শুক্রবার, ৭ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

মৌলভি আবদুর রশিদ মাস্টার

মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান

মৌলভি আবদুর রশিদ মাস্টার

বাঙালি মনীষার উজ্জ্বল প্রতিনিধি, শিক্ষক মৌলভি আবদুর রশিদ মাস্টার। কেবল শিক্ষক হিসেবেই নয়, বহু উজ্জ্বল কৃতী ও কীর্তিতে অনন্য হয়ে ওঠা একটি নাম। লেখক, শিক্ষক, সমাজসংস্কারক- কতভাবেই তো তিনি নিজেকে মেলে ধরেছিলেন জাতির সামনে। তাঁর জন্ম ১৯৩৭ সালে কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার সোনাইমুড়ি গ্রামে। জন্মের ১৫ দিন পর তাঁর পিতা আবদুর রহিম পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। তিন ভাই, দুই বোনের মধ্যে তিনি কনিষ্ঠ।

আবদুর রশিদের শিক্ষাজীবনের সূচনা মা মেহেরজানের সাহচর্যে। তিনি ১৯৫৩ সালে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের বেলচোঁ মাদ্রাসা থেকে দাখিল এবং ’৫৫ সালে আলিম পাস করেন। দুটোতেই প্রথম শ্রেণি ছিল তাঁর। ’৬০ সালে চট্টগ্রামের ওয়াজেদিয়া আলিয়া মাদ্রাসা থেকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে ফাজিল ও ’৬২ সালে ঠাকুরগাঁও পিটিআই থেকে সার্টিফিকেট ইন এডুকেশন ডিগ্রি লাভ করেন। শিক্ষাজীবনে কৃতিত্বের অধিকারী আবদুর রশিদ শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। তিনি শিক্ষকতা করেছেন দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, রংপুর ও কুমিল্লার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। অবসর নেন কুমিল্লার বরুড়ার মন্দুক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ১৯৯৮ সালে। ৩১ বছরের কর্মজীবনে যথেষ্ট সুনাম ছিল তাঁর।

তাঁকে বিবেচনা করা হয় সুশিক্ষক ও প্রগতিশীল চিন্তার অধিকারী একজন অনন্যসাধারণ মানুষ হিসেবে। শিক্ষকতা ছিল তাঁর কাছে সামাজিক আন্দোলন। তাঁর বিশ্বাস ছিল শিক্ষাদানের মাধ্যমে সমাজে সুনাগরিক তৈরি করা সম্ভব। তিনি মহল্লায় ঘুরে অসচ্ছল পরিবারের সন্তানদের নিয়ে এসে ভর্তি করাতেন বিদ্যালয়ে। তাদের পড়াশোনার ব্যয়ভারও নিজে বহন করতেন। শিক্ষার্থীদের নৈতিক চরিত্র গঠনে তাঁর কঠোরতা প্রকাশ পেত। তাদের উপদেশ দিতেন- শিক্ষার মাধ্যমেই পরিপূর্ণ জীবন লাভ করা যায়। তাঁর স্বভাব ছিল কঠোর ও কোমলতার অপূর্ব সমন্বয়। ভালো ছাত্রদের জন্য তিনি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। আবার দুর্বলদের জন্য ছিল ভীষণ পক্ষপাত। তিনি বিশ্বাস করতেন, সবার ভালো মানুষ হওয়ার অধিকার আছে। তাঁর প্রিয় ছাত্ররা দেশ-বিদেশে বিভিন্ন স্থানে নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে আজ প্রতিষ্ঠিত। তিনি ছিলেন বিজ্ঞানমনস্ক আদর্শ শিক্ষক, সমাজ সচেতন। আর পরিবারের কাছে ছিলেন আদর্শ পিতা, অভিভাবক। নিজ সন্তানদের তিনি কঠোর শাসন, স্নেহে সুশিক্ষিত করেছেন।

আবদুর রশিদ মাস্টার মেধাবী শিক্ষার্থীদের উন্নত স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করার ক্ষেত্রে ছিলেন পথপ্রদর্শক। অনেকেই তাঁর পরামর্শ নিতেন। ঘরে ঘরে সুশিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার অন্যতম কারিগর তিনি। নিজে মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও শিক্ষকতা করেছেন বাংলা মাধ্যমের বিদ্যালয়ে। গোঁড়ামি, কুসংস্কার, সাম্প্রদায়িকতা তাঁকে স্পর্শ করেনি।  তাঁর ব্রত ছিল সামষ্টিক উন্নয়ন ও সম্প্রীতি। মানুষের মধ্যে সত্য, ন্যায় ও আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য সব সম্প্রদায়ের মানুষ তাঁকে ভালোবাসত। শিক্ষার ক্ষেত্রে ধর্মীয় বাধা, মতপার্থক্য তাঁর কাছে ছিল তুচ্ছ। জ্ঞান বিস্তারই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। তাঁর জীবনদর্শন ছিল মধ্যযুগের কবি চ-ীদাসের অমর বাণী, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’।

নারী শিক্ষার প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল প্রবল। তখনকার দিনে মেয়েদের স্কুল, কলেজে পড়া নিয়ে অনেকেই কলুষ ধারণা পোষণ করত। আবদুর রশিদ মাস্টার বিশ্বাস করতেন, শিক্ষার বিস্তারের মাধ্যমেই নারী জাতির মুক্তি সম্ভব। মেয়েদের পড়াশোনায় এগিয়ে নেওয়ার জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছেন। অভিভাবকদের বুঝিয়েছেন। শিক্ষা অর্জনে উৎসাহিত করেছেন। নারী শিক্ষার মাধ্যমেই বাল্যবিয়ে রোধ, নারীর স্বাস্থ্যসচেতনতা ও শিক্ষিত প্রজন্ম তৈরিতে তাঁর ভূমিকা ছিল অগ্রণী। এমনকি নিজের চার মেয়েকে দিয়েছেন সর্বোচ্চ শিক্ষা।

ব্যক্তিজীবনে আবদুর রশিদ ছিলেন অত্যন্ত নির্লোভ, নিরহংকারী। অতি সাধারণ ছিল তাঁর জীবন যাপন। সম্মান এবং মর্যাদাকে বেশি মূল্যায়ন করতেন। তাঁর নিজের জন্য কখনো অন্যদের মুখাপেক্ষী হননি। ধর্মচর্চায় ছিলেন নিবেদিত। মানুষের বিপদাপদে পাশে থাকতেন। তাঁর অপছন্দ ছিল বিলাসিতা, অপচয়, অপব্যয় আর মিথ্যা। প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোনো কাজ-কথা ছিল তাঁর রীতিবিরুদ্ধ।

তাঁর পাঠাভ্যাস ছিল আকর্ষণীয়। নিয়মিত পত্রিকা ও বই পড়া ছিল তাঁর অভ্যাস। মাওলানা মুহিউদ্দিন খান সম্পাদিত জনপ্রিয় পত্রিকা ‘মাসিক মদিনা’য় তিনি নিয়মিত লিখতেন। তাঁর লেখা পাঠকসমাজে বেশ সমাদৃত ছিল। মানুষের প্রতি তাঁর ছিল উদার দৃষ্টিভঙ্গি। প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনের প্রতি তিনি ছিলেন আন্তরিক। অসহায় এতিমদের লেখাপড়ার খরচ জুগিয়েছেন নির্মোহভাবে। এতিমের সম্পদ রক্ষায় অভিভাবকের ভূমিকা পালন করেছেন। ব্যক্তিজীবনে অত্যন্ত আবেগপ্রবণ মানুষ ছিলেন কিন্তু তা প্রকাশ করতেন না। আত্মপ্রচার, পরনিন্দা থেকে ছিলেন মুক্ত। রীতি-নীতি, সততা, কর্তব্যনিষ্ঠা ও ন্যায়পরায়ণতার জন্য ছিলেন সর্বজনের শ্রদ্ধেয়। শিশুর মতো কোমল হৃদয় ছিল তাঁর।

১৯৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় জীবনে সবচেয়ে গৌরবজনক অধ্যায়। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে গর্জে উঠেছিল বাংলার জনগণ। তারা মৃত্যুকে উপেক্ষা করে ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বাধীন করেছিল প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধের সময় আবদুর রশিদ মাস্টারের অসাধারণ দেশপ্রেমের পরিচয় ফুটে ওঠে। একজন সংগঠক হিসেবে তাঁর ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। তিনি বাঁশ কেটে বাঁশের চোখা মাথা তৈরি করে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। পাক হানাদার বাহিনীর আক্রমণ হলে এসব বাঁশের ফলা দিয়ে তাদের পরাজিত করার নিজস্ব প্রস্তুতি তাঁর ছিল। সম্ভ্রমহানি থেকে রক্ষায় নারীদের বাড়ির পাশে জঙ্গলে গর্ত করে লুকিয়ে রাখার পরিকল্পনা করেছিলেন। এভাবে এলাকার বহু নারীর সম্ভ্রম রক্ষা হয়েছিল। তাঁর আরেকটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ ছিল যুদ্ধ চলাকালে খাদ্য সংকট থেকে রক্ষা পাওয়ার কৌশল। বাড়ির পেছনে গর্ত করে মাটির মটকা, কলসি ভরে চাল, ডাল, মূল্যবান বস্তু লুকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। এর ফলে পাক বাহিনী বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়ার পরও আশপাশের লোকদের না খেয়ে মরতে হয়নি। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর সাহসী পদক্ষেপের কথা জেনে ছোটবেলায় আমাদের উদ্দীপনা বেড়ে যেত। ’৭১-পরবর্তী প্রজন্ম হিসেবে তাঁর গল্প শুনে মনের অজান্তেই চোখের কোণে জল জমে উঠত। প্রশিক্ষিত পাক হানাদার বাহিনীর সুসজ্জিত আগ্নেয়াস্ত্র সম্পর্কে সামান্যতম ধারণা না রেখে তাঁরা যে দুঃসাহসী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তা অত্যন্ত গৌরবজনক। তিনি বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা গড়ে তোলা এবং আমাদের বিবেক জাগ্রত করার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন।

একজন সমাজ সংস্কারক হিসেবে আলহাজ আবদুর রশিদ মাস্টারের অবদান অপরিসীম। ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে তাঁর ছিল সুস্পষ্ট অবস্থান। সব ধর্ম-বর্ণের মানুষের প্রতি ছিল অগাধ শ্রদ্ধা। পারিবারিক বা বিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে পবিত্র কোরআন পাঠপূর্বক বাংলায় তার পর্যালোচনা করতেন। সব সময় সৎ পথে চলা, ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ করতেন। কুমিল্লা বার্ড-এর প্রতিষ্ঠাতা আখতার হামিদ খানের উৎসাহে এলাকার মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে বার্ডের আওতায় সমবায় সমিতি গঠন করেছিলেন তিনি। তাঁর সমিতি রিকশা কিনে দিয়েছিল অসহায় মানুষদের। এভাবে এলাকার দরিদ্র মানুষের বেকারত্ব ঘোচাতে সহায়তা করেন তিনি। তিনি বিশ্বাস করতেন আর্থিক মুক্তি না ঘটালে সামাজিক অনাচার দূর হবে না। যে কোনো প্রয়োজনে পরস্পরের বিভেদ দূর করে সামাজিক শান্তি প্রতিষ্ঠায় তিনি নিমগ্ন ছিলেন। শিক্ষকতার মহান ব্রত নিয়ে আলো ছড়িয়েছেন সর্বত্র।

১১ আগস্ট, ২০১৯-এ আমাদের ছেড়ে চলে যান এই মহান মানুষটি। তিনি বেঁচে থাকবেন সবার হৃদয়ে- তাঁর আদর্শ আর ন্যায়নিষ্ঠার জন্য। তাঁকে স্মরণ করি গভীর শ্রদ্ধায়। আমাদের বিশ্বাস, উত্তর প্রজন্মের মাধ্যমে তিনি আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠবেন।

সর্বশেষ খবর