শুক্রবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা
জলেশ্বরীর সৈয়দ হক

যেভাবে আমাদের হলেন

মাজহারুল ইসলাম

যেভাবে আমাদের হলেন

সৈয়দ শামসুল হক, আনোয়ারা সৈয়দ হকের সঙ্গে লেখক দম্পতি

‘আনন্দ আলো’র বারো বছরপূর্তি উপলক্ষে বিশিষ্ট বারোজনকে সম্মাননা জানানোর জন্য চ্যানেল আই চত্বরে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। সৈয়দ শামসুল হক তাঁদের অন্যতম। কীভাবে যেন আমার মতো অভাজনের নামও সে তালিকায় ঢুকে গেছে। আমি মঞ্চের ডান দিকে ফরিদুর রেজা সাগরের পাশে বসে আছি। তারিখটা ছিল ১৪ এপ্রিল ২০১৬। বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন।

অনুষ্ঠান শুরুর প্রস্তুতি চলছে। সৈয়দ হক সামনের সারিতে বসা। হঠাৎ তিনি উঠে এসে হাতের ইশারায় আমাকে ডেকে মঞ্চের পেছনে নিয়ে বললেন, আমার শরীরটা খুব খারাপ। এর মধ্যে কয়েকদিন হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। আগামীকাল সকালে লন্ডন যাচ্ছি চিকিৎসার জন্য।

আমি বললাম, আমি তো কিছুই জানি না। কী হয়েছে আপনার? সৈয়দ হক বললেন, পরে বলব। আমার জন্য দোয়া কর। কথাগুলো বলে কিছুদূর গিয়ে আবার ফিরে এসে শক্ত করে আমার ডান হাতটা ধরলেন। নিচুস্বরে বললেন, বারডেমের ডাক্তাররা ধারণা করছে ফুসফুসে ক্যানসার। কথাটা তোমাকে বললাম, আর কাউকে এখন বলবে না। এরপর আর কোনো কথা না বলে তিনি ধীর পায়ে হেঁটে নিজের বসার জায়গায় চলে গেলেন।

আমি স্তম্ভিত হয়ে তাঁর হেঁটে যাওয়া দেখলাম। এই প্রথম মনে হলো, তাঁর ওজন অনেকটা কমে গেছে। কিছুক্ষণ একা দাঁড়িয়ে থাকলাম। এই তো মাত্র কদিন আগে ২৩ মার্চ নাসের, কমল ও আমাকে দুপুরে ঢাকা ক্লাবে খাওয়ালেন। আনোয়ারা ভাবিও ছিলেন। কত কথা হলো, গল্প হলো সেদিন।

এপ্রিলের ১ তারিখ থেকে ‘অন্যদিন’ ঈদসংখ্যার উপন্যাস লেখা শুরু করবেন। গেল বছর ঈদসংখ্যায় লিখতে না পারার কারণ ব্যাখ্যা করলেন, যদিও তার কোনো প্রয়োজন ছিল না। ক্লাব থেকে বেরিয়ে একসঙ্গে ছবি তুললাম। সেদিন দেখে একবারও মনে হয়নি তিনি অসুস্থ। এর মধ্যে এত কিছু ঘটে গেছে, অথচ আমি কিছুই জানি না!

২০১১ থেকে ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ করে যাচ্ছি। ২০১২-তে চলে গেলেন হুমায়ূন আহমেদ, পরের বছর সহোদর। যদিও খবরটা শোনার পর হক ভাইকে বলেছিলাম, চিন্তা করবেন না। দেখবেন বিলেতের ডাক্তাররা হয়তো বলবে কিছুই হয়নি। কিন্তু আমার ভয় হচ্ছিল, যদি তেমনটা না বলেন? যদি এখানকার ডাক্তারদের কথাই সত্যি হয়? তাহলে কি তাঁর পায়ের আওয়াজ থেমে যাবে? কলমের সঙ্গে সৈয়দ হকের সংসারের ইতি ঘটবে?

এরমধ্যে কখন মঞ্চে যাওয়ার জন্য আমার নাম ঘোষণা করা হয়েছে খেয়াল করিনি। কেউ একজন এসে বলায় দৌড়ে গিয়ে মঞ্চে উঠলাম। বারোজন একসঙ্গে দাঁড়ানো। হক ভাইয়ের মুখের দিকে তাকাতে পারছি না। প্রথমেই মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে তিনি কথা বলে মঞ্চ থেকে নেমে গেলেন। দীর্ঘদিনের পরিচিত সেই ভারি কণ্ঠস্বর আজ যেন কিছুটা ম্লান মনে হলো। অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার খানিকটা আগেই সৈয়দ হক চলে গেলেন। দূর থেকে তাঁর চলে যাওয়া দেখলাম।

নীল জিন্সের প্যান্ট, কালো কর্ডের শার্ট, গলায় ও হাতে মোটা সোনার চেইন পরা ৬৭ বছরের তরুণ সৈয়দ শামসুল হক। বাংলা একাডেমি বইমেলায় অন্যপ্রকাশের স্টলে চেয়ারের উপর দু’পা তুলে বসে অটোগ্রাফ দিচ্ছেন। চোখে কালো সানগ্লাস।  ১৯৯৮ সালের কথা বলছি। অন্যপ্রকাশ থেকে প্রথম উপন্যাস ‘একমুঠো জন্মভূমি’ প্রকাশিত হয়েছে। এই দৃশ্য বইমেলায় সবার নজর কাড়ে। কোনো কোনো দৈনিকে পরদিন সে ছবি ছাপাও হয়। সেই থেকে অন্যপ্রকাশের সঙ্গে সৈয়দ হকের পথচলা শুরু। এরপর একটার পর একটা নতুন বই প্রকাশ হতে থাকে। বাস্তবতার দাঁত ও করাত, দ্বিতীয় দিনের কাহিনি, গল্প কলকাতার, বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে, শ্রেষ্ঠ কবিতা, মার্জিনে মন্তব্যসহ ৩৮টি বই অন্যপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত হয়।

‘মার্জিনে মন্তব্য’ সৈয়দ শামসুল হকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। এই বইটির শিরোনামে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় একটি কলাম লেখা শুরু করেন আশির দশকের প্রথমদিকে। সেখানে তিনি লেখালেখির কৌশলের বিষয়টি তুলে ধরেছেন।

অন্যপ্রকাশ ২০০২ সাল থেকে সৈয়দ হকের ‘উপন্যাস সমগ্র’ প্রকাশ করতে থাকে। এ পর্যন্ত দশটি খ- প্রকাশিত হয়েছে। কিংবদন্তি এই লেখক ১৯৬৪ সালে মাত্র ২৯ বছর বয়সে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান। তারপর একে একে সব রাষ্ট্রীয় পুরস্কারে ভূষিত হন। যখন কম্পিউটার আবিষ্কার হয়নি তখন সৈয়দ হক টাইপরাইটার মেশিনে লেখালেখি করতেন। পরে তিনি কম্পিউটারে লেখা শুরু করেন। অত্যন্ত আধুনিক এবং ফ্যাশন সচেতন একজন মানুষ ছিলেন তিনি। নতুন বই প্রকাশিত হলে লেখক কপি নিতেন মাত্র দুটি।

একজীবনে বহুকিছু করেছেন সৈয়দ হক। বহুমাত্রিক প্রতিভার লেখক বলেই বাংলা সাহিত্যে তাঁর পরিচয় ‘সব্যসাচী লেখক’ হিসেবে। তিনি গত শতকের পঞ্চাশের দশকের প্রথমার্ধে লেখালেখি শুরু করেছিলেন, ষাট বছরের বেশি সময় ধরে অসাধারণ মেধা, প্রজ্ঞা ও প্রতিভায় নিজেকে রেখেছেন বিপুলভাবে সক্রিয়। ... শুরুতে তিনি গল্পের দিকে হাত বাড়িয়েছিলেন। তাঁর প্রথম প্রকাশিত বইটি গল্পসংকলন। নাম ‘তাস’, প্রকাশিত হয় ১৯৫৪ সালে। পরবর্তী বাষট্টি বছর ধরে লেখা তাঁর নানা গল্পে নানা নিরীক্ষার ছাপ রয়েছে। তিনিই প্রথম এদেশের গল্পে কালেকটিভ ভয়েস ‘আমরা’ ব্যবহার করেছেন। বাংলাদেশের উপন্যাস সাহিত্যের তিনি অন্যতম প্রধান শিল্পী। ‘দেয়ালের দেশ’ তাঁর প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস (১৯৫৯)। এই মাধ্যমেও নানা ধরনের নিরীক্ষা করেছেন তিনি। বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের আবেগ-অনুভূতি-বিকার সবই খুব সহজ কথা ও ছন্দে উঠে এসেছে তাঁর উপন্যাসে।

... ১৯৫১ সালে মুম্বাইতে গিয়ে কিছুদিন একটি চলচ্চিত্র প্রয়োজনা সংস্থায় কাজ করেন। সিনেমার জন্য চিত্রনাট্য তৈরি করেছেন, এমনকি অসংখ্য গান লিখেছেন তিনি চলচ্চিত্রের জন্য। পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও। ‘বড় ভালো লোক ছিল’ ছবির  ‘হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস’-এর মতো আরও অনেক গান মানুষের মুখে মুখে ফিরে। বিবিসি বাংলায় কাজ করেছেন সাত বছর। ১৯৭১ সালে লন্ডন বিবিসি বাংলা থেকে তিনি সংবাদ পাঠ করেছেন। ছবি আঁকতেন। বাংলা মঞ্চনাটকে তাঁর অবিস্মরণীয় সৃষ্টি ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ (১৯৭৬) ও ‘নূরলদীনের সারা জীবন’ (১৯৮২)। কোনো কোনো সাহিত্য সমালোচক বলেছেন যে, ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ এবং ‘নূরলদীনের সারা জীবন’ই যদি শুধু লিখতেন সৈয়দ হক, তাহলেও বাংলা সাহিত্যে তিনি অমর হয়ে থাকতেন।

১৯৭০ সালে প্রকাশিত হয় সৈয়দ হক রচিত কাব্যগ্রন্থ ‘বৈশাখে রচিত পঙ্ক্তিমালা’। আধুনিক সময়ে কোনো কবির এত দীর্ঘ কবিতা বেশ বিরল। তাঁর এই কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি ‘আদমজী সাহিত্য পুরস্কার’ লাভ করেন। এরও দশ বছর আগে ১৯৬১ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘একদা এক রাজ্যে’। তাঁর আরেক বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘পরানের গহীন ভিতর’ (১৯৮১) দিয়ে তিনি আঞ্চলিক ভাষাকে উপস্থাপন করেছেন তাঁর কবিতায়। কবিতায় তাঁর ধারাবাহিকভাবে যে অবদান তা বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ।

অনুবাদ সাহিত্যেও অসামান্য অবদান রেখেছেন তিনি, বিশেষত শেকসপিয়রের নাটকে। তাঁর তুল্য শেকসপিয়রের নাটকের অনুবাদ সমগ্র বিশ্বসাহিত্যেই বিরল।

লন্ডনে চিকিৎসাধীন অবস্থায় প্রায়ই ফোনে কথা হতো। অধিকাংশ সময় আমিই ফোন করতাম। কখনো কখনো হক ভাইও ফোন করতেন। তবে হক ভাই ম্যাসেজ পাঠাতেন বেশি। ম্যাসেজগুলো লিখতেন ইংরেজিতে আর আমি উত্তর দিতাম বাংলায়। ফোনে তাঁর চিকিৎসা-সংক্রান্ত নানা তথ্য জানতাম-কখন তিনি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, কটা কেমো নিয়েছেন, নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন, সেইসব পরীক্ষার রেজাল্টই বা কী ইত্যাদি। কোনো কারণে হক ভাই ফোন ধরতে না পারলে ভাবি ধরতেন। কথা হতো তাঁর সঙ্গেও। একদিন হক ভাইয়ের ফোন এল। তিনি জানালেন, শেকসপিয়রের ‘হ্যামলেট’-এর অনুবাদ শেষ হয়েছে। শিল্পকলা একাডেমি নাটকটি প্রযোজনা করবে এবং আতাউর রহমান নির্দেশনা দেবেন। তারপর বললেন, আতাউর আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু। ওঁর ওপর আমার আস্থা আছে। দেখো আতাউর খুব ভালো করবে। আরও বললেন, বইটা তোমরা প্রকাশ করবে। কিন্তু এখন না, প্রথম মঞ্চায়নের দিন বইটি প্রকাশ হবে। আমি শুনে খুবই খুশি হলাম। ক’দিন পর আমাকে বললেন, বইয়ের শুরুতে ‘সবিনয় নিবেদন’ শিরোনামে একটা লেখা যাবে। সেটা আমি লিখে ফেলেছি। এটা তোমাদের ‘অন্যদিন’-এ ছাপতে পার। আমি বললাম, অবশ্যই ছাপব। আপনার এবং নাটকের নির্দেশকের দুটো সাক্ষাৎকারও ছাপতে চাই। ভাইবারে আপনার সাক্ষাৎকার নেওয়া হবে। সেই সঙ্গে ‘হ্যামলেট’ নিয়ে একটা বড় স্টোরি থাকবে।

আমার পরিকল্পনা হক ভাই পছন্দ করলেন। এরপর আলোচনা করে ঠিক করা হলো দুটো সাক্ষাৎকারই নেবেন শফি আহমেদ। তারিখ ও সময় ঠিক করা হলো। ফোন রেখে আতাউর রহমান ও শফি আহমেদের সঙ্গে এবিষয়ে কথা বললাম। দুজনই সানন্দে রাজি হলেন।

নির্ধারিত তারিখে অন্যদিন অফিসে বসে সাক্ষাৎকার দুটো গ্রহণ করলেন শফি আহমেদ। প্রায় চল্লিশ মিনিট হক ভাই সাক্ষাৎকার দিলেন।

ই-মেইলে তিনি কিছু ছবি পাঠালেন সাক্ষাৎকারের সঙ্গে ছাপানোর জন্য। প্রচ্ছদে ছবি কী যাবে? সিদ্ধান্ত হলো হক ভাইয়ের ছবি দিয়ে প্রচ্ছদ হবে এবং এই সংখ্যাটি হবে অন্যদিন ঈদুল আজহা সংখ্যা।

এরমধ্যে হক ভাই ফোন করে জানালেন, সেপ্টেম্ব^রের ১ তারিখ দেশে আসবেন কিছুদিনের জন্য। আগের দিন আমি চলে গেলাম কলকাতায় বাংলাদেশ বইমেলায় অংশ নিতে। কলকাতা থেকে খবর পেলাম দেশে এসে তিনি ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল। তাহলে কি শরীরটা আরও খারাপ করেছে? নাকি দীর্ঘ বিমান ভ্রমণের ধকল নাজুক শরীরটাকে আরও নাজুক করে দিয়েছে?

কলকাতা থেকে ফিরে এসে ফোন করলাম ভাবিকে। তিনি এই মুহূর্তে হাসপাতালে যেতে বারণ করলেন। ডাক্তার বলেছেন দর্শনার্থী যত কম আসবে ততই ভালো। ভাবি বললেন, দু-একটা দিন যাক, আমি তোমাকে জানাব। এর মধ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হক ভাইকে দেখতে যান ইউনাইটেড হাসপাতালে। পরদিন সব জাতীয় দৈনিকে ছবিসহ সংবাদ ছাপা হয়। সেদিনই সকাল এগারোটার দিকে হক ভাইয়ের ফোন। বললেন, আজ বিকেলে তোমরা চলে আসো।

বিকেলে আমি ও স্বর্ণা হক ভাইয়ের কেবিনে পৌঁছে যাই। মুখে মাস্ক লাগিয়ে হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত জীবাণুমুক্ত করে হক ভাইয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ধবধবে সাদা বিছানায় চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছেন। তাঁরও মুখে মাস্ক লাগানো। হাতের ইশারায় কাছে ডাকলেন। হাড্ডিসার একজন মানুষ শুয়ে আছেন। মনে হলো শরীরের ওজন কমে অর্ধেক হয়ে গেছে। কুশল বিনিময় এবং টুকটাক কিছু কথা হলো। বললেন, ‘হ্যামলেট’ প্রকাশ করে ফেলো। কাভার করতে দাও। নাটক মঞ্চায়ন হতে দেরি আছে। আমি বই আকারে দেখতে চাই। এরমধ্যে ভাবিকে বললেন, তোমার ক্যামেরা দিয়ে একটা ছবি তোলো।

যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ‘হ্যামলেট’ প্রকাশ করব বলে বিদায় নিয়ে চলে এলাম। আসার আগে বললেন, একদিন নাসেরকে আসতে বোলো।

কথাপ্রসঙ্গে হক ভাই জানালেন লন্ডনে বসে ‘নদী কারও নয়’ উপন্যাস প্রায় শেষ করে ফেলেছেন।

সৈয়দ হককে নিয়ে অন্যদিন ঈদুল আজহা সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। দশ কপি অন্যদিন নিয়ে হাসপাতালে হক ভাইকে দেখতে গেলাম। তিনি পত্রিকাটি হাতে নিয়ে পাতা উল্টে দেখলেন। খুব খুশি হলেন তিনি। ভাবিকে বললেন, দেখো কী করেছে ওরা! এর দু-একদিন পর ভাবি ফোন করে বললেন, আরও কয়েকটা ‘অন্যদিন’ নিয়ে এসো। তোমাদের হক ভাই যে-ই আসছে তাকে একটা করে ‘অন্যদিন’ দিয়ে দিচ্ছে। এখন একটা কপিও নাই। সঙ্গে সঙ্গে আরও কয়েকটি কপি হাসপাতালে পাঠিয়ে দিলাম।

ঈদের কয়েকদিন পর হক ভাই বললেন, তোমাদের অন্যমেলা থেকে আমাকে তিন রঙের তিনটা পাঞ্জাবি বানিয়ে দেবে। একটা সাদা, একটা কালো এবং একটা লাল। হাসপাতাল থেকে বাসায় গেলে অনেকেই আমাকে দেখতে আসবে। তখন একেকদিন একেক কালারের পাঞ্জাবি পরে তাদের সামনে যাব। হাতার উপরের দিকে অনেকগুলো কুচি দেবে যেন সেগুলো ফুলে থাকে। ‘হ্যামলেট’ নাটকে ক্লডিয়াসের রাজপোশাকের মতো। আমি বললাম, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি বানিয়ে দেব।

হক ভাইকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে পড়ে গেলাম বিপদে। ঈদের ছুটিতে ফ্যাক্টরি বন্ধ। এরমধ্যে একদিন আমাকে ও শায়ককে ডেকে হক ভাই বললেন, কবিতার বই হবে তিনটা। একটা করবে শায়ক, একটা অন্যপ্রকাশ এবং আরেকটা করবে প্রথমা। আমরা দুজনই বললাম, আপনি যেটা ভালো মনে করেন সেটাই হবে।

২৫ সেপ্টেম্ব^র পাঞ্জাবি তিনটা নিয়ে গেলাম। ডিজাইন এবং রং দুটোই তিনি পছন্দ করলেন। পরদিন সকালে শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে আইসিউই-তে নিয়ে যাওয়া হলো হক ভাইকে। তারপরের ঘটনা আমাদের সবার জানা। ২৭ সেপ্টেম্বর বিকেল ৪টায় বাংলা ভাষার শক্তিমান এই লেখক চলে গেলেন না-ফেরার দেশে। ২৮ সেপ্টেম্বর শহীদ মিনারে সর্বস্তরের মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হলেন হক ভাই। বিকেল ৩টায় শেষযাত্রায় আমিও ছিলাম তাঁর সঙ্গে। হেলিকপ্টারে দুই সারিতে বসে আছি আমরা। আমার পাশে বসেছেন আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানক। অন্যদিকে আসাদুজ্জামান নূর, আনোয়ারা সৈয়দ হক, সস্ত্রীক দ্বিতীয় সৈয়দ হক এবং তাদের পুত্র, কবি তারিক সুজাত, মিমি ভাবি, কবি পিয়াস মজিদসহ আরও কয়েকজন। কারও মুখে কোনো কথা নেই। চোখের ভাষাও যেন হারিয়ে গেছে। কফিনের ওপর রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধাঞ্জলি রাখা। বারবার সেদিকে দৃষ্টি চলে যাচ্ছে। ওপর থেকে কুড়িগ্রাম কলেজের মাঠ দেখা যাচ্ছে। এ মাঠের একপ্রান্তে লাখো মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন আমাদের প্রিয় হক ভাই। জলেশ্বরীর সৈয়দ হক। বাংলাদেশের, বাংলা ভাষার সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক। ঘড়িতে তখন বিকেল ৪টা ২৮ মিনিট।

২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০, তার চতুর্থ প্রয়াণবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় স্মরণ করছি তাকে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর