শিরোনাম
শুক্রবার, ২ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

বঙ্কিমচন্দ্রের দীর্ঘশ্বাস

সাইফুর রহমান

বঙ্কিমচন্দ্রের দীর্ঘশ্বাস

ছাই মোড়ানো আকাশটি মুখ কালো করে আছে সকাল থেকে। এক পসলা বৃষ্টি হয়ে গেছে বোধকরি খানিক আগে। পাথরের চাঙর বসানো কচ্ছপের পিঠের মতো সড়কটির পাথরের খাজে খাজে জল জমে আছে। সেই জলের ওপর পড়েছে ঈষৎ কৃষ্ণবর্ণ আকাশের প্রতিবিম্ব। মনে হচ্ছে যেন ঊর্ধ্বে ও মর্ত্যে দুটো আকাশ। সেসব দেখতে দেখতে হঠাৎ নবীনচন্দ্রের দৃষ্টি পড়ল পার্শ্ববর্তী বাংলোটিতে। বাংলোর বারান্দায় দীর্ঘাকৃতি, গৌরবর্ণ ও তেজোদ্দীপ্ত একজন পুরুষ অনাবৃত দেহে বসে বই পড়ছেন। কলকাতা কোর্টের হাকিম ফিল্ড সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষ করে নবীনচন্দ্র ফিরে যাচ্ছিলেন। ল্যান্ডোতে উঠতে উঠতে কোচওয়ানকে তিনি কৌতূহলী দৃষ্টিতে জিজ্ঞেস করলেন-এ লোকটি কে? কোচওয়ান ব্যাটা তরমুজের বিচিসদৃশ একপাটি দাঁত দেখিয়ে বলল-উনি সঞ্জীব বাবু, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট বঙ্কিমচন্দ্রের মেজ ভাই। নবীনচন্দ্র ভ্রু কুচকে বললেন, এনিই তাহলে সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়? গাড়োয়ান বলল, জি হুজুর। দাঁড়াও দাঁড়াও। আমি গাড়িতেই অপেক্ষা করছি তুমি বরং আমার এ ভিজিটিং কার্ডখানা সঞ্জীব বাবুর হাতে গিয়ে দাও। কার্ডখানা হাতে পাওয়া মাত্র সঞ্জীবচন্দ্র হৈ হৈ করে নেমে এলেন বারান্দা থেকে। চিরপরিচিতের মতো জড়িয়ে ধরলেন নবীনচন্দ্রকে। তিনি বললেন, আমি ঠিক দেখছি তো! এইকি সেই চাঁটগার বিখ্যাত কবি ও ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট নবীনচন্দ্র সেন। নবীনচন্দ্র স্মিত হেসে বললেন, আমাকে আর লজ্জা দেবেন না। আপনি তো একখানা ভ্রমণকাহিনী লিখেই এ বঙ্গদেশ একেবারে মাতিয়ে দিয়েছেন। চারদিকে তো এখন ‘পালামৌ’ বইখানির ব্যাপক জয়জয়কার। অন্যদিকে আপনার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার কথা আর নাই বা বললাম। তিনি তো এখন বাংলা সাহিত্যে সম্রাটের মুকুট পরে বসে আছেন।

সঞ্জীবচন্দ্র বললেন, ভালো কথা মনে করেছেন, দাদা আপনাকে দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছেন। আমার উচিত আপনাকে এক্ষুণি কয়েদ করে নিয়ে যাওয়া। নবীনবাবু বললেন, আমি আপনার দাদার চেয়েও বেশি উন্মুখ হয়ে আছি তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য। আমাকে কয়েদ করে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আচ্ছা আজ তো শনিবার আমি কালই আসছি আপনাদের বাড়িতে। আপনাদের বাড়ি তো এখন সেই নৈহাটিতেই নাকি? জি, আমরা সবাই এখন ওখানেই আছি। ও ভালো কথা, সঙ্গে আমার এক উকিল বন্ধুও থাকছে কিন্তু, নাম অক্ষয়চন্দ্র সরকার অসুবিধা নেই তো। সঞ্জীবচন্দ্র বললেন, কোনো অসুবিধে নেই। আপনি নির্দ্বিধায় তাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসতে পারেন।

পরদিন বিকালবেলা অক্ষয়চন্দ্র সরকারকে নিয়ে নবীনচন্দ্র ছুটলেন নৈহাটির উদ্দেশ্যে। রেলস্টেশন থেকে নেমে গঙ্গা নদী পার হয়ে তবেই নৈহাটি কাঁঠালবাগান, বঙ্কিমচন্দ্রের ভিটা। স্টেশন থেকে গঙ্গা অবধি বেশ কিছুদূর পায়ে হাঁটা পথ। খানিক আগে ভারি বৃষ্টিপাত হওয়ায় রাস্তাখানা কর্দমাক্ত। শুধু কর্দমাক্ত বললে ভুল হয়। বন্ধুরও বটে। চারদিকে উঁচু-নিচু ও মাটির বড় বড় ঢিবি, সেই সঙ্গে প্রচুর চোরাকাটার গাছ। নবীনবাবু অক্ষয়চন্দ্রকে উদ্দেশ্য করে বললেন, দেখে পথ চলবেন দাদা। পা পিছলে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে কিন্তু। অক্ষয়চন্দ্র বললেন, ও আপনি ভাববেন না। বরং আপনি সামলে চলুন।

বঙ্কিমবাবুর সদর ফটকে নবীনচন্দ্র ও অক্ষয়বাবুরা যখন পৌঁছলেন তখন সন্ধ্যা প্রায় সমাগত। সঞ্জীববাবু সাদরে অভ্যর্থনা জানিয়ে তাদের ফরাস বিছানায় বসালেন। অবিলম্বে বঙ্কিমবাবুকে খবর পাঠানো হলো অন্দর মহলে। নবীনচন্দ্র সঞ্জীববাবুর সঙ্গে কথোপকথনে যখন ব্যস্ত ঠিক এমন সময় পেছন দিক থেকে কেউ একজন নবীনচন্দ্রকে জড়িয়ে ধরে বললেন-বলুন তো আমি কে?

নবীনচন্দ্র ঈষৎ হেসে বললেন, আপনি নিঃসন্দেহে বাংলার সাহিত্যসম্রাট, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বঙ্কিমচন্দ্র কপট বিস্মিত কণ্ঠে বললেন, আপনি আমায় চিনলেন কী করে? নবীনচন্দ্র সহাস্যে বললেন, শিকারি বিড়ালের গোঁফ দেখলেই চেনা যায়। বঙ্কিমচন্দ্র বললেন, আমার গোঁফের ওপরই তাহলে আপনার চোখ পড়েছে দেখছি?

নবীনচন্দ্র বঙ্কিমবাবুর লেখালেখির প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠলেন। সঙ্গে সবাই যোগ দিলেন সেই প্রশংসায়। বঙ্কিমচন্দ্র বললেন, আজ আর আমার লেখালেখি কিংবা আমার প্রশংসা শুনতে চাই না। আজ আমার সব দোষ-ত্রুটি শুনব তোমাদের মুখ থেকে। আমাকে যদি তোমরা সত্যি সত্যি ভালোবাসো তবে আমার ও আমার সাহিত্যকীর্তির দোষ-ত্রুটিগুলো শোনাও আমায়। ধর আজ আমি তোমাদের কাঠগড়ায়। আমার ভুল ভ্রান্তিগুলো তোমাদের মুখ থেকে শুনতে চাই আজ।

ঘরের ভিতর উপস্থিত সবাই একটু ইতঃস্তত বোধ করতে লাগলেন। বঙ্কিমবাবু এক্ষুণে একি খেলায় সবাইকে আহ্বান করছেন! বঙ্কিমবাবু বললেন, আরে তোমরা তো বিষয়টাই বুঝতে চাইছ না। কলকাতা কিংবা ধর এই বঙ্গের মানুষ আমাকে নিয়ে যা ভাবে কিংবা আমার বিরুদ্ধে যেসব কথা বলে আমি সেসবই তোমাদের মুখ থেকে শুনতে চাইছি। নবীনচন্দ্র চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললেন। অভয় দিচ্ছেন বলেই বলছি।

বঙ্কিম সহাস্য কণ্ঠে বলে উঠলেন-আরে আজ তো তোমাদেরই দিন। মন খুলে জিজ্ঞেস কর। যা জানতে চাইবে সব উত্তর পাবে আজ। লোকজন বলাবলি করে, সমসাময়িক কোনো লেখক সাহিত্যিকের সঙ্গেই নাকি সৎভাব নেই আপনার। সে হোক আপনার অগ্রজ কিংবা অনুজ। দীনবন্ধু মিত্র আপনার অকৃত্রিম বন্ধু সে ঠিক আছে কিন্তু আড়ালে আবডালে তাকে নিয়েও নাকি আপনি কটুকাটব্য করেন। বঙ্কিমচন্দ্র শুকনো মুখবদনে বললেন, তোমার একথা সত্যি নয় নবীন। নবীনচন্দ্র চোখ কপালে তুলে বললেন, কী বলছেন! সত্যি নয়? আচ্ছা আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো আপনার পুত্রবয়সী লেখক। তাঁর সঙ্গেও আপনার দ্বন্দ্বে জড়াতে হবে কেন? আপনাদের বাগযুদ্ধ দেখে তো সেসময় কলকাতার বিদ্বৎসমাজ বিস্মিত ও হতবাক! রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন তেইশ আর আপনার ছেচল্লিশ। অনেকেই আপনাকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করত নিভৃতে, বলত বঙ্কিমের কি মাথায় গন্ডগোল হলো নাকি? নিজের ছেলের বয়সী একজন লেখকের সঙ্গে এমন দ্বন্দ্বে নেমেছে। বঙ্কিম উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন, ঐ ছোকরাটাই তো পত্রিকায় আমাকে গালমন্দ করে প্রবন্ধ লিখেছে। আমি যেখানে নিজের গলার মালা খুলে ওর গলায় পরিয়ে ওকে কবি হিসেবে বরণ করে নিয়েছি অথচ সে কিনা আমার বিরুদ্ধে তির্যক মন্তব্য করে। নবীনচন্দ্র বললেন, দাদা আমার মনে হয় আপনার একটু ভুল হচ্ছে। আপনিই রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে আগে কটাক্ষপাত করেছেন।

বঙ্কিমচন্দ্র রাগে কাঁধ ঝাঁকিয়ে চেয়ার ছেড়ে ওঠে বেশ ঝাঁজাল কণ্ঠে বললেন, তুমি তো কিছুই জান না নবীন। আমার লেখা গান ‘বন্দে মাতরম’ ভারতে তখন জনপ্রিয়তার শীর্ষে, আলোচনা চলছে বন্দে মাতরমই হয়তো হবে ভারতের জাতীয় সংগীত কিন্তু রবীন্দ্রনাথ নেহরুকে চিঠি লিখে বারণ করলেন কিছুতেই যেন ‘বন্দে মাতরম’ গানখানি জাতীয় সংগীত না করা হয়। গানটিতে নাকি মুসলমানদের প্রবল আপত্তি। এ জন্যই তো নেহরু বন্দে মাতরম গানটিকে বাদ দিয়ে রবীন্দ্রনাথের ‘জনমন অধিনায়ক’ গানটিই ভারতের জাতীয় সংগীত করলেন।

নবীনচন্দ্র চিবুক দুটো ডান হাতের আঙুল দিয়ে ঘষতে ঘষতে বললেন, আপনি তো বিদ্যাসাগর সম্পর্কেও বাজে মন্তব্য করেছেন।

বঙ্কিম স্ববিস্ময়ে বললেন, আমি বিদ্যাসাগরের বিরুদ্ধে লেগেছি কে বলল তোমায়? নবীনচন্দ্র বললেন, কেন, বিষবৃক্ষ উপন্যাসে আপনি তাঁর বিরুদ্ধে লেখেন নি? উপন্যাসের ১১তম পরিচ্ছেদে সেই যে সূর্যমুখীর পত্রে লেখা হলো-‘ঈশ্বর বিদ্যাসাগর নামে কলিকাতায় কে নাকি বড় এক পন্ডিত আছেন! তিনি আবার একখানি বিধবা বিবাহের বহি বাহির করিয়াছেন। যে বিধবা বিবাহের ব্যবস্থা দেয়, সে যদি পন্ডিত হয় তবে মূর্খ কে?’ বঙ্কিমচন্দ্র মুখে বঙ্কিম হাসি হেসে বললেন, ও তাহলে তুমি পড়েছ উপন্যাসখানা।

নবীনচন্দ্র বললেন, আমি কেন অনেকেই পড়েছে। বিদ্যাসাগর মশাই কিন্তু বেশ কষ্ট পেয়েছেন আপনার এ কর্মকান্ডে। আমার সঙ্গে বিদ্যাসাগরের সম্পর্ক অত্যন্ত নিগূঢ়। উনার বাড়িতে আমার নিয়মিত যাতায়াত। উনিই একদিন আমাকে বললেন, দেখেছ নবীন আমার সম্পর্কে কী লিখেছে বঙ্কিম। আমি উনাকে জিজ্ঞেস করলাম, এর হেতু কি দাদা। বিদ্যাসাগর তখন আফসোস করে বললেন, প্রথমে আমিও বুঝতে পারিনি আমাকে ছোট করে বঙ্কিমের কি ফায়দা হাসিল হলো। তবে বেশ পরে জেনেছি এর কারণ। রহস্যভেদ হওয়ার পর মনে হয়েছে এত ছোট মনের মানুষও থাকতে পারে এ দুনিয়ায়? হায় ভগবান! আমি তখন বিদ্যাসাগরকে উদ্দেশ্য করে বললাম, খুলে বলুন না দাদা, এত হেয়ালি করছেন কেন? বিদ্যাসাগর আবেগতাড়িত কণ্ঠে বললেন, কী আর বলবরে ভাই, ১৮৫৮ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিএ পরীক্ষা দিয়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। মোট দশজন ছাত্রের মধ্যে কেবল দুজন ছাত্রই দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। এ দুজন ছিলেন যদুনাথ বসু ও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। এঁরা দুজনেই ছয়টি বিষয়ের মধ্যে পাঁচটিতেই কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হলেন বটে কিন্তু ষষ্ঠ বিষয়ে ফেল করায় এঁদের দুজনকেই সাত নম্বর করে গ্রেস দিয়ে পাস করানো হলো। এরমধ্যে ওই যে ষষ্ঠ বিষয় অর্থাৎ সংস্কৃত, বাংলা ও ওড়িশা ভাষার পরীক্ষক ছিলাম আমি। আমি তখন সংস্কৃত কলেজের প্রিন্সিপাল পন্ডিত। তো হয়েছে কি জান; এ দুজনের খাতা দেখতে গিয়ে দেখলাম এঁরা দুজনেই সংস্কৃত ও বাংলা মোটামুটি ভালো জানলেও ওড়িশা ভাষাতে বেশ দুর্বল। এ কারণে দুজনের কেউই ওড়িশা সাবজেক্টে পাস করতে পারল না। সাত নম্বর কম পেল। আমি তো তখন দুজনের কাউকেই চিনতাম না। আমার অপরাধটা কোথায় বলতে পার নবীন।

নবীনচন্দ্রের মুখে এসব শুনে কিছু সময় চুপ করে রইলেন বঙ্কিমচন্দ্র। তারপর চুকচুক করে অস্ফুট কণ্ঠে বললেন, আর যাই হোক, ফেল করার মতো ছাত্র নই আমি। বিদ্যাসাগর আমাকে ইচ্ছা করে ফেল করিয়েছে। নবীনচন্দ্র বিস্ময়াভিভূত কণ্ঠে বললেন, তাহলে উনি যদুনাথ বসুকেও ফেল করালেন কেন? আপনাকে ফেল করিয়েই তো উনার মনস্কামনা পূর্ণ হতো। বঙ্কিমের কণ্ঠ নিরুত্তর।

নবীনচন্দ্র বঙ্কিমচন্দ্রকে বললেন, আমার আরেকটি বিষয় জানার খুব ইচ্ছে। আপনি আপনার কিছুু উপন্যাসে মুসলমানদের বেশ হেয় করেছেন, কেন? বঙ্কিমচন্দ্র অবাক দৃষ্টিতে বললেন, কোনো উপন্যাসে তাদের হেয় করা হলো? নবীনচন্দ্র বললেন, প্রচ্ছন্নভাবে বেশ কিছু উপন্যাসেই, তবে মুসলমান সমাজকে সবচেয়ে বেশি আঘাত করা হয়েছে ‘আনন্দমঠ ও রাজসিংহ’ উপন্যাস দুটোতে। রাজসিংহ উপন্যাসের এক জায়গায় আপনি লিখেছেন-‘একখন্ড  রুটির ভিখারী ঔরঙ্গজেব শেষে বেত্রাহত কুকুরের মত বদনে লাঙ্গুল নিহিত করিয়া রাজসিংহের সম্মুখ হইতে পলায়ন করে। সম্রাট ঔরঙ্গজেব নির্মল কুমারীর মতো একজন অতি সাধারণ হিন্দু যুবতীর প্রণয়াকাক্সক্ষী। জেবউন্নিসার মত বিদুষী বাদশাজাদী স্বেচ্ছাচারিণী তো বটেই, এমন কি তার কামপ্রবণতা এতদূর বিস্তৃত যে, তা পিসির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতাতে পর্যন্ত পৌঁছায়।’

তাছাড়া আনন্দমঠের প্রথম সংস্করণে আপনি ইংরেজদের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করলেও উপন্যাসটির দ্বিতীয় সংস্করণে শত্রু হিসেবে আপনি চিহ্নিত করলেন মুসলমানদের। ‘ইংরেজ’, ‘গোরা’, ‘ব্রিটিশ’, শব্দগুলো আচানক পরিবর্তিত হয়ে ‘মুসলমান’, নেড়ে’, ‘যবন’, প্রভৃতি হয়ে গেল? সেটা খুবই বিস্ময়কর। প্রথম সংস্করণের দ্বিতীয় খন্ডের একাদশ পরিচ্ছেদের ১৫১ পৃষ্ঠায় আপনি লিখেছেন-‘ভবানন্দ বলিল, ভাই ইংরেজ ভাঙ্গিতেছে,... ফিরিয়া আসিয়া ইংরেজদিগকে আক্রমণ করিতে ধাবমান হইল। আকস্মাৎ তাহারা ইংরেজের উপর পড়িল। ইংরেজ যুদ্ধের আর অবকাশ পাইল না।’ ঠিক এই অংশটি দ্বিতীয় সংস্করণে পরিবর্তিত হয়ে লেখা হলো- ‘ভাই নেড়ে ভাঙ্গিতেছে... ফিরিয়া আসিয়া যবনদিগকে আক্রমণ করিতে ধাবমান হইল। আকস্মাৎ তাহারা যবনের উপর পড়িল। যবন যুদ্ধের আর অবকাশ পাইল না।’  

বঙ্কিমচন্দ্র ভ্রু কুচকে বললেন, তুমি শুধু তোমার চোখে যা কিছু দৃষ্টিকটু সেটাই দেখলে। কিন্তু ‘আনন্দমঠে’ পরোক্ষভাবে মুসলমানদের প্রশংসাও আছে, সেটা কীভাবে তোমার চোখ এড়িয়ে গেল? নবীনচন্দ্র অবাক দৃষ্টিতে বললেন-যেমন? বঙ্কিমচন্দ্র বললেন, প্রথম খন্ডের অষ্টম পরিচ্ছেদে আমি লিখেছি-‘সেই সময়ে ইংরেজের কৃত আধুনিক রাস্তা সকল ছিল না। নগরসকল হইতে কলিকাতায় আসিতে হইলে মুসলমান-সম্রাট-নির্মিত অপূর্ব রাস্তা দিয়া আসিতে হইত।’

নবীন তুমি কি জান, আনন্দমঠের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হওয়ার পর সাম্প্রদায়িকতার ধ্বনি তুলে কতিপয় মুসলমান বইটি প্রকাশ্যে দাহ করেছিল। ইহুদিদের প্রতি নিন্দে-মন্দ আছে বলে শেকসপিয়রের ‘মার্চেন্ট অব ভেনিস’ তো অগ্নিদগ্ধ হয়নি। কিন্তু আমার উপন্যাস কেন প্রকাশ্যে পোড়ানো হলো? আনন্দমঠ যে শিল্পকর্ম হিসেবে স্বার্থক সে কথা আমি কখনোই বলিনি। ‘আংকল টম্স কেবিন’ প্রথম শ্রেণির উপন্যাস না হয়েও সমাজের জন্য যে অসামান্য উপকার করেছে তা তো কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। ‘আনন্দমঠও’ উপন্যাস হিসেবে যত অকিঞ্চিৎকরই হোক না কেন স্বাধীনতা আন্দোলনে তার দান অতুলনীয়। তোমরা যদি আনন্দমঠকে সে দৃষ্টিতে বিচার কর তবেই দেখতে পাবে এর সার্থকতা। ঐ যে তুমি বললে-আমি ইংরেজদের খুশি করতে আনন্দমঠের কিছু অংশ পরিবর্তন করেছি, তোমার সে ধারণা ভুল। আমি স্বেচ্ছায় অবসরে যাই ১ নভেম্বর ১৮৯১ সালে। ছোটলাট এলিয়ট যখন জানলেন আমার বয়স তখন মাত্র তিপান্ন, তিনি আমাকে আরও কিছুকাল চাকরি করার জন্য বারংবার অনুরোধ করলেন। কিন্তু চাকরির প্রতি আমার কোনো মোহ ছিল না। আমি স্বেচ্ছায় অবসরে চলে গেলাম।

নবীনচন্দ্র এবার মুখ খুললেন-আচ্ছা দাদা আমি সবই বুঝলাম কিন্তু আপনার একটা লেখা আছে-‘কাক, কুকুর এবং মুসলমান’ শিরোনামে। সেখানে আপনি লিখেছেন- ‘ঢাকাতে দুই চারিদিন বাস করিলেই তিনটি বস্তু দর্শকদের নয়নপথের পথিক হইবে-কাক, কুকুর এবং মুসলমান। এ তিন সমভাবে কলহপ্রিয়, অতি দুর্দম, অজেয়। ক্রিয়াবাড়িতে (অর্থাৎ বেশ্যালয়ে) কাক এবং কুকুর, আদালতে মুসলমান। এ তিনটি সমভাবে কলহপ্রিয়।’ এমন ধরনের লেখা কোনো সুস্থ লেখক কি লিখতে পারে? আপনিই বলুন। এরপরও কি বলবেন-আপনি মুসলমান-বিদ্বেষী নন।

বঙ্কিমচন্দ্র বললেন, তুমি পূর্ববঙ্গের মানুষ এ জন্য তোমার মুসলমানদের প্রতি এত দরদ। নবীনচন্দ্র বললেন, এটা কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর হলো না দাদা। আমি আপনার কাছে সুনির্দিষ্ট উত্তর আশা করেছিলাম। বঙ্কিমচন্দ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন-চলো চলো, দেরি হয়ে যাচ্ছে, তোমার বৌদি রাতের খাবার নিয়ে অপেক্ষা করছেন।

সর্বশেষ খবর