শুক্রবার, ১৫ মে, ২০২০ ০০:০০ টা
গল্প

একাকিত্ব

আনোয়ারা সৈয়দ হক

একাকিত্ব

রাজিয়া বানুর চেম্বারে আজ ভিড় কম। ভিড় কম হলে অবশ্য ভালো। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরা যাবে। মনে মনে ভাবলেন রাজিয়া। তিনি মানসিক অসুখের বিশেষজ্ঞ। শেষের তিনটে রোগী দেখলেই আজ মোটামুটি ছুটি। বেল টিপলেন রাজিয়া। অর্থাৎ তার সহকারীকে অনুরোধ করলেন রোগী পাঠাতে।

রোগী যখন ঘরে ঢুকল তখন দেখলেন হুইল চেয়ারে করে একজন প্রায় সত্তর বছর বয়সের বছরের বৃদ্ধ তার চেম্বারে ঢুকছেন। বৃদ্ধের মুখ হাসিহাসি। তিনি আপন মনে কথা বলছেন। কখনো বা অদৃশ্য কারও দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ছেন। কখনো শব্দ করে হেসে উঠছেন।

রোগী ঘরে ঢোকা মাত্রই রাজিয়া বানুর ডায়াগোনসিস এবং চিকিৎসা ব্যবস্থা কী হবে মনে মনে সারা! আজ কম বছর হলো না তো তিনি এসব রোগী দেখছেন।

রোগীর সঙ্গে আর তিনজন আত্মীয় ঘরে ঢুকলেন। প্রত্যেকের মুখে একটি বিরক্তির ভাব। যেন এরকম সুন্দর বিকালটা তাদের মাঠে মারা যাচ্ছে ডাক্তারের চেম্বারে এতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করে।

কিন্তু কী আর করা।

রোগীর মাঝবয়সী ছেলে বলে উঠলেন, আমার বাবা। আজ বছর দুয়েক ধরে এরকম আপন মনে কাদের সঙ্গে যেন কথা বলেন।

রাজিয়া তার কথা শুনে মাথা নাড়লেন।

আমার শ্বশুর। দেখতে বেশ সুন্দর মাঝবয়সী মহিলাটি বলে উঠলেন।

আর ষোল সতেরো বছরের মেয়েটি রোগীর দিকে তাকিয়ে গম্ভীরভাবে বলে উঠল, আমার দাদা।

রাজিয়া সব বুঝলেন।

রোগীর ছেলে বললেন, আমার বাবা কিছুদিন আগে মানে বছর দুই হবে জন্ডিসে ভুগছিলেন। তারপর ভালো হয়ে যান। এর কিছুদিন বাদে দেখা গেল, তিনি আপন মনে কথা বলছেন। হাত নাড়ছেন। ছাদের দিকে তাকিয়ে হাসছেন। দেখে যেন মনে হচ্ছে তার সামনে সব অদৃশ্য মানুষরা দাঁড়িয়ে আছে। আমরা তাকিয়ে চোখে কিছু দেখি না, কিন্তু তিনি যেন দেখতে পান।

রাজিয়া এবার রোগীর ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনার মা কি বেঁচে আছেন?

উত্তরে ভদ্রলোক বললেন, না, বেঁচে নেই। বছর পাঁচেক হলো মারা গেছেন।

রাজিয়া কী যেন চিন্তা করে বললেন, তাহলে ইনি কোথায় থাকেন?

আমাদের সঙ্গেই থাকেন। বললেন ভদ্রলোক।

আপনারা ফ্ল্যাটে থাকেন, নাকি বাড়িতে?

আমরা বাড়িতে থাকি। অবশ্য চারতলা বাড়ি। আমরা দোতলায় থাকি। বাবা নিচের তলায় থাকেন। আর দুটো ফ্ল্যাট ভাড়া।

তো আপনার বাবাকে দেখাশোনা করেন কে?

উত্তরে ভদ্রমহিলা বললেন, আমরাই করি। আমি অবশ্য ব্যস্ত থাকি। একটা স্কুলে পড়াই তো। আমার মেয়েই বেশির ভাগ দেখে। আর কাজের মেয়ে আছে।

রাতের বেলাতেও উনি কি একা থাকেন?

ছেলে উত্তর দিলেন, না। একটা ছেলে রাতে তার সঙ্গে এসে থাকে। সে আমাদের দোকানে কাজ করে।

এ সময় রোগী বলে উঠল, যা, যা, বাজে বকিস নে। তোর দৌড় জানা আছে!

রাজিয়া দেখলেন রোগী তার গায়েবি আওয়াজের সঙ্গে কথা বলছেন।

রাজিয়া বললেন, আপনারা এর মধ্যে কোনো ডাক্তার দেখাননি?

এ কথা শুনে ভদ্র মহিলা ভদ্রলোকের দিকে আড়চোখে তাকালেন। ভদ্রলোক তাড়াহুড়া করে বললেন, না, মানে হ্যাঁ, একজন হুজুরকে দেখিয়েছিলাম। উনি বললেন আমার বাবা কানে গায়েবি আওয়াজ শুনছেন। একটা খারাপ জিন আমার বাবাকে কষ্ট দিচ্ছে। তো উনি দোয়া পড়ে, বাড়ি বন্ধ করে তাবিজ দিয়েছিলেন। অনেক কষ্ট করে সেই তাবিজ ওঁর কোমরে জড়িয়ে দিয়েছিলাম, কিন্তু টান মেরে তিনি সেটা ফেলে দেন। তখন সেই তাবিজ গোপনে তার তোষকের নিচে রেখে দিয়েছি।

শেষ কথাটা তিনি রাজিয়ার কাছে এসে ফিসফিস করে বললেন।

আপনাদের পক্ষে তো তাহলে বেশ কষ্ট হচ্ছে ওঁকে দেখে রাখার। রাজিয়া একটু ভেবে নিয়ে বললেন।

এ কথার উত্তরে ভদ্রলোক একটু বিরস মুখে বললেন, হ্যাঁ। কষ্ট একটু নয়, অনেক হচ্ছে। আমার ছেলে তো এসব একেবারে সহ্য করতে পারে না। বলে, দাদাকে ওল্ড পিপলস হোমে দিয়ে দাও। তা ছাড়া ওর লজ্জাও লাগে। ওর বন্ধু-বান্ধব বাসায় এলে বাবা খুব হৈ চৈ করেন। বলেন, শত্রু এসেছে, শত্রু। দরজা লাগাও! তা সত্যি বলতে ম্যাডাম, আমার ছেলে যতই বলুক ওল্ড পিপলস হোম, কিন্তু হোম তো এসব মানুষদের নেবে না। মাঝে মাঝে বাবা খুব চিৎকার করে কাদের যেন গালি দেন। জিনিস ভাঙচুর করেন।

রাজিয়া এবার নড়েচড়ে বসলেন।

বললেন, তো এতদিনেও একবার ডাক্তার দেখালেন না কেন? তাহলে এসব কিছু হতো না। এই ধরনের অসুস্থতার তো খুব ভালো চিকিৎসা আছে।

এ প্রশ্নের উত্তরে ভদ্রমহিলা বলে উঠলেন, হ্যাঁ, আমিই তো আমার স্বামীকে বললাম, আব্বাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে চলো। আমাদের বাড়ির ভাড়াটে একজন তিনিও এ কথা বললেন।

রোগী এবার ছাদের দিকে তাকিয়ে কাকে যেন লক্ষ্য করে মিটি মিটি হাসতে লাগলেন। সঙ্গে সঙ্গে বিড় বিড় করে চলতে লাগল কথা। মাঝে মাঝে খুব সমজদারের মতো মাথাও নাড়ছেন।

ভদ্রলোক বললেন, আমার ছোট ভাই আমেরিকায় থাকে, সে বিশেষ করে আপনার কথা বলল। গুগুলসে নাকি আপনার নাম দেখেছে।

রাজিয়া হঠাৎ বলে উঠলেন, যে বাড়িতে আপনারা থাকেন সে বাড়িটা কি আপনার?

উত্তরে ভদ্রলোক বললেন, না। আমার বাবার। আমরা দুই ভাই। ছোট ভাই আমেরিকায় থাকে।

এ কথা শুনে রাজিয়া হঠাৎ বলে উঠলেন, তাহলে আপনার ছেলেকে বলেন না কেন, তার দাদা ওল্ড পিপলস হোমে কেন যাবেন? তার নিজের বাড়িতে তিনি থাকবেন। এই বাড়ি তো তাঁর কোনো ছেলে কিনে দেয়নি বা তৈরি করে দেয়নি। বরং এই ভদ্রলোকের বাড়িতেই তো আপনারা আছেন। হয়তো ভাড়াও দেন না এজন্য বাবাকে!

কথাটা বলেই মনে মনে নিজেকে গালি দিলেন রাজিয়া।

এই রে, আবার তিনি রোগী দেখতে গিয়ে সামাজিকতার বেড়া ডিঙিয়ে ফেললেন! এজন্য তাকে কতবার করে যে তার স্বামী সতর্ক করে গেছেন। রাজি, সাবধান। তুমি রোগী দেখতে গিয়ে অনেক হাবিজাবি কথা বলে ফেল। তুমি সমাজ সংস্কারক নও। তুমি ডাক্তার। একটি গন্ডির ভিতরে তোমার কাজ কাম। মনে রেখ!

কিন্তু রাজিয়া বানুর দোষ হচ্ছে তিনি প্রায়শ এই সতর্কবাণী ভুলে যান। তার স্বামী যখন বেঁচেছিলেন, তখনো ভুলে যেতেন। এখন যেন আরও বেশি করে ভুলে যাচ্ছেন। কোন দিন যে কী বিপদ হয়!

রাজিয়া নিজেকে আবার সতর্ক করেন।

কথাটা বলার পর পরই রাজিয়া একটু হেসে বললেন, আসলে এসব অসুখ সারা এত সহজ যে, এর জন্য রোগীকে ওল্ড পিপলস হোমে পাঠাবার কোনো দরকার নেই। আমি যে ওষুধ লিখে দিচ্ছি একটু যত্ন করে খাওয়ালেই উনি ভালো হয়ে যাবেন। অসুখটার নাম ওল্ড এজ স্কিজোফ্রেনিয়া। এখন উনি দিন-রাত কানে গায়েবি আওয়াজ শুনছেন, যেমন আপনারা আমার কথা যেরকম শুনছেন ঠিক তেমনি। এবং সেসব কথা তিনি বিশ্বাসও করছেন। তবে চিন্তার কোনো কারণ নেই। ওষুধ লিখে দিচ্ছি, ঠিক ছয় সপ্তাহ বাদে আবার আমার কাছে নিয়ে আসবেন।

রোগীকে তিন সপ্তাহের ভিতরেই আরও একবার দেখার দরকার ছিল। কিন্তু রাজিয়া এ মাসের শেষে ইউরোপে একটা সেমিনারে যাচ্ছেন, সেখান থেকে একটু বেড়িয়ে আসবেন, সে কারণে ছয় সপ্তাহ।

তবে ওষুধ এত সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছেন যে, কোনো রকমের অসুবিধে হবে না।

সিঁড়িভাঙা অঙ্কের মতো সব কিছু বুঝিয়ে দিলেন রাজিয়া কলেজে পড়া সেই মেয়েটিকে।

নরম সুরে বললেন, তোমার দাদাকে তো একটু এবার দেখতে হবে, বাবু। কয়েকটা সপ্তাহ একটু যত্ন করলেই দেখবে উনি ভালো হয়ে গেছেন। একেবারে আগে যে রকম ছিলেন, সেরকম।

মেয়েটি গম্ভীর হয়ে বলল, কিন্তু আমার তো পরীক্ষা সামনে।

রাজিয়া এরকম কথা শুনে অভ্যস্ত। তিনি বললেন, পরীক্ষা আমাদের সারা জীবনই থাকবে বাবু, এরপর বিসিএস না কি বলে, সে পরীক্ষাও তো দিতে হবে, তাই না?

মেয়েটি উত্তরে এবার একটু মুচকি হেসে বলে উঠল, আমি ওসব বিসিএস ফিসিএস দেব না, আমি সোজা আমেরিকায় চলে যাব। ওখানে আমার চাচ্চু আছেন।

রাজিয়া শুনে হেসে বললেন, তাহলে তো আরও ভালো খবর!

ছয় সপ্তাহ বাদে আবার চেম্বারে বসেছেন রাজিয়া বানু। ভেবেছিলেন এতদিন বাইরে ঘুরে এসে কাজে বুঝি মন লাগবে না! কিন্তু রোগীদের দিকে তাকিয়ে তার মনে হলো রোগীরা তাকে যেমন মিস করেছে, তিনিও তেমনি তাদের মিস করেছেন।

এক রোগী বললেন, আপনি বিদেশ গেলে আমার নিজেকে এতিম মনে হয়, ম্যাডাম!

আমারও! বললেন ম্যাডাম, অর্থাৎ রাজিয়া বানু। তবে মনে মনে বললেন। বাইরে শুধু হাসলেন।

কয়েকজন রোগী দেখার পর সেই ভদ্রলোক তার বৃদ্ধ বাবাকে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। সঙ্গে তার স্ত্রী।

মেয়েটি এবার আসেনি। কিন্তু ছেলেটি এসেছে। শোনা গেল সেই নাকি গাড়ি চালিয়ে নিয়ে এসেছে। যেহেতু তাদের ড্রাইভার ছুটিতে।

ছেলের চেহারা বেশ লম্বা-চওড়া। হ্যান্ডসাম।

সেই হুইল চেয়ার টেনে ঘরে ঢুকল।

রাজিয়া একবার মাত্র তার স্মৃতি নাড়াচাড়া করে রোগীর দিকে তাকালেন। রোগীর মুখ গম্ভীর। যেন তিনি একটু হতবুদ্ধি।

রাজিয়া তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার কানে কি গায়েবি আওয়াজ আর আসে, ভাই?

নাঃ। রোগী কিছুটা যেন বিরক্ত হয়ে বললেন।

উত্তর শুনে রাজিয়া বানু মনে মনে খুব খুশি! আরে কতবড় একজন ডাক্তার তিনি।

কবে থেকে গায়েবি আওয়াজ আর আসে না? রাজিয়া হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন।

সেই কবে থেকে। মনে নাই। রোগী বলল।

রোগীর ছেলে বলে উঠলেন, আমার বাবা এখন একেবারে শান্ত হয়ে গেছেন, ম্যাডাম। নিজে থেকেই ভাত চেয়ে খান। গোসল করেন। আগে তো গোসল করতেই চাইতেন না। আপন মনে বিড় বিড় করে কথা বলা, হাসা, এদিক ওদিক চোখ চালাচালি করা, সব বন্ধ হয়ে গেছে। কাজের মেয়েটা আগের মতোই সকাল বেলা এসে সবকিছু করে দিয়ে যায়। রাতের বেলা একটা ছেলে এসে তার ঘরে ঘুমায়। তবে এখন একটাই সমস্যা ওষুধ খেতে চান না। বলেন, ওষুধ আমি খাব না।

তাহলে, ভাইসাব, আপনি এখন ভালো আছেন, কি বলেন?

ভদ্রলোকের কথা শুনে রাজিয়া বানু উৎসাহিত হয়ে বলে ওঠেন।

কে বলে আমি ভালো আছি? আমি ভালো নাই! রোগী বলে উঠলেন।

তার কথা শুনে রাজিয়া মনে মনে অবাক। একটু থমকে গিয়ে বললেন, এ কথা কেন বলছেন, ভাই-

আরে রাখেন, ভাই! রোগী বলে উঠলেন। ভাই বললেই সব হয়ে গেল, তাই না? আমার কানে যদি গায়েবি আওয়াজ আসেই, তাতে আপনাদের অসুবিধা কি? যদিও আমি সেটা গায়েবি মনে ভাবি নাই, সত্যি ভাবছি, আর আমার ভাবনাই ঠিক, তারা ছিল আমার বন্ধুর মতো। আমার লগে কত হাসি তামশা করত, কত খবরা-খবর দিতো, কত জোকস করত, কত ফান। আপনি আমারে ওষুধ দিয়া সব বন্ধ করছেন! ক্যান? তারা আপনার কী ক্ষেতি করছিল। আমার বাড়িতে কেউ তো আমার লগে কথা বলে না। দিন যায়, রাত যায়, কেউ কথা বলে না। নাতি-নাতনি কথা বলে না। বউমা কথা বলে না। ছেলে রাত-দিন কামে ব্যস্ত। তাগো সময় নাই। অথচ তাগো রাতের বেলা খাওয়ার টেবিলে কত হাসি-মশকরা। আর আমারে তিনবেলা নিচে ভাত দিয়া যায়। কাজের মাইয়া মুখ ঝামটা মারে। যে চ্যাংরা রাইতে আমার লগে ঘুমায়, সে শুধু মোবাইলে পেঁচাল পারে! আমি বলি এই চ্যাংরা, থাম। তো সে হাসে। কয়, পাগলা বুড়া, চুপ কইরা ঘুমা, আমি আমার গার্লফ্রেন্ডের লগে বাত করি!

তোয়, আপনি আমার কানের গায়েবি আওয়াজ বন্ধ করলেন, ক্যা? ওরা আপনের কি ক্ষেতি করছিল?

ওরা কি আপনের পাকা ধানে মই দিছিল, হ্যাঁ?

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর