শুক্রবার, ৫ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

ব্যাংককের কাঠের বাড়ি

মঈনুস সুলতান

ব্যাংককের কাঠের বাড়ি

দীর্ঘ যানজটের পাশ দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসি নিচে। আমার মাথার উপরে ব্যাংকক শহরের পরস্পরকে ক্রিসক্রশ করে চারদিকে উড়ে যাওয়া ফ্লাইওভারগুলোকে পিরিচে জড়িয়ে মাড়িয়ে পড়ে থাকা অতিকায় নুডলসের মতো দেখায়। মেট্রোপলিটান নগরীর ইস্পাত-কংক্রিটের কঠিন ইনফ্রাস্ট্রাকচারের নিচে যেন আরেকটি ভিন্ন ধরনের আটপৌরে শহর। এ জনপদ ঠিক আধুনিক না, যান চলাচলের গতি অনেক কম, আর এখানে নেই হাল ফ্যাশনের স্কাইস্ক্যাপারের আয়না ঝলসানো ঠাঁট ঠমক। পুরনো দিনের ব্যাংকক যেন কাঠের দেয়ালের ওপর টালির ছাদ দেওয়া ঘরদুয়ার, বেশ কিছু সবুজ গাছপালা, পানিপূর্ণ গামলায় ফোঁটা শালুক, আর সড়কের পাশে দাঁড় করিয়ে রাখা টেম্পো-টুকটুক নিয়ে পেতেছে ভিন্ন ঘরানার সংসার। হাঁটতে গিয়ে পায়ের মাসোলে চিনকিরি দিয়ে তীব্র ব্যথা জানান দেয়। ব্যাংককের ভাপসা গরম আসলেই অপ্রেসিভ। ঘামতে ঘামতে ব্যাকপ্যাকে আইভিপ্রুফেইন ট্যাবলেট খুঁজি। পেইনকিলার না পেয়ে ফুটপাথের দোকান থেকে এক শলা সিগ্রেট কিনি, কেরোসিনের কুপি থেকে তা জ্বালিয়ে নিয়ে একটু গিল্টি ফিল করি। অনেক দিন হয় সিগ্রেট ছেড়েছি, পেইন ম্যানেজ করার জন্য না হয় একটু স্মোকই করলাম। এদিকে হাঁটাহাঁটি করে ঘণ্টা কয়েক কাটিয়ে দিতে হবে। তারপর বিকালের দিকে আবার ফিরে যাব হাসপাতালে।

আজকে আমার যেন সবকিছুতে কুফা লেগেছে। নানা দেশে ঘুরে বেড়ানোর ফলে পাসপোর্টের সবগুলো পৃষ্ঠায় পড়েছে ভিসার সিল-ছাপ্পড়। নতুন একটি বইয়ের জন্য সকালবেলা স্বদেশের অ্যামবেসিতে যাই। না, বার্থ সার্টিফিকেট ও বাংলাদেশে সয়-সম্পত্তি আছে এ ধরনের দলিল দেখাতে না পারলে নতুন বই ইস্যু করা হবে না। তারপর লেগ মাসলের ব্যথার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে যাই হাসপাতালে। মাস কয়েক আগে লাওসের একটি ইরিগেশন প্রজেক্ট দেখতে গিয়ে পাহাড়ের ঢালে পা ফসকে পড়ে এ ঝামেলার সূত্রপাত। কিছুদিন আগে ব্যাংককের একই হাসপাতাল থেকে একটি ওয়াকিং-স্টিক দিয়েছিল। তা দিয়ে চলাফেরাও করছিলাম বেশ। আজ এক স্প্যাশিয়েলিস্ট আবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বলল- লাঠিটার মাপঝোঁকের এলাইনমেন্টে ভুলভাল আছে। বিকালে আবার যেতে বলেছে। আফটারনুন আওয়ারে যদি টেকনিশিয়ান আসে- নতুন করে ওয়াকিং-স্টিক বানিয়ে দেবে। ভেবেছিলাম, পাসপোর্টের নয়া বইটি পেলে না হয় সিঙ্গাপুরে চলে যাবো পা দেখাতে। তাও সহজে হবে বলে মনে হচ্ছে না।

নানা কথা ভাবতে ভাবতে ফুটপাথে চিকেন গ্রিল করার দোকান ও পার্ক করে রাখা এক সারি ঠেলাগাড়ি অতিক্রম করে চলে আসি আরেকটি অত্যন্ত নিরিবিলি গলিতে। এখানে একটি কাঠের বাড়ি দেখে খুব অবাক হই। একেবারে ব্যাংককের মতো মেগা মেট্রোপলিটানের সেন্টারে বেশ অনেকখানি জায়গা নিয়ে ঘাস, সবুজ ঝোপঝাড় ও বেশ কিছু ফুলগাছের ভিতর গাছের খুঁটি ওপর দাঁড়িয়ে আছে ঘরখানি। এ গৃহের ছাদের প্রান্তে কারুকাজ করা কাঠের কৌণিক নিশানা থাই ঈছান অঞ্চলের কোনো পাড়াগাঁয়ের কথা মনে করিয়ে দেয়। খুব খাটো ঝুলের স্কার্ট পরা একটি মেয়ে কোমর বাঁকিয়ে কাঁচি দিয়ে ছাটছে ঝোঁপের নরোম ডাল ও গুচ্ছ গুচ্ছ সবুজ পাতা। আমি ছবি তোলার জন্য ব্যাকপ্যাক থেকে ক্যামেরা বের করতে যাই, মেয়েটি ঘুরে তাকায়। পায়ে তীব্র ব্যথার জন্য বোধ করি ভারি ব্যাকপ্যাক খুলতে অসুবিধা হয়। একটু জোরাজোরি করতেই ব্যালেন্স হারিয়ে হাতে ধরা ব্রাউন প্যাকেট থেকে ফুটপাথে পড়ে যায় একাধিক এক্স-রের ফিল্ম। পায়ের মাসোল স্টিফ হয়ে আছে, তাই উবু হয়ে তা কুড়িয়ে তুলতেও অসুবিধা হয়।

মেয়েটি অল্প হেসে এসে ফিল্মগুলো তুলো দিয়ে ফুঁ দিয়ে ধুলা উড়াতে উড়াতে বলে, ‘তান, হন লাই মাই, বা মিস্টার তোমার কি খুব গরম লেগেছে, কাম কাম..কিন নাম, অর্থাৎ আসো, একটু ঠান্ডা পানি খাও।’

কাঠের ঘরের খোলা নিচের তলায় ঝুলছে লাল সোনালিতে চিত্রিত কলাবতির ঝাড় থেকে চয়ন করা কিছু ফুল। আমাকে রোজউডের চকচকে পালিশ করা জলচৌকিতে বসিয়ে মেয়েটি সিঁড়ি দিয়ে উঠে যায় দোতালায়। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাই, সিঁড়ির উপরের ধাপে শুধু তার নিরাভরণ পা ও নিচু ঝুলের স্কার্টের নিচে ঊরুর খানিকটা দেখতে পাই। একটু অবাক লাগে, মসৃণ হলুদাভ ত্বকে ফুটে থাকা চাকা চাকা কালচে লাল দাগ দেখে। দেয়ালহীন নিচের তলায় বসতেই একটু হাওয়া আসে। আমি ফ্লোরে রাখা ডেকোরেশনগুলো দেখি। নীলে সোনালি বুটির কাজ করা অনেকগুলো সিরামিকের প্লেট, তাদের প্রতিটিতে রাখা মুখোশ পরানো রামায়ণ নৃত্যের ফিগারিনগুলো। এদের দিকে তাকিয়ে থাকলে মনে হয়, অভিনীত হয়ে চলছে রাম-রাবণ-সীতা হরণের পালা।

মেয়েটি সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসে কাচের গেলাসে ‘নাম-মাকনাও’ বলে লেবুজল নিয়ে। আমি শরবত খেতে খেতে দেখি, সে পায়ে সস্তা সিল্কের লেগিং পরে এসেছে, তাই চাকা চাকা কালচে লাল দাগগুলোকে আর দেখা যাচ্ছে না। এক্স-রের ফিল্মগুলো দেখিয়ে সে জানতে চায়, আমার পায়ে ফ্র্যাকচার হয়েছে কি? আমি তীব্র মাসল পেইনের কথা বলি, সে তৎক্ষণাৎ জলচৌকির তলা থেকে টেনে বের করে ফোল্ড করা গদি, সরং বা থাই কেতার লুঙ্গি ও ইউক্যালিপটাসের গন্ধ মাখানো তেলের বাটি। এ গদির এক প্রান্তে আছে গোলাপি ত্রিভুজাকৃতির শক্তপোক্ত একটি বালিশ। আমি সরং পরে তাতে হেলান দিয়ে আধশোয়া হই। তার ম্যাসেজের হাতটি চমৎকার। পিয়ানোর রিডের ওপর সংগীতশিল্পীর আঙ্গুলের মতো মেয়েটির দুই হাত খেলে যায় আমার ব্যথাদীর্ণ মাসলের ওপর। গদিতে আমি আধশোয়া হই, তবে তার শরীরের দিকে সরাসরি তাকাতে চাই না, তাই খানিক ঘাড় বাঁকিয়ে দূরের সিটিস্কেপের দিকে নজর দেই। কাঠের ঘরদুয়ার, মন্দিরের লোহিতে সোনালি কারুকাজ করা ছাদ প্রভৃতি ছাড়িয়ে গলিগুঁজির ফাঁক দিয়ে একটি স্কাইস্ক্যাপারকে বিচিত্র এক আরবান মনুমেন্টের মতো দেখায়।

ব্যাংককের গরম সত্যিই অপ্রেসিভ। আমি আবার ঘামতে শুরু করি। সে স্কার্টের কটিদেশে গুঁজে রাখা রুমাল বের করে তা দিয়ে আমার কপাল মুছিয়ে দিয়ে আঙ্গুলে চেপে ধরে দুই পাশের রগ। তখন আমার চোখ আবার তার ভি-কাট টপের দিকে চলে যায়। তাতে লেগে আগে বেশ কয়েক টুকরা কাঁচিতে কাটা পাতা। তার নিচে স্তনযুগলের সংকোচন প্রসারণে মৃদু মৃদু দুলে মানচিত্রে দ্বীপের মতো কয়েকটি কালচে লাল চাকা চাকা দাগ। আমি চোখ ফেরাই, তার আঙ্গুলগুলো আমার মাসলে দেবে যেতে থাকে। মৃদু ঠেলে সে আমাকে পাশ ফিরিয়ে দেয়, আমি ঘাড়ের কাছে তার আঙ্গুলের ছোঁয়া অনুভব করি। অতঃপর ফের চোখ খুলি, দেখি, খানিক দূরে একটি মন্দিরের আঙিনার দেয়ালের ওপর ঝুলছে ভারি সুন্দর একটি ঘণ্টা। চোখ বুঝে আমি কল্পনা করি, ঘণ্টা থেকে নিসৃত হয়ে চতুর্দিকে নিঃশব্দে ছড়িয়ে যাচ্ছে ধ্বনি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর