শিরোনাম
শুক্রবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

কষ্টিপুকুর

বাবলু ভঞ্জ চৌধুরী

কষ্টিপুকুর

বৃষ্টিভেজা সন্ধেটা যেন শীতের পিঠা, নরম-ঠান্ডা। আমাদের গ্রামটা যেন সেই পিঠার বাটি, আর তার মধ্যে আমি পিঁপড়ের মতো গন্ধ শুঁকে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছি।

রাস্তায় আর কেউ নেই। বামপাশে মোল্লাদের ভিজে বাগান, ডানপাশে বাঁশতলার পুকুর, রাস্তার বাঁক ঘুরে শেখদের পরিত্যক্ত ভিটের আজবা ওলক্ষেতের কোল ঘেঁষে মোল্লাদের বাঁশঝাড়ের তল দিয়ে আতপ আলীর জমকালো বেড়া টপকে ঢুকে পড়লাম বিশাল বাগানে। এই বাগানের মাঝখানে ঘাস পুকুর। কোনকালে অকারণে শান বাঁধানো ঘাট করেছিল কেউ, কোনো দিন কাজে লাগেনি। কেউ এখানে আসে না। শান ভেঙে গেছে, ভাঙার খাঁজে ঘাস জন্মিয়েছে। ওই পকুরপাড়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছে জোনাকি।

জোনাকির সঙ্গে আমার দুই মাসের পরিচয়। পরিচয় বললে ভুল হবে, বলতে হবে প্রেম। ২৫-২৬ বছর বয়স হবে ওর। পাকা জামের মতো টসটসে শ্যামলা শরীর। সেজেগুজে থাকলে বোঝাই যায় না সাত বাড়ি কাজ করে বেড়ায় ও। স্বামী আছে, বাচ্চাও আছে দুটো। সংসারের বারোআনা ভার ওকেই বইতে হয়, আর ষোলআনা গালাগালি ওকেই সইতে হয়। স্বামী সন্দেহ করে।

কিছু দূর যেতেই একটা গাছের আড়াল থেকে বেরুল ও, ছায়ার মধ্যে এক দলা ছায়া হয়ে, একটা উত্তেজনার পিন্ড  হয়ে। আমি ওকে জড়িয়ে ধরব বলে দুহাত বাড়িয়েছি, ও চট করে সরে গেল।

‘আগে কী এনেছ দেখাও!’

আমি জামার ভিতর থেকে শাড়ির প্যাকেটটা বের করে ধরলাম। জোনাকি খপ করে বুকের কাছে নিয়ে হাসল।

‘শাড়ি! কী রং গো?’

‘মেটে, ভালো মানাবে তোকে!’

জোনাকির মুখ থেকে ঢুপ করে হাসিটা মিলিয়ে গেল।

‘কিন্তু আমার যে টাকা চাই, শাড়িতে আমার কোনো কাজ নেই।’

পকেট থেকে দুটো পাঁচ শ টাকার নোট বের করলাম সঙ্গে সঙ্গে।

‘এই নে!’

জোনাকি ঝুঁকে এসে দেখল, পাঁচ শ টাকার নোট বুঝতে পেরেই খপ করে নিয়ে আগের মতো হেসে উঠল।

আমি ঠোঁটে আঙ্গুল চেপে শব্দ করতে নিষেধ করলাম, ‘জোরে কথা বলিস নে!’

‘কেন গো বাবু! এখানে কেউ আসবে না।’

‘কী করে জানলি?’

‘কে মরতে আসবে এই ঝুম বাগানে?’

‘তোর স্বামী?’

‘য়ু..., ’ জোনাকি চট করে চারপাশটা দেখে নিল, ‘তার কী জো আছে গো! ঠ্যাঙ ভেঙে বসে আছে রিকশা থেকে পড়ে!’ শব্দ হওয়ার ভয়ে জোরে হাসতে পারল না জোনাকি।

‘তোমায় একটা খুশির খবর দিই বাবু!’

‘বল শুনি!’

‘পুকুরের ওই মাথায় একটা কুঁড়েঘর দেখেছি, চারপাশ ঝোপ-জঙ্গলে আটা, হাবভাব দেখে মনে হলো কেউ থাকে না, আমি সেখানে কলারপাতা বিছিয়ে রেখেছি, চলো...’

জোনাকি খিলখিলিয়ে হেসে আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। অন্ধকারে আগান-বাগান মাড়িয়ে চলছি। ওর বেশ পথঘাট মুখস্থ। মনে হচ্ছে এই বাগানে ওর নিত্য আসা-যাওয়া। জানি, আমাকে খুশি করার জন্য এমন করছে ও। কাপড় আর টাকা পেয়ে ওর হৃদয়টা কৃতজ্ঞতায় ভরে গেছে। এ সময় কোনো বিপদের চিন্তা মনে আসে না সহজে। কুঁড়েঘর রয়েছে, মানুষ নিশ্চয়ই আছে। হয়তো এটুকু চিন্তা করার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছে আমাকে খুশি করার চিন্তায়। পুকুরধারের উঁচু তালগাছটার কাছে আসতেই আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম।

‘দাঁড়া জোনাকি! ওখানে যদি মানুষ থাকে!’

‘থাকে থাকবে,’ ইয়ার্কির ছলেই বলল বুঝি, ‘বলবে আমি তোমার বউ! তোমার বাড়ি কাজ করি, তাই বলে কি তোমার বউ হতে পারি না?’ খিলখিল করে হাসল খানিকটা।

ওর এই কথাটার মধ্যে যতটা শাঁস আছে, ততটা রস পেলাম না। এ যেন জীবন-পয়সার ও পিঠ, উল্টালেই দেখতে পাব। কিন্তু উল্টিয়ে দেখার মতো মানসিক অবস্থা বা শক্তি কোনোটিই আমার নেই। বারো বছরের সংসার রয়েছে আমার। তাই খানিকটা হকচকিয়ে ওর মুখের দিকে চেয়ে রইলাম নিষ্পলক। আকাশের গা থেকে অন্ধকারটা ধীরে ধীরে নিচের দিকে হালকা হয়ে আসছে। বোধহয় চাঁদ উঠছে। ছায়ায় ডুবে থাকা ওর মুখখানিতে একটু আগের হাসির ঝিলিক এখনো লেগে আছে।

‘ভয় পেয়ো না গো বাবু! এমনি এমনি বললাম, ওই কুঁড়েঘর আমি তোমার জন্যই বানিয়েছি। আজ দুদিন ধরে বানিয়েছি, এখানে কেউ আসবে না।’

আমার জন্য ঘর? বেশ বিস্মিত হলাম।

‘বাগানের মালিক জানে?’

‘জানলে কি আর বানাতে দিত? তার জানার উপায় নেই, সে তো এখানে থাকে না, আর ঘর তো তেমন নয়, কঞ্চি দিয়ে খুঁটি করা, ডাল-পাতার বেড়া আর পলিথিনের ছাউনি, ইচ্ছে করলে এক মিনিটে ভেঙে ফেলা যাবে, ওখানে একবার বীজ পুঁতেছিল কেউ, তাই মাটিটা বেশ সাইজমতো উঁচু, ওইটেই ভিট হয়েছে ঘরের...’ বলেই হেসে উঠল, ‘আমি এই বাগানে কাঠ কুড়োই, আমি সব জানি! চলো তো!’

বাগানে একটা ঘর উঠছে, আর মালিক জানবে না-এ কথা কি বিশ্বাস করা যায়? হয়তো জানে, কিন্তু কিছু বলবে না, হয়তো এই ঘরে মালিকও আসবে জোনাকির কাছে। এ ধরনের মেয়েরা তো এমনই হয়। কিন্তু আমায় ধরিয়ে দেবে না তো? না, ও তেমন মেয়েই নয়। কোনো কুটবুদ্ধি ওর মধ্যে থাকতে পারে না। বেশ সহজ-সরল দেখেছি ওকে। আর ঝক্কি বাধিয়ে আয়ের পথটা বন্ধ হবে, জোনাকি কি তা চাইবে?

আগান-বাগান লতাপাতা ঠেলে জোনাকি নিয়ে এলো সেই কুঁড়েঘরের কাছে। বেশ জায়গাটি, সমস্ত পৃথিবী যেন আড়ালে চলে গেছে এখানে। চারপাশে পাটবনের মতো ঘন লম্বা ঘাসবন, এর মধ্যে ছোট্ট একটা ঘর। গাছগাছালির মাথায় রুপালি আলো ছড়াতে শুরু করেছে উদীয়মান চাঁদ। মেঘ কেটে গেছে। আঁধার আর জোছনা মিলেমিশে চুপটি করে রয়েছে গাছপালার খাঁজে খাঁজে। পাশের হাঁ-হয়ে পড়ে থাকা পুকুরটা দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। তার গভীর কালো জল চোখ মেলছে। নিস্তব্ধ নির্জন চারধার।

জোনাকি ছুটে সেই খুপরির মধ্যে গিয়ে কেরোসিনের একটা ল্যাম্প জ্বালাল।

‘কিরে আলো জ্বালালি কেন?’

‘জ্বালাব না? আলো ছাড়া কি জমে? ভূত না মানুষ দেখতে হবে তো, তাছাড়া সাপ-খোক তো থাকতে পারে।’

ক্ষীণ আলো। বেশি দূর ছড়াচ্ছে না। ছোট্ট ওই আলোটুকুর জন্য অন্ধকার ঘরটিকে বেশ মায়াবী বলে মনে হচ্ছে। অল্প আলোয় এবার দেখলাম, ঘরটি কুঁড়েঘরও না, খেলা ঘর। খেলার জন্য বাচ্চারা যেমন কঞ্চি-টঞ্চি দিয়ে ঘর বানায় তেমন। দরজা নেই, দরজার জায়গায় পলিথিন ঝোলানো। কিন্তু এর মধ্যে জোনাকির যে পরিশ্রম ও যত্ন মিশে আছে, তাতে ওর প্রতি গভীর টান অনুভব করলাম। সেই টানে আমি একছুটে ঘরে গিয়ে কলার পাতায় বসে ওর একটা হাত ধরে টান দিয়েছি, ও জোরে হাতটি ছাড়িয়ে নিল।

‘অত তাড়া কেন বাবু? এত কষ্ট করে ঘর বানালাম, একটু গপ্পসপ্প করি, একটু সময় কাটাই!’

‘না জোনাকি, আমাকে তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে, সারা দিন বাড়ি যাইনি, আর তাছাড়া কেউ এসে যেতে পারে...’

জোনাকি আমার মুখের কথা কেড়ে বলল, ‘ঠিক আছে বাবু! অন্তত একটু পানমুখ করো! পানটা খেয়েনি,’ আঁচলের গেরো খুলে দুটো পানের খিলি বের করে একটা আমায় দিল, আর একটা ও নিজে মুখে পুরল, ‘এই পানটা খাওয়া পর্যন্ত একটু সময় নেব, এই সময়টুকুতে যতটুকু কথা বলা যায়, সেটুকুই বলব।’

‘কী আর বলবি? তোর সব কথা তো আমি জানি, তোর স্বামী সন্দেহ করে, তোকে বকাবকি করে...’

‘না বাবু, আজ আমার কথা বলব না, আজ তোমার কথা বলব।’

‘আমার আবার কী কথা? ধুর! ওসব পরে হবে,’ আমি জোনাকির হাত ধরতে গেলাম।

‘পান এখনো শেষ হয়নি বাবু, আর একটু দেরি করো!’ জোনাকি হেসে সরে গিয়ে বলল।

‘দিলি তো মুডটা নষ্ট করে! তবে তুই থাক! আমি চললাম!’ বিরক্ত হয়ে ঘর থেকে বের হচ্ছিলাম, জোনাকি ছুটে এসে পথ আটকালো, ‘পায়ে পড়ি বাবু একটু দাঁড়াও!’ আমি থমকে দাঁড়াতেই স্থির হয়ে জোনাকি বলল, ‘তোমার বউ একটা কথা বলে বাবু, আজ আমি সেটার প্রমাণ নিতে এসেছি।’

সাধারণত এমন কথায় যা হয়, আমারও নানান চিন্তা ঢুকে গেল মাথায়।

‘আমার বউয়ের আবার কী কথা?’

‘তার আগে একটি কথা বলি বাবু, এই যে পুকুরটা দেখছ, এটা কিন্তু সাধারণ পুকুর নয়।’

‘বউয়ের কথা রেখে পুকুরের কথায় যাচ্ছিস কেন? তুই তো ঘোরাচ্ছিস, আমার মতো মানুষের সঙ্গে তোর কি এমন করা উচিত হচ্ছে?’

‘না বাবু! তোমার বাড়ি এই গাঁয়ে হতে পারে, কিন্তু এই পুকুরের ঘটনা তুমি জানো না...’

‘আহ থামবি! ...’

‘ঠিক আছে বাবু, পুকুরের কথা বাদ দিলাম, তোমার বউ যে কথা আমার সঙ্গে বলেছে, তা কাউকে বলতে বারণ, তুমি যেন বউকে কিছু বোলো না!’

‘বলব না, তাড়াতাড়ি বলে শেষ কর!’

‘সে দশ বছর আগের কথা, তোমাদের তখন নতুন বিয়ে হয়েছে। তুমি ব্যবসা করতে। তোমার যে মহাজন, পাওনার জন্য সে বারবার তাগাদা দিত। একদিন সে টাকা চাইতে এলে, তুমি তাকে একটা প্রতিশ্রুতি দিয়ে অকারণে বলেছিলে, এবার টাকা না দিতে পারলে বউ দিয়ে দেবে, তোমার বউয়ের সামনে বলেছিলে এ কথা। লজ্জায় অপমানে তোমার বউ ছুটে ঘরের মধ্যে চলে গিয়েছিল, তার ঠিক দুমাস পরে সেই মহাজন আবার এলে তুমি টাকা দিয়েছিলে ঠিকই, কিন্তু সে তোমার সামনে হাসতে হাসতে তোমার বউয়ের হাত ধরলে তুমিও হেসেছিলে, কোনো প্রতিবাদ করনি। তোমার বউ কাঁদতে কাঁদতে ঘরের মধ্যে পালিয়েছিল। সেই থেকে...’ থেমে গেল জোনাকি।

‘সেই থেকে কী?’

‘সেই থেকে তোমার বউ তোমার কাছে গেলেই একটা কটু গন্ধ পায়, আর সেই গন্ধ আমিও পাই কিনা পরীক্ষা করতে এসেছি, তোমার বউ মিথ্যে বলেছে কিনা জানতে এসেছি।’

অঞ্জনা আজ দশ বছর আমার কাছে আসে না তা ঠিক। কাছে ডাকলেই সে নানা অজুহাতে এড়িয়ে যায়। কিন্তু সে কি সেই গন্ধের জন্য? কোনো দিন তো কিছু বলেনি আমায়। জোনাকিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুইও কি গন্ধ পাচ্ছিস?’

‘আগে তো কাছে গিয়ে নিই,’ একটু হাসল জোনাকি, ‘অতো ভেবো না তো বাবু, বউরা আজকাল কত কথা বলে, তুমি ওসব কিছু মনে করো না, আমার একটা আব্দার রাখবে বাবু?’

‘কী বল?’

‘আমার না জোছনা রাতে খুব হাঁটতে ইচ্ছে করে, আমরা গরিব, তাই বলে কি আমাদের রোমান্স থাকতে নেই?’

‘আবার রোমান্সও জানিস দেখছি!’

‘জানব না কেন? মেয়েরা এসব ভালো জানে! চলো না বাবু, কী সুন্দর জোছনা, পুকুরপাড়ের ওই তালগাছ পর্যন্ত একটু ঘুরে আসি!’

জোনাকির কথাবার্তায় আমি একটু এলোমেলো হয়ে গিয়েছিলাম। ওর মনেও কেমন একটা অপরিচ্ছন্ন ধারণা জন্মেছে বলে মনে হলো। জোছনায় যদি একটু ঘুরি, ওর আব্দারটা মিটবে, আবার আমার মনটাও ভালো হতে পারে। তাই আর আপত্তি করলাম না।

গাছপালার মাথা ছাড়িয়ে চাঁদটা ফাঁকা আকাশে চুপটি করে বসে আছে। পুকুর, বাগান, ছায়া-সব ছবির মতো স্থির। পুকুরের পাড় দিয়ে ছায়া মাড়িয়ে চলছি আমরা। জোনাকি কোনো কথা বলছে না, শুধু পুকুরের দিকে তাকিয়ে কী একটা দেখছে। তালগাছটার কাছে পৌঁছিয়েই কেমন স্থির হয়ে গেল ও। তারপর বলল, ‘চলো বাবু আর না,’ বলেই দ্রুত সেই কুঁড়েঘরের দিকে ফিরতে লাগল। এত দ্রুত যাচ্ছে ও, আমি প্রায় দৌড়িয়েও ওকে ধরতে পারছি না।

কুঁড়েঘরের কাছে পৌঁছিয়েই আমার দিকে ফিরে ও একপা-দুপা করে পিছতে পিছতে বলল, ‘আমিও এখন সেই কটুগন্ধ পাচ্ছি বাবু! তুমি বেঁচে নেই! তুমি মরে গেছ, অনেক আগে, দশ বছর আগে মরে গেছ তুমি!’ বলেই উল্টোদিক দিয়ে ছুটে পালিয়ে গেল।

জোনাকির এমন আচরণে আমি যারপরনাই বিস্মিত হলাম। কী ধুরন্ধর মেয়েছেলে বাবা! যাক! এর উত্তর পরে নেওয়া যাবে। অঞ্জনার জন্য এবার আমার মন খারাপ লাগছে। ওর সেদিনের অপমানটা এখন আমি বুঝতে পারছি। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে ক্ষমা চাইতে হবে। যে পথে এসেছিলাম, পুকুরপাড়ের সেই পথে ছোট ছোট কলাগাছের পাশ দিয়ে ফিরছি। পাশে শান্ত পুুকুরের দিকে আমার নজর গেল। এই পুকুর নিয়ে কী যেন বলতে চেয়েছিল জোনাকি। আর নজর যেতেই আমি থমকে গেলাম। পুকুরে সব কিছুর ছায়া পড়েছে, আমার ছায়া কই!

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর