আশরাফ রিকশা চালাতে পারে দারুণ। ওর কখনো চেইন পড়ে যায় না। জ্যামের মধ্যে ফাঁক ফোকর বেয়ে দিব্যি এগিয়ে যেত পারে। শরীরটাও ভালো বলে ট্রিপ টানতে পারে প্রচুর; মহাজনের কাছে জমা বাকি পড়ার ঘটনা ঘটে না। আশ্চর্য শোনালেও সত্যি, তার অ্যাডভান্স বুকিংও থাকে মাঝে মধ্যে। চেনা-পরিচিতদের কারও শহরের বাইরে যেতে গেলেই মনে পড়ে আশরাফের কথা। তাঁর রেট একটু বেশি। তবু চাহিদা কমে না। ভালো জিনিসের মর্যাদা যে বড় মানুষরাও দেয় এটা জেনে আশরাফ তৃপ্তিবোধ করে। পৃথিবীতে গরিবের গুরুত্ব তাহলে একেবারে শেষ হয়ে যায়নি।
তার স্ত্রী আলেয়ার ওকে নিয়ে গর্বের শেষ নেই। কিন্তু সেই গৌরবের কথা শুনবে কে? সে তাই করে কী, মাঝে মধ্যেই হুট করে চলে যায় বাপের বাড়ি। বাবা ওকে দেখেই প্রমাদ গুনেন। রিকশাওয়ালার বউয়েরা সাধারণত একটা কারণেই বাপের বাড়ি আসে। জামাইয়ের মার খেয়ে।
আলেয়া উদ্বেগ দূর করতে হাসতে হাসতে বলে, ‘তোমাদের জামাইয়ের কান্ড জানো?’‘আবার কী করল হে?’ বাবার উদ্বেগ হাসিতে পুরো দূর হয় না।
‘আমাগো নতুন ইউএনও সাহেব তো এখন আর নিজের গাড়িতে চড়েন না। রাত নাই, দিন নাই, বলেন, এই আশরাফরে ডাকো। ওর রিকশা ছাড়া উনি কোথাও যাইব না।’
‘কস কী?’
‘গত সোমবার, না, না মঙ্গলবার রাত একটার সময় ডাইকা পাঠাইলেন। কোথায় ডাকাত ধরতে যাবেন। আশরাফরে লাগব। আমি তো ভয় পায়া গেলাম। পরে দেখি, বিরাট কান্ড। ইউএনও সাহেব আমাগো দরজার সামনে দাঁড়ায়া।’
‘আমার জামাই তো তাহলে বিরাট লায়েক হয়ে গেছে। তা আসতে কইস একদিন।’
আশরাফ তাই বেশ আছে। ভালো রোজগার, যথেষ্ট পরিমাণ সামাজিক মর্যাদা, স্বামীব্রতা স্ত্রী এবং ৯ বছরের মেয়ে রোজি। মেয়েটাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে। সুন্দর সুন্দর ছড়া-কবিতা বলে। বড়লোকের বাচ্চা কাচ্চাদের সঙ্গে থেকে মেয়েটার গায়ের ভিতর থেকে এক ধরনের সুন্দর গন্ধ বের হয়। আশরাফ রাতে ফিরে সেই গন্ধটা শুঁকে তারপর ঘুমাতে যায়। কী যে ভালো লাগে। মেয়ের গা থেকে রিকশাওয়ালার গন্ধ দূর করলেই জীবন সার্থক। ওরা তিন পুরুষের রিকশাওয়ালা বংশ। চতুর্থ জনে সেটা দূর করবে আশরাফ।
আজ অ্যাকাউন্টস অফিসার সাহেব ওর রিকশায় উঠেছিলেন দুপুরে। গেলেন একটা খেলনার দোকানে। ওনাকে নামিয়ে দিয়ে এক কাপ চা খাওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে ছিল, হঠাৎ দোকানের গ্লাসের দেয়াল ভেদ করে চোখ যায় ভিতরে। অ্যাকাউন্টস অফিসার সাহেব কী সুন্দর একটা খেলনা দেখছেন! একটা মেয়ে পুতুল কিন্তু চাবি দিলে চলছে। আবার এদিক-ওদিকে লাগানো বোতাম টিপলে কথাও বলে। মানুষের বুদ্ধি বটে। শুধু জান দেওয়া ছাড়া সবই করতে পারছে। আচ্ছা জিনিসটার নাম কী? দামই বা কত?
চা খেল বটে কিন্তু বিষয়টা মাথা থেকে গেল না। নাম কী খেলনাটার?
অ্যাকাউন্টস অফিসার সাহেব একটু পর বেরোতেই সে সামনে গিয়ে বলল, ‘চলেন স্যার।’
‘ও তুমি! যাওনি।’
‘না এখানে দাঁড়াইয়া থাকতে ভালো লাগে। বাচ্চারা সুন্দর সুন্দর খেলনা কিনে কীরকম আনন্দ করে। দেখতে ভালা লাগে স্যার।’
‘আনন্দ!’ অ্যাকাউন্টস অফিসার সাহেব একটু বিরক্ত হয়ে বলেন, ‘এই আনন্দের সুযোগটাই তো এরা নেয়।’
রিকশা চলে। আশরাফের খুব ইচ্ছে হয় সাহস করে খেলনাটার নাম জিজ্ঞেস করে। নাম জানলে পরে দামটাও জানা যাবে। একটা বড়লোকী ইচ্ছে ওর মাথায় উঁকিঝুঁকি মারছে। পেছন দিকে তাকিয়ে অবশ্য ওনার চেহারা দেখে সাহসটা চলে গেল। রিকশা চালায় বলে মানুষকে সে খুব ভালো চেনে। জানে বড়লোকদের সঙ্গে কখন কথা বলতে হয় আর কখন চুপ থাকতে হয়। একবার এরকম ভুল করায় একজন ওকে কষে একটা চড় বসিয়ে দিয়েছিল। বিচার নেই এসবের। এদেশে রিকশাওয়ালাদের মারাটা একদম অপরাধের পর্যায়ে পড়ে না।
রিকশা থেকে নেমে অ্যাকাউন্টস অফিসার ভাড়াটা দিলেন প্রসন্ন ভঙ্গিতে। মেজাজ ঠিক হয়ে গেছে। সে ভাঙ্গতি ফেরত দিতে চাইলে বললেন, ‘নিয়ে নে। আজ মেয়ের জন্মদিন। রেখে দে।’ আর তাতেই সাহস চলে আসল আশরাফের। বলে, ‘স্যার জিনিসটা খুব সুন্দর।’
‘সুন্দর তো পয়সায়। পুরো পকেট খালি করে দিল।’
‘স্যার জিনিসটার নাম কী?’
‘নাম দিয়ে তুই কী করবি?’
‘এমনিই স্যার।’
‘নামটা যে কী? এগুলোর আবার গালভারী নাম থাকে। আমিই উচ্চারণ করতে দাঁত ভেঙে ফেলি। তুই হয়তো মরেই যাবি।’
নামটা কীভাবে জানা যায়! সেটা একটা ব্যাপার, সঙ্গে জন্মদিনের ব্যাপারটাও মাথায় উঁকি দিল। সে জানে, জন্মদিন মানে হচ্ছে যে তারিখে মেয়েটার জন্ম হয়েছে। বড় একটা ভুল হয়েছে। ওর মেয়ের জন্মের তারিখটা মনে রাখা হয়নি।
আচ্ছা এক কাজ করলে কেমন হয়, একটা তারিখ নিজে নিজেই ঠিক করে নিলে কেমন হয়! সিদ্ধান্ত নিল, মেয়ের জন্মদিনও সে ঠিক করবে। আর এবারের জন্মদিনে...। ছোটলোকী দূর করতে টাকা-শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে জন্মদিন, খেলনা এসবও লাগে।
আশরাফ আরও কয়েকটা ট্রিপ মেরে বিকালবেলা আবার দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। খেলনাটার নাম জানতে হবে। এমনিতে দোকানদার ওকে পাত্তা দেবে না। নামটা যদি জানা যায় তাহলে হয়তো একটু গুরুত্ব পাবে। তখন জেনে আসবে দাম।
আশরাফ দাঁড়িয়ে এক কাপ চা খেল। একটা বিড়ি ধরাল। আর আশা করে থাকল অন্য কেউ যদি এই খেলনা কিনে বের হয় তাহলে গিয়ে জিজ্ঞেস করবে। হয়তো বলবে না। গাল দেবে। তবে লেগে থাকলে এক সময় হয়ে যাবে।
আশরাফ প্রতিদিন দুপুরে একবার করে যায়। অপেক্ষা আর আশায়। চতুর্থদিনে দেখল ফুটফুটে দুটো বাচ্চা মায়ের সঙ্গে এই খেলনাটা নিয়ে বেরোচ্ছে।
আশরাফ দেরি করল না। সামনে গিয়েই বলল, ‘ম্যাডাম আসেন।’
আশরাফ রিকশায় প্যাডেলটা মেরেই বাচ্চাদের সঙ্গে খাতিরের চেষ্টা শুরু করে। ‘পুতুলটা তো খুব সুন্দর। তোমাগো মতো।’
ছোট মেয়েটা ফিক করে হেসে বলে, ‘এটা তো পুতুল না। আপু এটাকে পুতুল বলছে, লোকটা কী বোকা!’
আশরাফের এত ভালো লাগে। সে কাছাকাছি চলে যাচ্ছে! বলে, ‘আমি মূর্খ-সুর্খ মানুষ। নামটা কী মা?’
এই সময়ই মায়ের মোবাইল ফোনটা বেজে ওঠে। আর মা ধমক দিয়ে বলেন, ‘চুপ। আমি আব্বুর সঙ্গে কথা বলব। চুপ।’
মা কথা বলেন। মেয়েরা চুপ। আশরাফের বুকটা ভেঙে যায়।
কথা চলে। রিকশা চলে। কথা শেষ হয়। রাস্তাও শেষ হয়।
নেমে মহিলা ভাড়া দিচ্ছেন, এই সময় ছোট মেয়েটি আবার বলে, ‘আপু লোকটা কী বোকা? বলে পুতুল।’
মা ধমক দেন, ‘এভাবে বলে না মা। এটা তো পুতুলই।’
‘পুতুল না। এর নাম তো মিউজিক ডল।’
উফ! হয়ে গেল। মিউজিক ডল। একটা মিউজিক ডল কিনবে আশরাফ। যেদিন কিনবে সেদিনই হবে মেয়ের জন্মদিন।
আশরাফ যেন প্রায় ইঞ্জিন লাগিয়ে ফিরে আসে দোকানের সামনে। নাম জানে সে। দোকানদার পাত্তা না দিয়ে পারবে না।
লিনা টয় হাউসের মালিক মাঝবয়সী মানুষ। খেলনার দোকানের মানুষদের হাসিখুশি হওয়ার কথা। কিন্তু এই মানুষের মুখে হাসি নেই। আছে পান। আর আছে ক্রমাগত পিক ফেলার দোষ। একটা সুবিধা অবশ্য আছে। এরকম মানুষ কাউকে খাতির করতে যেমন পারে না, তেমনি অপমান করতেও পারে না।
আশরাফ জানতে চাইল, ‘এই মিউজিক ডলটার দাম কত?’
মালিক কথাই বললেন না প্রথম। ভালো করে ওর লুঙ্গিটা দেখলেন শুধু। আশরাফ আগেই ঠিক করেছে একটা প্যান্ট কিনে নেবে। পরবে দরকারমতো। আজ থাকলে কী ভালো হতো।
আচ্ছা সে কি নামটা ঠিকমতো বলতে পারছে? আবার মনে মনে উচ্চারণ করে নিল। মিউজিক ডল।
তারপর ফের প্রশ্ন করে, ‘এই মিউজিক ডলটার দাম কত?’
‘দাম দিয়া কাম কী?’ মানুষটা খুব নিস্পৃহভাবে বলে। ‘এমনিই।’
‘আমি এখানে জিনিস বেচতে বসছি। দাম জানাইতে বসি নাই।’
নাম তাহলে ঠিকই আছে। আর তাতে আশরাফের আত্মবিশ্বাস চলে আসে। ‘আমি একটা কিনতে চাই।’
মানুষটা আবার ওর লুঙ্গিটা দেখেন। তারপর হাসেন, ‘তুই কিনবি?’
আশরাফের আত্মবিশ্বাসটা এই এক হাসিতে চুরমার হয়ে যায়। বলে, ‘আমি না। আমি না।’
‘তাইলে ক্যাডা?’
‘আমার স্যার। আমারে দামটা জাইনা যাইতে বলেছে।’
‘আড়াই হাজার টাকা। এক দাম।’
আট মাস আগের ক্রেতাকে দোকানদারের মনে থাকার কথা না। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, লিনা টয়সের মালিক ওকে চিনতে পারলেন। টাকা গুনতে গুনতে বললেন, ‘তোর স্যারের এই এক বছর পর সময় হইল। দামও তো বাইড়া গেছে। এখন ২৮০০ টাকা।’
‘কিন্তু উনি তো আমারে...’
দোকানদার ভালো করে ওকে দেখেন। তারপর বলেন, ‘ধসুবিধা নেই। জিনিস নিয়া যা। রসিদ দিতাছি, ওনারে দেখাইয়া পরে দাম দিয়া যাইস।’
আশরাফ ওর এই ভালোমানুষীতে অবাক হয়ে গেল।
আলেয়া দেখে বলল, ‘এইটা কার? খুব সুন্দর তো।’
আশরাফ একটু নাটক করে, ‘এটা আমাদের রোজির হইলে কেমন হইত?’
‘থাক থাক আর বেশি স্বপ্ন দেখার দরকার নেই। মেয়ে যা পায় তাতেই রাজরানী।’
আশরাফ হাসে। তারপর রোজিকে ডাকে। বলে, ‘মা তুমি জানো, আজকা তোমার জন্মদিন।’
মেয়ে পড়াশোনা করায় জন্মদিন-টিন এসব বোঝে। বলে, ‘আগে তো বলোনি।’
‘এখন থাইকা প্রতি বছর ১৫ জানুয়ারি...’
‘কিন্তু হেডস্যার যে লিখে দিয়েছে ১ জানুয়ারি। আমাদের যাদের জন্মদিন আমরা বলতে পারিনি সবাইকে হেডস্যার দিয়ে দিয়েছে ১ জানুয়ারি।’ আশরাফ চিন্তায় পড়ে যায়। ‘তাইলে...’
রোজি বলে, ‘অসুবিধা নাই বাবা। ওইটা তো নকল। এইটা আসল।’
‘অসুবিধা নাই তো?’
‘না।’
নিজের নির্ধারিত তারিখে সমস্যা নাই নিশ্চিত হয়ে নাটকীয়ভাবে ঘোষণা করে, ‘এই আসল জন্মদিনে আমার মায়ের জন্য আসল উপহার।’
আলেয়া বিস্মিত। ‘এইটা তুমি কিনেছ?’
‘হ্যাঁ।’
রোজি হাতে নিয়ে বলে, ‘এটা আমার...আমার। সত্যি বাবা। কেউ নিয়ে যাবে না তো?’ ‘কে নিব?’
ঠিক সেই সময়ই একটু হৈ চৈ শোনা গেল। কিছু মানুষের পায়ের শব্দ। দৌড়ে পালাচ্ছে বোধহয়।
এসব অবশ্য অস্বাভাবিক ব্যাপার না। এই বস্তিতে মদ-গাঁজা খাওয়ার একটা দল আছে। মাঝে মধ্যেই পুলিশ হানা দেয় তাদের কাছ থেকে টাকা নিতে।
অন্যদিকে মন দিয়ে এই সময়টা নষ্ট করতে নেই। আশরাফ আলেয়া আর রোজিকে দেখে। উফ! কী যে খুশি মা মেয়ে। দুজন এমনভাবে জিনিসটাকে ধরছে যেন জোরে হাত দিলে নষ্ট হয়ে যাবে। আর কেউ ক্ষেপে গিয়ে ধমক দেবে। গরিবদের কাছে দামি জিনিস মানেই অন্যের জিনিস।
আশরাফ বলে, ‘এইটা আমাদের জিনিস। ঠিকমতো দেখো। চাবি দাও।’
চাবি দিল। একটা গান শুরু করল পুতুলটি।
আর তখনই কে যেন ভারী গলায় বলল, ‘এখানে কী হচ্ছে?’
আশরাফ বেরিয়ে দেখে থানার সাব ইন্সপেক্টর সাহেব। দুয়েকবার ওকে রিকশায় উঠিয়েছে কিন্তু খুব চেনা-পরিচয় নেই। সালাম দিয়ে বলল, ‘ভালো আছেন স্যার।’
‘ভিতরে কীসের শব্দ?’
আশরাফ মিইয়ে গিয়ে বলে, ‘একটা খেলনা স্যার।’
‘কার খেলনা?’
‘আমার মেয়ের।’
‘তোর মেয়ের খেলনা! দেখি তো কই।’ অপেক্ষা না করেই তিনি ভিতরে ঢুকে বলেন, ‘এত দামি খেলনা! এর দাম কত?’
‘আড়াই হাজার টাকা স্যার।’
‘এত দামি খেলনা তুই কোথায় পেলি?’
‘কিনেছি।’
‘কিনেছিস?’ ইন্সপেক্টর সাহেব হাসেন। ‘চল আমার সঙ্গে।’
‘কোথায় স্যার?’
‘থানায়।’
‘থানায় কেন স্যার?’
‘কোথা থেকে এটা চুরি করেছিস দেখতে হবে না।’
‘চুরি করিনি স্যার। কিনেছি। এই যে রসিদ আছে।’
‘আবার রসিদও জোগাড় করেছিস। চল, থানায় চল। এই ধর এঁকে।’
অন্য পুলিশটি এগিয়ে আসে।
আশরাফের মাথায় রক্ত চড়ে যায়। বলে, ‘স্যার আপনি আমারে অপমান করতেছেন। খাইয়া না খাইয়া টাকা জমাইয়া...’
এরই মধ্যে অনেক মানুষ জড়ো হয়ে গেছে। আশরাফের চেনা-বন্ধুস্থানীয় সবাই। ও চুরি করতে পারে এটা কেউ ঠিক বিশ্বাস করে না কিন্তু এরকম দামি খেলনা একজন রিকশাওয়ালার পক্ষে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় জোগাড় তো সম্ভব না। তাই ঠিক পক্ষে কেউ দাঁড়ায় না।
আশরাফ পুলিশের গাড়িতে উঠতে যাচ্ছে তখনই রোজি দৌড়ে এসে খেলনাটা ইন্সপেক্টরের হাতে দিয়ে বলে, ‘স্যার আমরা প্যাকেটটা খুলিইনি, নতুন আছে।’
ইন্সপেক্টর দেখেন। তারপর বলেন, ‘তাই তো দেখছি। মাত্রই দাওটা মেরে এনেছে।’
রোজি বলে, ‘স্যার আমার বাবা ভুল করেছে। এইটা আপনি নিয়ে যান। বাবাকে ছেড়ে দেন। আমি লেখাপড়া করি, বাবাকে বুঝিয়ে বলব, চুরি করা ভালো না।’
আশরাফের বুকটা ভেঙে যায়। উফ! মেয়েও ভাবছে এটা চুরি।
রোজি বলে, ‘বাবা আমাকে বেশি ভালেবাসে তো। তাই...। মাফ করে দেন।’
আশরাফ চিৎকার করে, ‘মা-রে আমি চুরি করি নাই রে মা।’
ইন্সপেক্টর সাহেব কষে একটা চড় দেন। ‘লজ্জা করে না। এমন একটা ভালো মেয়ে তোর। চুরির আগে মেয়েটার মুখ ভাসেনি চোখে।’
আশরাফ কথার শক্তি হারিয়ে ফেলে। আলেয়ার দিকে তাকায়। আলেয়াও বোধহয় তাই মনে করে। রোজির কথায় তো প্রতিবাদ করেনি।
আশরাফ আর কিছু বলে না। ইন্সপেক্টর সাহেব মেয়ে সম্পর্কে আরও কিছু ভালো ভালো কথা বলেন। একটু আদরও করে দেন।
আশরাফ দেখেও দেখে না। অন্ধকার রাত। গাড়ি চলতে শুরু করে।শীত শীত ভাবের বেশ আরামদায়ক আবহাওয়া। আশরাফের অবশ্য খুব গরম লাগে। আর দমবন্ধ।
পুলিশ দুজন কথা বলে নিজেদের মধ্যে। হাসে খ্যাকখ্যাক করে। আশরাফের কানে যায় না কিছু।
কিছুদূর এগিয়েছে ওরা, তখনই সামনে কে যেন একজন এসে দাঁড়ায়। হাত তুলে গাড়ি থামিয়ে বলে, ‘ইন্সপেক্টর সাহেব একটা কথা ছিল।’
‘কে আপনে?’ ইন্সপেক্টর লাইট মেরে বলেন, ‘ও, লিনা টয়স এর বদরুল ভাই।’
আশরাফ একটু চমকায়। সেই দোকানদার। এখানে কেন?
ইন্সপেক্টর নেমে আসেন।
বদরুল সাহেব বলেন, ‘ওকে ছেড়ে দেন।’
‘ছেড়ে দেব?’
‘জি ছেড়ে দেন। এইটা ওরই জিনিস।’
‘আপনার দোকান থেকে কিনেছে?’ ‘হ্যাঁ।’
‘কিন্তু টাকাটা... চুরি না করলে এত টাকা...’
‘আট-নয় মাসে জোগাড় করেছে।’
‘আপনি কীভাবে জানেন?’
বদরুল সাহেব দরদী গলায় বলেন, ‘কেউ খেলনা কিনতে আসলে গভীরভাবে মানুষগুলোকে দেখি। ভালোবাসার ছবিটা দেখা যায় তো। এই মানুষটা গত বছর যখন লুঙ্গি পরে আমার দোকানে গিয়ে মিউজিক ডলের দাম জানতে চাইল তখনই চেহারাটা মনে রেখেছিলাম। যদিও বলেছিল, ওর স্যার পাঠিয়েছেন কিন্তু চোখ দেখে বুঝেছিলাম কথাটা ঠিক না। নিজের বাচ্চার জন্য কিনতে চায়। কিন্তু টাকা নেই। সাহসও নেই। আমি তাই কৌতূহল নিয়ে অপেক্ষা করতাম, মানুষটা টাকাটা জোগাড় করতে পারল কি না! শেষে আজ ওকে দেখে যে কী আনন্দ হলো। দাম তিনশ টাকা বেড়ে গেছে, তবু ওকে আড়াই হাজার টাকাতেই দিয়ে দিলাম।’
‘বলেন কী?’ ইন্সপেক্টর একটু যেন লজ্জিত।
‘আমি তাই আমার কর্মচারীকে বললাম, লোকটাকে সে চেনে কি না। বলল, চেনে। ও-ই ঠিকানাটা জোগাড় করল। ঠিক করলাম দোকান শেষে বাসায় এসে দেখব আমার ধারণাটা ঠিক কি না। একজন রিকশাওয়ালা এক বছর টাকা জমিয়ে মেয়ের জন্য এরকম একটা খেলনা কিনেছে-এটা তো দেখারই জিনিস। ’
ইন্সপেক্টরের রাগী গলায় এখন মমতার ছায়া, ‘যাক আপনি এসে আমাকে বড় লজ্জা থেকে বাঁচালেন। আমি তো মেরে-ধরে শেষ করে দিতাম। এই ওকে ছাড়ো।’
আশরাফের হাতের বাঁধন খুলে দেওয়া হয়। ইন্সপেক্টর বলেন, ‘নাম ভাই। বড় ভুল হয়ে গেছে। তা তুই বলবি না ভালো করে। নে একটা সিগারেট খা।’
ইন্সপেক্টর এবং বদরুল সাহেব সসম্মানে ওকে বাসায় ফিরিয়ে দিয়ে গেলেন। ইন্সপেক্টর আলেয়ার কাছে মাফ চাইলেন। বদরুল সাহেব বের করলেন এক প্যাকেট চকলেট।
রোজি দৌড়ে এসে বুকে জড়িয়ে ধরেছে। আলেয়া বলছে, আমি জানতাম...।
পাড়া প্রতিবেশীরাও এসেছে আবার। আশরাফ যে চুরি করতেই পারে না, এটা যে তারা জানত সেসব কথাই বলছে ওরা।
আলেয়া চা বসায়। সামনের উঠানে বসে অনেকেই। বেশ একটা উৎসবের মতো ব্যাপার। ওখানে আলোচনায় বারবার ঘুরে ফিরে পুলিশের কাছ থেকে বাঁচার ব্যাপারটাই আসছে। খেলনাটার কথা কেউ বলেও না। ওদিকে তাকায়ও না। আশরাফ দুয়েকবার সেই প্রসঙ্গ ওঠাতে গেল। কারও আগ্রহ নেই। সবার বরং পুলিশ বা পুলিশের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া সংক্রান্ত নানা গল্প মনে পড়ছে। বুড়ো আসগর কুলী বলল, ‘বড় বাঁচা বাঁইচা গেছস রে আশরাফ। মসজিদের বাক্সে দশটা টাকা দিস।’
আর শুধু ওরাই বা কেন? আলেয়া বা রোজিরও এখন মূল আনন্দ- ওকে পুলিশ ছেড়ে দিয়েছে।
বড় অদ্ভুত আর বিষণœ লাগে আশরাফের। রিকশাওয়ালা বা গরিবদের শেষ পর্যন্ত আসলে একটাই পরিচয়। গরিব। বাবা-স্বামী-মানুষ কোনোটাই এরা হতে পারে না।
মার না খেয়ে দিন কাটিয়ে দিতে পারা কিংবা পুলিশের হাত থেকে বেঁচে আসাটাই এই জীবনের একমাত্র সার্থকতা।