শুক্রবার, ২৬ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

লকডাউন

মাজহারুল ইসলাম

লকডাউন

১.

লাইনে দাঁড়িয়ে আছে করিমন। লম্বা লাইন। মাথার ওপর গনগনে সূর্য। মেয়ে ময়না সঙ্গে আছে। সাত বছরের শিশু। কী কষ্টই না ওর হচ্ছে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে! মা-মেয়ে ঘামে নেয়ে একাকার। তবুও অপেক্ষা।

আজ রিলিফ দেওয়া হবে। কাউন্সিলর সাহেব আসবেন। তিনি নিজ হাতে রিলিফ দেবেন। সকাল ১০টায় লাইনে দাঁড়িয়েছে করিমন। এখন দুপুর দেড়টা বাজে। রিলিফের ব্যাগগুলো টেবিলের পাশে স্তূপ করে রাখা আছে। কিছু ব্যাগ টেবিলের ওপর সাজানো। সাদা প্লাস্টিকের ব্যাগে রোদ পড়ায় চিকচিক করছে। করিমনের মতো অনেকেরই চোখ ওই প্লাস্টিকের ব্যাগের দিকে। কে জানে আজ কী আছে ওই ব্যাগে! কাউন্সিলর সাহেব যেহেতু নিজের হাতে রিলিফ দেবেন, এত বড় নেতা, ভালো কিছু থাকবে বলেই করিমনের বিশ্বাস।

ময়না আজ আসতে চায়নি। দুদিন ধরেই ওর শরীর ভালো না। রাতে জ্বর আসে। করিমন গলির মোড়ের ফার্মেসি থেকে জ্বর কমার ট্যাবলেট কিনে এনে খাইয়েছে। লাইনে দাঁড়ানোর পর থেকে কয়েকবারই মেয়েটা বাড়ি চলে যেতে চেয়েছে। এখনো সেই কথার পুনরাবৃত্তি করল।

করিমন মেয়েকে বোঝায়, তুই চইলা গেলে তো এক ভাগ কম পামুরে মা। আরেকটু কষ্ট কইরা খাড়া।

ময়না বিরক্ত হয়ে বলে, আমগোর ঘরে তো অনেক খাওন...!

মেয়ের কথা শেষ হতে পারে না, তার আগেই ওর মুখ চেপে ধরে করিমন। এই কথা কারও কানে গেলে তো দুজনকেই লাইন থেকে বের করে দেবে। রাগে করিমনের শরীর জ্বলতে থাকে। আস্তে করে মেয়ের গালে একটা চড়ও বসিয়ে দেয়।

শেখেরটেক বস্তিতে একটা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে করিমন। মোহাম্মদপুর তাজমহল রোডে সোলেমান সাহেবের বাড়িতে কাজ করে কোনোরকমে তার সংসার চলে। ময়নাও তার সঙ্গে যায়। ময়নার কাজ হলো সোলেমান সাহেবের ছোট মেয়েটার সঙ্গে খেলাধুলা করা আর কিছু ফুটফরমায়েশ খাটা। বেগম সাহেব খুব ভালো মানুষ। ময়নার জন্য প্রতি মাসে আলাদা এক হাজার টাকা দেয়। সকাল-দুপুর খাবারের কোনো চিন্তা নাই মা-মেয়ের। রাতে বস্তিতে ফিরে দুইমুঠ চাল ফুটিয়ে নেয়, সঙ্গে আলুসেদ্ধ। কখনো বেগম সাহেব খাবার দিয়ে দেয়। এছাড়া প্রায় রাতেই সোলায়মান সাহেবের বাড়িতে নানা অনুষ্ঠান হয়। অনেক মানুষ আসে। পোলাও-কোর্মা রান্না হয়। সেদিন করিমনের ফিরতে রাত হয়। বেগম সাহেব একশ টাকা হাতে দিয়ে বলে, এত রাতে হেঁটে যাবি না করিমন। মেয়েকে নিয়ে রিকশায় যাবি।

এরকম একদিন, রাত তখন প্রায় একটা বাজে, করিমনরা বাড়ি ফিরছে। এই সময়ে শেখেরটেক বস্তি ঘুমিয়ে থাকলেও রহমানের চায়ের দোকান সারা রাত খোলা থাকে। আজও তার ব্যতিক্রম নয়। হিন্দি গান বাজছে। কিছু বখাটে ছেলে বাংলা মদ খেয়ে গলির মাথায় দাঁড়িয়ে মাতলামি করছে। করিমন পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় একজন বাজে একটা মন্তব্য করে। সারা দিনের ক্লান্ত শরীরে যেন বিদ্যুৎ চমকায়। করিমন ঘুরে দাঁড়ায়। তারপর খানিকটা এগিয়ে গিয়ে চোখ পাকিয়ে বলে, হারামির বাচ্চারা! তগো ঘরে কি মা-বইন নাই? থাপড়াইয়া দাঁত ফালায়া দিমু।

ময়না ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে মার পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়। এরমধ্যে একজন এসে করিমনের গায়ে হাত দেয়। বলে, ওই খানকি মাগি, এত ফাল পাড়স ক্যান? এত রাইতে কই থেইক্কা ফুর্তি কইরা আইছস আমরা বুঝি না?

আর যাবে কোথায়! করিমন এক দৌড়ে নিজের ঘর থেকে ধারালো বঁটি নিয়ে ছুটে আসে। মায়ের অগ্নিমূর্তি দেখে ময়না ভয়ে কাঁদতে থাকে। মুহূর্তে বখাটেদের দল দৌড়ে পালায়। পরদিন এই খবর বস্তিতে চাউর হয়ে যায়। তারপর থেকে আর কেউ করিমনের সামনে আসে না, তাকে ঘাঁটায় না। বস্তির সর্দারও করিমনকে কিছুটা সমীহ করে চলে।

খেয়ে-পরে কেটে যাচ্ছিল মা-মেয়ের দিন। এর মধ্যেই কী এক রোগ এল দেশে। করিমন শুনেছে শুধু আমাদের দেশই না, গোটা দুনিয়া নাকি নাস্তানাবুদ এ রোগে। রোগের নাম করোনা। এইটা নাকি ভাইরাস। বেগম সাহেব কত কথা বললেন এ নিয়ে। কিছুই করিমনের মাথায় ঢোকে না। একটা বিষয় করিমনের কাছে দিনের আলোর মতোই ফকফকা- তা হলো তার কপাল পুড়তে যাচ্ছে। রোগশোক সে বোঝে না। সে বোঝে ক্ষুধার জ্বালা। বোঝে শরীর ঢাকার জন্য দরকার একটা কাপড়। মাথা গোঁজার একটু ঠাঁই। এসবই করোনা কেড়ে নিতে চাচ্ছে।

এক মাসের বেতন দিয়ে বেগম সাহেব করিমনকে ছাঁটাই করে দিয়েছেন। তবে কিছুটা স্বস্তি পেয়েছে যখন বেগম সাহেব মাসে তিন হাজার টাকা বেতনে ময়নাকে রাখতে চাইলেন। একটাই শর্ত, করোনাকালে করিমন কখনো মেয়েকে দেখতে আসতে পারবে না এবং ময়নাও বস্তিতে যেতে পারবে না। করিমন চট করেই রাজি হয়ে যায়। আয়ের তো একটা সুযোগ থাকল! এটা হাতছাড়া করা যাবে না। ময়নাও খুবই আনন্দে রাজি হয়ে যায়। বেগম সাহেবের ছোট মেয়েটার সঙ্গে ওর ভালো খাতির। ময়নার থেকে এক বছরের ছোট। করিমন ভাবে, কত দিন কাজ ছাড়া থাকতে হবে কে জানে! তাই সে ময়নাকে বেগম সাহেবের কাছে রেখে দেয়।

শেখেরটেক বস্তিতে করিমনের মতো অনেকেই কাজছাড়া হয়ে যায়। ভয়ে-আতঙ্কে সব বাসা থেকেই ছুটা কাজের লোক বিদায় করে দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হওয়া নিষেধ। রিকশা, ভ্যান, ঠেলাগাড়ির চালকসহ দিনমজুররা বেকার হয়ে পড়েছে। করোনার ভয়াবহতা বোঝার জ্ঞান নাই বস্তিবাসীদের। তারা দিন এনে দিন খায়। তাদের ঘরে এখন খাবার নাই। পেটে খাবার না থাকলে করোনার ভয় আসবেই বা কীভাবে? মহল্লার মুদি দোকানদারও অবস্থা বুঝে বাকি দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে।

করিমনের নিজের কাজ ছুটে গেলেও মেয়ে কাজে আছে। রহিমার মাকে সে গোপনে একশ টাকা দিয়ে আসে। তার দুই ঘর পরে থাকে রহিমার মা। ছেলে ভ্যান চালাত আর ছেলের বউ ইট ভাঙার কাজ করত। তিন মাস আগে ডায়রিয়ায় একমাত্র ছেলেটা মারা যায়। চল্লিশ দিন না যেতেই তার বউ আরেকজনকে বিয়ে করে অসুস্থ শাশুড়িকে ফেলে চলে গেছে।

বিয়ের পর করিমন যখন প্রথম এই বস্তিতে আসে রহিমার মা তাকে খুব আদর করত। ময়নার বাপ যখন তাকে তালাক দিয়ে ঘর থেকে বের করে দেয়, এই রহিমার মা-ই তাকে আশ্রয় দিয়েছিল। ময়নার বয়স তখন এগারো মাস। তিন দিনের মধ্যে করিমনকে একটা কাজও জোগাড় করে দিয়েছিল। করিমনের মনে আছে সব। কী করে ভুলবে সে সেই দুঃসময়ের কথা! ছায়া হয়ে রহিমার মার পাশে থাকার কথা! করিমন অকৃতজ্ঞ নয়। তাই রহিমার মাকে সাহায্য না করে পারে না সে।

শেখেরটেক বস্তির মানুষদের বেশিদিন কষ্ট করতে হয়নি। অল্প ক’দিনের মধ্যেই কিছু ব্যক্তি ও সংগঠন খাদ্য ও ত্রাণ সহায়তা নিয়ে আসে করিমনদের বস্তিতে। করিমন শারীরিকভাবে শক্তসমর্থ। ধাক্কাধাক্কি করে সামনে যেতে পারে বলে অন্যদের থেকে বেশি ত্রাণ পায় সে। অনেক সময় লাইনের সবাই ত্রাণ পায়ও না। কিন্তু করিমন কখনো খালি হাতে ফেরত আসে না। আসা-যাওয়ার সুবিধার কারণে অনেকেই শেখেরটেক বস্তিতে ত্রাণ দিতে আসে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের লোকেরাও এসেছে। নাটক-সিনেমার নায়ক-নায়িকারাও একদিন এসে হাজির। করিমনের মতো অনেকেই সেদিন রিলিফ নেওয়ার চেয়ে নায়ক-নায়িকা দেখাতেই ব্যস্ত ছিল বেশি। সবাই চলে যাওয়ার পর ইদ্রিস মোল্লা জানাল, নায়িকা পরীমনিও নাকি এসেছিল। ভিড়ের কারণে দূর থেকে করিমন চিনতে পারেনি। আগে জানলে ঠেলেঠুলে সামনে চলে যেত। পরীমনিকে খুব পছন্দ করিমনের। ওর কয়েকটা সিনেমা দেখেছে সে। ‘আমি ডানাকাটা পরী’ গানটা প্রায়ই গুনগুন করে করিমন। তার আফসোস, পরীমনি এত কাছে এল, কিন্তু তাকে দেখতে পেল না সে।

করোনার শুরুতে যতটা আশঙ্কা করেছিল করিমন, তার চেয়ে ভালোই দিন কাটছে তার। শেখেরটেক বস্তিতে এখন কারও ঘরে খাবারের তেমন অভাব নেই। শুধু সারা দিন অপেক্ষার পালা কখন রিলিফের গাড়ি আসবে। অথচ করিমনের পরিচিত অনেক জায়গায় একপয়সার রিলিফ বা খাবার কিছুই যায়নি। এসব নিয়ে এখন চিন্তা করতে চায় না করিমন।

করিমন লক্ষ করেছে যারাই রিলিফ দিতে আসে সবাই খুব যতœ করে ছবি তোলে। কেউ কেউ সেলফিও তোলে। আবার অনেকে তো টেলিভিশনের ক্যামেরা সঙ্গে নিয়ে আসে। প্রথম বিশ-পঁচিশজনকে রিলিফ দিয়ে ছবি তোলা শেষ হলেই দামি গাড়িতে ওঠে চলে যায়। বাকি রিলিফ দেয় তাদের চ্যালা-চামুন্ডারা। শুরু হয় হট্টগোল। হুড়াহুড়িতে দু-চারজনের হাত-পাও ভাঙে। সেজন্য করিমন সব সময় লাইনের সামনে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে।

করিমন লক্ষ করেছে, অনেকে বাচ্চা নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়েছিল বলে দুই ভাগ রিলিফ পেয়েছে। ফলে তার মাথায় ঢুকে যায়, সোলেমান সাহেবের বাড়ি থেকে ময়নাকে আনতে হবে।

একদিন পর তাজমহল রোডে সোলেমান সাহেবের বাড়িতে যায় করিমন। দারোয়ান উপরে উঠতে দেয় না। ইন্টারকমে বেগম সাহেবকে কাকুতিমিনতি করে করিমন বলে, দরজার কাছ থাইকা একটু মাইয়াডারে একনজর দেইখা চইলা যামু। মাইয়াডার জন্য সারাক্ষণ মন পুড়ে গো আম্মা।

শুনে বেগম সাহেবের মনটা নরম হয়ে যায়। দারোয়ানকে বলে দেয় হ্যান্ডস্যানিটাইজার দিয়ে করিমনের দুই হাত ভালো করে পরিষ্কার করিয়ে উপরে পাঠাতে।

দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে মেয়ের সঙ্গে কথা বলে করিমন। বেগম সাহেব ভেতরে গেছেন, এই ফাঁকে মেয়েকে রাজি করিয়ে ফেলে তার সঙ্গে বস্তিতে ফিরে যেতে। দুই-এক দিন পর আবার রেখে যাবে। বেগম সাহেব ফিরে এলে তাকে একথা বলার সঙ্গে সঙ্গে তিনি তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন। তাঁর সাফ জবাব, মেয়েকে নিয়ে যেতে হলে একবারে নিয়ে যাও। বস্তিতে গেলে আমি আর ওকে ঘরে তুলব না।

ভাগ্যিস ময়না কথাগুলো শোনেনি। সে ভেতরে গেছে কাপড় বদলাতে।

বেগম সাহেব রাগে গজগজ করতে থাকে। ময়নার পনের দিনের বেতন করিমনের হাতে ধরিয়ে দিয়ে মুখের ওপর দরজা লাগিয়ে দিলেন।

বস্তিতে ফিরে এসে দুদিন না যেতেই মন টিকে না ময়নার। সে আবার ফিরে যেতে চায় বেগম সাহেবের কাছে। সেখানে কত ভালো ভালো খাবার! টেলিভিশনে কার্টুন দেখা যায়। কত আনন্দ!

করিমন মেয়েকে বোঝায়। বলে, তোরে ছাড়া রাইতে আমার ঘুম আহে না, মা। ডর লাগে আমার। তা ছাড়া চাইরদিকে রোগবালাই। এই সময় তুই মাইনষের বাড়িত থাকবি ক্যান? আমার ঘরে কি খাওন কম আছে?

মেয়েকে কোনোভাবেই বোঝাতে পারে না করিমন। ময়না একাই চলে যেতে চাইলে তিন দিন ওকে ঘরে তালা দিয়ে আটকে রাখে। একদিন বেশ মারধরও করে। এভাবে কয়েক দিন পার হওয়ার পর মেয়েকে বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজি করিয়ে একদিন লাইনে দাঁড় করায় করিমন। মা ও মেয়ে দুই ব্যাগ রিলিফ নিয়ে ঘরে ফেরে। করিমন মহাখুশি। ব্যাগের মধ্যে চাল-ডালের সঙ্গে দুই প্যাকেট বিস্কিট পেয়ে ময়নাও খুশি হয়।

মানুষ হলো গোল্ডফিসের মতো। অল্প সময়ে সবকিছু ভুলে যায়। এক সময় ময়নাও তাজমহল রোডের ওই বাড়ির কথা ভুলে গেল।

একদিন ময়না বলে, মা, যারা খাবার দেয় তারা মুখে কীসব লাগাইয়া আসে। মুখে ওইসব না লাগাইলে নাকি শক্ত অসুখ হয়। মানুষ মইরা যায়। আমিও ওইসব লাগামু মা।

করিমন শক্ত করে ধমক দিয়ে মেয়েকে বলে, গরিব মাইনসের ওইসব লাগে না রে মা। আমাগো লগে আল্লা আছে।

ময়না বলে, তাইলে অগো লগে কি আল্লা নাই?

করিমন এবার মেয়ের দুই গালে দুই চড় লাগায়। বলে, তুই বেশি প্যাচাল পাড়স।

ময়না কাঁদতে থাকে। করিমন মেয়েকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে আদর করে। নিজের অজান্তেই সে আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। সেও শুনেছে করোনা নাকি যাকে ধরে তাকে শেষ করে ফেলে। বিদেশে নাকি অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে। দেশেও কয়েকজন মরেছে। দুদিন আগে ইদ্রিস মোল্লা বলছিল, বাইর থেইকা আইসা হাত-মুখ সাবান দিয়া ধুবিরে করিমন। ভাত খাওনের আগেও ভালো কইরা হাত সাবান দিয়া ধুবি। খুব খারাপ রোগ রে করিমন। তারপর আক্ষেপ করে বলে, মানুষ কত খারাপ হইয়া গেছে। আইজ টেলিভিশনের খবরে দেখলাম অনেক জায়গায় এলাকার চেয়ারম্যান-মেম্বাররা গরিব মাইনষের রিলিফের চাইল-ডাইল চুরি করতাছে। কয়েকজনরে পুলিশ ধরছে।

কথাটা শুনে করিমনের মন খারাপ হয়ে যায়। সে বলে, আল্লার বিচার আছে না? গরিব মাইনষের হক মারলে তো ধরা পড়বই। চোরগুলারে ট্রাকের তলায় পিষা মারন দরকার।

ইদ্রিস মোল্লা বস্তির সর্দার হুরমত আলীর ডান হাত। ঘরভাড়া তোলা থেকে শুরু করে কাউকে উচ্ছেদ করা কিংবা নতুন ভাড়াটে ঠিক করা সব কাজই তাকে করতে হয়। হুরমত আলীর এখন বয়স হয়েছে। থানা-পুলিশ, এলাকার মাস্তান এসবও এখন ইদ্রিসই দেখভাল করে। করিমনকে ইদ্রিস পছন্দ করে। প্রথমদিকে করিমন ওকে সহ্য করতে পারত না। এক সময় করিমন মনে মনে ঠিক করে, ইদ্রিসকে ক্ষেপিয়ে লাভ নেই। বরং ইদ্রিসকে দিয়া রহিমা খালার জন্য কিছু করা যায় কি না সেই চেষ্টা করে সে।

একদিন করিমন সুযোগ বুঝে ইদ্রিসকে বলে, রহিমা খালা যেন আরও ছয় মাস বিনা ভাড়ায় থাকতে পারে। অসুস্থ শরীর নিয়া এই বয়সে বুড়ি যাইব কই?

ইদ্রিস করিমনের গালে একটা টোকা দিয়া বলে, তুই কইলে তো রাখতেই হয়। তর কথা তো আর ফালাইবার পারি না। মাগার তুুই তো আমারে পাত্তাই দেস না। একটু খাতির করলে তো অনেক কিছু পাইবার পারস।

করিমন ইদ্রিসের ইংগিত বুঝতে পারে। অজানা এক আশঙ্কায় সে শিউরে ওঠে। বলে, যা ভাগ, তোর কিছু করতে হইব না। একটা মুখঝামটা দিয়ে করিমন অন্যদিকে চলে যায়।

আজকাল ময়নার প্রায়ই শরীর খারাপ থাকে। কদিন হলো মার সঙ্গে সে বাইরে যায় না। করিমন একাই যায় রিলিফ আনতে। এর মধ্যে ইদ্রিসের সহায়তায় বাড়তি কিছু চাল-ডাল বিক্রিও করেছে। করিমনের হাতে এখন বেশ টাকা। ময়নার শরীরে জ্বর আছে। সঙ্গে গলা ব্যথা ও কাশি। তাই সারা দিন কোথাও বেরোয় না করিমন। মেয়ের কাছে কাছে থাকে। রাতে মেয়েকে নিয়ে অন্যদিনের তুলনায় একটু আগেই শুয়ে পড়ে।

অমাবস্যার রাত। বাতি নেভাতেই বেড়ার ফাঁক দিয়ে ঘন কালো অন্ধকার ঢুকে পড়ে করিমনের ঘরে। দূরের লাইটপোস্টে টিম টিম করে আলো জ্বলছে। করিমনের চোখের পাতায় তন্দ্রা নেমে এসেছে। এর মধ্যে শুরু হলো বৃষ্টি। টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ কেমন ঘোরলাগা। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসে করিমনের।

দরজায় কয়েকটা টোকার শব্দে আচমকা করিমনের ঘুম ভাঙে। বৃষ্টির শব্দের সঙ্গে একটা ফিসফিস কণ্ঠ ভেসে আসে। দরজাটা খোল করিমন। বৃষ্টির পানিতে ভিজা যাইতেছি। দরজাটা খোল তাড়াতাড়ি।

করিমন নিশ্চিত, এটা ইদ্রিসের গলা। কী করবে বুঝতে পারে না সে। ময়নার দিকে তাকিয়ে দেখে সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। করিমন ভয় পায়। না না, সে এই নিশুথি রাতে ঘরের দরজা খুলবে না। মুহূর্তেই অন্য একটা ভাবনা ভর করে করিমনের মাথায়। তারও তো একটা শরীর আছে। অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছিল। বছর না পেরোতেই ময়নার জন্ম। মেয়েটার বয়স ছয় মাস না হতে হারামিটা তাকে ছেড়ে চলে গেল। তারপর থেকে মনকে প্রবোধ দিয়েছে। একাই এই শরীরটাকে টেনে চলেছে। মন মানলেও শরীর বিগড়ে যেতে চায়। শরীরেরও তো একটা চাহিদা আছে।

করিমন সন্তর্পণে চৌকি থেকে নামে। পা টিপে টিপে দরজার কাছে যায়। ইদ্রিসের নিঃশ্বাস টের পায় সে। হাত কাঁপতে থাকে করিমনের। নিজের অজান্তেই দরজার খিল খুলে দেয় সে।

কাকডাকা ভোরে ঘুম থেকে ওঠে করিমন। ময়নার জ্বর একটু কম। গোসল করে তৈরি হয়ে নেয় সে।

এলাকায় আজ বড় নেতা আসবে। ইদ্রিস বলেছে রিলিফের সঙ্গে নগদ টাকাও নাকি দিবে। লাইন আজ আরও বড় হবে। তাই আগেভাগেই যেতে হবে। ঘর থেকে বেরুনোর সময় মেয়ের কপালে আবার হাত রাখল করিমন। আঁতকে উঠল সে। জ্বরে কপাল পুড়ে যাচ্ছে। গায়ে হাত দিয়ে দেখে একই উত্তাপ। কাঁপছে মেয়েটা। জ্বর কমার ওষুধ খাওয়ায় করিমন। কপালে জলপট্টি দেয়। কাশির জন্য সিরাপ খাওয়ায়। প্রায় ঘণ্টা খানেক পর জ্বর একটু কমলে মেয়েকে বলে, তুমি ঘুমায়া থাকো মা। আমি তাড়াতাড়ি চইলা আসব। খিচুড়ি রান্না করা আছে। খিদা লাগলে তুমি খাইয়া নিও।

ময়নার দুর্বল কণ্ঠ, মা, আজ তুই বাইরে যাইস না। আমার ভালা লাগতেছে না। আমাগো ঘরে তো খাওনের অভাব নাই। একদিন না গেলে কী হইব?

করিমন মেয়ের মাথায়-গায়ে স্নেহের পরশ বুলিয়ে দেয়, বড় নেতা আইবো। আইজ নগদ টাকা দিবরে মা। কাইল থেইকা আর তোরে ছাইড়া কোথথাও যামু না।

ময়নার দুই চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। মার হাত ছাড়তে চায় না। করিমন দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। তার চোখের সামনে নগদ টাকা আর রিলিফের হাতছানি। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে আদর করে সে। শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুছে দেয়। তারপর বলে, তোর লাইগা কমলা-আঙুর এসব কিন্না আনমুরে মা। গরম জিলাপিও নিয়া আইমু। তুই চিন্তা করিস না।

মেয়ে কোনো কথা বলে না। করিমন বাইরে থেকে দরজায় শিকল দিয়ে বেরিয়ে যায়। যাওয়ার সময় রহিমা খালাকে বলে যায় ময়নাকে একটু যেন দেখে রাখে।

স্কুলের মাঠে শামিয়ানা টাঙানো হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ। আসতে দেরি হওয়ায় ময়না সামনে জায়গা পায় না। মাইকে বলা হচ্ছে, আপনেরা ধৈর্য ধরে বসেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের প্রাণপ্রিয় নেতা চলে আসবেন। তিনি এলেই রিলিফ দেওয়া শুরু হবে। সবাই ৩ ফুট দূরে দূরে বসেন। লাইন ভাঙবেন না।

মাইকে একই কথা শুনতে শুনতে দুপুর পার হয়ে যায়। করিমন ছটফট করতে থাকে মেয়ের জন্য। মনে মনে নেতাকে দুটো গালিও দেয়। এরপর বেলা তিনটায় ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি পরে নেতা আসেন। কোনো টেলিভিশন ক্যামেরা নেই দেখে তার লোকদের গালিগালাজ করতে থাকেন। দূর থেকে দুই-একটা গালি করিমনের কানে আসে। করিমন অবাক হয়, ভদ্দরলোকের মুখ এত খারাপ হয় ক্যামনে!

আরও আধাঘণ্টা অপেক্ষার পর দুটি টিভি ক্যমেরা এলে রিলিফ দেওয়া শুরু হয়। এক পর্যায়ে কিছু মানুষকে ত্রাণ দেওয়ার পর টেলিভিশন ক্যামেরা চলে গেলে নেতাও গাড়িতে উঠে চলে যায়। শুরু হয় হট্টগোল। করিমন চেষ্টা করে সামনে যেতে। মানুষের ভিড়ে এগোতে পারে না। ধাক্কা খেয়ে পড়ে গিয়ে পায়ে ভীষণ ব্যথা পায়। মাইকে ঘোষণা আসে, আজ আর ত্রাণ দেওয়া হবে না। আপনারা সামাজিক দূরত্ব রেখে যার যার ঘরে ফিরে যান।

মসজিদে আসরের আজান হচ্ছে। করিমন খোঁড়াতে খোঁড়াতে বস্তির দিকে হাঁটতে থাকে। ফল কেনার টাকা তো তার কাছে নেই। বস্তির মুখের দোকান থেকে বাকিতে কয়েকটা জিলাপি নিয়ে ঘরের কাছে চলে আসে। দেখে ঘরের সামনে মানুষের জটলা। করিমনের মনে আতঙ্ক ভর করে। দৌড়ে ভিড় ঠেলে সে ঘরে ঢোকে। চৌকির ওপর রহিমা খালা বসা। করিমনকে দেখে ডুকরে কেঁদে উঠে সে বলে, হতচ্ছাড়ি, তোরে কইছিলাম আইজ ঘর থেইকা বাইরে যাইস না।

করিমন জিজ্ঞেস করে, আমার ময়না কই?

রহিমা খালা কান্নায় ভেঙে পড়ে বলে, তোর ময়না নাই।

তারপর রহিমা খালা ইশারায় দেখায় চাদর দিয়ে ঢাকা ময়নার শরীর। করিমন পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে। একটু পর ময়নার মুখ থেকে চাদর সরিয়ে বিকট চিৎকার দেয় করিমন। সেই চিৎকারে ঘন অন্ধকার নেমে আসে জগৎজুড়ে।

পরিশিষ্ট : করোনায় আক্রান্ত হয়ে ময়নার মৃত্যু হয়েছে ধরে নিয়ে কেউ ওর জানাজা এবং দাফন করাতে রাজি হয় না। রহিমা খালা গোসল দিয়ে দেয়। গলির মাথার চায়ের দোকানদার রহমান চারজন মানুষ নিয়ে জানাজা পড়ায়। চারজনের একজন হুরমত আলী। ইদ্রিস মোল্লা নিজে দায়িত্ব নিয়ে ময়নার দাফনের ব্যবস্থা করে। করিমন, ইদ্রিস এবং রহিমা খালাকে সরকারি হাসপাতালে আইসোলেশনে রাখা হয়। শেখেরটেক বস্তি ১৫ দিনের জন্য লকডাউন ঘোষণা করে পুলিশ।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর