শুক্রবার, ৩ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা
গল্প

সারা দিন ঝড়-বৃষ্টি

মতিয়ার রহমান পাটোয়ারী

সারা দিন ঝড়-বৃষ্টি

এ দুর্যোগের মধ্যে মোহিত কী আসবে বকুলকে নিয়ে?

ঘরের ভিতর শুয়ে থাকতে মাঝে মাঝে বুকটা আঁতকে উঠছে। টিনের চালের ওপর আম গাছের বড় ঠেলটা বাতাসে টিনের চালায় দুড়ুম দুড়ুম শব্দ করছে। আবার কখনো কখনো বাতাসের ঝাপটায় মোচড় দিয়ে ওঠে ঘরটা। কখন যে উড়ে যায় ঘরের চাল।

বাতাসের সঙ্গে প্রচ- বৃষ্টিও হচ্ছে। সে বৃষ্টি তীরের ফলার মতো পড়ছে। এ বৃষ্টিতে ছাতা নিয়ে বেরোনোর উপায় নেই।

আশ্বিনের শেষে এ বৃষ্টির পানি বেশ ঠান্ডা। ভিজলেই শীত চেপে ধরবে। এ জন্য হয়তো রিকশা বা অটোওয়ালা তেমন একটা বের হয়নি। আর বের হলেও কাঁচা রাস্তা দিয়ে কাদা-পানি ভেঙে এখানে সহজে আসতে চাইবে না। তাহলে মোহিত ও বকুল কী করে এখানে আসবে?

দুই দিন আগে মোহিত বলেছে, শফিফ ভাই, দুপুরের খাবার পর ৩টার দিকে আপনার ওখানে যাব। অর্থাৎ আজ শুক্রবার ছুটির দিন, ওদের আসার কথা। এর আগেও ওরা পাঁচ-ছয় দিন এসেছিল, ছুটির দিনে। তবে একদিন ওরা আগেভাগে এসেছিল। সেদিন বকুল রান্না করেছিল দুপুরের। ওর হাতের সুস্বাদু রান্না সেদিন চেটেপুটে খেয়েছি। এর পর ওকে বলেছি, তোমরা যখন আস-ই তাহলে একটু সকাল সকাল এসো। এলে খাবারের টেস্ট চেঞ্জ করা যাবে। জানো তো কাজের মেয়ের হাতের রান্না খেতে খেতে অরুচি ধরেছে।

তখন বকুল মুচকি হেসে বলেছে, শফিফ ভাই সে সুযোগ তো নেই। এমনিতে দুপুরের পর বাড়ি থেকে বেরোলে মা প্রশ্ন করেন, কোথায় যাচ্ছিস? তখন জবাব দিই, রেবাদের বাসায় যাচ্ছি। মা তখন ধরে নেয়, আমি ওখানে লেখাপড়ার কথা বা আড্ডা জমাতে যাচ্ছি। মা’র মাথায় এখনো ঢোকেনি প্রতি শুক্রবার একই সময় বের হয়ে যাচ্ছি...। রেবা আমার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। তার কথা বলাতে তেমন আপত্তি তুলছে না। আর ৩টার আগে বেরোলেই মা প্রশ্ন করে বসবেন, কোথায় যাচ্ছিস, কেন যাচ্ছিস? এর উত্তর দিতে দিতে পেরেশান হতে হবে। শেষে একদিন বেরিয়ে আসবে থলের বিড়ালটা। কারণ, মিথ্যা দিয়ে সত্য চাপিয়ে রাখা যায় না। তখন দশ নম্বরের মহাবিপদ সংকেত বেজে উঠবে। এমনিতে আমি খুব ভয়ে আছি শফিক ভাই।

কথাগুলো বলার পর বকুল গম্ভীর হয়ে যায়।

মোহিত ও বকুলের আসা নিয়ে এখানেও ফিসফাঁস হয়। চপল একদিন খুনসুটি মেরে বলেছিল, ওরা কেন এখানে আসে?

চপলের সেই প্রশ্নের উত্তর আমি ক্ষোভের সঙ্গে দিয়েছি। বলেছি, ওরা এখানে আসে আবাল-আবাল খেলতে। এ খেলার সুযোগ আমিই ওদের দিই। ওরা যখন আসে, তখন আমি ঘরের বাইরে চলে যাই। ঘুরে বেড়াই এখানে-ওখানে। তখন ওরা দরজা বন্ধ করে...

চপল হোঁচট খায়, আমা বেফাঁস কথায়। এরপর মুখটা ছোট করে ফেলে। ওর ধারণা ছিল না, আমি এ ধরনের কথা বলতে পারি। ও জানে, আমি হাসি-খুশি ভরা একজন মানুষ। হাসি দিয়ে অনেক জটিল বিষয়ও এড়িয়ে যাই।

চপল বয়সে আমার চেয়ে ছোট। ঊর্ধ্বতন না হলেও চাকরিতে আমি ওর বেশ সিনিয়র। এসবের পরেও আমরা দুজন এক ঘরে থাকি। ঘুমাই পাশাপাশি বিছানায়। তবে ও তেমন একটা খোলামেলা নয় আমার কাছে।

পরে বুঝতে পেরেছি চপল কেন ওভাবে প্রশ্ন করেছিল। আশপাশের লোকেরা ওকে উসকে দিয়েছিল, মোহিত ও বকুলের আসা নিয়ে। তা না হলে ও বলত না কথাটা। কারণ মোহিত ও বকুল যে এখানে আসে, তা চপল কখনো দেখেনি।

ও শুক্রবার এখানে থাকে না। বৃহস্পতিবার অফিস করে চলে যায় কাউনিয়ায়, গ্রামের বাড়িতে। বউ-বাচ্চার কাছে। শনিবার সকালে ট্রেনে ফিরে এসে অফিস করে।

পাশে লাগোয়া আরও দুটো ঘর আছে। সে ঘর দুটোতে চারজন লোক থাকে। তারাও চাকরি করে এনজিওতে। কিন্তু তাদের এনজিও ভিন্ন। আমার সঙ্গে তাদের তেমন কোনো কথা হয় না। তবে চপলের সঙ্গে তাদের বেশ ওঠাবসা আছে। তারাই হয়তো মোহিত ও বকুলের ঘটনাটা বলে দিয়েছে।

চপলের প্রশ্নের উত্তর রাগতভাবে দিলেও বিষয়টি নিয়ে বেশ কয়েকবার ভেবেছি। মোহিত ও বকুলকে প্রশ্রয় দেওয়া কতটা ঠিক হচ্ছে। বকুল স্থানীয় মেয়ে। কলেজে লেখাপড়া করে। মোহিতের বাড়ি যশোরে। ও এনজিওতে ফিল্ড ওয়ার্কার। আমিও এনজিওতে কর্মরত। স্থানীয় লোক না। দুজনের গোপন অভিসারের সহযোগিতা করার খেসারত আমাকে দিতে হবে কিনা।

শুনেছি, বকুলের এক চাচা খুব প্রভাবশালী। আগামীতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একটি বড় রাজনৈতিক দলের নমিনেশন নেবেন। এলাকার লোক তাকে মান্য করেন। আবার ভয়ও করেন তাকে। খুব মেজাজি লোক বলে। তার বাঁকা চোখ যদি একবার মোহিত কিংবা আমার ওপর পড়ে যায়, তাহলে পাততাড়ি গুটিয়ে নেওয়ার সময় থাকবে না। এসব ভাবার পরও ওদের আমি প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছি।

ভালো লাগছে না শুয়ে থাকতে। দুপুরের খাবারের পর শুয়ে পড়েছি। ঘুমও আসেনি। মোহিত ও বকুলের কথা ভাবতে ভাবতে।

ওরা আসতে চেয়েছে। কিন্তু ওরা কী করে আসবে? এই ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে। এক দেড় মাইল পথ পায়ে হেঁটে।

এখন ক’টা বাজে, তা জানা যাচ্ছে না, ঘড়ি না দেখা পর্যন্ত। ওটা টেবিলের ওপর রয়েছে। মোবাইলটাও। ও দুটো দেখতে হলে টেবিলের কাছে যেতে হবে।

ঘড়িটা দেখলাম, বিছানা থেকে উঠে গিয়ে। চারটা বিশ বেজে গেছে।

মোহিত ও বকুল কী আর আসবে না?

সিগারেটের প্যাকেটটা নিলাম টেবিলের ওপর থেকে। ম্যাচ ঠুকে একটা সিগারেট ধরালাম। কয়েকটা ঘন ঘন টান দেওয়ার পর মনে হলো ঘরটা বেশ অন্ধকার। হ্যাঁ, অন্ধকারই। এমনিতে ঝড়-বৃষ্টির দিন। এর ওপর ঘরে দরজা-জানালা বন্ধ। এ অবস্থায় ঘর অন্ধকার থাকার কথাই।

ঘরে দুটো জানালা। একটা দক্ষিণে, অন্যটা পুবে। দক্ষিণের জানালার দিকে এগুলাম না। কারণ ঝড়-বৃষ্টি আসছে দক্ষিণ দিক থেকে। ওটি খোলার সঙ্গে সঙ্গে বাতাসের ঝাপটা আসবে ঘরের ভিতর। তখন বৃষ্টির পানিও ঢুকবে। ভিজে যাবে ঘরটা। পুবের জানালাটি খুললাম। খুলতেই চোখে পড়ল একটা মেয়েকে। সে দাঁড়িয়ে আছে।

জানালার সঙ্গে লাগোয়া এক চিলতে বারান্দা। বারান্দায় মাত্র দুটো কাঠের খুঁটি। সে খুঁটির একটিতে হেলান দিয়ে আছে মেয়েটা। তার পাশে একটা কুকুর দাঁড়িয়ে আছে। ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে কুকুরটাও এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছে। মেয়েটার সারা শরীর ভেজা। যেন পুকুরের পানিতে ডুব দিয়ে এসেছে। তার শাড়ি ব্লাউজ থেকে পানি পড়ছে চুইয়ে চুইয়ে। ভেজা শাড়িটা দিয়ে সে অনেক কষ্টে আড়াল করে নিয়েছে বুকপিঠ। আব্রু ঢাকতে সে কার্পণ্য করেনি। শীতে কাঁপছে, তা সামলে নেওয়ার জন্য অনেকটা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কাঠের খুঁটিটা চেপে ধরে। 

আর একটু এগিয়ে গিয়ে জানালার শিকের ফাঁক দিয়ে সিগারেটের টুকরোটা ফেলে দিলাম। এরপর তাকালাম মেয়েটার মুখের দিকে। সে মুখ ঘুরিয়ে নিল না। কিন্তু মাথাটা নিচু করে ফেলল। তার দৃষ্টি পড়ে থাকে তার নগ্ন পায়ের ওপর।

মেয়েটার বয়স কত হবে, তা অনুমান করলাম। তার বয়স হবে বাইশ-তেইশের মতো। বৃষ্টি ভেজার পরও তার মুখের মলিনতার ছাপ মুছে যায়নি।

বৃষ্টির ছাঁট মেয়েটির গায়ে লাগছে তা সে মালুম করছে না। বৃষ্টি থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য সে আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু সে বৃষ্টি এখনো তার গায়ে পড়ছে। বৃষ্টি থেকে মুক্ত হতে হলে ঘরের বেড়ার কাছাকাছি তাকে দাঁড়াতে হবে। অর্থাৎ জানালার পাশে তাকে আসতে হবে।

সে কুকুরটার মতো নীরব।

ভাবলাম, মেয়েটা ওভাবে থাকলে আরও কষ্ট পাবে। আচ্ছা, তাকে ভিতরে ডাকা যায় না। ওখানে থাকার চেয়ে ভিতরে অনেক নিরাপদ।

আবার ভাবলাম, তাকে ডেকে ভিতরে নিয়ে এলে সমস্যা হবে। তার ভেজা শাড়ি-সায়া-ব্লাউজের পানিতে ভিজে যাবে ঘরের মেঝে। ভেজা কাপড়-চোপড়গুলোর পরিবর্তে তাকে শুকনো কাপড় চোপড় দেওয়া যাবে না। কারণ, ঘরে কোনো মেয়ে মানুষের কাপড় নেই।

এ ছাড়া মনে পড়ে গেল পাশের ঘরের লোকদের কথা। তারা চপলকে উসকে দিয়েছিল, মোহিত ও বকুলের ব্যাপারে। আজ যদি মেয়েটাকে ডেকে এনে ঘরে আশ্রয় দিই তাহলে তারা নানান কথা ছড়াবে। বলবে উনি বিপত্নীক মানুষ তো...

জানালার পাশ থেকে এসে টেবিলের কাছে দাঁড়ালাম।

আর একটা সিগারেট ধরালাম। কেমন জানি অস্থিরতা চেপে ধরল। মেয়েটাকে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। নানান প্রশ্নও উঁকি মারতে থাকে মনের ভিতর।

বৃষ্টি পড়ছে আগের মতো। বাতাসও বইছে তেমনি। ঘরের চালের ওপর আম গাছের ঠেলটা দুড়ুম দুড়ুম শব্দ করছে বাতাসে।

ঝড়-বৃষ্টি যে এখন থামবে সে সম্ভাবনা নেই। এ অবস্থায় মোহিত ও বকুল আসবে কী করে?

আচ্ছা, মোবাইলে একবার রিং দিয়ে জেনে নিই না, তোমরা-

-না, দরকার নেই।

মেয়েটির দিকে তাকালাম। সে আগের মতো শীতে কাঁপছে। শীতের প্রকোপে তার ঠোঁট দুটো কালছে হয়ে গেছে।

আমি যে এনজিওতে কাজ করি, তাতে দুস্থ-অসহায় মানুষের সহযোগিতা করা হয়। সাহায্য-সহযোগিতাই হলো আমার চাকরি। এর বিনিময়ে আমি মাসে মাসে টাকা পাই। সে টাকা দিয়ে আমার জীবন নির্বাহ হয়। আর এখানে একটি মেয়ে দুর্যোগের দিনে ভিজে একাকার হয়ে এসেছে। তার জন্য আমি কিছুই করতে পারব না? সেটা কেমন কথা।

মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে জানালার দিকে এগুলাম, মেয়েটিকে ডাকতে। তুমি ভিতরে এসো। ওখানে ওভাবে দাঁড়িয়ে থেকে কষ্ট করবে কেন?

মেয়েটাকে ডাকা গেল না। বারান্দায় এক বুড়ো লোককে দেখে। লোকটা বৃষ্টিতে ভিজে কাঁপতে কাঁপতে এসে বারান্দায় আশ্রয় নিয়েছে। তার পরনের কোঁচকানো পুরনো ময়লা পাঞ্জাবি ভিজে গায়ের সঙ্গে লেপটে গেছে। মাথার টুপিটা মিশে গেছে চুলের সঙ্গে। তার কাঁধে ঝুলানো একটি কাপড়ের ঝোলা। সেটিও ভিজে গেছে।

লোকটা আমাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, বাবা, দিয়াশলাই অইবো।

আমি বললাম, হ্যাঁ, হবে।

টেবিলের কাছে গিয়ে ম্যাচটি নিলাম। ম্যাচটি দেওয়ার সময় মনে হলো, শীতে অস্থির হয়ে পড়েছেন লোকটা।

ম্যাচটি নেওয়ার পর লোকটি ভেজা ঝোলার ভিতর থেকে বিড়ির প্যাকেট বের করলেন। বিড়ির প্যাকেটটা মোড়ানো ছিল পলিথিন দিয়ে। একটা বিড়ি নিয়ে সে কাঁপতে কাঁপতে ধরালেন।

বিড়িতে কয়েকটা ঘন ঘন টান মেরে খুকখুক করে কাশতে থাকেন।

ম্যাচ দেওয়ার কথা তিনি ভুলে গেছেন। আমি লোকটার দিকে তাকাচ্ছি। এরপর তাকাচ্ছি মেয়েটির দিকে। মাঝখানে কুকুরটা আগের মতো দাঁড়িয়ে আছে, বৃষ্টির দিকে মুখ করে। বারান্দায় শুকনো জায়গা থাকলে কুকুরটা হয়তো কুন্ডলি পাকিয়ে শুয়ে থাকত নিজের শরীর থেকে তাপ নিতে।

জানালার কাছ থেকে আবার চলে এলাম টেবিলের কাছে। টিনের চালে আবার দুড়ুম দুড়ুম করে শব্দ হলো, ঠেলের আঘাতে। ভাবলাম, আজ ঝড়-বৃষ্টি আর থামবে না।

এ ঝড় বৃষ্টি ঠেলে মোহিত ও বকুল আসবে কী?

এবার লোকটার কণ্ঠ শোনা গেল, লও-

মুখ ঘুরিয়ে তাকাতেই চোখে পড়ল তার ডান হাতটা। জানালার শিকের ভিতর দিয়ে ম্যাচসহ হাত বাড়িয়ে ধরেছেন।

ম্যাচটা নিতে গিয়ে চোখে পড়ল মেয়েটাকে। সে বারান্দা থেকে নেমে চলে যাচ্ছে রাস্তা ধরে।

মনে মনে বলে উঠলাম, মেয়েটা এখন কোথায় যাবে? কিছু দূর এগোলে বাজার। সেখানে যাবে কি মেয়েটা? না, অন্যখানে। দূরে, বহু দূরে যাবে।

মেয়েটার হালকা-পাতলা শরীর। বাতাসের বেগের মধ্যে সে সোজা হয়ে হাঁটতে পারছে না। একটু কুঁজিয়ে, পাহাড়ে ওঠার মতো এগিয়ে যাচ্ছে।

বুড়ো লোকটা আর দাঁড়িয়ে থাকল না। সেও বারান্দা থেকে নেমে চলে যেতে লাগল ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে।

বারান্দায় শুধু দাঁড়িয়ে থাকল কুকুরটা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর