শুক্রবার, ৮ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

একা একজন

মাসউদ আহমাদ

একা একজন

ভোর থেকেই মসলা বাটার শব্দ ও রান্নার আয়োজন চলছে। দুপুর গড়ালেই লোকজন খেতে বসে যাবে। পৌষের শীতের ছোটদিনের বেলা, তাই হাতে সময় কম। আত্মীয় ও অতিথি মিলে দুই শ মানুষকে দাওয়াত করা হয়েছে, তবু লোক কিছু বেশিও হতে পারে। কে কখন কী কাজ করবে, সবার দায়িত্ব বণ্টন করে দেওয়া হয়েছে। তবুও নূরজাহানের বড় ছেলে আক্কেল আলির তাড়াহুড়োর শেষ নেই। এই বুঝি দেরি হয়ে যায়।

আক্কেল আলিরা তিনভাই ও তিনবোন। সবাই বিবাহিত এবং নিজেদের সংসার নিয়ে ব্যস্ত। গ্রামের বাড়িতে কেউ থাকে না। আক্কেল নিজে আর তার আরেক ভাই শহরে থাকে। শহরে ওদের নিজের বাড়ি এবং চাকরি ও ব্যবসা আছে। এক বোনের বিয়ে হয়েছে রসুলপুর গ্রামে, আরেকজনের পাশের উপজেলায়; সবার ছোট মরিয়মের শ্বশুরবাড়ি ভিন জেলায়। একভাই, যে পড়াশোনা তেমন করেনি, বুদ্ধিতেও খাটো, সে গ্রামে থাকে। কৃষিকাজ করে সংসার চালায়। বুদ্ধিতে কম হলেও ছেলেমেয়ে পাঁচটি। কোনোভাবে দিন আনে দিন খায়।

একসময় ঈদ ও বিশেষ কোনো উপলক্ষে সব ভাইবোন বছরে অন্তত কয়েকবার গ্রামের বাড়িতে মিলিত হতো। এখন ঈদেও কেউ আসে না। প্রত্যেকর সংসারে যেমন ব্যস্ততা আছে, গ্রামের সঙ্গে সম্পর্ক ও প্রয়োজনও ধীরে ধীরে ফুরিয়ে এসেছে। শেষ কবে গ্রামের বাড়িতে এসেছে, ভাইবোনের দুই-একজন ছাড়া কেউ মনেও করতে পারে না।

মাসকয়েক বিছানায় পড়ে থাকার পর, গত মাসে নূরজাহান মারা গেছে। মায়ের শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠান উপলক্ষে ভাইবোন ও আত্মীস্বজন একসঙ্গে হয়েছে। মাসের পর মাস খেয়ে না খেয়ে, বিছানায় সেবাশুশ্রƒষাহীন প্রায় একা পড়েছিল নূরজাহান। বোনদের কেউ কেউ মাঝে মাঝে সকালে এসেছে, তবে বিকালে আবার ফিরেও গেছে। তাদের সংসার আছে, মায়ের কাছে থাকার অবসর নেই। মরিয়মের শ্বশুরবাড়ি সবচেয়ে দূরে, তবুও অন্যদের তুলনায় সে-ই বারকয়েক এসে থেকেছে মায়ের কাছে। ভাইদের কেউ দুই-একবার ফোনে খোঁজ নিয়েছে। ওইটুকুই। গ্রামের পথে ফিরেও তাকায়নি।

মায়ের মৃত্যু উপলক্ষে অনুষ্ঠান। গত দুদিন ধরে বাড়িতে উৎসবের আমেজ পড়েছে। সবাই ব্যস্তসমস্ত। এখানে মাংস কাটা চলছে, ওখানে আদা-রসুন-মসলা বাটার কাজ চলছে তো আরেক জায়গায় বড় বড় মাছ ও তরকারি কোটা হচ্ছে। যারা গরুর মাংস খায় না, তাদের জন্য আলাদা করে মুরগি রান্না হবে।

বাড়িময় নূরজাহানের ছেলেমেয়ে ও নাতিপুতিতে ভরে গেছে। তাদের চিৎকার, হাসি আর ছোটাছুটি। মেয়েদের এ ওকে ডাকছে, মায়েরা ছেলেমেয়েকে বকছে। কেউ আলগা বসে গল্পগুজব করছে; অনেকদিন ধরে জমে থাকা গল্পের ঝাঁপি খুলে ধরেছে।

কুয়োতলা থেকে বড় বড় পিতল ও সিলভারের গামলা ও হাঁড়ি মাজা-ধোয়ার শব্দ ভেসে আসছে। বাড়িসুদ্ধ সবাই শশব্যস্ত। কারও হাতে একদন্ড সময় নেই। ভাইয়ের ছেলেরা ছোটাছুটি করে খেলছে, কিন্তু বোনেরা যেন একটু সংকুচিত; ভাইদের বউ ও ছেলেমেয়ের গায়ে ঝকঝকে পোশাক ও গা-ভর্তি গহনা। কী করতে কোন ভুলটা হয়ে যায় ভেবে তারা কুণ্ঠিত। নিজেদের ছেলেমেয়েকে তাই চোখে চোখে রাখছে। সুযোগ মতো সাবধান করে দিচ্ছে। বলা তো যায় না, কখন কে কী বলে বসে। গরিব হলে নানা রকম দোষ আর অসংগতি থাকে মানুষের, আত্মীয় হলেও সেসব এড়ানো যায় না।

কিন্তু বাড়িতে এমন আয়োজন দেখলে যে মানুষটি সবচেয়ে বেশি খুশি হতো, আনন্দচিত্তে আহলাদ করত, সেই নূরজাহানই কেবল বাড়িতে নেই। জগতে কোথাও তার চিহ্নটুকুও নেই। বয়সের যে গন্ডি পার হয়ে গেলে মানুষের শরীরের আকৃতির পরিবর্তন হয় এবং চেহারাও চেনার উপায় থাকে না, নূরজাহান ঠিক সেই বয়সে পৌঁছেছিল, তা নয়। তার আগেই সে জীবন থেকে বিদায় নিয়েছে। জীবনের শেষের কদিন নূরজাহানের কষ্টের সীমা ছিল না। বড় একটা বাড়িতে সে একরকম একাই পড়ে থাকত। গ্রামে যে ছেলেটা থাকে, সে-ই এরকম মাকে দেখতো, কিন্তু তারও মনে হতো-‘মা তো আমার একার নয়। সবারই মাকে নিয়ে কিছু দায়িত্ব আছে।’ তাই সে সুবিধা মতো মাকে সহযোগিতা করলেও দায় ঘাড়ে নেওয়ার ভয়ে তেমন আগ্রহ করত না। মেয়েরা পরের সংসারে থাকে, পরাধীন। বিয়ের পর হয়তো সেটাই বিধিলিপি মেয়েদের। তবু মাঝে মাঝে মাঝে তারা এসে খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করলেও শহুরে ভাইয়েরা মায়ের কোনো সন্ধান নিত না। মা খেল, কি মরল-কেউ ফিরেও দেখত না। অথচ ভাইদের অবস্থা ভালো। শুধু মায়ের জন্য তাদের আলাদা করে সময় ও অবসর নেই। হয়ত এতটুকু মায়াও নয়।

ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট মরিয়ম। সে ছোটবেলা থেকেই চুপচাপ ও ঠান্ডা মেজাজের। কারও সাতে বা পাঁচে কখনো থাকে না। মায়ের প্রতি টানটা হয়তো তারই বেশি ছিল। মায়াটা নিশ্চয়ই প্রগাঢ়, তবে নীরব ধরনের। সে সময় ও অবসর পেলেই মায়ের কাছে ছুটে আসত। যতটুকু সম্ভব মায়ের সেবা করত। মা কী খেতে চায়, জিজ্ঞেস করে নিয়ে তার ব্যবস্থা করতে তৎপর হতো। সবসময় যে মায়ের ইচ্ছে পূরণ করতে পারত, এমন নয়। তবু সে আন্তরিকভাবে চেষ্টা করত।

এমনিতেই সে চুপচাপ স্বভাবের মেয়ে। মা মারা যাওয়ার পরে সে যেন আরও নীরব হয়ে গেছে। বাড়িতে সবাই কোনো না কোনো কাজে ও ব্যস্ততায় যুক্ত, সে বেশ খানিকটা দূরে বসে আছে, একা। সবাইকে সে দেখছে, আবার দেখছেও না।

বাড়িতে এত মানুষ ও আয়োজন, একঝাঁক ছেলেমেয়ে আর তাদের হুল্লোড়। সবাইকে সে আড়চোখে মাপছে ও দেখছে। কিন্তু কেউ তাকে খেয়াল করছে না। উৎসবের আমেজের এ হাওয়ায় কাউকে কারও খেয়াল করার কথাও নয়। কেবল সে সবাইকে লক্ষ্য করছে। একা নিরালায় বসে বসে সে ভাবছে, সবই বুড়ি নূরজাহানের রক্ত থেকে তো এসেছে। বুড়ির নিজের এতগুলো ছেলেমেয়ে, নাতিপুতি এবং শাখা-প্রশাখা। এদের কেউ কেউ বুড়িকে দেখেছে, কাছে বসেছে, বুড়ির কোলে উঠেছে, একসঙ্গে একপাতে বসে খেয়েছে। কোনো রাতে নূরজাহানের বুকের সঙ্গে লেপ্টে থেকে ঘুমিয়েছে। আবার এদের কেউ কেউ বুড়িকে হয়তো কোনোদিনই দেখেনি। তবুও এটাই সত্য, সবাই বুড়ির রক্ত থেকে উৎসারিত হয়েছে। এরা সবাই বুড়ির বংশধর।

এতগুলো কচিকাঁচা নাতি-নাতনি ও দামড়া ছেলেমেয়ে থাকতে বুড়ি নূরজাহানের শেষজীবনটা বড় দুঃখে কেটে গেল। খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেলে যেমন থালাটা আলগোছে মানুষ সরিয়ে দেয়, কলার খোসাটা ফেলে দেয় আর প্রয়োজন হয় না; মাকেও তেমন করে অবহেলায় সবাই সরিয়ে রেখেছিল। একা একা পড়েছিল মা, কেউ ফিরেও দেখেনি।

আজ মাকে নিয়ে, মায়ের বাড়িতেই এত খাওয়ার আয়োজন, অথচ সেই আয়োজনে বুড়ি মাটা নেই। মা কি আড়ালে বসে কাঁদছে? কাউকে ডেকে বকা দিচ্ছে? আশীর্বাদ ও অভিশাপ দিচ্ছে? কেউ জানতেও চাইল না।

এসব কথা ভাবতে গিয়ে মরিয়মের বুক ভেঙে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। চোখ ফেটে জল আসে। চোখের জল লুকাতে সে বাড়ির পেছনে বাঁশঝাড়ের ওদিকে চলে যায়।

মা অনেকদিন বিছানায় পড়েছিল। গ্রামের বোকা ভাইটা শহুরে ভাইদের ফোন করে বোঝাতে চেষ্টা করেছে। মাকে ভালো ডাক্তার দেখানো হলে সেরেও উঠতে পারে। তার নিজেরই সংসার চলে না। ভাইয়েরা এসে কিছু একটা ব্যবস্থা করুক। না, কোনো লাভ হয়নি। উল্টো তাকে শুনতে হয়েছে, তুমি এত কাছে থাক, একটু দেখে রাখ। আর বাড়িতে সামান্য জমিজিরেত তো আছে। শাকসবজি ও ফলমূল ইত্যাদির চাষ করলেও তো ঢের চলে। কিছু পয়সাও আসে।

কিন্তু বিষয়সম্পত্তি বলতে বাড়ির ভিটেটুকু আর বাড়ির পেছনের পাগার। এর বেশি কিছু তো নয়। পতিত জমিতে কী আর এমন চাষ হয়। বোকা ভাইটা কিছু বুঝতে পারেনি, কিছু করতেও তার বুদ্ধি খোলেনি।

গ্রামে আসার সময় শহুরে ভাইদের তিনটে করে ছেলেমেয়ে, স্ত্রী এবং সঙ্গে চাকর-ঝি সবাই এসেছে। সবাই হাত লাগিয়ে খাটছে। এত মানুষ খেতে আসবে, রান্নাটা ভালো হওয়া চাই। নিজেরা সরাসরি কাজে হাত না লাগালেও চাকর-ঝি এবং পাড়া থেকে ডেকে আনা পাঁচ-ছজন মহিলা ও পুরুষ রান্নার কাজে নিয়োজিত। তাদের তারা ফরমায়েশ করছে।

একটা গাড়ি এসে হর্ন বাজাতে থাকে। গাড়ি থামতেই আক্কেল আলি উঠে যায়। ওই তো এসে গেছে, বলে সে হাসিমুখে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ায়। ডেকোরেশন থেকে প্লাস্টিকের চেয়ার-টেবিল, প্যান্ডেলের ঘেরার জন্য বড় কাপড় আর খাবার জন্য প্লেট ও দরকারি সব হাঁড়িপাতিল এসে গেছে।

কাজের লোক আশপাশেই ঘুরছিল। আক্কেল আলি হাঁক ছাড়ল-এই সিরাজ, কোথায় গেলি? গাড়ি থেকে মালগুলো নামা।

যন্ত্রের গতিতে সিরাজ ও মন্টু ছুটে আসে। গাড়ি থেকে জিনিসপত্র নামাতে হাত লাগায়। একটু পরেই ওরা খাবার টেবিলগুলো সুন্দর করে সাজিয়ে দেবে। লোকজন এসে আরাম করে খেতে বসবে। 

মেজ বৌটা ঝিয়ের সঙ্গে কী নিয়ে যেন গল্প করছিল। গল্প করছিল আর হাসছিল। এমন সময় ছোট ছেলেটা মায়ের কাছে এসে ঘ্যানঘ্যান করতে লাগল। মা, বাসায় ফিরবে কখন?

কেন বাবা, কী হলো?

এমন বাড়িতে কি ঘুমানো যায়? এত মশা। রাতে ভালো করে ঘুমুতে পারিনি।

এই তো দুদিন আছি আমরা। আহারে বাছা, ঘুম হয়নি? বলেই ছেলেকে মা কোলে টেনে নেয়। বলে, আজ রাতে মশার কয়েল জ্বালিয়ে দেব। তাহলে আর কামড়াবে না। আরাম করে ঘুমুতে পারবে। একটু কষ্ট কর, বাবা। দুটো তো দিন মাত্র।

নূরজাহানের ছেলের বউয়েরও ভাবখানা এমন, সত্যিই তো, এখানে কি থাকা যায়? কী আর করা, দুটো দিন সহ্য করা যাক। শাশুড়ি না মরলে এখানে আসা লাগত নাকি? আর শাশুড়ি মরেছেই যখন, তার শ্রাদ্ধে ভালো করে না খাওয়ালে লোকেই বা কী বলবে? তাই তো গ্রামে আসা।

অথচ নূরজাহান বুড়িটা না খেতে পেয়ে, শীতে ভালো কাপড় আর একটু সেবাশুশ্রƒষার অভাবে নীরবে মরে গেল। কেউ ফিরেও দেখেনি।

মানুষজনের খাওয়া শেষ হতে হতে বিকাল গড়িয়ে গেল। খাবারের আয়োজনটা বেশ হয়েছে। খেয়ে ওঠে পরিতৃপ্ত চোখমুখে ঢেকুর তুলে ফিরে যাচ্ছেন আমন্ত্রিত অতিথি এবং কাছের ও দূরের আত্মীয়রা। সেই দৃশ্য দেখে বাড়ির লোকেরাও খুশি। যাক, মায়ের শ্রাদ্ধের আয়োজনটা মন্দ হলো না।

আজকের রাতটা সবাই এখানে থাকবে। যাদের বাড়ি কাছে এবং সংসারে কাজ আছে, তারা সন্ধ্যা নামার আগেই বাড়িতে ফিরে যাবে। কিন্তু দূরের অতিথিরা কে কোথায় ঘুমুবে, তা নিয়ে পরিকল্পনা করছে। কেউ ভাবছে, গ্রামে তো আসা হয় না; এমন রাত আর কবে পাব কি পাব না-রাতটা গল্পগুজব করে তাশ খেলে দিব্যি কাটিয়ে দেওয়া যায়।

মাকে নিয়ে শ্রাদ্ধের আয়োজন শেষ হলে পরদিন সকালে নূরজাহানের ছেলেমেয়ে ও নাতিপুতিরা যে যার ঠিকানায় ফিরে যায়। বহুদিন তারা আর আসে না। খোঁজও রাখে না বাড়িটার। সে-রকম প্রয়োজনও কেউ বোধ করে না। ভুল করে কোনোদিন তারা ফিরতেও পারে। হয়তো নয়। সে সম্বন্ধে স্পষ্ট করে কিছু বলা যায় না।

বাড়ির পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় পথচারী ও প্রতিবেশীরা মনে মনে বলে, এ বাড়িতে একসময় প্রাণের স্পন্দন ছিল। মানুষ ও ছোট ছেলেমেয়েদের কী যে কলরব ছিল; কিন্তু এখন জনশূন্য। বাড়িটাকে পাহারা দেওয়ার জন্যও কেউ রইল না।

বাড়িটা বেশ বড়সড় এবং বেশ কখানা ঘর। কিন্তু ঘরে এখন আর কেউ থাকে না। মানুষজন নেই বলে সারা দুপুর, এমনকি সন্ধ্যা নামলেই এক গভীর নির্জনতা আর বিষণœতা ঝুলে থাকে বাড়িটিকে ঘিরে। কিছুদিন আগেও এ বাড়িতে এক নিঃসঙ্গ বৃদ্ধা থাকত, একা। সে ভালো করে খেতে পেত না, তার ঘুম হতো না, সুখে ও অসুখে আড়ালে বসে সে চোখের জল ফেলত। কেউ দেখেনি, কেউ দেখলও না।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর