যদি আগে থেকেই জানা থাকত যে একজন আমেরিকান সাহিত্যিক নোবেল পুরস্কার পাবেন তা হলেও পশ্চিমের কোনো প্রভাবশালী গণকাব্যিক বলত না যে টুয়েন্টি টুয়েন্টির নোবেল পেতে যাচ্ছেন লুইস গ্রিক। যদি এটাও জানা থাকত যে, একজন আমেরিকান নারী সাহিত্যের নোবেল পুরস্কারটি পাচ্ছেন তাহলেও সবার আগে লুইস গ্রিকের নাম উচ্চারিত হতো না- গণমাধ্যম বলত ৮২ বছর বয়সী জয়েস ক্যারল ওটসের কথা। তারপর বলত এলিন ওয়াকার কিংবা ক্যারিলিন রবিনসনের কথা।
পুরুষ লেখকদের শীর্ষস্থানের ফিলিপ রথ প্রয়াত হয়ে তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন। তারপরও করম্যান জ্যাককার্থি এবং ডন ডে লিলোর নাম তো গত ১০ বছর ধরেই উচ্চারিত হয়ে আসছে। এমনকি স্টিফেন কিং কেন পুরস্কার পাবেন না সে প্রশ্নও আলোচিত হয়েছে।
একাধিক কেলেঙ্কারির পর সুইডিশ একাডেমির ইমেজ পুনরুদ্ধার জরুরি ছিল। তারা মৃদুস্বরের গীতিকার লুইস গ্রিককে বেছে নিয়েছেন। তিনিই সবচেয়ে যোগ্য কিনা এ বিতর্ক এড়িয়ে বরং এটা বলা যেতে পারে তাকে পুরস্কৃত করে সুইডিশ একাডেমি নতুন কোনো পথে পা ডুবানোর আশঙ্কা থেকে বেঁচে গেছে।লুই গ্রিক অবশ্য আমাদের অভিবাদন পেতে পারেন। তাকে সম্মান জানাতে তার সম্পর্কে কিছু কথা এবং তার কয়েকটি কবিতার অনুবাদ উপস্থাপন করা হলো।
লুইস এলিজাবেথ গ্রিক
লুইস এলিজাবেথ গ্রিক ২২ এপ্রিল ১৯৪৩ সালে নিউইয়র্ক সিটিতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতৃপুরুষ হাঙ্গেরিয়ান ইহুদি। তার দাদা অভিবাসী হয়ে নিউইয়র্কে এসে মুদির দোকান খোলেন। বাবা ড্যানিয়েল গ্রিক যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম নেওয়া প্রথম সন্তান। বাবা সাহিত্যে মন ছিল কিন্তু টিকে থাকার জন্য সাহিত্যনির্ভর হওয়ার মতো ক্ষমতা ছিল না। তিনি ছোটমাপের রম্য কবিতা লিখতেন। এক সময় তাদের ব্যবসায় জড়িয়ে পড়তে হয়। তার স্ত্রী বিয়াট্রিসের ভাইয়ের সঙ্গে ১৯৩০ এক্স অ্যাক্টো নাইফ আবিষ্কার করেন। ব্যবহারিক হাতিয়ার হিসেবে এই ছুরি ঘরে ঘরে ব্যবহৃত হয়। শুরুতে এই হাতিয়ারটি চিকিৎসা বিজ্ঞানের স্কালপেন হাতিয়ার হিসেবে তৈরি করা হয়েছিল- কিন্তু তা প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় কাটাকাটির এই যন্ত্রটিকে সাধারণ ব্যবহার্য হাতিয়ার হিসেবে বাজারজাত করা হয় এবং তা ভালো ব্যবসা পেয়ে যায়। লুইস গ্রিকের বাহুল্য ও জেদ মর্জিত কবিতা নিয়ে রসিক সমালোচক বলে যাবেন এগুলো এক্স অ্যাক্টো নাকি কবিতা। ছুরির টানে অপ্রয়োজনীয় সব কাটা পড়ে গেছে। লুইসের অকাল প্রয়াত একটি বড় বোন ছিল। তার জন্মের আগেই মৃত, কিন্তু এই মৃত্যু শৈশবেই লুইসকে ভাবিয়ে তোলে তাহলে জন্মের কী দরকার।
তার মা বিয়াট্রিসে বিখ্যাত ওয়েলসলি কলেজের গ্র্যাজুয়েট। মূলোৎপাটিত ইহুদিরা নিউইয়র্কে সফল ব্যবসায়ী হয়ে ওঠে এবং এক সময় শহরের বাণিজ্যিক নিয়ন্ত্রণও তাদের হাতে চলে যায়। লুইসের শৈশবেই অ্যানোরেপ্রিয়া নার্ভোমা (খাদ্যে অরুচি) দেখা দেয় এবং তা দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতার কারণ হয়ে ওঠে। লুইসের এক আত্মীয় এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন- একটি হচ্ছে মায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং স্বাধীনতার চেষ্টা এবং অন্যটি হচ্ছে বড় বোনের মৃত্যু যার সঙ্গে তার কখনো দেখাই হয়নি। দীর্ঘদিন তার মনো দৈহিক চিকিৎসা চলে এবং একপর্যায়ে তাকে পড়াশোনা থেকে প্রত্যাহার করিয়ে পুনর্বাসন কেন্দ্রে রাখতে হয়। এক সময় তার মনে হয়েছে তিনি মারা যাবেন, কিন্তু আরও তীব্রভাবে তিনি অনুধাবন করেছেন ‘আমি মরতে চাই না।’
মরতে না চাওয়ার তীব্র ইচ্ছা তাকে ফিরিয়ে আনে এবং ১৯৬১ সালে নিউইয়র্কের জর্জ হিউলেট স্কুল থেকে স্কুল গ্র্যাজুয়েট হন। শৈশবে পড়তে শেখার আগেই বাবা গ্রিক উপকথা পড়ে শোনাতেন। কল্পলোকের সেই রাজ্যটি তার কাছে এতটাই আপন হয়ে উঠেছিল যে, দ্রুত পড়তে শিখে গ্রিক পুরাণের চরিত্রগুলোকে রপ্ত করেছেন এবং মর্ত্যরে মানুষের জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে কোনো কোনো চরিত্রকে তাদের চেতনায় প্রতিস্থাপনও করতে শুরু করেন। তিনি লিখতে শুরু করেন তার শৈশবের অন্যতম নায়িকা জোয়ান অন আর্ক।
তাকে সাত বছর থেরাপির অনুশাসনে থাকতে হয়েছে। তিনি বুঝতে পারেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিয়মানুবর্তিতা ও আনুষ্ঠানিকতার কড়াকড়ি তিনি সহ্য করতে পারবেন না। সারাহ লরেন্স কলেজে কবিতার কোর্সে ভর্তি হলেন। ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত চারদিকে যত কবিতার ওয়ার্কশপ হয়েছে তিনি কোনোটাতেই নিজেকে অনুপস্থিত থাকতে দেননি। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব জেনারেল এডুকেশন শিক্ষার্থীদের জন্য ডিগ্রি কোর্স পরিচালনা করতেন। তিনি ভর্তি হলেন সাগ্রহে লিওনি অ্যাডামস এবং কবি স্ট্যানলি কুনিৎজ-এর ক্লাস করতেন। কবি হিসেবে তার বেড়ে ওঠার পেছনে এ দুজনের অবদানের কথা তিনি একাধিকার উল্লেখ করেছেন।
কিন্তু কোনো ডিগ্রি অর্জন ছাড়াই তিনি কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে এলেন। সাহিত্যিক কাজ তার নিজের ভরণপোষণের বন্দোবস্ত করলেন। ১৯৬৭-এ চার্লস হার্জ জুনিয়রকে বিয়ে করলেন। ভিন্ন রুচির দুজন মানুষের বিয়ে টিকে থাকার নয় এবং শিগগিরই তা তালাকে গড়াল। ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত হলো তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ফার্স্টবোর্ন। তারপর ভুগতে থাকলেন লিখতে না পারার ব্যাধি রাইটার্স ব্লক-এ।
কাব্যগ্রন্থ কিছুটা পরিচিতি এনে দিল। তিনি এক সময় ধরে নিয়েছিলেন শিক্ষকতা তার সৃজনশীলতার অন্তরায় হবে। কিন্তু নতুন করে ভাবলেন- ভালোভাবে টিকে থাকতে হবে। এবার ভারমল্টের গেভার্ড কলেজে শিক্ষকতার চাকরি নিলেন। কেবল কবিতা পড়াবেন। এটা তার জন্য এক জাদুকরী প্রত্যাবর্তন। কবিতা পড়াতে গিয়ে তার রাইটার্স ব্লক কেটে গেল- তিনি লিখতে শুরু করে তার স্বতন্ত্র স্বর আবিষ্কার করলেন। যখন তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ হাউস অব মার্শল্যান্ড বের হলো- সমালোচকরা কবিতার স্বতন্ত্র স্বর হিসেবে তাকে স্বাগত জানালেন। তারপর লুইস গ্রিকের কেবল এগিয়ে যাওয়া। শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেলেন, কবিতার বিচারক হলেন। একের পর এক আমেরিকার শ্রেষ্ঠ সাহিত্য পুরস্কারগুলো পেলেন। কেউ তাকে এমিলি ডিভিশন, কেউ তাকে সিলভিয়া নামে ডাকতে শুরু করেন। তিনি তার লিরিকধর্মী কবিতা নিয়ে বরাবরই সন্তুষ্ট ছিলেন। ১৯৯৩ সালে ‘দ্য ওয়ার্ল্ড আইরিস’ কাব্যগ্রন্থ তাকে এনে দেয় পুলিৎজার। ২০০৩-০৪ বর্ষে তিনি ছিলেন পোয়েট লরিয়েট। নোবেল সাহিত্য পুরস্কারের চেয়ে বড় কিছু এই মর্ত্যমান সে বিরল সম্মানও তিনি পেলেন।
একটি কল্পকথা
দুজন নারী
একই দাবি নিয়ে
জ্ঞানী রাজার
চরণে পড়ল।
দুজন নারী কিন্তু একটি শিশু মাত্র
রাজা জানেন
কেউ একজন মিথ্যে বলছে।
তিনি বললেন
শিশুকে কেটে দুই টুকরো কর
তাদের কেউই
খালি হাতে যাবে না।
তিনি টেনে তার তরবারি
বের করতেই একজন নারী
তার দাবি প্রত্যাখ্যান
করে নিল।
এটাই চিহ্ন, এটাই শিক্ষা।
ধর
তুমি গেছ তোমার মাকে নিয়ে
দুই মেয়ের টানাহেঁচড়া
তাকে বাঁচাতে তুমি
কী করতে পার কিংবা
নিজেই শেষ করে দিতে পার
তাকে- সে জানবে তার
সঠিক অধিকারী সন্তান
মায়ের খন্ডিত হওয়া
সহ্য করতে পারবে না।
সাইরেন
(সাইরেন গ্রিক পুরাণের দেবী যে তার মিষ্টি সুরে বেপথু করে কাছে এসে অনিবার্য ধ্বংসের দিতে ঠেলে দিত।)
আমি যখন প্রেমে পড়লাম
অপরাধী হয়ে গেলাম
তার আগে আমি ছিলাম ওয়েস্ট্রেস
আমি তোমার সাথে শিকাগো যেতে চাইনি
আমি তোমাকে বিয়ে করতে চেয়েছি
আমি চেয়েছি তোমার স্ত্রীর ভোগান্তি হোক।
আমি চেয়েছি সেই নারীর জীবন হোক নাটকের মতো
যে নাটকের প্রত্যেকটি অধ্যায়ই দুঃখের।
কোনো ভালোমানুষ কি এভাবে চিন্তা করে?
আমি আমার সাহসের জন্য
প্রশংসা পেতে পারি
তোমার সামনের বারান্দায় আমি অন্ধকারে বসি।
সব কিছুই আমার কাছে স্বচ্ছ :
যদি তোমার স্ত্রী তোমাকে যেতে না দেয়
তা প্রমাণ করে যে সে তোমাকে ভালোবাসে না।
সে যদি তোমাকে ভালোবাসত
সে কি তোমাকে সুখী দেখতে চাইত না?
আমি এখন ভাবি
যদি আমি কম অনুভব করতাম
আমি আরও ভালো মানুষ হতাম।
আমি ছিলাম একজন ভালো ওয়েস্ট্রেস
আমি এক সাথে আটজনের ডিঙ্ক
বহন করতে পারতাম।
আমি তোমাকে আমার স্বপ্নের কথা বলতাম।
কাল রাতে আমি একজন নারীকে অন্ধকারে
একটি বাসে বসে থাকতে দেখেছি।
সে তার স্বপ্নের ভেতর ফুঁপিয়ে কাঁদছিল
যে বাসে সে ছিল তা চলতে শুরু করে
একহাত নেড়ে সে বিদায় জানাচ্ছে
অন্য হাত টোকা দেয় ডিমের কার্টনে
বাচ্চায় পরিপূর্ণ।
স্বপ্ন সেই কুমারীকে রক্ষা করে না।
কানা গলি
আমি বললাম, শুনুন দেবদূত, আমাকে এখান থেকে
মাইছাড়া করুন।
আমি বললাম, আমাকে এই জঘন্য একঘেয়ে ডায়েট থেকে
তালাক দিন।
শস্যদানার খাবারের অপব্যবহার ভদকা ও টমেটো জুস
অপব্যবহার থেকে মুক্তি দিন
আপনার পরিকল্পিত প্রেমপত্র টুকিটাকির মধ্যে
এসব থেকে ছাড়িয়ে নিন।
আমার থেমে যাওয়াটা ছিল প্রত্যাঘাত
আমি তার রক্তশূন্যতার সেবা করেছি
বাসন কোসন ধোয়ামোছা করেছি
পুরো বিষময় চারটি মাস- প্রমিত সহবাস।
কিন্তু প্রিয় আমার, প্রিয় আমার আমি এমন স্বপ্নে
তোমার হাত তোমার চুল দেখি
এটা সেই কানাগলির স্বচ্ছতা- আমি মিস করি
দাবার মতো, রক্তের বিরুদ্ধে মন।
কবিতা
সন্ধ্যার শুরুটাতো এখন একজন পুরুষ তার
লেখার টেবিলের উপর মাথা নুইয়ে ছিলেন
আস্তে আস্তে মাথা তোলেন, একজন নারী
গোলাপ হাতে হাজির হন।
আয়নার পৃষ্ঠদেশে তার মুখমন্ডল ভেসে উঠে
গোলাপ বৃন্তের সবুজ পদ্মবৃত্ত তাকে আরো
চিহ্নিত করে।
এটি ভোগান্তির
একটি ধরন তারপর সব সময় স্বচ্ছ পাতা জানালায়
তুলে ধরা হয়, যতক্ষণ না
শিরা উপশিরা ভেসে উঠে যেমন কথা
শেষ পর্যন্ত কালিতে পূর্ণ হয়
আমাকে বুঝতে বাধ্য করা হবে
কী তাদের একত্রে বোধ রাখে
অথবা সন্ধ্যার মধ্যে কোন ধূসর বাড়ি তাদের
ধরে রাখে এক সাথে।
কারণ আমাকে তাদের জীবনে ঢুকতে হবে
এখন বসন্তকাল, নাশপাতি গাছ
দুধল সাদা পুষ্প প্রস্ফুটনের ছবি তুলছে।