার করোটিতে আছড়ে পড়ছে-

জ্বালো জ্বালো, আগুন জ্বালো

স্বৈরাচারের গদিতে আগুন জ্বালো একসাথে...।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর