শুক্রবার, ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

একজন সরদার ফজলুল করিম

মার্জিয়া লিপি

একজন সরদার ফজলুল করিম

এগারো বছরের জেলজীবন, ৫৮ দিনের অনশন, বিলেতে বৃত্তির আমন্ত্রণপত্র ছিঁড়ে ফেলা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়ে আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাওয়া-এ সব অভিজ্ঞতার কোনো কিছুই সরদার ফজলুল করিমের হিসাবে লোকসান নয়। তিনি মনে করতেন, তাঁর পুরো জীবনটাই লাভের। তিনি, আমাদের কালের অসাধারণ মানুষ, আলোর পথযাত্রী, এ যুগের সক্রেটিস। মানব মুক্তির দর্শনে আজীবন বিশ্বাসী বাঙালি জাতির বাতিঘর। তিনি ভালোবাসতেন নিজেকে কৃষকের সন্তান বলে পরিচয় দিতে। এই পরিচয়ে স্মরণ করতেন উৎসের কথা; জানিয়ে দিতেন, উত্তর জীবনে তাঁর সব পরিবর্তন, উত্তরণে, জীবনের নিশান সততায় প্রোথিত। নিম্নমধ্যবিত্ত কৃষকসন্তান হয়েছেন জাতীয় অধ্যাপক, জ্ঞানের শক্তিকে উপলব্ধি করেছেন নিজের মধ্যে; প্রভাবিত করতে চেয়েছেন সেই শক্তি অপরের মাঝে। তাঁর স্বপ্নে, তাঁর কর্মে, চিন্তার প্রবহমানতায় মহৎ জীবন সৃষ্টির সংগ্রামকে সমর্পিত করতে চেয়েছেন অনাগত প্রজন্মে, কালের পরিক্রমায় মানব সমাজে।

সরদার ফজলুল করিম ১৯২৫ সালের ১ মে বরিশালের আঁটিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা খবিরউদ্দিন সরদার। মা সফুরা বেগম। কৃষক পরিবারের চতুর্থ সন্তান-যিনি সর্বদাই নিঃসঙ্কোচে স্মরণ করতেন, বলতেন, ‘আমার দরিদ্র পিতা-মাতার দান করা জীবন নিয়ে এই পথটা হেঁটে এসেছি।’ তিনি কৃষক বাবার সঙ্গে স্কুলে পড়াশোনার পাশাপাশি কৃষিকাজে সহযোগিতা করতেন। ছোট থেকেই তিনি ছিলেন মা-বাবার অনুগত আর বাধ্য।

আঁটিপাড়া বোর্ড স্কুলে শিক্ষাজীবনের শুরু। কাঠকয়লা গুঁড়ো করে পানিতে মিশিয়ে তৈরি কালিতে বাঁশের কঞ্চির কলম ডুবিয়ে সিদ্ধ করা তালপাতার ওপর হাত ঘুরিয়ে বর্ণমালা অ, আ, ই, ঈ অক্ষর লিখতে শিখেছেন জাতীয় অধ্যাপক সরদার ফজলুল করিম । ১৯৩৮ সালে বরিশাল জেলা স্কুলে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হন। ওই সময় তিনি সংস্পর্শে আসেন সমগ্র ভারতের বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দলের সক্রিয় এক রাজনৈতিক কর্মী মোজাম্মেল হকের সঙ্গে। সহপাঠী মেধাবী সেই বন্ধুর কাছে রাজনীতির হাতেখড়ি। একরাতে গোপনে পাঠ করার হুকুম দিয়ে হাতে তুলে দেন ব্রিটিশ সরকারের ঘোষিত নিষিদ্ধ বই ‘পথের দাবী’। এ বই সর্বপ্রথম তাঁর চোখে স্বপ্ন জাগিয়েছিল। তিনি বরিশাল জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পেয়েছিলেন পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিষয়ে সর্বোচ্চ নম্বর ও জেলাভিত্তিক স্কলারশিপ। ঢাকায় ইন্টারমিডিয়েট কলেজে (বর্তমানে ঢাকা কলেজ) ভর্তি হন।

ঢাকায় আসার পর থেকে কলেজে ছাত্রদের মধ্যে যে কমিউনিস্ট গ্রুপ ছিল তারা তাঁকে দলে নেওয়ার চেষ্টা করে। তাঁর ভাষায় ‘ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময় আমি যতটা না কমিউনিস্ট, তাঁর চেয়ে বেশি জাতীয়তাবাদী ছিলাম।’ সে সময়ে তিনি বন্ধুদের সঙ্গে মিলে হাতে লেখা পত্রিকা প্রকাশ করতেন। হোস্টেলে ব্যক্তিগত লাইব্রেরি গড়ে তোলেন। রাত জেগে বিভিন্ন বই যেমন : পার্ল এস. বাক্-এর ‘গুড আর্থ’ পড়তেন-যা তাঁর রাজনৈতিক চেতনা ও চরিত্র গঠনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। ১৯৪২ সালে ঢাকা কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। ঢাকা বোর্ডের মেধা তালিকায় তিনি দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন। ১৯৪২ সালে কলেজ জীবন অতিবাহিত করে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে। অধ্যাপক হরিদাস ভট্টাচার্যের দরাজ বক্তৃতা শুনে তিনি দর্শনশাস্ত্র পড়ার বিষয়ে বিশেষ আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এ কারণে ইংরেজি বিভাগ ছেড়ে তিনি দর্শনশাস্ত্রে ভর্তি হন। বিভাগ পরিবর্তন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাক্রমে অনার্স ও এম এ উভয় পরীক্ষায় দর্শনে প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করেন।

১৯৪২ সাল। পৃথিবীজুড়ে শুরু হয় বিশ্বযুদ্ধ। সে সময় সরদার ফজলুল করিম ঢাকায় অবস্থানরত সৈন্য- আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট ক্যাডারদের সংস্পর্শে আসেন। সংস্পর্শে আসেন বিজ্ঞানী সত্যেন বোসের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছাড়াও ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ তাঁকে ভীষণভাবে আলোড়িত করে। নয়াবাজারের সিরাজউদ্দৌলা পার্কে ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষের সময় তিনি লঙ্গরখানায় স্বেচ্ছাসেবক ছিলেন। বিভিন্ন গ্রামেও ত্র্রাণ বিতরণের কাজ করেন। ১৩৫০ সালের দুর্ভিক্ষে কমিউনিস্ট কর্মীরা লঙ্গরখানা এবং দুর্ভিক্ষপীড়িতদের সহযোগিতায় বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়। ১৯৪৪ সালে প্রগতি লেখক সংঘের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে লেখালেখিতে সক্রিয় হন।

১৯৪৫ সালের শেষের দিকে তিনি কলকাতায় রওনা হন একটি স্কলারশিপের ইন্টারভিউর জন্য। কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিংয়ে ইন্টারভিউ দেওয়ার আগে সরদার ফজলুল করিম কমিউনিস্ট পার্টির হেড কোয়ার্টারে যান। সেখানে কমরেড মুজফ্ফর আহমদ ও নৃপেণ চক্রবর্তীকে বলেন, ‘আমি তো বিলেত যাচ্ছি।’ স্কলারশিপটা ছিল মুসলমান ছাত্র ও দর্শনশাস্ত্রের জন্য সংরক্ষিত। কথোপকথনের এক পর্যায়ে ইন্টারভিউ কার্ড ছিঁড়ে ফেলেন এবং কর্তব্য স্থির করেন দেশে থেকে দেশের জন্য কাজ করবেন।

১৯৪৬ সালে তিনি প্রভাষক পদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে যোগদান করেন। তিনি শিক্ষকতা শুরু করেন নিয়মতান্ত্রিকভাবে দরখাস্ত দিয়ে নয়। তৎকালীন বিভাগীয় প্রধান বিনয় রায়ের আদেশ, ‘ফজলুল করিম, কাল থেকে তুমি ক্লাস নিতে শুরু কর।’ ছাত্রদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল বন্ধুত্বসুলভ। ক্লাস নেওয়ার সময় ছাত্ররা তাকে শিক্ষক হিসেবে গণ্য করার চাইতে সহপাঠী হিসেবে বিবেচনা করত।

১৯৪৭ সালের শেষের দিকে দেশের সামাজিক-রাজনৈতিক সংকট বৃদ্ধি পেতে থাকে। ভারত ও পাকিস্তান বিভক্ত হয়। ধর্মের ভিত্তিতে সহস্র মাইলের ভৌগোলিক দূরত্বকে অতিক্রম করে বাংলাদেশ পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে একত্রীভূত হয়। আগে যা সম্প্রদায়ে সীমাবদ্ধ দাঙ্গা হিসেবে সংঘটিত হয়েছে, সে সময়ে তা ব্যাপক। ১৯৪৬-এর ১৬ আগস্টে ‘ক্যালকাটা কিলিংয়ের প্রতিক্রিয়ায় সংঘটিত হয় নোয়াখালীতে হত্যাকান্ড। সাধারণ মানুষের নিরাপত্তাহীনতা, অসহায় লাখ-লাখ নর-নারীর নিজ জন্মস্থান ত্যাগ করে শুরু করে উদ্বাস্তু জীবনযাপন।

এই অনিশ্চয়তার আঘাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও এসে লাগে। পূর্ব পাকিস্তানে বামপন্থি রাজনীতিকদের বিষয়ে তৎকালীন মুসলিম লীগ সরকারের কঠোর নজরদারি, বিধি-নিষেধ ও ধর-পাকড়াও শুরু হয়েছিল। সরকারের স্পেশাল ব্রাঞ্চ খোঁজ করছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম বামপন্থি ছাত্র-শিক্ষকদের। সরদার ফজলুল করিমের নাম সামনে চলে আসে। পার্টির আদেশে তাঁর চাকরিতে ইস্তফা দেওয়া ও আত্মগোপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তিনি পদত্যাগ শুধু বিশ্ববিদ্যালয়েই নয় সরকারি মহলেও আলোচিত ছিল।

সরদার ফজলুল করিম, মোহাম্মদ তোয়াহা ও তাজউদ্দীন আহমদের পাশে দাঁড়িয়ে ঐতিহাসিক ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চে সাধারণ ধর্মঘট ও  পিকেটিংয়ে অংশগ্রহণ করেন। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ছাত্ররা ধর্মঘট আহ্বান করে। ১১ মার্চের সন্ধ্যায় ফজলুল হক হলে মো. কামরুদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে সর্বদলীয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। তাজউদ্দীন আহমদের দিনলিপিতে উল্লেখ রয়েছে সে সভায় শামসুল হক, শামসুদ্দীন, সরদার ফজলুল করিম, মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, আজিজ আহমদ, নৈমুদ্দীন, অধ্যাপক কাশেম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

১৯৪৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছাড়ার পর সরদার ফজলুল করিম গ্রেফতার এড়ানোর জন্যে আত্মগোপন জীবন বেছে নেন। তিনি পার্টির কাছে আশ্রয় চাইলেন এবং এভাবেই প্রকাশ্যে জীবনযাপন না করে পার্টির পরামর্শে পুরোপুরি তাঁর আত্মগোপনের জীবনযাপন শুরু হয়। ১৯৪৯ সালে নানা ঘাত-প্রতিঘাতে প্রথমে কলকাতা ও  পরে কিছুকাল ঢাকার গ্রামাঞ্চলে, কৃষকদের সঙ্গে নরসিংদীর চালাকচর, পোড়াদিয়া, সাগরদি, হাতিরদিয়া অঞ্চলে আত্মগোপনে থাকেন।

চালাকচরে মুসলমানদের মধ্যে কখনো মজিদ নামে পরিচিত ছিলেন অথবা কখনোবা অশোক নামে কোনো হিন্দু বাড়িতে আশ্রিত হয়েছেন। ১৯৪৯ সালের শেষের দিকে সংবাদবাহকের মাধ্যমে কমিউনিস্ট পার্টি থেকে বার্তা আসে- ‘জেলা কমিটির মিটিংয়ে ঢাকায় আসতে হবে।’ ডিসেম্বর মাসে চালাকচর থেকে সরদার ফজলুল করিম ঢাকায় আসেন। ১৯৪৯ সালের ২৫ ডিসেম্বর দুপুরে সন্তোষ গুপ্তের বাড়িতে পুলিশ হানা দেয়। সেদিন ওই বাসায় গ্রেফতার হয় সন্তোষ গুপ্তের মা-মাসীমা, অজিত চ্যাটার্জি নামে একজন কৃষক নেতার স্ত্রী,  জ্ঞান চক্রবর্তী,  সরদার ফজলুল করিমসহ মনু মিয়া নামের দিনমজুর ও কমিউনিস্ট পার্টির কয়েকজন। সেদিন থেকেই কারাগারে শুরু হয়ে যায় তাঁর ডিটেনশন লাইফ। তাঁর প্রথমবারের জেলজীবনের মেয়াদ ছিল একটানা ছয় বছর। ১৯৪৯ সালে গ্রেফতার হয়ে জেল থেকে ছাড়া পান ১৯৫৫ সালে।

জেলখানার মানবেতর পরিবেশ উত্তরণের জন্য রাজনৈতিক বন্দীরা অনশন ধর্মঘটকে ব্যবহার করতে চেয়েছেন যথাসাধ্য। বন্দীদের নির্মমভাবে পিটিয়েছে জেলখানার কর্তৃপক্ষ, ধর্মঘট প্রত্যাহারে বাধ্য করেছে। জেল কর্তৃপক্ষ বন্দীদের সেল থেকে খাবার পানির কলস সরিয়ে রাখে। পানির তৃষ্ণার যন্ত্রণায় মেঝেতে গড়াগড়ি করেন কারাবন্দী।

১৯৫৪ সালে গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হওয়ার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছিল সরদার ফজলুল করিম জেলে অবস্থানকালীন। ন্যাপ নেতা অধ্যাপক মুজফ্ফর আহমদ যুক্তফ্রন্টের নেতা শেখ মুজিব ও সোহরাওয়ার্দীকে বলেছিলেন, ‘আমাদের একজন লোক নিতে হবে।’ জেলখানায় অধ্যাপক মুজফ্ফর আহমদ সরদার ফজলুল করিমকে তাদের সিদ্ধান্তের কথা অবহিত করে প্রার্থী মনোনয়নের প্রয়োজনীয় কাগজপত্রে স্বাক্ষর করিয়ে নেন। ১৯৫৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে তিনি জেল থেকে মুক্তি পেয়ে গণপরিষদের নির্বাচনে বিজয়ী হন।

১৯৫৭ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি সুলতানা রাজিয়ার সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। ১৯৫৮ সালে ৭ অক্টোবর পাকিস্তান সরকার সামরিক শাসন জারি করে এবং সংসদ ভেঙে দেয়। সামরিক শাসন জারির পর সরদার ফজলুল করিম আবারও গ্রেফতারের আশঙ্কা করেছিলেন। ১৯৫৮ সালে তাদের প্রথম সন্তান আফসানা করিম স্বাতী জন্মগ্রহণ করেন। সে বছরেই অক্টোবর মাসে সরদার ফজলুল করিম বাসার কাছ থেকে পুনরায় গ্রেফতার হন। ১৯৬২-এর ডিসেম্বর মাসে জেল থেকে শর্তসাপেক্ষে মুক্তি পান। সরদার ফজলুল করিমের শ্বশুর তাঁর জামিনদার হন।

১৯৬৩ সাল থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত বাংলা একাডেমিতে সংস্কৃতি বিভাগে অধ্যক্ষ পদে নিয়োজিত ছিলেন সরদার ফজলুল করিম। ১৯৭১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর বাংলা একাডেমি থেকে তিনি গ্রেফতার হন। বিজয় দিবসের পরের দিন-’৭১-এর ১৭ ডিসেম্বরে স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি মুক্ত হন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নির্দেশে এবং জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের প্রচেষ্টায় দ্বিতীয় মেয়াদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে সহকারী অধ্যাপক পদে নিয়োগ লাভ করেন। ১৯৮৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন কিন্তু শিক্ষকতা থেকে অবসর গ্রহণ করেননি। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগ এবং সরকার ও রাজনীতি বিভাগে খ-কালীন শিক্ষকতায় নিযুক্ত হন। তাছাড়াও সেন্ট্রাল উইমেন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন-এই দার্শনিক, আজন্ম জ্ঞানতাপস ও ক্ষণজন্মা শিক্ষক।

একজন মানুষ, একজন শিক্ষকের বিনয় ও মূল্যবোধ কতটা হতে পারে তাঁর সার্থক উদাহরণ হতে পারেন সরদার ফজলুল করিম। বিনয়, সহনশীলতা, সততা ছিল তাঁর প্রবাদতুল্য। মানবিক বোধ, সামাজিক দায়বদ্ধতা, সামাজিক সম্পর্ক বিশেষত তরুণ, ছাত্র-শিক্ষক-রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সাংবাদিক, প্রকাশক এবং এমনকি রিকশাচালকের প্রসঙ্গ উল্লেখযোগ্য।

আক্ষরিক অর্থে এই ক্ষীণকায়া মানুষটি ছিলেন বিনয়ের অবতার ও তাঁর বিনয় কিংবদন্তিতুল্য। তিনি ছাত্রাবস্থায়ই প্রগতি লেখক সংঘের কাজে সম্পৃক্ত হন। কলেজে পড়ার সময় তিনি এবং সহপাঠীরা মিলে হাতে লেখা পত্রিকা বের করতেন। ১৯৩৯ সালে ঢাকার মানবতাবাদী প্রগতিশীল লেখকদের উদ্যোগে গঠিত হয় ‘প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘ’। তিনি চিরায়ত গ্রিক দর্শনের গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থগুলো অনুবাদ করে দেশের বিদ্যুৎ সমাজে এবং সাধারণ পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে পরিচিতি লাভ করেন। বহু বছর ধরে বিদ্যা ও জ্ঞান বিতরণ করেছেন শত-সহস্র ছাত্রছাত্রীর মাঝে; রাজনীতি ও সংস্কৃতি অঙ্গনের নেতাকর্মীদের প্রেরণা জুগিয়েছেন আমৃত্যু। কত মানুষ তাঁর স্নেহ-ভালোবাসায় ধন্য হয়েছেন, কত মানুষকে তিনি ভালোবেসেছেন, প্রেরণা জুগিয়েছেন, পথ দেখিয়েছেন, তার পরিমাপ নেই।

২০১১ সালে জুন মাসে প্রজ্ঞাপন জারি করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার সরদার ফজলুল করিমকে জাতীয় অধ্যাপক মনোনীত করেন। এ ছাড়াও বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও বাংলাদেশ সরকারের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেন।

সরদার ফজলুল করিম মৃত্যুবরণ করেন ১৫ জুন ২০১৪ সালে। ১৯২৫ সাল পেরিয়ে ৮৯ বছর সময়কাল অতিবাহিত করে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর ভাষায়, ‘মানুষের মৃত্যুদিন হচ্ছে তাঁর সত্যিকারের জন্মদিন। মৃত্যুর পর যে কোনো ব্যক্তির পুরো পোর্ট্রেটটা আমাদের সামনে আসে।’ মনীষী বহুমাত্রিক সরদার ফজলুল করিম কল্পনা নন, বাস্তব। তাঁর স্বপ্নে, তাঁর কর্মে, চিন্তার প্রবহমানতায় তিনি সমর্পিত হতে চেয়েছেন অনাগত প্রজন্মে, কালের পরিক্রমায়  মানব মুক্তির ইতিহাসে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর