শুক্রবার, ২২ মে, ২০২০ ০০:০০ টা
গল্প

বলয়

মৃত্তিকা গুণ

বলয়

অঘ্রাণের কুয়াশার মতো তুলতুলা আমার মাইয়াডা। নয়া সবজির গায়ের রোঁয়ার মথন পশম উঠসে গায়ে। ছোট্ট হৈলদ হাঁসের বাচ্চা যেমুন প্যাঁক প্যাঁক কইরা সারা দিন আমার পিছে পিছে ঘোরে। কতটুক চিনসে হেয় জীবনডারে! বয়স কত হের! শুক্কুরে শুক্কুরে আট বচ্ছর। ওর উপর একটু গড়ম হয়া থাকলেই আর সইতে পারে না- আইসা আমার পায়ে পায়ে ঘুরে। পেপার কাইটা ছবি জমায়, কার্টুন এর ছবি, পেলেনের ছবি, পুতুলের...। আমার মনে লয়না আমার মাইয়ারে কেউ মারব কইয়া! কেডায় মারবে ওরে! উইতো মিছা কথা কইতেও শিখে নাই। উইতা কারো ক্ষতি করতে যানে না। কারা ওরে নির্যাতন করসে সারারাত? আমার মাইয়া নিজে নিজের গায়ে আগুন দিসে? আত্মহত্যা? আত্মহত্যা করবার চাইয়া আগুন দিসে! আর আমার মাইয়াডারে তোরা ভেলায় ভাসাইয়া দিছস? ভেলা বানাইলি কহন? ওই জারজের বাচ্চারা, ওই ইবলিসের বাচ্চারা, আমার মাইয়া গায়ে আগুন দিব কিল্লিগা! হেয় আগুন চিনে? আমার মাইয়া সবতে আগে আমার বগলে আইব না? মাইয়াডাতো কোন কিচ্ছা ছাড়াই খালি মা...মা ...বুলায়-আমিই তিক্ত হইয়া যাই যবান দিতে দিতে। উই মরণের আগে দিয়া আমারে বুলাইলো না কিল্লিগা? আগুন ... গায়ে আগুন দিবো কিল্লিগা হেয়। আগুন তো তোরা দেস। আগুন দিয়া মাইনসের সংসার পুড়াস, বিশ্বাস পুড়াস, মাইনসের সুখ পুড়াস।

আমি বিশ্বাস যাইনা তোগো। আমার মা কই সেতো মরে নাই! সেও তো নির্যাতিত হইসিলো যুদ্ধের সময়। একডা মাস আসিলো ক্যাম্পে। কি আকুষ্টা কাল গেসে। হেরপর শ্যাষম্যাষ দেশে যুদ্ধ শেষ হইলো। আব্বার লগে মায় বিয়া বইলো, আমি হইলাম। মায়ে ভাবলো, যুদ্ধ শেষ হইলো তারও। চাইরোদিকে খালি সন্ধ্যে, জুলুমের কাল আসিলো সময়ডা। হগগলে সন্দেহ করে হগগলরে। হের মইধ্যে আমার চক্ষু দুইডা কটা, ব্যাকে কইলো আমি পাকিস্তানির পয়দা। জারজ। জাউরা। কই? আমার মায়ে তো মরে নাই এইডা শুইনা। গতরে আগুন দেয়নাইক্কা। আমারে বুক দিয়া আগলাইয়া রাখসে। হেই বেডি তো আত্মহত্যা করেনাইক্কা। আমার মাইয়া তাইলে মরতে চাইব কেন? স্বাধীনের এতোডি বছর পরে দ্যাশে কি আকুষ্টা কাল শ্যাষ হয় নাই! স্বাধীন কি খালি দ্যাশ ওইসে দ্যাশের মাইয়ারা অয়নাইক্কা?

আমি বিশ্বাস যাই না। আমার মাইয়া আত্মহত্যা করতে পারে না। ক্যান করব? আমি তো মরিনাই অহনতরি। লড়ছি, লড়তাছি। এইগুলা দেখেনাই আমার মাইয়া? সেতো দেখসে আমি পাথ্থরের লাহান শক্ত একটা মানুষ। দুনিয়া কি এখন আগের থনও বেশি জালিম হয়া গেসে, যে মরতে হইব! ঐ যে বড়চাচায় যায়। চাচা, ও চাচা এমুহি আহেন। কন সবতেরে কন-আপনি যে ছুডুবেলায় আমারে আইসক্রিম খিলাইতেন আর আমার ফরকের ভিতর হাত ঢুকাইয়া দিতেন, আমি চিখ্খুর দিলে, কাঁনলে আমার মুখডা চাইপা ধইরা ভয় দেখাইতেন, কইতেন আমারে আমার আসল বাপের কাছে দিয়া আইবেন! আর আমি ভয়েডরে চোক্ষু দুইটা মুইঞ্জা ফালাইতাম। মনে মনে তখন আমার খাচায় রাখা চড়ুই পাখিডার কথা ভাবতাম। যানেন চাচা, লগে লগে ওই পাখিটা আমার বগলে এক্কেরে সামনে আইয়া পরতো- আমারে উড়ায়া নিয়া যাইতো মেঘের উপর দিয়া, ম্যাঘের দেশে। হেই ম্যাঘের দ্যাশে একটা রাজপুত্তুর আসিলো-হেয় আমার বন্ধু আসিলো। হের পিরানে আসিলো সাত আসমানের রঙ। হেয় আমারে তার দেশডা ঘুড়াইয়া দেহাইসে। ওইহানে সব বাচ্চা পুলাপানরা হাসে, কান্দেনা। কেউ ভয়ে কুকড়াইয়া থাহেনা। হেইদ্যাশে কত খাইদ্য খালি ভাত আর ভাত। ভাতের কুনু অভাব নাই। ওই দ্যাশের হগগল মাইনষের কান্ধে পাঙ্খা। পোলা আর মাইয়া নাই-হগগলে স্বাধীন, আর দেখতে কি সোন্দর! হেইহানে কুনো বাচ্চারে কেউ দুঃখ দেয় না। হগল বাচ্চাগোর মুখে হাসি, হাতে খেলনা। তয় হেইহানে একডা খাচার ভিৎরে কতগুলা পশু আটকাইনা থাকে-যাগো বদন সুরৎ হুবহুব্ মাইনষের লাহান। ঠিক আফনের মতোন, ইস্কুলের বাবু স্যারের মতোন, মহল্লার মোড়ের মাথার তিনকোনা ইচ্চা দোকানের হেই দর্জিটার মতোন। জীবনে পরথম ভালোবাসা দিসিলাম যে রতনরে, বিশ্বাস করসিলাম-হের মতোন দেখতেও একডা যন্তু আসে সেই খাঁচায়। সবগুলান জানোয়ারের লেজ আসে আর জিব দিয়া সারাডাক্ষণ কুত্তার লাহান লালা ঝরতাসে- কামড়ানির লুভে। খাওনের লালচে। কিন্তু ওই দ্যাশে ওই জানোয়ার গুলারে কেউ খাওন দেয় না। খাইবার চাইলেই আগুনলাখড়ির কাড দিয়া বাইড়ায়। বাইড়াইতে বাইড়াইতে মুখটা থ্যাঁতলা কইরা ফালায় য্যান আর কুনদিন খাইতে না পারে।

বলতে বলতে সেই দৃশ্যে হারিয়ে যায় সখিনা আর নির্যাতনের বর্ণনা তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। উড়ে এসে গালের চাপায় হঠাৎ আছড়ে পরা একটা লাথ্থিতে, রক্তের নোনতা স্বাদ ছিটকে পরে মুখের ভেতর এবং জ্বিভে। সে লাথিতে আক্রোশের জোর ছিলো বেশুমার-তাই জখম মুখে রক্তের স্বাদ চাকতে চাখতে মুখ বন্ধ করতে বাধ্য হয় সখিনা। কিছুটা সময় মাথার ভিতরটা ভন ভন করতে থাকে তার, চোখ অন্ধকার। তারপর কিছুটা সময় গেলে মাথার ভেতরের অন্ধকারটা কাটতে শুরু করে। সে দেখতে পায়-বড় চাচা সামনে দাঁড়ানো।

চাচার চোখ গুলান হঠাৎ অনেক বড় হইয়া গ্যাছে-মুখডা জুইড়া খালি চোখ। আগুন জ্বলতাসে চোখে। চোখগুলা চিৎকার করতাসে-মাগি, শালি, জাউরা, তোগো পুরা ফ্যামিলি চল্লি আমার কান্ধের উপরে এখন আমার নামে নোংরামি করস না? জারজের বাচ্চা, আর একটাও মিছা কথা কইলে তোর জিব্বা টাইনা ছিঁইড়া ফালামু। তোর ময়েরে..., তোরে....তোর মেয়েরেও....তুই কি করবি? কি করার আসে তোর?

লাথ্থিটা ততটা না যতটা এই কথাগুলো পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনলো সখিনাকে। চাচার দিকে ভালো করে তাকালো সখিনা- কত বুড়া হইয়া গ্যাসে চাচা। হয়তো স্মরণ করতে পারতেছে না সবকিছু ঠিকঠাক। হাছাইতো-কি বিহিত করবার পারতো তার মা! আর অহন? সেই দিনের সেই ছোট্ট সখিনার জন্য কষ্ট হয় আজকের এই আতঙ্কে, উদ্বেগে কুঁচকে ওঠা মুখ আর জীবন, সংসারের দায়িত্বের ভারে কিছুটা কুঁজো হয়ে পড়া সখিনার। কি জুলুম! কি কষ্ট! সখিনা ফের ভাবে-সেও তো নিজের মাকে কোনো কথা জানায়নি, ভয় পেয়েছে। মায়ের ক্ষমতা নিয়ে বিশুদ্ধ সন্দেহ ছিলো তার।

হাছাইতো কি করবার পারতো মায়ে! আর অহন! চাচা তো কিছুই ইয়াদ করতে পারতাছে না, বুড়া হইছেতো। আচ্ছা, আমার ম্যাইয়াডারও কি আমার মতন যাইতে হইতো সেই ম্যাঘের দ্যাশে? রাজপুত্তুরের সাথে হেরও কি দেহা হইতো! ইশ্শ্! যদি বাইচ্চা থাকতো আমার ম্যায়াটা! তাইলে আমার মাইয়ার মাইয়াডা, হেরও কি কল্পনায় দেখতে হইতো মেঘের দেশ, আর তার যে মাইয়া...আর তার যে মাইয়াডা...তারও...বুক ঠেলে বমির মত শির শির করে আতঙ্ক আর হাহাকার মেশানো মাতম উঠতে থাকে গলা বেয়ে সখিনার। হায় হায়! সব মাইয়া মাইনসের বুকডা কি ইমুন হায় হায় করতাসে না! আইচ্ছা তারা কি হাছাই কুন দিন যাইতে পারব না সেই স্বাধীন ম্যাঘের দ্যাশে? এই দ্যাশটা হইতে পারে না হেই স্বাধীন দ্যাশের মথন? 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর