শুক্রবার, ২০ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা
গল্প

মায়ের মুখ

সাঈদ আজাদ

মায়ের মুখ

রোজার মধ্যে এমন ডিউটি কার ভালো লাগে! তাও দুপুরের পর!

ঢাকা মেডিকেল মর্গে যেতে হবে। সুরতহালের কাজে। পেশাগত দায়িত্ব হিসেবে এ ধরনের কাজ আগেও করতে হয়েছে অনেকবার। কোনো বারই কাজটা করতে ভালো লাগেনি। আজও যেতে ভালো লাগছিল না। একে রোজা, তার ওপর শেষ দুপুর। তাহলেও যেতে তো হবে। ওই দায়িত্ব।

পুরনো ঢাকা থেকে আড়াইটা নাগাদ রওনা হয়ে পৌঁছতে পৌঁছতে বিকাল শেষ হয়ে গেল। ঢাকার রাস্তা নিয়ে কোনো অনুমান বা হিসাব-নিকাশ চলে না। আধ ঘণ্টার রাস্তা ১০ মিনিটও লাগতে পারে, আবার তিন ঘণ্টাও লাগতে পারে।

মনে পড়ে মর্গে প্রথম এসেছিলাম, ঠিক নয় বছর আগে। আমি তখন ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। থার্ড ইয়ারে। আমার মামাতো ভাই আলম আত্মহত্যা করেছিলেন, কী জন্য তা আজও জানতে পারিনি। উনি আমার চেয়ে পাঁচ ছয় বছরের বড় ছিলেন। এত কম কথা বলতেন, অচেনা কেউ মনে করত বোবা। অধিকাংশ সময় আকার ইঙ্গিতে কাজ সারতেন। শবেবরাতের রাতে ফ্যানের সঙ্গে দড়ি ঝুলিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। বুকের ভিতর কী দুঃখ ছিল কেউ জানতে পারেনি!

সুরতহাল ময়নাতদন্ত ইত্যাদি শেষে যখন উনার লাশ বাড়ি নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিল, কফিনের ডালা সরিয়ে একটু উঁকি দিয়ে দেখেছিলাম। যদি জনিতাম, না দেখলেই ভালো ছিল! দেখি ভাইয়ের পুরো মুখ ভোমরার মতো নীল! চোখ দুটো আধবোজা! হাত দিয়ে বন্ধ করে দিলেও পুরো বন্ধ হচ্ছিল না। আর হাত দিয়ে যখন স্পর্শ করলাম, কী যে ঠান্ডা ত্বক। বরফ যেন। ছ্যাঁৎ করে উঠেছিল বুকের ভেতর। প্রাণহীন মানুষের মুখ এত ঠান্ডা হয়!... ট্রাকে করে কুমিল্লায় বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার সময় আমিও সঙ্গে গিয়েছিলাম। জীবনে প্রথম লাশের সঙ্গে এতক্ষণ! প্রথমে, মৃত্যু এবং তার পরবর্তী ধাক্কায় ভয়টা ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। বাড়ি পৌঁছে আমার জ্বরে অচেতন হওয়ার মতো অবস্থা।

আলম ভাই সবার বড় ছিলেন ভাইবোনের মধ্যে। সদ্য চাকরিতে ঢুকেছিলেন। মাস ছয়েকও চাকরি করতে পারলেন না। তার আগেই চলে গেলেন না ফেরার দেশে। অসময়ে। স্বেচ্ছায়।

জোয়ান ছেলেকে হারালে বৃদ্ধ বাবা-মায়ের দুঃখ বুঝি সীমাহীনই হয়। আলম ভাইয়ের বাবা-মা একেবারে নির্বাক হয়ে গেলেন। ছোট ভাই-বোনেরা আছাড়ি-পিছাড়ি বিলাপ করছিল। আমি চারদিকে তাকিয়ে দেখছিলাম। বাড়ির চারপাশে কেমন যেন শূন্যতা। না বাড়ি ভর্তি মানুষ ছিল। চিৎকার কান্নার আওয়াজ, আরও আরও শব্দ ছিল ঠিকই। তাহলেও আমার মনে হচ্ছিল, এসব কোলাহলের মাঝেও এক ধরনের শূন্যতা লুকিয়ে আছে।

লাশ কবর দেওয়ার তাড়া দিচ্ছিলেন মসজিদের ইমাম সাহেব। নাকি মৃত ব্যক্তিকে তাড়াতাড়ি কবরস্থ করাই নিয়ম।

আত্মীয় বন্ধু-বান্ধব আর গ্রামের লোকেরা মিলে আলম ভাইয়ের লাশ কবরে শুইয়ে দিয়ে এলাম। এই প্রথম মৃত্যুকে এত ঘনিষ্ঠভাবে দেখা আমার। একটা মানুষ চেনাজানা পৃথিবী থেকে একেবারে অচেনা জগতে চলে যায়, বিষয়টা মন যেন মানতে চাইছিল না। দীর্ঘক্ষণ লাশের সঙ্গে থেকে এবং এখন কবর থেকে ফিরে আমার কেমন যেন দিশাহারা লাগছিল।

ততক্ষণে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে। মামি, আলম ভাইয়ের মা জাননী সঙ্গে। উনি বাড়ির সীমানায় নারিকেল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে। আমরা এত এত মানুষ তার সামনে দিয়ে ফিরলাম, উনি যেন দেখলেনই না। উনাকে অতিক্রম করে চলেই গিয়েছিলাম অন্যদের সঙ্গে। আবার ফিরে এসে ছোট করে ডাকলাম, মামি। মামি কোনো শব্দ করলেন না। আমি আবার ডাকতে গিয়ে থমকালাম। স্থির দৃষ্টিতে মামি তাকিয়ে আছেন কবরস্থানের দিকে। দুচোখ থেকে অশ্রু ঝরছে।

এখন কত লাশ দেখি! কবর থেকে গলিত, অর্ধগলিত লাশ তোলার সময় উপস্থিত থাকি। ময়নাতদন্তের সময়ও অনেকবার উপস্থিত থেকেছি। যারা লাশ কাটে, কী নির্বিকার তাদের আচরণ! মেঝের ওপর, মৃত একটা মানুষের বুক চিরে কলিজা, ফুসফুস, নাড়িভুঁড়ি বের করেছে একপাশে। আরেক পাশে পিরিচে চা, কাজের ফাঁকে ফাঁকে সেই চায়ে চুমুক দিচ্ছে! বিস্কুট খাচ্ছে। হরর সিনেমায় দেখা দৃশ্যের মতো। কিন্তু বাস্তব। তবে বেশ কয়েকবার দেখতে দেখতে এসব এখন চোখ সওয়া হয়ে এসেছে আমার। অভ্যস্ত চোখে সবই বোধহয় বৈচিত্র্য হারায়। ভয় আনন্দ বা বিস্ময়, সবই।

গাড়ি থেকে নামতে পেট গুলানো কেমন একটা দুর্গন্ধ নাকে ধাক্কা মারল। আগেও যতবার এসেছি গন্ধটা পেয়েছি। গন্ধটা কেমন ভয় ভয় জড়ানো! লাশকাটা ঘরে যাওয়ার পথের ওপর একদল ভেড়া চরছে। আমি ভেড়াগুলোর দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলাম। কোত্থেকে চুয়িয়ে চুয়িয়ে ফোটা ফোটা রক্ত পড়েছে রাস্তায়। ভেড়াগুলো চেটে চেটে রক্ত খাচ্ছে! সত্যি ভেড়া রক্ত খাচ্ছে! আমার গাড়ির ড্রাইভার বলল, স্যার ভেড়ায় রক্ত খায় দেখে অবাক হয়েছেন?

তুমি আগে কখনো দেখেছ, গরু ছাগল বা ভেড়া রক্ত খায়!

গরু ছাগলকে দেখি নাই। তবে, এখানের ভেড়াগুলো রক্ত খায় আগেও দেখছি। যে স্যাররাই মর্গে আসে আমিই তো নিয়ে আসি।

আমিও তো আগে এসেছি। আগে ভেড়াগুলোকেও দেখিনি, রক্ত খেতেও দেখিনি!

আমি ভেড়াগুলোর মাঝ দিয়ে হেঁটে যেতে থাকি। একটা অ্যাম্বুলেন্সে কফিন তোলা হচ্ছে। ভেতরে না জানি কোন হতভাগার লাশ। আহা, প্রতীক্ষিত স্বজনের কাছে যাবে দুঃখের বাহন হয়ে। তারপর পরিজনদের কাঁদিয়ে কাঁদিয়ে কবরে ঠাঁই হবে তার। সময়, এক সময় তাকে মিটিয়ে দেবে মাটিতে! জীবন আসে সুখ নিয়ে চলে যায় দুঃখ দিয়ে!

এখানে ওখানে লোকজন দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো প্রিয়জনের লাশ গ্রহণ করতে। বেশির ভাগেরই চোখে মুখে বিষাদের ছায়া। কেউ কেউ নিচুস্বরে কাঁদছে। তা মর্গের আশপাশে বিষাদ আর কান্না ছাড়া কি-ই-বা থাকবে!

মেঝেতে পাশাপাশি চারটা লাশ। কালচে নীল পলিথিনে জড়ানো। কত যতেœর শরীর! লাশ হয়ে বিবর্ণ মলিন ঠান্ডা মেঝের ওপর পড়ে আছে। এ ঘরে ভয় ভয় মেশানো বমি উদ্রেককারী গন্ধটা খুব প্রবল। লাশ রাখার ঘর আর আশপাশ কতদিনে একবার পরিষ্কার করা হয় কে জানে!

আমি যে লাশটার সুরতহালের কাজে এসেছি, ডোম তার গা থেকে পলিথিন সরায়। মুখে ধুলাবালি, গায়ের গেঞ্জিটাও নোংরা। তাহলেও বোঝা যায়, মুখটা সুন্দরমতো। বয়স সাতাশ আটাশ হবে। আমার কাছাকাছিই বয়স! সে মৃত, আর আমি জীবিত।

বদমাইশটা যতদিন বাঁইচ্চা ছিল, জ্বালাইয়া গেল!

মরছে, এইবার একটু শান্তিতে থাকতে পারমু।

টাকা পয়সা ঘরে রাখার উপায় ছিল না। হাঁড়ি পাতিল পর্যন্ত চুরি কইরা বিক্রি কইরা দিছে।

আমার বিয়াটা পর্যন্ত ভাঙল। এমন ভাই থাকলে কে বিয়া করতে রাজি হইব। এমন সন্ত্রাসীরে মারলে কার দুঃখ লাগে!

বিধবা হইয়া বাঁচচি। জোর কইরা বিয়া করছিল। একটা দিন শান্তিতে থাকতে দেয় নাই। কপাল ভালা বাচ্চা কাচ্চা হয় নাই। বাপের পরিচয় দিতে লজ্জা লাগত।

না জানি কোন হতভাগাকে নিয়ে ঘরের কোনায় দাঁড়িয়ে কথা বলছে কজন মানুষ! মন্তব্যগুলো শুনতে শুনতে লাশটা দেখতে থাকি। আমার সঙ্গে পুলিশের এসআই বাহার সাহেবও আছেন।

লাশের বুকে চার চারটা ফুটো। র‌্যাবের ক্রসফায়ারে মারা গেছে। সুরতহাল রিপোর্ট তৈরির জন্য লাশের চুল থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত, খুটিয়ে দেখে, বিবরণ লিখতে হয়। ডোম লাশের গা থেকে গেঞ্জিটা খুলে নেয়। মাথার চুল বালিতে মাখামাখি। আন্দাজ তিন ইঞ্চিমতো লম্বা হবে, কালো। আমি লাশ দেখে বিবরণ লিখতে থাকি। বয়স, চুলের রং। কানের বর্ণনা। ঘাড়ের কাছে ডানদিকে আঁচড়। বুকের ওপর দুটো ফুটো। ফুটোর চারপাশে কালচে রক্ত জমে আছে।... পেটের কাছে আরেকটা ফুটো। ডোম পরনের প্যান্ট টেনে নামায়। নিম্নœাঙ্গে কোনো অস্বাভাবিকতা আছে কিনা, দেখি আমি।

এতদিন র‌্যাব যাগ মারত, তাগ লাই¹া দুঃখ লাগত! এখন বাবুরে মারাতে বুঝছি, ঠিক কাজই করে র‌্যাব। এমন ভাগিনা কারও যেন না থাকে।

আমগোও কম জ্বালায় নাই। চাচা বইল্লা পরিচয় দিতে লজ্জা লাগত। অথচ ছোটবেলা কত আদর করতাম! বংশের বড় সন্তান আছিল।

এক এক সময় মনে হইত, আমিই পিটাইয়া মাইরা ফেলি। বড়ভাই থাকলে বোনেরা কত শান্তিতে থাকে। যত গুন্ডা বদমাইশ নিয়া বাড়িতে আসত। মদ খাইত। বন্ধুগ চাহনি, ব্যবহার কোনোটার যদি ঠিক থাকত। বদমাইশটার সামনেই গায়ে হাতটাতও দিত।

তোমার ভাইও কম মাইয়্যার সর্বনাশ করে নাই! বউ ঘরে থাকতেও ফিরা চাইত না। এমন কী কালা কুৎসিত আমি। জোর কইরা বিয়া না করলে কত ভালো বিয়া হইত আমার!

দুঃখ কইরো না ভাবী, এখন তো মুক্ত তুমি। ভালো দেইখা একটা বিয়া কইরো আবার।

কার এত বদনাম করছে ওরা! না শুনতে চাইলেও, কথাগুলো আমার কানে আসছিলই।

ডোম লাশ উল্টিয়ে ফেলেছে। পিঠের উপরের দিকে দুটো ফুটো। গুলি বুক এফোঁড় ওফোঁড় করে এদিক দিয়েই বোধ হয় বের হয়েছে। কোমরের একটু উপরে আরেকটা ফুটো। ডান পায়ের গোছে রক্ত জমে আছে। আমি লিখতে থাকি।

লাশের বর্ণনা লেখা শেষ হয়। ময়নাতদন্তের জন্য নিতে হবে। ডোম চিল্লায়, এই লাশের আত্মীয়-স্বজন কে আছে?

আমি ওর চাচা। বয়স্ক লোকটা এগিয়ে আসে।

আমি অবাক। এতক্ষণ এইলোকও নিন্দা করছিল! তার মানে, এরা সবাই আমি যে লাশের সুরতহাল রিপোর্ট লিখছিলাম তার আত্মীয় স্বজন! শুনেছিলাম লাশটা একটা বড় সন্ত্রাসীর। ওদের কথা শুনে মনে হচ্ছে ঠিকই। অথচ কত অল্প বয়স! ছেলেই বলা যায়। উপুড় হয়ে ঠান্ডা মেঝেতে পড়ে আছে। অতি নিকটজনরাও কত ঘৃণা করে লাশটাকে! মানুষ মরে গেলেও তার কীর্তির দ্বারাই তো বিচার্য হয়।

আপনাদের লাশ কাটতে হইব। কেউ একজন সঙ্গে আসেন। কাগজপত্রে সই লাগব।

ওর তো বাবা নাই। আমিই গার্জিয়ান।

ঠিক আছে। আপনি সই দিলেই হইব।

সই স্বাক্ষরের দরকার কী। অপারেশন তো আর করবেন না।

চাচামিয়া, আপনি বেশি কথা বলেন! সঙ্গে আসেন, কাটাছিঁড়ার আগে সই লাগব।... স্যার, ইফতারের সময় হইয়া আইল। আপনে ভিতরে গিয়া ডাক্তার স্যারদের সঙ্গে ইফতার কইরা নেন। আমি ততক্ষণে লাশটারে নিয়া যাই লাশ কাটা ঘরে।

না, আমি বাইরে ইফতার করে নেব। আমার সঙ্গে গাড়ি আছে। বাইরে গিয়ে কিছু একটা কিনে নিয়ে খেয়ে আসি আমি। তুমি বাহার সাহেবের জন্য ব্যবস্থা কর।

আসলে আমি একটু বাইরের আবহাওয়ায় যেতে চাচ্ছিলাম। মৃতদেহের কাছাকাছি থাকতে ভালো লাগছিল না।

গাড়ি নিয়ে হাসপাতালের বাইরে যেতে বলি ড্রাইভারকে। ড্রাইভার শহীদ মিনারের পাশ দিয়ে কার্জন হলের দিকে যেতে থাকে। বাতাসটা এখন একটু ঠান্ডা যেন। যেতে যেতে মনে হয় আমার, মৃত্যু সবসময় কষ্ট নিয়ে আসে না, কখনো কখনো স্বস্তিও দিয়ে যায়।

টায়ার্ড লাগছে খুব। আজান হলে একটা ডাব খাই আমি। কিছু ইফতারি কিনেছিলাম। কেন যেন গলা দিয়ে নামছে না। গাড়িতে বসে তবু কয়েক মুঠো ছোলা মুড়ি খাই। কয়েক ঢোক পানি খেয়ে, মর্গে ফিরে আসি।

কাচ ঘেরা ঘরটার দরজা বন্ধ। আমি একবার উঁকি দিয়ে দেখি। ঠান্ডা মেঝেতে লাশটা রাখা হয়েছে। এখনো বোধহয় কাজ শুরু হয়নি। কর্তব্যরত ডাক্তার আর অন্যরা বোধহয় ইফতারি শেষ করে আসেননি। বাহার সাহেব শুধু অপেক্ষা করছেন। আমি এসআই বাহার সাহেবের সঙ্গে লাশকাটা ঘরের বাইরে বসি। কাজ শেষ হলে রিপোর্টে স্বাক্ষর করে দেব।... বসে থাকতে থাকতে পায়ে ঝিঁঝিঁ ধরে যায়। হাঁটতে হাঁটতে বাইরে খোলামতো জায়গাটাতে এসে দাঁড়াই।

আমার মামাতো ভাইয়ের লাশ নিতে এসে সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত এখানেই বসেছিলাম।

তুমি সেই তখন থাইক্কা ফ্যাচফ্যাচ করতাছ ক্যান, মা!

আমি তাকাই। খোলা জায়গাটার একপাশে মলিন কাপড়ের এক মহিলা বসে আছেন। কাছে দাঁড়ানো মেয়ে তাকে ভর্ৎসনা করছে।

মহিলা নতমুখে নিঃশব্দে কাঁদছে আর বিড়বিড় করে বলছে, আমি যে ওর মারে! এই দেহটা যারা কাটতে নিল, তারা কি জানে, জন্মের আগে এই দেহটা আমার মধ্যে ছিল নয় মাস। বাবু আমার বড় ছেলে।...ও হওয়ার আগে সারা রাত কী কষ্ট আমার! কী যে কষ্ট পাইছি। রাতভর সমানে বৃষ্টি! আমি জবাই করা মুরগির মতো তড় পাইতেছিলাম।...বাবু হইল শেষ রাতের দিকে। কুপির আলোয় ওর মুখ দেইখ্যা সব কষ্ট গেল আমার। আহা কী সুখ সেই কচি মুখ দেইখ্যা পাইছিলাম।... তরা সবাই ঠিক। বাবু অমানুষ হইয়া গেছিল। কিন্তু মায়ের প্রাণ যে বুঝে না গো। তারে যে খারাপ ভাবতে গিয়াও খারাপ ভাবতে পারি না আমি। আহারে, আমার কলিজার টুকরা! কত গুলি করছে র‌্যাব সারা শইল্যে। মরার সময় না জানি কত কষ্ট পাইছে মানিক! এখন আবার বুক কাটব, কলিজা কাটব!

স্যার, কাজ শেষ হয়েছে। রিপোর্ট লিখবেন, আসুন। ভেতর থেকে বাহার সাহেব ডাকেন।

রাত বাড়ছে। তবে লাইটের আলোতে চারপাশ ভালোই আলোকিত। আমি ভেতরে গিয়ে দ্রুত হাতে রিপোর্ট লিখি। সিল-সিগনেচার শেষে ফটোকপি করতে দেই। বেশ কয়েকটা কপি করতে হবে। বাহার সাহেব, লাশের আত্মীয়রা, মেডিকেল কর্তৃপক্ষ, আমি এক কপি করে নেব। তা ছাড়াও আরও কয়েকটা কপি লাগতে পারে।

কাজ শেষে বের হয়ে, গাড়িতে ওঠার আগে একবার পেছন ফিরে দেখি, সেই মহিলা এখনো তেমনিভাবে বসে আছে। মুখ নিচু। ভাবলেশহীন। লাইটের আলোতে মুখ চকচক করছে তার। খেয়াল করে দেখে বুঝলাম, মহিলার চোখ বেয়ে পানি পড়ছে! কিন্তু মুখের মাংশপেশিতে কোনো কাঁপন নেই। কান্নারও কোনো শব্দ নেই! আচমকা দৃশ্যটা চোখে ভাসে আমার, বছর নয় আগে এমনই একটা মুখ দেখেছিলাম আমি। নারিকেল গাছের তলে সন্ধ্যাবেলায়। সে মুখও এক পুত্রহারা মায়ের মুখ।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর