শুক্রবার, ২১ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে

নেয়ামত উল্ল্যা ভূঁইয়া

যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে

‘কুবের হাকিয়া বলে, যদু হে এ এ এ-মাছ কিবা? খানিক দূরের নৌকা হইতে জবাব আসে, জবর।’ ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র এই একটি সংলাপ থেকেই অনায়াসে ঠাওর করা যায়, এ উপন্যাসের মানুষ কারা এবং লেখক কোন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। আর ময়না দ্বীপের মতোই রহস্যময় হোসেন মিয়ার গীত ‘নিদ ভাঙে না, দিল জাগে না, বিবির বুকের শির,/পাড়ি দিবার সময় গেল, মাঝি তবু থির/মাঝি কত ঘুমাইবা?’-প্রতীকী অর্থে কেতুপুরের কোন সমাজের কোন শ্রেণির চিরবঞ্চিত অসহায় ও চিরসুপ্ত অচেতন মানুষের বাস্তব চিত্র লেখক রূপায়িত করেছেন, তাও পাঠকের বোধাতীত থাকে না।

‘পদ্মা নদীর মাঝি’ পদ্মা তীরবর্তী অঞ্চলের জেলে সম্প্রদায়ের জীবন চিত্র। জেলে ও মাঝিদের দুঃসাহসিক জীবনযাত্রা এ উপন্যাসের উপজীব্য হলেও তাদের সীমাহীন দারিদ্র্যের নির্মম কষাঘাতে জর্জরিত বেদনার অন্তর্গত আর্তনাদ পরম বিশ্বস্ততার সঙ্গে চিত্রিত করেছেন যে সাহিত্যিক তিনিও একজন মানুষ। এ চিত্রকর সাহিত্য-শিল্পী। চিত্রশিল্পীর সামগ্রী রং, তুলি, ক্যানভাস। আর সাহিত্যশিল্পীর সামগ্রী শব্দ, কলম, কাগজ। তবে দুজনেরই যে-বাড়তি অথচ অতি প্রয়োজনীয় জিনিসটার দরকার তার নাম মননমধু, মনের মাধুরী। বাস্তব অভিজ্ঞতার সঙ্গে একাকার হয়ে যখন কল্পনার বর্ণালি রং শিল্পীর অন্তর্গত জমিনে আলপনা আঁকে তখন তা প্রাণের স্বতঃস্ফূর্ততায় বহিরাঙ্গনে পাড়ি জমায়। আত্মা যুক্ত হয় পরম আত্মীয়ের সঙ্গে; মানুষের সঙ্গে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ও তার বাস্তব অভিজ্ঞতার ছাঁকনিতে নিপুণ কলমের আঁচড়ের মমতার রস সিঞ্চনে করে কুবের, কপিলা, মালা, মহাজন, হোসেন মিয়া, গণেশকে চিত্রায়ণের মাধ্যমে যুক্ত হয়েছেন পাঠকের সঙ্গে, মানুষের সঙ্গে। তার সাহিত্যের এই মানুষগুলোর আশ্রয়েই তিনি মানুষের জন্য সাহিত্য রচনা করেছেন।

যথার্থ অর্থে মানুষের সঙ্গে যুক্ত হতে পারলেই শিল্পী প্রকাশ বেদনার ভার থেকে মুক্তি পান। শিল্পীর ভাব শুক্তির জঠরে থাকা মুক্তার মতো— যার কদর অন্দরে নয়, বাইরে। শুক্তির অন্দরে তার মুক্তি নেই, সমাদরও নেই। মুক্তোমালায় যুক্ত হয়ে সমজদারের কণ্ঠে অলংকাররূপে সমাদৃত হলেই তার মণিকা জীবন সার্থক। সাহিত্যের কাজও ওই মুক্তোর মতো। অন্দর থেকে বাইরে এসে দেশ কাল পাত্র মন মনন ও মানুষের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ ঘটিয়ে এবং বিছিন্নকে যুক্ত করে সার্থকতা লাভ করে। সাহিত্য মানুষের জীবন-মানসের প্রতিফলন ঘটায় পরম নিষ্ঠায়, অবিচল বিশ্বস্ততায় ও শৈল্পিক সুষমায়।

বস্তুত মানুষ প্রকৃতির মতো কিছুই সৃষ্টি করতে পারে না। পারে রূপান্তর করতে, মূল্য সংযোজন করতে। কিন্তু যে অমূল্য জিনিসটি সে সৃষ্টি করতে পারে, তার নাম শিল্প-সাহিত্য। সাহিত্য মানুষের এমন এক সৃজনশীল কর্ম যার লক্ষ্য এবং উপলক্ষও মানুষ। এর স্রষ্টাও মানুষ, সৃষ্টি তথা পাত্রপাত্রী, চরিত্রগুলোও মানুষ। আবার এর অংশীজন বা উপকারভোগী এবং উদ্দেশ্য ও বিধেয়- সবই মানুষ। এককথায়, সাহিত্যের কর্তা, কর্ম, করণ- সবই মানুষ। আর মানুষ সামাজিক প্রাণী বলেই পরস্পর এমনভাবে সংসৃষ্ট যে তাদের একে অপরকে ভালোবাসা ছাড়া উপায়ন্তর নেই। হ্যাঁ, এ ছন্দেরও পতন ঘটে বটে, তবে তা সর্বজনীন নয়। স্বনামধন্য জাপানি সাহিত্যিক হারুকি মুরাকামি বলেছেন, ‘কোনো ব্যক্তিবিশেষের জীবন প্রাকৃতিকভাবে নিঃসঙ্গ হতে পারে; তবে তা বিছিন্ন নয়। সেই জীবনের সঙ্গে অন্য জীবনের নিবিড় সম্পর্ক অবশই আছে। কিটস-এর বিখ্যাত কবিতা ‘ওড টু নাইটিংগেল’-এর বহুল উদ্ধৃত উক্তি   ‘Here, where men sit and hear each other groan’ ছত্রটি আমাদের জানান দিয়ে যায়, মানুষ পরস্পর কেমন সুনিবিড়ভাবে যুক্ত হয়ে আছে, দেখো। সাহিত্য মানুষের দ্বারা লেখা, মানুষকে নিয়ে লেখা এবং মানুষের জন্য লেখা। মানব সমাজের মতো সাহিত্যও বিবর্তনাধীন। এর আদি শব্দশিল্প ‘কবিতা’ হলেও বিচিত্র আবর্ত আঘাতে মানব সমাজ ও সভ্যতার বিবর্তনের ধারায় মানুষ ক্রমান্বয়ে তাদের ভাব, অনুভূতি ও অভিজ্ঞতাকে শিল্পময় করে প্রকাশের তাগিদে কবিতার বীজ থেকে অঙ্কুরিত, পল্লবিত, পুষ্পিত করেছে সাহিত্যের-বৈচিত্র্যময় বহুব্রীহি আঙ্গিক।

সুদীর্ঘ পথযাত্রায় বোধ করি আজ অব্ধি সাহিত্য সুনির্দিষ্ট কিংবা সর্বজনগ্রাহ্য কোন সংজ্ঞার ওপর থিতু হতে পারেনি। আর হবেই বা কেন! এ-যে এক চির চলমান শিল্প। সদা-চলিষ্ণু পাথরে শ্যাওলা জমে না। কোনো নির্দিষ্ট নিগূঢ়ে বাঁধা পড়ে না। আর এ কথাও আমার বোধে আসে না যে, সব কিছুর সংজ্ঞা থাকতে হবেইবা কেন? মায়ের মমতা, বোনের সোহাগ, বাবার স্নেহ, মিত্রের মৈত্রী, প্রেমের পুলক, বন্ধুর দরদ, সখার সখ্য, প্রসূতির প্রসন্ন প্রসূনে নিহিত নন্দিত আনন্দ, মোনালিসা’র হাসি- এ সবের কি কোনো সংজ্ঞা আছে?

সাহিত্যের রূপ অন্তহীন। কখনো হয়েছে জীবনের রঙ্গমঞ্চ, কখনো হয়েছে জীবনালেখ্য, কখনো সমাজের প্রতিচ্ছবি, কখনো জীবন ও সমাজের প্রতিফলন, কখনো সময়ের দর্পণ। কখনো নিজেই হয়েছে প্রশ্ন, নিজেই হয়েছে জবাব, আবার মানুষ ও সমাজকে জোর তাগিদ দিয়ে বলেছে, ‘প্রশ্ন করো, জানতে চাও।’ কখনো হয়েছে আবেগের আতিশায্যে উদ্বেল, কখনো অনুভূতির বাঁধভাঙা প্রকাশ, কখনো সমকালের মুখপাত্র, কখনো শব্দ ঝংকার, কখনো মিলনের মোহনা, কখনো প্রাণোচ্ছ্বাসের প্রেরণা, কখনো বিরহের বিলাপ, কখনো শোকের আর্তনাদ; আবার কখনো প্রেমিক, কখনো বিপ্লবী, কখনোবা বঞ্চিতের সঞ্চিত ভোরের শব্দ প্রকাশ, দ্রোহর সেøাগান, আবার কখনোবা হয়েছে একান্ত শিল্পের জন্যই শিল্প। সাহিত্য আসলে অনামিকা। তাকে যার যার পছন্দের নামে ডাকা যায়। বোধকরি, সেই তরিকাতেই রসবোদ্ধারা কালে কালে ‘আপন অন্তর হতে সৌন্দর্য সঞ্চারী’ তাদের আদুরে সাহিত্য লতিকাকে নানান শোভা-সৌরভে সাজিয়েছেন স্বপ্নিল সুষমায়।

সাহিত্যের পরিধি এতটাই ব্যাপক যে, মানুষের কল্যাণের জন্য জগতে যত বাণী উচ্চারিত হয়েছে, সবই সাহিত্যের পর্যায়ভুক্ত। এ ব্যাপকতাকেই লক্ষ্য করে বোধকরি ডা. লুৎফর রহমান সাহিত্যের বিষয়ে একটি স্মরণযোগ্য মন্তব্য করেছেন, ‘জীবনের কল্যাণের জন্য, মানুষের সুখের জন্য এ জগতে যিনি যত কথা বলিয়া থাকেন,- তাহাই সাহিত্য।’ শিল্পের চিরায়ত উপাদান তিনটি : মানুষ, সময় ও নিসর্গ। মানুষের যাপিত জীবন, সময়ের প্রবহমানতা, প্রকৃতির পালাবদল- এ সবের মাঝে রয়েছে এক অলৌকিক ছান্দিক সাযুজ্য। আত্মপ্রকাশের আকাক্সক্ষা, বাইরের জগৎ ও জনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার আকুলতা, বাস্তব জগতের অপূর্ণতাকে কল্পজগতের বিত্তবৈভব দ্বারা পূর্ণতাদানের আকুতি, সহজাত রূপপ্রিয়তা- মোদ্দা কথায়, এ চারটিই মানুষের সাহিত্য সৃষ্টির মূল উৎস। তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, সাহিত্য কি? শিল্পমানসম্পন্ন কাল্পনিক বা সৃজনশীল রচনার নাম সাহিত্য। তাহলে সাহিত্যের উদ্দেশ্য কী? রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘বিষয়ী লোকে বিষয় খুঁজিয়া মরে। লেখা দেখিলেই বলে, বিষয়টা কী? কিন্তু লিখিতে হইলে যে বিষয় চাই-ই এমন কোনো কথা নাই। বিষয় থাকে তো থাক, না থাকে তো নাই থাক, সাহিত্যের তাহাতে কিছু আসে যায় না।... বিশুদ্ধ সাহিত্যের মধ্যে উদ্দেশ্য বলিয়া যাহা হাতে ঠেকে তাহা আনুষঙ্গিক। এবং তাহাই ক্ষণস্থায়ী। যাহার উদ্দেশ্য আছে তাহার অন্য নাম... লক্ষণ অনুসারে তাহাকে দর্শন বিজ্ঞান বা ইতিহাস বা আর-কিছু বলিতে পার। কিন্তু সাহিত্যের উদ্দেশ্য নাই।’ সাহিত্যের সাধারণ উদ্দেশ্য যদি থেকে থাকে, তা কেবলই আনন্দ সঞ্চার।

সাহিত্যের ‘উদ্দেশ্য প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ উল্লেখ করেন’, সাহিত্যের প্রভাবে আমরা হৃদয়ের দ্বারা হৃদয়ের যোগ অনুভব করি, হৃদয়ের প্রবাহ রক্ষা হয়, হৃদয়ের সহিত হৃদয় খেলাইতে থাকে, হৃদয়ের জীবন ও স্বাস্থ্য-সঞ্চার হয়। যুক্তিশৃঙ্খলের দ্বারা মানবের বুদ্ধি ও জ্ঞানের ঐক্য বন্ধন হয়, কিন্তু হৃদয়ে হৃদয়ে বাঁধিবার তেমন কৃত্রিম উপায় নাই। সাহিত্য স্বতঃ উৎসারিত হইয়া সেই যোগসাধন করে। সাহিত্য অর্থই একত্র থাকিবার ভাবমানবের ‘সহিত’ থাকিবার ভাবমানবকে স্পর্শ করা, মানবকে অনুভব করা। সাহিত্যের প্রভাবে হৃদয়ে হৃদয়ে শীতাতপ সঞ্চারিত হয়, বায়ু প্রবাহিত হয়, ঋতুচক্র ফিরে, গন্ধ গান ও রূপের হাট বসিয়া যায়। উদ্দেশ্য না থাকিয়া সাহিত্যে এইরূপ সহস্র উদ্দেশ্য সাধিত হয়।” অক্ষয়কুমার বড়ালের ‘মানব বন্দনা’ কবিতার সেই প্রতীকী প্রশ্ন পক্ষান্তরে মানুষেরই মাহাত্ম্য প্রকাশ, মানুষেরই জয়গান। ‘সেই আদি-যুগে যবে অসহায় নর নেত্র মেলি ভবে,/ চাহিয়া আকাশ পানে কারে ডেকেছিল, দেবে না মানব?’ বাংলার মধ্যযুগের কবি বড়– চ-ীদাস উচ্চারণ করেছিলেন মানব-ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ মানবিক বাণী-‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’। সমগ্র বিশ্ব যখন হিংসায় উন্মত্ত, রক্ত ঝরছে পৃথিবীর নাজুক শরীর থেকে, তখন বাংলাভাষী এক কবি বিশ্বকে শুনিয়ে ছিলেন মানবতার বাণী চিরন্তনী। আর সেই ধারাবাহিকতায় বিদ্রোহী কবির শাণিত উচ্চারণ ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহিয়ান।’ 

সত্য-যে সর্বোৎকৃষ্ট তা স্বতঃসিদ্ধ। তবে শুধু আলোর গতি ছাড়া নিরেট, পুরাদস্তুর, নিপাতনীয় সত্য বলে কিছু নেই। আর সবই আপেক্ষিক। টেস্ট টিউব আর কলকব্জা যাদের মগজ মননে, তাদের সেসব বৈজ্ঞানিক সূত্রে অবশ্য সাহিত্যের তেমন ক্ষতি-বৃদ্ধি নেই। সাহিত্যের সত্য কল্পনার সত্য। সাহিত্যের সম্ভোগ আত্মমুগ্ধ সৌন্দর্যরস। জীবনের নিখাদ ও নিখুঁত সত্যের নাম বাস্তব সত্য নয়; ভাবসত্য।

শিল্পই  সাহিত্যের প্রসূতি। এক কথায়, যার শিল্পমূল্য নেই, তা সাহিত্য নয়। তাহলে শিল্প কী? মানুষের সৃষ্টিশীলতা বা কল্পনার প্রকৃষ্ট প্রকাশ ও নান্দনিক প্রয়োগই শিল্প। আর তা নিষ্ঠ হয় সৌন্দর্য সৃষ্টি এবং ভাবাবেগের পরাক্রমে। স্থিতির মধ্যে চলিষ্ণুতা, বিন্দুতে সিন্ধু, খন্ডাংশে অখন্ডতা, ক্ষণকালের মধ্যে চিরকাল, সসীমে অসীম, রূপের মধ্যে অরূপকে রূপায়িত করবার মাঝেই কলার কালোত্তীর্ণ কেরামতি। আর্ট চলিষ্ণু জীবনের স্থিতিমান মুহূর্তের প্রকাশ। ‘দৃশ্য বা অদৃশ্যকে শিল্পীর চিত্তরসে রূপায়িত করিয়া যে স্থিথিশীল রূপ-মহিমা দান করা হয়, উহাই আর্ট বা ললিত কলা কিংবা কারুশিল্প এবং যিনি এই সৌন্দর্যসৃষ্টি করেন, তিনিই আর্টিস্ট বা শিল্পী।’

সাহিত্যিক রূপ বিলাসী রূপকার। আর সে অর্থেই সাহিত্যিক উচ্চমার্গের আর্টিস্ট। প্রসঙ্গতঃ পাবলো পিকাসোর শরণ নিয়ে বলি, ‘Art is a lie that makes us realize truth’. শিল্পীর সত্য তথ্যসত্য (Truth of fact) নয়। সে সত্যের নাম কাব্য সত্য (Poetic truth) সাহিত্যের সত্য ও প্রকৃত সত্য-যে এক নয়, সে প্রসঙ্গে ররীন্দ্রনাথের এ উক্তিটি স্মরণীয় ‘সাহিত্যের মা যেমন করিয়া কাঁদে, প্রকৃতির মা তেমন করিয়া কাঁদে না। তাই বলিয়া সাহিত্যের মার কান্না মিথ্যা নহে।’ সাহিত্যিক কল্পনার আশ্রয়ে বাস্তব সত্য। সৌন্দর্য নান্দনিক সত্য, সর্বজনীন, পারমার্থিক। সেই সৌন্দর্য তখন অনশ্বর, অবিনাশী, অনন্তকালের আনন্দ সঞ্চারক ও সঞ্চালক। বিবর্ণতা একে গ্রাস করতে পারে না। বরং সময়ের প্রবহমানতা একে আরও লাবণ্যময় করে তোলে। সে কখনো নিঃশেষ হয় না। আর সৌন্দর্যচর্চার পুরোভাগে যাদের অবস্থান তারা শিল্পী। কারণ তাদের ওপরই বিধাতা অলৌকিক আনন্দের ভার অর্পণ করছেন অকৃপণ আশিসে। ‘সেই সত্য যা রচিবে তুমি, ঘটে যা তা সব সত্য নহে/ কবি তব মনোভূমি, রামের জন্মস্থান অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো।’ সেই পরিক্রমায় সত্য সুন্দর; সুন্দরই সত্য; সত্যই অমৃত, সুন্দরই অনশ্বর। সৌন্দর্যের উৎকর্ষ সাধনের মধ্যেই মানুষের নান্দনিক সৌকর্যের উৎসারণ। আর এই সৌন্দর্য উৎসারণের কাজটা যার দায় এর নাম সাহিত্য।

‘মানুষের সাহিত্য’ বলতে মানুষের জন্য রচিত সাহিত্যকে বোঝালেও এর অর্থবাচকতার গ-ি আরো খানিকটা বিস্তৃত। কারণ এ মানুষ সকল মানুষ; অসাধারণ-সাধারণ , গণ্য-নীগণ্য, উচ্চ-তুচ্ছ, ধনী-নির্ধন সকল শ্রেণি, পেশা, ধর্ম, গোত্র, বর্ণ, ভৌগোলিক সীমারেখা নির্বিশেষে গণমানুষ। মুক্ত-চিন্তাকরা গণমানুষ আর জনসাধারণ এ দুয়ের মধ্যে বিস্তর কোন ফারাক দেখে না। তবে যারা কেবল বুদ্ধিকেই জীবিকাবৃত্তির শেষ অবলম্বন হিসেবে বেছে নিয়েছেন, সেই বোদ্ধাদের কেউ কেউ এ দুয়ের সাযুজ্যে নারাজ। ‘গণ’-এর মধ্যে তারা কেমন একটা বাম-বাম ব্যেমো খুঁজে পান। কেমন কেমন উদ্ধত উপদ্রবের ভাব। আর জন? কী গোবেচারা শব্দ, কী নিরুপদ্রব! প্রাণ জুড়িয়ে যায়। ধরুন, জনপ্রিয় জননেতা, জনস্রোতে জনসভা জনসমুদ্র, জনমত জরিপ, জনহিতকর জনপদ, জনমনের জনরায়, জনগণমন অধিনায়ক। বাহ, কী মাধুর্য!

আরেক শ্রেণির কাছে ‘গণ’ শব্দাংশটাই ভীতিকর। কারণ তা তন্ত্রের উপসর্গ হয়ে ‘গণতন্ত্র’ বানায়। সাধারণভাবে একটা জনপদের ইতরভদ্র সকল শ্রেণির লোকই এককথায় সাহিত্যের মানুষ, সাহিত্যের চরিত্র। তাদের সঙ্গেই সাহিত্যের সুনিবিড় সংযোগ।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর