শুক্রবার, ১৭ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

সিলেটে রবীন্দ্রনাথ

সুমন বনিক

সিলেটে রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিলঙে বেড়াতে এসেছিলেন ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি। শিলং পাহাড়ের অনুপম সৌন্দর্য, শৈলশিখরে সাদা মেঘের ভেলা, পাহাড়ের শরীরজুড়ে আলোছায়ার লুকোচুরি কবিচিত্তকে মুগ্ধ করেছিল। শিলঙের স্তব্ধ নীরবতা, সুদূরপ্রসারী পাহাড়ের উঁচুনিচু ঢেউ, পাইন বনের শন শন বাতাসের খেলা কবিমনে গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল। কবি শিলং এসেছেন এই বার্তা সিলেটে আসা মাত্রই শ্রীহট্ট ব্রাহ্মসমাজের তৎকালীন সম্পাদক গোবিন্দ নারায়ণ সিংহ একটি টেলিগ্রাম পাঠালেন কবিকে শ্রীহট্টে আমন্ত্রণ জানিয়ে। প্রতিউত্তরে কবি অপারগতা প্রকাশ করে Journey Long and tedious লিখে ‘তার বার্তা’ পাঠালেন। কবির অসম্মতিসূচক বার্তা পেয়ে ‘আঞ্জুমান ইসলাম, মহিলা সমিতি ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান শ্রীহট্টে কবিকে আমন্ত্রণ জানিয়ে টেলিগ্রাম পাঠালেন। অগত্যা কবি শ্রীহট্ট ভ্রমণের সম্মতি জানালেন। শিলং থেকে সড়কপথে সিলেট আসার ব্যবস্থা তখন ছিল না। লোকজন চেরাপুঞ্জি দিয়ে থাবায় করে খাসিয়াদের পিঠে চড়ে সিলেট আসতেন। এ কথা শুনে কবি বলেছিলেন ‘বরং দশ মাইল হেঁটে পাহাড় উৎরাই করতে পারি তবু মানুষের কাঁধে চড়তে পারব না।’ তাই আসাম বেঙ্গল রেলপথ দিয়েই সিলেটের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেছিলেন। কবির সফরসঙ্গী ছিলেন-তাঁর পুত্র শ্রীযুক্ত রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং পুত্রবধূ শ্রীযুক্তা প্রতিমা দেবী। কবিকে অভ্যর্থনা জানাতে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের একটি অগ্রবর্তী দল- বদরপুর রেলস্টেশন পর্যন্ত গিয়েছিলেন। কুলাউড়া এসে কবি রাতযাপন করেন ট্রেনে। মাইজগাঁও বরমচাল, ফেঞ্চুগঞ্জ প্রভৃতি স্টেশনেও কবিকে প্রাণঢালা  অভিনন্দন ও উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানো হয়েছিল। ৫ নভেম্বর বুধবার সকালে কবি সিলেট রেলস্টেশন পৌঁছান। কবিকে অভ্যর্থনা জানান মিউনিসিপ্যালটির তৎকালীন চেয়ারম্যান রায় বাহাদুর সুখময় চৌধুরী, আবদুল করিম সাহেব, সাবেক মন্ত্রী খান বাহাদুর আবদুল মজিদ, রায় বাহাদুর প্রমোদচন্দ্র দত্তসহ শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। আতশবাজি, তুমুল হর্ষধ্বনি হাজার জনতার উল্লাসে মুখরিত ছিল শ্রীহট্ট কবির পদার্পণে সঙ্গে সঙ্গেই। তখন সুরমা নদীর ওপর ব্রিজ ছিল না। সুরমা ঘাটে ছিল সুসজ্জিত মারবোট ও বজরা। কবি বোটে চড়ে নদী পার হলেন। নদীর উভয় তীরে বিশাল জনসমুদ্র কবিকে এক নজর দেখতে ছিল উন্মুখ। বন্দে মাতরম, রবীন্দ্রনাথ কী জয় ইত্যাদি ধ্বনিতে মুখরিত ছিল চারদিক। ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে হাজার জনতার আনন্দ উল্লাসে প্রকম্পিত ছিল সিলেট নগরী। মৌলবী আবদুল্লা সাহেবের স্বেচ্ছাসেবক দল, মজুমদারবাড়ি, দস্তিদারবাড়ি, আহিয়া সাহেবের বাড়ির প্রতিনিধিসহ হাজারো জনতা কবিকে নদীরপাড়ে চাঁদনীঘাটে অভ্যর্থনা জানিয়েছিল। মৌলবী আবদুল করিম সাহেবের একটি সুসজ্জিত ফিটনে এনেছিলেন।

শহরের একটি টিলার ওপর ছিল পাদ্রি টমাস সাহেবের বাংলো। কবি সিলেট সফরকালীন সময়ে সেখানেই বাস করেছিলেন। ০৫ নভেম্বর সন্ধ্যায় কবি ব্রাহ্মসমাজের উদ্যোগে আয়োজিত উপাসনায় “বীণা বাজাও হে মম অন্তরে/ সজনে বিজনে বন্ধু, সুখে দুখে বিপদে/ আনন্দিত তান শুনাও হে মম অন্তরে” এই গানটি গেয়েছিলেন/ উপনিষদের মন্ত্র উচ্চারণ করে উপাসনা শুরু করেছিলেন। ০৬ নভেম্বর কবি সিলেটের রতনমনি টাউন হলে ‘বাঙালির সাধনা’ সম্বন্ধে প্রায় দেড় ঘণ্টা বক্তৃতা করেছিলেন। কবির সেই ভাষণটি অনুলিখন করেন উপেন্দ্র নারায়ণ সিংহ ও মনোরঞ্জন চৌধুরী। কবি তাঁর বক্তৃতায় বলেন- ‘তাই বলছি, আজ এই সভাতে আপনাদের সঙ্গে আমার এই যে যোগ হলো সে কেবল সাহিত্যের যশ নিয়ে নয়। এর ভিতরে একটি গূঢ় কথা আছে যা খ্যাতির চেয়ে অনেক বড়। সে কথাটি এই যে বাংলাদেশের লোক আপনার মধ্যে একটি শক্তির জাগরণ অনুভব করছে।’ তার বক্তৃতায় দেশপ্রেম অসাম্প্রদায়িক চেতনা, বাঙালির এগিয়ে যাওয়ার দিক-নির্দেশনা প্রতিফলিত হয়। পাদ্রি টমাস সাহেবের বাংলোয় বহির্দ্বারে টাঙানো ছিল মণিপুরীদের তৈরি প্রায় পঞ্চাশ বছরের পুরনো একটি আচ্ছাদন বস্ত্র। ওই আচ্ছাদন বস্ত্রে মণিপুরী শিল্প নৈপুণ্যের পরিচয় পেয়ে কবি মুগ্ধ হয়েছিলেন। তাই প্রবল আগ্রহ নিয়ে ৬ নভেম্বর বিকালে শহরের একপ্রান্তে মাছিমপুর মণিপুরী পল্লীতে কবি গিয়েছিলেন। সেখানে মণিপুরী সম্প্রদায় কবিকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান। কবি মণিপুরী মেয়েদের তাঁতে বোনা কাপড়, তাদের শিল্প নৈপুণ্য দেখে মুগ্ধ হন। মণিপুরী ছেলেদের রাখাল নৃত্য দেখে কবি বিমোহিত হলেন। পরবর্তীতে মণিপুরী মেয়েদের ‘গোষ্ঠলীলা’ নৃত্য দেখে তিনি অনুপ্রাণিত হয়ে শান্তিনিকেতনে মণিপুরী নৃত্য বিভাগ চালু করেন। ৬ নভেম্বর তিনি অধ্যাপক নলিনী মোহন শাস্ত্রী মহাশয়ের আমন্ত্রণে তার বাসভবনে যান। দুপুরে ব্রাহ্মসমাজ মন্দিরে মহিলা সমিতি কবিকে সংবর্ধনা প্রদান করে। ৭ নভেম্বর  সকালে কবি শহরের সিংহবাড়িতে আমন্ত্রিত হন। গোবিন্দ নারায়ণ সিংহ মহাশয়ের বাড়িতে একটি প্রার্থনা সভায় যোগ দেন। ওইদিন কবি এমসি কলেজ হোস্টেলে সংবর্ধিত হন এবং হাজারো ছাত্র জনতার উদ্দেশে বক্তৃতা দান করেন। কবি তিন দিন সিলেটে অবস্থান করেছিলেন। এ ক-দিন সিলেট ছিল উৎসবনগরী। মানুষের প্রাণচাঞ্চল্যে মুখরিত ছিল সিলেট শহর। সিলেটের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মুগ্ধ হয়ে কবি সিলেটকে শ্রীভূমি উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। সুন্দরী শ্রীভূমি কবিতাটি রচনা করে কবি সিলেটবাসীকে তার অন্তরে স্থান দিয়েছিলেন। আজ শতবর্ষ পরেও সিলেটবাসী কবিকে হৃদয়ের গহীনে ঠাঁই দিয়ে রেখেছে- পরম ভালোবাসা-শ্রদ্ধায়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর