শুক্রবার, ১৭ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

দাপুটে মানুষের প্রবাসে অন্য মুখ

ফরিদুর রেজা সাগর

দাপুটে মানুষের প্রবাসে অন্য মুখ

তিনি বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত ব্যবসায়ী। অনেক রকম ব্যবসা রয়েছে তার। এর মধ্যে রয়েছে এক জাপানি গাড়ির বিজনেস। বিখ্যাত সেই জাপানি গাড়ির প্রতিনিধিত্ব করেন তিনি বাংলাদেশে। রয়েছে একটি আলীশান শোরুম। যে শোরুমে সব রকম সুদৃশ্য গাড়ি, দামি-দামি সব গাড়ি লাইন দিয়ে সাজানো। বাংলাদেশে এসব জাপানি গাড়ির প্রধান পরিবেশক এই মানুষটি।

অর্থাৎ তার গাড়ির অভাব নেই। এমনও শুনেছি, দেশের অনেক বিত্তশালী ব্যক্তি বিদেশ গিয়ে তাকে ফোন করেন। রীতিমতো অনুরোধ করে কোনো বিশেষ মডেলের গাড়ির জন্য বুকিং দেন। জাপানি অমুক মডেলের, অমুক কোম্পানির অমুক রঙের গাড়িটা লাগবে। এ ধরনের গাড়ি বাইরে এসেও খুঁজে পাওয়া যায় না।

অথচ আমার কন্যার বায়না এই গাড়ির। এই মডেলের এই কোম্পানি আর এই কালারের গাড়িটা ওর লাগবেই! এই দুষ্প্রাপ্য গাড়িটা আপনি এনে দিন।

সেই অনুরোধে অসাধ্য সাধন করে দেন আলোচ্য এই ব্যবসায়ী! অনুরোধের ঢেঁকি গেলেন হাসিমুখে তিনি।

ক্লায়েন্টের অনুরোধ, ‘আপনি যদি জাপানে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিতে একটু রিকোয়েস্ট করে দেন, আপনার ই-মেইল বার্তা অথবা টেলিফোন ওরা গুরুত্ব দেবে।’

কোম্পানির কাছে না থাকলেও ওটা বানিয়ে দুমাস পরে শিপমেন্ট করে দিলে, আমার মেয়ের কাছে সুইডেনে পাঠিয়ে দেন ব্যবসায়ী ভদ্রলোক! সুইডেনে গাড়িটা পাঠানো বিরাট কোনো কথা না। কিন্তু মানুষজনের কাছে এই ব্যবসায়ীর আকাশচুম্বি কদর বাড়ে অবিশ্বাস্যভাবে।

সেই লেভেলে বড় আকারের ব্যবসায়ীর আসল গল্প এবার বলি। প্রতিনিধিত্বকারী ব্যবসায়ী ভদ্রলোক একবার বেশ কয়েক বছর দেশের বাইরে ছিলেন। তাকে থাকতে হয়েছিল বিদেশে।

সেই সময়টাতে তার সঙ্গে আমার বিদেশের মাটিতেই দেখা।

তাকে ফোন করতেই বললেন, ‘চলে আসো। আমার শহরে এসেছ যখন, কবে দেখা হবে বলো।’

সানুনয়ে বললাম, ‘আমার একটু ব্যস্ততা আছে। অমুক অমুক দিন ব্যস্ত থাকতে হবে। আমি ফ্রি হয়ে কথা বলব।’ খুশি হলেন তিনি ফোন পেয়ে।

আরও খুশি হলেন যখন এক ক্যাফেতে আচমকা দেখা হয়ে গেল তার সাথে।

সপ্রতিভ হাসি দিয়ে হাত মেলালেন।

বললেন, ‘এবার কি তোমার ব্যস্ততা খানিক কমেছে?’

জানালাম মাথা নেড়ে, ‘একটু কমেছে।’

বললেন, ‘তোমার সঙ্গে যখন দেখা হয়েই গেল আজ অথবা কাল তোমাকে ডিনার করতে হবে আমার সঙ্গে।’

বললাম, ‘নিশ্চয়। তাহলে কাল।’

বললেন, ‘কোনো সমস্যা নেই। আগামীকাল ফিক্সড থাকল।’

আমি বললাম, কাল ডিনারটা বা নাই হলো!

মাথা ঝাঁকাতে থাকলেন। প্রবল আপত্তি তুলে বললেন, ‘এবার তোমার সঙ্গে যখন দেখা হয়েই গেলো, একটা সন্ধ্যা আমাকে দিতে হবে। এবং সেটা সম্ভব হলে আজ তা না হলে কাল। দেশের সব খবরাখবর জানা যাবে ডিনার টেবিলে!’

অগত্যা বললাম, ‘ঠিক আছে। কাল। ফাইনাল।’

‘তুমি কোন হোটেলে আছ?’

জানালাম হোটেলের কথা।

বললেন, ‘কাল সূর্যাস্তের পরে ছ’টায় গাড়ি চলে যাবে তোমাদের তুলতে। গাড়ি পাঠিয়ে দেবো।’

বললাম, ‘গাড়ি পাঠিয়ে দেবেন কেন, আমরা চলে আসব নিজের মতো করে। বিদেশে গাড়ি পাঠাবেন কেন, এখানে রাস্তায় জ্যাম নেই। অনায়াসে ঠিকানা ধরে চলে আসতে পারবো। ভাড়া গাড়িও তো প্রচুর।’

হইহই করে উঠলেন, ‘আমি তোমার হোটেলে গাড়ি পাঠালে কোনো সমস্যা আছে?’

বললাম, ‘না, কোনো সমস্যা নেই!’

‘তবে! তোমরা রেডি থাকবে। গাড়ি টাইম ধরে চলে আসবে।’

হাসতে হাসতে বললাম, ‘প্রবাসেও আপনার এত ক্ষমতা? গাড়ি পাঠাবেন?’

উনি বললেন, ‘আমার ক্ষমতা মাপার তোমার দরকার কি? গাড়ি পাঠাব। ব্যস, চলে আসবে।’

বিস্ফারিত চোখে বললাম, ‘এ দেশে গাড়ি আছে, গাড়ির ড্রাইভারও আপনার আছে?’

এ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তিনি দাঁত ছড়িয়ে হাসলেন। মুক্তোর মতো দাঁত দেখা গেল তার।

যথারীতি পরদিন সন্ধ্যায় ভদ্রলোকের গাড়ি এসে হোটেল লবিতে হাজির।

ইন্টারকমে হোটেল কক্ষে খবর এলো। গাড়ি স্ট্যান্ডবাই।

ভুলটা করলাম আমি। ব্যস্ততার জন্য আমার স্ত্রী কণাকে বলতে ভুলে গেছিলাম দাওয়াতের কথা।

ফলে প্রথমবার কণা দেরি করলো।

তৈরি হতে ওর দেরি হয়ে গেল স্বাভাবিকভাবে। ঝকঝকে চকচকে গাড়ি। দরজা খুললে পাদানি বেরিয়ে আসে। অটোমেটিক দরজা খোলে!

পৌঁছাতে পৌঁছাতে আমরা যখন তার বাড়িতে গেলাম, তখন রাত নটা পার হয়ে গেছে।

দেখলাম যে এদেশেও তিনি রাজকীয় গাড়ি চালান। ড্রাইভার উর্দি পরা। ধোপ দুরস্ত।

যে বাড়িতে পৌঁছে দিলেন উর্দি পরা ড্রাইভার, সেটাও রাজকীয় বাড়ি। সেই বাড়ি আর গাড়ির বিস্তারিত বর্ণনায় যাচ্ছি না। কারণ আমাদের লেখাটি তো ‘মানুষের মুখ’ নিয়ে।

বাড়িতে পৌঁছে কিছুক্ষণ গল্প করলাম। উনি বললেন, ‘তোমাদের ডিনার খাওয়াতে নিয়ে যাবো আমার একটা প্রিয় রেস্তোরাঁ আছে সেখানে। অনেকদিন ওই রেস্তোরাঁয় যাওয়া হয় না। কিন্তু সেটা আবার বন্ধ হয়ে যায় সাড়ে ১০টার মধ্যে। চিন্তা করো না। আমি রিকোয়েস্ট করছি। আমার অনুরোধ নিশ্চয়ই ফেলবেন না।’ কথাটা বলেই জিভে কামড় দিলেন উনি।

একই কাজটা উনিও করেছেন। ভাবীকে বলা হয়নি। ভাবী স্বাভাবিকভাবেই একটু সময় নিলেন।

ওনার কাছ থেকে ফোন পেয়ে দামি রেস্তোরাঁটা সময় বাড়াল। বিষয়টি বিদেশের নিয়মানুবর্তিতা। নিয়মে চলে পুরো জাতি। রেস্তোরাঁ সময় বাড়াল। কিন্তু ড্রাইভার! ড্রাইভার চলে যাবেন ঘড়ির কাঁটা ধরে ১০টায়। কিন্তু ওনার অবস্থা বিবেচনা করে ড্রাইভারকে বললেন, ‘১০টার কিছু এদিক-ওদিক আজ হবে।’ ড্রাইভারের জবাব, ‘রেস্তোরাঁয় নামিয়ে দিয়েই আমি চলে যাব।’

তাই করলেন ড্রাইভার।

আমি ওনার বিব্রত মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘কোনো অসুবিধা নেই। উনি গাড়ি নিয়ে চলেই যাক। বিদেশে ট্যাক্সি পাওয়া খুব কঠিন ব্যাপার না। এখনকার উবারের মতোই। ওয়ান-টু’র ব্যাপার।’

খাওয়া দাওয়ার পর ট্যাক্সি ডাকা হলো। কিন্তু কণা আর ভাবীর গল্প যেন শেষ হয় না। ট্যাক্সি ড্রাইভার রাগ দেখাচ্ছে। ভদ্রলোকের মুখ দেখে তাকে বেশ অসহায় লাগল। কণাকে তাড়া দিলাম। মনে মনে বললাম, ‘আহারে বিদেশে-প্রবাসে কি অবস্থা দেশের বিখ্যাত ব্যবসায়ীর!’

এত গাড়ির মালিক তিনি। অথচ এখানে ট্যাক্সি ড্রাইভারের বিরক্ত চেহারা হজম করতে হচ্ছে তাঁকে!

এই যে প্রচ- দাপটের মানুষের করুণ মুখ, সেটা তাকিয়ে দেখার মতো। ওদিকে তার বাড়ির বিদেশি কেয়ারটেকার দেরি হচ্ছে বলে ঘন ঘন ফোন দিচ্ছে।

সব মিলিয়ে ভদ্রলোকের ফরসা চেহারাটা বিব্রত দেখাতে লাগল।

ঢাকা শহরে যার এত বিশাল গাড়ির শোরুম। পরিবেশক হিসেবে নাম্বার ওয়ান।

দুজন দুদিকে যাবো বলে ট্যাক্সির কিউতে দাঁড়িয়ে থাকলাম। আমাদের ট্যাক্সি আগে এলো। দেখলাম তিনি কিউতে দাঁড়িয়ে আছেন। কখন ট্যাক্সিতে উঠবেন।

ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম, ক্ষমতাবান মানুষটি ভাবীকে নিয়ে ট্যাক্সিতে উঠছেন!

তখন যে স্বস্তি মনে হচ্ছিল তার শরীরী ভঙ্গিমা আর আধো আলো অন্ধকার মুখে, সেটা মনে হয় ঢাকা শহরে অনেক দামি গাড়িতে উঠেও এটা পেতেন না তিনি! এই মুখটি তার কখনো আমার দেশে দেখা হয়নি।

সর্বশেষ খবর