শুক্রবার, ৩ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

বোবা-কান্না

ইকবাল খন্দকার

বোবা-কান্না

তৃতীয়বারের মতো মা হতে চলেছে খাদিজা। হাতে চার মাসের মতো সময় আছে। তবে তার মনে হচ্ছে এত সময় সে পাবে না। মাসখানেকের মধ্যেই সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখাতে হবে। উফ, কদিন ধরে যা যন্ত্রণা দিচ্ছে না! যেন দুনিয়ায় আসার জন্য অস্থির হয়ে গেছে। সমানে লাথি মারছে। আগে দুবার মা হলেও এত অশান্তি ভোগ করতে হয়নি খাদিজাকে। প্রতিবেশীরা তাকে ভয় দেখাচ্ছে। বলছে কোনো একটা সমস্যা নাকি অবশ্যই আছে। হতে পারে সন্তানের অবস্থান ঠিক নেই। তাদের পরামর্শ, হাসপাতালে গিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা দরকার।

খাদিজার স্বামী রুস্তম আলীও চায় স্ত্রীকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে। পরীক্ষা করাতে। তবে তার এ চাওয়া সন্তানের অবস্থান জানার জন্য না। বরং লিঙ্গ জানার জন্য। অনাগত সন্তান মেয়ে না ছেলে, জানার জন্য উতলা হয়ে উঠেছে সে। খাদিজা বারান্দায় বসে তরকারি কাটছিল। এমন সময় রুস্তম আলী এসে বসে তার পাশে। গামছা দিয়ে মুখের ঘাম মুছতে মুছতে সে আলট্রাসনোগ্রাম সম্পর্কে একটা নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দেয়। তারপর জানায় পরীক্ষাটা সে করাতে চায়। খাদিজা হাতের আধকাটা ঝিঙেটা বাটিতে রেখে স্বামীর দিকে তাকায়। আর বলে- কয়ডা দিন একটু শান্তিতে থাকতে চাইছিলাম। আপনের কথা শুইনা তো মনে হইতাছে শান্তি আমার কপালে নাই।

স্ত্রীর কথা বুঝতে পারে না রুস্তম আলী। খাদিজা বুঝিয়ে বলে- পোলা হইবো না মাইয়া হইবো, এইটা যতদিন জানা যাইবো না, ততদিন আপনে একটু চুপ থাকবেন। কিন্তু পরীক্ষা করায়া যখন জাইনা ফেলবেন মাইয়া হইবো, তখন কি চুপ থাকবেন? সেকেন্ডে সেকেন্ডে আমারে কথা শোনাইবেন না? কথা শোনাইবেন কী, আমার তো মনে হয় আপনে আমারে বাড়ি থেইকা ঘাড় ধইরা বাইর কইরা দিবেন। এক মাইয়ার পরে আরেক মাইয়া হইতেই যা করছিলেন! তিন নম্বর মাইয়া হইলে কী করবেন, তার কোনো ঠিক আছে?

রুস্তম আলী বসা থেকে ওঠে পড়ে। আর বলে- তুই খালি আচিন্তা-কুচিন্তা করস। তর পেটেরটা মাইয়া-ই হইবো, এইটা তরে কেডা কইল? আরে অইন্য গেরামের কথা বাদ দিলাম, এই গেরামেই তো এইরকম মহিলা ম্যালা আছে, যাগোর ঘরে দুইটা মাইয়া হওয়ার পরে পোলা হইছে। গেরাম বাদ দে, আমাগো পাড়ায়ই তো হইছে। দুলালের বউয়ের ঘরে হইছে না? উদাহরণ হিসেবে আরও কারও কারও নাম উল্লেখ করতে চায় রুস্তম আলী। কিন্তু তার আগেই খাদিজা জানিয়ে দেয়, সে হাসপাতালে যেতে রাজি। আর মনে করিয়ে দেয় পরীক্ষা এবং যাতায়াত-ব্যয়ের কথা। জানতে চায় এত টাকা সে কীভাবে জোগাড় করবে। রুস্তম আলী এই বলে বাড়ির বাইরে চলে যায়- টেহা-পয়সার চিন্তা মাইয়া মানুষের না। এই চিন্তা বেডা মানুষের।

রুস্তম আলী বিভিন্নজনের কাছে টাকা চেয়ে যখন পায় না, তখন হঠাৎ তার মাথায় আসে হাকিম ভাইয়ের কথা। হাকিম ভাই ঢাকায় থাকেন। দু-তিন মাস পরপর গ্রামে আসেন। তবে মাসের শুরু কিংবা মাঝের দিকে আসেন না। আসেন শেষের দিকে। আজ আটাশ তারিখ। তার কেন যেন মনে হয় তিনি এসেছেন। হাকিম ভাই গ্রামে আসলেও সহজে কেউ টের পায় না। কারণ, তিনি বাড়ির বাইরে বের হন কম। ফলে খুব অল্পসংখ্যক লোকই তার সাক্ষাৎ পায়। রুস্তম আলী ওই অল্প সংখ্যকদের একজন। হাকিম ভাই তাকে বিশেষ পছন্দ করেন। অকারণে করেন না। অবলীলায় খাটাতে পারেন বলেই করেন। আর রুস্তম আলীও তার ফুটফরমায়েশ খাটার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে। কাজের বিনিময়ে কড়কড়ে নোট পেলে কেন উন্মুখ হবে না?

হাকিম ভাইয়ের বাড়িতে গিয়ে হতাশ হয় রুস্তম আলী। কারণ, তার ভাই জানান, এই মাসে তো তিনি আসবেনই না, আগামী দু-তিন মাসেও আসার সম্ভাবনা নেই। রুস্তম আলীর জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়, না আসার কারণ কী। কিন্তু সাহস পায় না। সে তার খোঁচা খোঁচা দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে চিকন রাস্তা ধরে মোটা রাস্তার দিকে হাঁটতে থাকে। এমন সময় গাড়ির হর্ন শুনতে পায়। স্বাভাবিকভাবেই তার চোখ চলে যায় মোটা রাস্তার দিকে। আর খুশিতে প্রায় লাফিয়ে ওঠে সে।

হাকিম ভাই এসেছেন। ওই তো গাড়ি থেকে নামলেন তিনি। রুস্তম আলী দৌড়ে গিয়ে কাজে লেগে যায়। গাড়ি থেকে ব্যাগপত্র নামানো, মাথায় নেওয়া, হাতে নেওয়া- আরও কত কাজ! মাগরিবের নামাজের একটু আগে হাকিম ভাইকে একান্তে পায় রুস্তম আলী। কিন্তু সে আর্থিক আর্জি পেশের আগেই তিনি বলতে থাকেন- আমি মনে করেছিলাম তুমি চলে গেছ। চলে গেলেও অবশ্য ডেকে আনতাম। যাওনি, ভালো করেছ। শোনো, তোমার জন্য একটা সুখবর আছে। সারাজীবন তো কষ্টই করলে! খেয়ে না খেয়ে কোনোরকমে দিন কাটালে। এবার অন্তত পেট ভরে খাওয়ার একটা বন্দোবস্ত হতে যাচ্ছে।

খুশিতে রুস্তম আলীর চোখ-মুখ চকচক করে ওঠে। হাকিম ভাই হেলান ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে বসে বলেন- আজকে আসার কোনো পরিকল্পনা ছিল না। হুট করেই চলে আসলাম। যা-ই হোক, তুমি জানো কিনা জানি না, আমি কিন্তু বিদেশিদের সঙ্গে কাজ করি। তো কিছুদিন আগে এক দেশের একটা টিমের সঙ্গে মিটিং হলো। তারা বলল, বাংলাদেশের মানুষ যাতে পরিবার পরিকল্পনার প্রতি উৎসাহী হয়, এ জন্য তারা একটা প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে। প্রজেক্টটা হচ্ছে, যাদের একটা বা সর্বোচ্চ দুইটা সন্তান, তাদের তারা মাসিক ভাতা দেবে।

রুস্তম আলীর চোখ-মুখের চাকচিক্য কমে আসে। আর তা নজর এড়ায় না হাকিম ভাইয়ের। তবু তিনি কথা চালিয়ে যান- মাসিক ভাতা যেটা দেবে, সেটা কিন্তু দেশি ভাতার মতো অল্প না। বেশ মোটা অঙ্কের টাকা। তো তোমার যেহেতু দুই বাচ্চা, তুমি অবশ্যই ভাতাটা পাবে। আমি নামের যে লিস্টটা বানিয়েছি, সেখানে তোমার নামটা এক নাম্বারে রেখেছি। লিস্টটা এখনই আমি তোমাকে দিয়ে দেব। তোমার কাজ হচ্ছে, এ এলাকায় আর কার কার এক বা দুই সন্তান আছে, তাদের খুঁজে বের করা এবং নাম লেখা।

রুস্তম আলী পানসে মুখে জানায়, সে লিখতে জানে না। হাকিম ভাই হেসে বলেন- আরে গাধা, তুমি যে লিখতে জান না, তা তো আমি জানি। লিস্টটা তোমার হাতে দিচ্ছি, তার মানে তো এই না, তোমাকেই লিখতে হবে। কাগজটা হাতে থাকলে লেখার লোকের অভাব হবে না। তোমার কাজ হচ্ছে, কোনোরকম দুই নম্বরি যাতে না হয়, সেটা নিশ্চিত করা। আমি তোমাকে বিশ্বাস করি বলেই দায়িত্বটা দিচ্ছি। আমার বিশ্বাসের কোনো অমর্যাদা যেন না হয়। তুমি যদি আরও কাউকে সঙ্গে নিতে চাও, নিতে পার।

-কারও যদি তিন বাচ্চা থাহে, হেয় তো ভাতা পাইবো না, ঠিক না? উত্তর জানা থাকলেও প্রশ্নটা না করে পারে না রুস্তম আলী।

-তোমাকে এতক্ষণ আমি কী বোঝালাম? বেআক্কেল কোথাকার! শোনো, একটা কথা আছে কিন্তু। কম জাত ভালো, কম আক্কেল ভালো না।

-জি, জি।

রুস্তম আলী তার পানসে মুখ আরও পানসে করে খাটের তলার দিকে তাকিয়ে থাকে। হাকিম ভাই নিজের বিগড়ে যাওয়া মেজাজটাকে যথাসম্ভব আগের জায়গায় ফিরিয়ে এনে পুরো ব্যাপারটা আবার বলেন। তারপর আগাম কিছু পারিশ্রমিক দিয়ে বিদায় দেন রুস্তম আলীকে। রুস্তম আলী আকাশ-পাতাল চিন্তা করতে করতে যখন বাড়ি পৌঁছে, খাদিজা তখন মেয়েদের রাতের খাবার খাওয়াচ্ছে। সে কারও সঙ্গে কোনো কথা না বলে বিছানায় শুয়ে পড়ে। খাদিজা তাকে জিজ্ঞেস করে শরীর খারাপ কিনা। সে কোনো উত্তর দেয় না।

মেয়েদের খাওয়া শেষ হলে রুস্তম আলী খাদিজাসহ বারান্দায় যায়। জানায় আগামীকাল সে তাকে নিয়ে হাসপাতালে যাবে। পেটের বাচ্চা ছেলে না মেয়ে পরীক্ষা করবে। খাদিজা আপত্তি করতে চাইলে রুস্তম আলী ধমক দিয়ে তার মুখ বন্ধ করে দেয়। তারপর খাওয়া-দাওয়া সেরে সোজা চলে যায় বিছানায়। মেয়েরা ঘুমিয়ে পড়লে সে বলে- পেটের বাচ্চা যদি পোলা হয়, তাইলে কোনো কথা নাই। আর যদি মাইয়া হয়, তাইলে কথা আছে। কী কথা আছে, সেইটা এহন কমু না। জিগাইলেও কমু না। পরীক্ষাডা করানির পরে কমু। এহন ঘুমা।

ডাক্তার জানান, খাদিজার মেয়ে হবে। রুস্তম আলী ডাক্তারের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আর খাদিজা তাকিয়ে থাকে উপরের দিকে। সে চোখের টলোমলো পানির গড়িয়ে পড়া রোধ করার চেষ্টা করছে। ডাক্তারের সঙ্গে কথা শেষ করে রুস্তম আলী খাদিজাকে নিয়ে নির্জন একটা জায়গায় দাঁড়ায়। আর প্রায় একদমে বলে ফেলে হাকিম ভাই যা যা বলেছেন। তারপর চারপাশ একবার দেখে নিয়ে বলে- এইটা কিন্তু আমাগো লাইগা বিরাট একটা সুযোগ খাদিজা। এই সুযোগ হাতছাড়া করলে সারাজীবন হায় হায় করতে হইবো। আমি এই সুযোগ কোনোভাবেই ছাড়তে চাই না। তুই কী কস?

খাদিজা ভালোভাবে চোখ কচলে সবিস্ময়ে দেখে স্বামীকে। তার ঠোঁট কাঁপতে থাকে তিরতির করে। রুস্তম আলী বলে- হোন, আমাগো তো দুইটা মাইয়া আছেই। কী দরকার আরেকটা মাইয়ার? যদি পোলা হইত, সেইটা আছিল অইন্য হিসাব। এহন আর কথা না বাড়াই। আমি ডাক্তারের লগে আলাপ কইরা একটা ডেট ফাইনাল কইরা ফালাই। ডেটমতো আইসা বাচ্চাডা ফালায়া দিয়া যামু গা। আমাগো দুইডার বেশি বাচ্চা থাকবো না। হাকিম ভাই যেই লিস্টি করছে, ওইডার এক নম্বরে আমাগো নাম আছে, থাকবো।

ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে প্রশ্রয় পায় না রুস্তম আলী। ডাক্তার তাকে সাফ সাফ জানিয়ে দেন, এখন বাচ্চা নষ্ট করতে গেলে মার জীবন হুমকির মুখে পড়ে যাবে। জেনেশুনে তিনি এ ঝুঁকি নিতে পারবেন না। রুস্তম আলী ভিন্নপথে হাঁটার সিদ্ধান্ত নেয়। সে কবিরাজ ধরে। কবিরাজ তাকে আশ্বস্ত করে, একাধিক ডোজের দরকার নেই, এক ডোজ খেলেই কাজ হয়ে যাবে। এমনভাবে বাচ্চাটা বের হয়ে আসবে, মা টেরও পাবে না। রুস্তম আলী বলে- আমার বউ তো এই ওষুধ খাইতে চাইবো না। কী করি?

কবিরাজ হাসতে হাসতে উপায় বাতলায়। বলে খাদিজার প্রিয় কোনো খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে খাইয়ে দেওয়ার জন্য। রুস্তম আলী কবিরাজের কথামতো কাজ করে। ওষুধটা পেটে পড়ার বিশ মিনিটের মধ্যেই ব্যথা শুরু হয়ে যায় খাদিজার। প্রচ- ব্যথা। অসহনীয় ব্যথা। ব্যথায় গড়াগড়ি খেতে থাকে সে। রক্তে ভিজে যায় বিছানা। মার মুমূর্ষু অবস্থা দেখে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে মেয়েরা। তাদের কান্না শুনে প্রতিবেশীরা ছুটে আসতে শুরু করলে রুস্তম আলী এমন একটা ভাব করে, যেন সে কিছুই জানে না।

প্রায় এক ঘণ্টা অবর্ণনীয় কষ্ট ভোগের পর মৃত সন্তান প্রসব করে খাদিজা। আর রুস্তম আলী বাঁচে হাঁফ ছেড়ে। মাথার ওপর থেকে যেন হাজার মণ ওজনের একটা পাথর নেমে যায় তার। মৃত সন্তান প্রসবের পর মিষ্টি খাওয়ানোর নিয়ম না থাকলেও অবচেতন মনেই সে ছুটতে চায় বাজারের দিকে। আর এমন সময় পেছন থেকে ডাক দেন পাশের বাড়ির চাচি। বলেন- মন খারাপ করিস না রুস্তম। সবই আল্লাহর লীলাখেলা। নাইলে এইরকম ফুটফুইট্যা একটা পোলা দিয়া ক্যান আল্লায় কাইড়া নিবো!

-পোলা! অতিরিক্ত বিস্ময়ে বিকৃত হয়ে যায় রুস্তম আলীর গলার স্বর আর চেহারা।

-ক্যান, তুই দেখস নাই? এক্কেরে তর চেহেরা পাইছিল পোলাডা।

মাথা থেকে নেমে যাওয়া পাথরটা এবার বুকে চেপে বসে রুস্তম আলীর। সে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। ধপ করে বসে পড়ে কাদায় ভরা উঠোনে। কিন্তু এক মাস পর সে আর বসেও থাকতে পারে না। হাকিম ভাইয়ের একটা ফোন তাকে অর্ধমৃত বানিয়ে শুইয়ে দেয় বিছানায়- ‘ওই যে প্রজেক্টটার কথা বলেছিলাম না, ওইটা বাতিল হয়ে গেছে।’

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর