শুক্রবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

রবীন্দ্রনাথের কোরীয়ভক্ত কিম ইয়াং-শিক

প্রবীর বিকাশ সরকার

রবীন্দ্রনাথের কোরীয়ভক্ত কিম ইয়াং-শিক

এশিয়া মহাদেশের গুরুত্বপূর্ণ দেশ জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে একেবারেই বিধ্বস্ত হয়েছিল। হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে পৃথিবীর প্রথম আণবিক বোমা নিক্ষেপ করে আমেরিকা। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ তো আমরা সবাই জানি। যুদ্ধের পর থেকেই জাপান শান্তিবাদী দেশ হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিত। সেই শান্তিকে সমুন্নত রাখতেই যুদ্ধের পর জাপানের একাধিক প্রভাবশালী বুদ্ধিজীবী রবীন্দ্রনাথের শততম জন্মোৎসবকে কেন্দ্র করে একটি আন্দোলনই গড়ে তোলেন ১৯৫৭ থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত। তাঁর প্রকৃতিমুখী পরিপূর্ণ মানব তৈরির শিক্ষাকে জাপানি শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তি করে তোলারও পরিকল্পনা করেছিলেন কোনো কোনো শিক্ষাবিদ। এই রবীন্দ্র-আন্দোলন ব্যাপক আলোড়ন তোলে তৎকালীন কতিপয় তরুণ চিন্তাশীল ব্যক্তির মননে। তাঁদের মধ্যে বহুশ্রুত নাম জাপানি রবীন্দ্র-গবেষক অধ্যাপক ড. কাজুও আজুমা ছিলেন প্রধান। তিনি অসামান্য কাজ সাধন করেছেন রবীন্দ্রনাথকে কেন্দ্র করে বাংলা ভাষা, সাহিত্য এবং জাপান-বাংলা-ভারত পারস্পরিক সম্পর্ককে আরও জোরদার করার লক্ষ্যে। আজ তিনি এক কিংবদন্তি জাপান, ভারত ও বাংলাদেশে। সেই সঙ্গে তিনি প্রতিবেশী দেশ দক্ষিণ কোরিয়াতেও সুপরিচিত। রবীন্দ্রভক্ত কোরিয়ান বংশো™‚¢ত প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী মিনা কাঙ ছিলেন বিশ্বভারতীর ছাত্রী, তাঁরও আবির্ভাব এই জাপানেই ৯০ এর দশকে, তিনিও অধ্যাপক আজুমার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে। আমার সঙ্গেও মিনা কাঙের পরিচয় হয়েছিল টোকিওতে ৯০ এর গোড়ার দিকে। অধ্যাপক আজুমার কাছেই কোরিয়াতে রবীন্দ্রচর্চার কথা আমি শুনেছিলাম। সেখানে তাঁরই সমসাময়িক রবীন্দ্রভক্ত শ্রীমতী কিম ইয়াং-শিক রবীন্দ্রচর্চার আন্দোলন গড়ে তুলেছেন ৮০ দশকের মাঝামাঝি থেকে। অধ্যাপক আজুমার সঙ্গে যে তাঁর নিবিড় যোগাযোগ ছিল একটি গ্রন্থ ও আলোকচিত্র তার প্রমাণ বহন করছে। ১৯৯৩ সালে শ্রীমতী কিমের একটি ইংরেজি কাব্যগ্রন্থ “India: Selected Poems by Kim Yang-shik”, যা কবি স্বহস্তে স্বাক্ষর করে অধ্যাপক আজুমাকে উপহার দিয়েছিলেন। ২০১১ সালে অধ্যাপক আজুমার প্রয়াণের পর গ্রন্থ ও ছবি আমি তাঁর সহধর্মিণী আরেক বড়মাপের রবীন্দ্রভক্ত ও গবেষক মাদাম কেইকো আজুমার কাছ থেকে সংগ্রহ করি। উল্লেখ্য, গ্রন্থটি টেগোর সোসাইটি অব কোরিয়া প্রকাশ করেছে।

আমরা অনেকেই জানি না যে, ভারতবর্ষের সঙ্গে অবিভক্ত কোরিয়ার প্রাচীন সম্পর্ক বিদ্যমান। খ্রিষ্টীয় ৪৮ অব্দে অযোধ্যার এক রাজকন্যা ‘সুরিরত্না’ যার কোরীয় নাম ‘হেও হোয়াং-অক’ (Heo Hwang-ok) কোরীয় এক রাজার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন এবং ‘কারাক’ রাজবংশের উদ্ভব ঘটে। খ্রিষ্টীয় ৫২৬ অব্দে গিয়োমিক নামে একজন সন্ন্যাসী ভারতে যান সংস্কৃতি ভাষা শিক্ষালাভের জন্য। তিনি বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করে স্বদেশে ফিরে গিয়েউল বৌদ্ধ সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠা করেন। এভাবে ক্রমশ কোরিয়ায় ভারতীয় বৌদ্ধধর্ম প্রচার লাভ করে এবং পরবর্তীকালে জাপানে সম্প্রসারিত হয়।

বিংশ শতকে এসে ভারতের সঙ্গে দক্ষিণ কোরিয়ার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক গড়ে ওঠার পেছনে রয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর বিশ্বব্যাপী ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। কেননা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উপনিবেশ হিসেবে পাশ্চাত্যে ভারতবর্ষ একটি অবহেলিত, অনালোচিত এবং নিকৃষ্ট অঞ্চল। সেখান থেকে কেউ নোবেল বিজয়ী হতে পারে এটা ছিল ধারণার বাইরে! রবীন্দ্রনাথ সেই অসাধ্য সাধন করেছিলেন প্রথম এই বিশ্বস্বীকৃতি অর্জনের মধ্য দিয়ে। যে কারণে এশিয়া মহাদেশের সর্বত্র তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল দাবানলের মতো। পর্বতসম সম্মান তিনি অর্জন করেছিলেন জাপানে ১৯১৬ সালে। জাপানের সেই সম্মান প্রদানের সংবাদ পাশ্ববর্তী দেশ কোরিয়াতেও ছড়িয়ে পড়েছিল জাপান প্রবাসী কোরীয় নাগরিকদের কল্যাণে। ১৯১০-৪৫ সাল পর্যন্ত কোরিয়া ছিল জাপানের উপনিবেশ। এশিয়ার প্রথম শিল্পোন্নত রাষ্ট্র হিসেবে জাপান মনে করেছিল এশিয়ায় প্রথম নোবেল পুরস্কার এ দেশের কোনো কবি-সাহিত্যিকই পাবেন। কিন্তু তা হয়নি, পেয়েছিলেন ভারতবর্ষের বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ফলে জাপান তাঁর এদেশ ভ্রমণের আগ্রহকে সম্মান জানিয়ে আমন্ত্রণ পাঠায়। এদেশে এসে তিনি একাধিক বক্তৃতা করেন। জাপানের ভালো দিকগুলো নিয়ে অকুণ্ঠ প্রশংসার পাশাপাশি উগ্র জাতীয়তাবাদ, সমরবাদ এবং উপনিবেশবাদ সম্পর্কে কঠোর সমালোচনা করতেও দ্বিধাবোধ করেননি। তাঁর এই উষ্মার কথা কোরিয়ার জাতীয়তাবাদী তরুণ বিপ্লবীদের কানেও পৌঁছেছিল।

বস্তুত, জাপানিদের মতো কোরীয়রাও রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার অর্জনের পরপরই তাঁর প্রতি গভীরভাবে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। ১৯১৩ সালেই ‘গীতাঞ্জলি’র বাণী তৎকালীন কোরিয়ান কবি, সাহিত্যিক তথা বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিল। তাঁদের মধ্যে সর্বজন শ্রদ্ধেয় স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রনায়ক বৌদ্ধভিক্ষু, সংস্কারক, বিপ্লবী কবি মানহায়ে হান ইয়ং-উন অন্যতম। তিনি কিছু কবিতা অনুবাদ করে তাঁর প্রকাশিত মাসিক কাগজ ‘ইউসিম’ বা ‘আত্মশক্তি’তে প্রকাশ করেন। শুধু তাই নয়, শিশুদের জন্য স্থাপিত বিদ্যালয়ে এসব কবিতা পড়ে শোনাতেন তিনি। প্রভূত প্রভাবিত হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের মরমিবাদ, প্রকৃতিবন্দনা, মানবতাবাদ এবং উপনিবেশবিরোধী চিন্তা-ভাবনা দ্বারা।

১৯১৬ সালে রবীন্দ্রনাথের কিছু কবিতা কোরিয়ার তৎকালীন সাহিত্য সাময়িকী ‘চোংচুন’-এ হাঙ্গুল তথা কোরীয় ভাষায় প্রকাশিত হয়। ‘গীতাঞ্জলি’ অনূদিত হয় ১৯২০ সালে। ১৯২৪ সালে ‘দি ক্রিসেন্ট মুন’ ও ‘গার্ডেনার’ এবং ১৯২৬ সালে ‘ডাকঘর’ গল্পসহ অন্যান্য আরও কিছু প্রবন্ধ।

১৯২৪ সালে এক ঘটনা ঘটে। এই বছর রবীন্দ্রনাথ চীন থেকে জাপানে আসেন তাঁর এক নারী ভক্ত জাপানের প্রথম মনস্তত্ত্ববিদ ড. তোমি কোওরার আমন্ত্রণে। তখন কবিগুরু ৬৩ বছর বয়সী। শারীরিক দিক দিয়ে তেমন শক্ত-সমর্থ নন। এই সময় টোকিওতে তিনি একাধিক বক্ততা দেন, সংবর্ধনা সভায় স্বরচিত কবিতা বাংলা ও ইংরেজিতে পাঠ করে অভ্যাগতদের অভিভূত করেন যাঁদের মধ্যে প্রবাসী কোরীয়রাও ছিলেন। তখন প্রচুর কোরীয় ছাত্র জাপানে বৌদ্ধধর্ম এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছিলেন। তাঁদের মধ্যে পরবর্তীকালে খ্যাতিমান বিপ্লবী এবং চা-শিল্পী (Tea Master) ভিক্ষু হিয়োদেং চোই বেওম-সুল অন্যতম। যিনি রবীন্দ্রনাথের বাংলায় পঠিত কবিতা শুনে বিমোহিত হয়ে কোরিয়া ফিরে গিয়ে বিপ্লবী কবি মানহায়েকে বর্ণনা করেছিলেন। অনুরূপ তখন টোকিওস্থ কোরিয়ার প্রভাবশালী ‘দং-এ ইলবো’ বা ‘East Asia Daily’ পত্রিকার ব্যুরো প্রধান সাংবাদিক লি তায়ে-রো উক্ত পত্রিকার পক্ষ থেকে কবিকে সিউল ভ্রমণের আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু কবি আর্জেটিনাগামী বিধায় এই আমন্ত্রণ রক্ষা করতে পারেননি। তার পরিবর্তে তিনি লি এবং তাঁর সঙ্গী জু ইও-হানকে একটি কবিতা লিখে উপহার দেন। ইংরেজিতে লিখিত সেই কবিতাটি হলো : 

In the golden age of Asia

Korea was one of its lamp bearers

And that lamp is waiting to be lighted once again

For the illumiation of the East.

কবিতাটির শিরোনাম A Lamp of the East (প্রাচ্যের প্রদীপ)। এটি কোরিয়ার হাঙ্গুল ভাষায় অনুবাদ করেন টোকিওর তৎকালীন মেইজি একাডেমির অন্তর্ভুক্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র, পরবর্তীকালে স্বনামধন্য কবি এবং উক্ত পত্রিকার পিয়ংইয়ং ব্যুরো প্রধান জু ইও-হান উক্ত পত্রিকায় ১৯২৯ সালের ২ এপ্রিল কবিতাটি প্রকাশের পর ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে মুক্তিকামী, জাতীয়তাবাদী মানুষের মনে যাঁরা জাপানি শাসন থেকে স্বদেশকে মুক্ত করতে বদ্ধপরিকর। অতিদ্রুত কোরিয়ান জাতীয়তাবাদের প্রতীক হয়ে ওঠে এই ক্ষুদ্র কবিতাটি। অতিরঞ্জিত করে অনেকে এর অনুবাদ করেন বিভিন্নভাবে মূলত জাতীয় জাগরণ এবং স্বাধীনতা মনোভাব থেকে। কেউ কেউ এর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথেরই ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য’ কবিতাটির বেশ কয়েকটি লাইনও অনুবাদ করে জুড়ে দেন।

বস্তুত, কোরিয়ানরা অনুভব করেন যে, এই কবিতার ভেতরে রয়েছে বিগত ৫০০০ বছর প্রাচীন কোরীয় জাতি-সভ্যতার উত্থান, চিন্তা-চেতনা, দর্শন, সংস্কৃতি এবং গৌরবোজ্জ্বল ‘জোসেওন’ রাজবংশীয় (১৩৯২-১৮৯৭) ইতিহাসের প্রতিচ্ছবি, যা জাপানি সাম্রাজ্যবাদ দ্বারা আক্রান্ত ১৯১০ সাল থেকে। যদি আন্দোলন-লড়াই করা যায় তাহলে হৃতগৌরব ও স্বাধীনতা উদ্ধার করা সম্ভব- এই গুপ্ত আশার আলোই দেখতে পায় সমগ্র জাতি এই কবিতাটির মধ্যে। অবশ্য যথার্থভাবেই রবীন্দ্রনাথ রচিত

এই ক্ষুদ্র নিরপেক্ষ কবিতাটির বর্ণে বর্ণে বহুমুখী ইঙ্গিত সুস্পষ্ট। কোরিয়ানরা জাতীয়তাবাদ ও স্বাধীনতার দৃষ্টিকোণ থেকে একে গ্রহণ করেছেন তাতে দোষের কোনো কিছু নেই। আবার কবিগুরু জাপানের পরম ভক্ত হয়ে তার উপনিবেশ কোরিয়াকে বিদ্রোহী করে তোলার জন্য এটি লিখে দিয়েছেন তাও বলা যাবে না। বড় বুদ্ধিজাত সুদূরপ্রসারী একটি কূটনীতি তিনি এখানে প্রয়োগ করেছেন বলেই মনে হয়। কেননা তখন বিশ্বব্যাপী আগ্রাসী শ্বেতাঙ্গ সাম্রাজ্যবাদী রাজনীতির করালগ্রাস থেকে নিজেদের রক্ষাকল্পে জাপান ও কোরিয়া দুটো দেশই পরস্পরের ওপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় ছিল না।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কোরিয়া স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু কোরীয়রা রবীন্দ্রনাথকে বিস্মৃত হননি। তাঁর রচিত “প্রাচ্যের প্রদীপ” কবিতাটি উচ্চবিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হয় এবং কোরীয় জাতিকে নতুন করে উন্নতির আলোকে আলোকিত হতে উদ্বুদ্ধ করতে থাকে। শ্রীমতী কিমও যে এই কবিতার দ্বারা আলোড়িত হয়েছেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ১৯৭৫ সালে তিনি প্রথম ভারত ভ্রমণ করেন। ভারতের আধ্যাত্মিক চিন্তা তাঁকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। ১৯৭৭ সালে দোংকুক  বিশ্ববিদ্যালয় (Dongkuk University) থেকে ভারতীয় দর্শন বিষয়ে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন, যার সন্দর্ভের শিরোনাম ছিল “Philosophy of Upanishads as reflected in Tagore’s Works. এরপর তিনি  ‘একাডেমি অব ইন্টারন্যাশনাল কংগ্রেস অব পোয়েটস’ সংস্থা কর্তৃক সম্মানজনক ডক্টরেট ডিগ্রিতে ভূষিত হন। ১৯৮১ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘টেগোর সোসাইটি-কোরিয়া’ এবং হন প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট। সেই সঙ্গে তিনি কোরিয়ার আধুনিক কবি পরিষদ, নারী লেখিকা পরিষদ, ইন্টারন্যাশনাল পেন ক্লাব প্রভৃতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন দীর্ঘদিন। ১৯৭১ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত স্বরচিত কাব্যগ্রন্থ, প্রবন্ধ ছাড়াও বিদেশি কবি, সাহিত্যিকদের বিস্তর রচনা অনুবাদ করেছেন যার গ্রন্থসংখ্যা ২৫টির বেশি। সম্পাদনা ও প্রকাশনা কর্মের মধ্যে ৭টি বড় কাজ তাঁর সাহিত্য-প্রতিভার অত্যন্ত উজ্জ্বল স্বাক্ষর বহন করে। এসবের মধ্যে রবীন্দ্র-অনুবাদ হচ্ছে : ‘গীতাঞ্জলি’, ‘পোস্ট অফিস’, ‘চিত্রাঙ্গদা’, ‘সাইকল অব স্প্রিং’, ‘ফায়ারফ্লাইজ’ ও ‘সাধনা’। এ ছাড়া কৃষ্ণ কৃপালনীর ‘টেগোর: এ লাইফ’ গ্রন্থটিসহ অন্যান্য খ্যাতিমান ভারতীয় লেখকদের গ্রন্থও উল্লেখযোগ্য। তাঁর একাধিক কবিতা হিন্দি, চীনা, মালয়, জাপানি, ফরাসি, ইংরেজিসহ অন্যান্য ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তিনি স্পেইন, বেলজিয়াম, রাশিয়া, চীন, মালয়েশিয়া এবং ভারতের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কবি সম্মেলন, সাহিত্যসভা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বক্তৃতামালায় অংশগ্রহণ করেন। ভারতের দিল্লিস্থ জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়, শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতীও এসবের অন্তর্ভুক্ত। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তাঁর অনেক গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও বক্তৃতা রয়েছে। এ পর্যন্ত ছয় খন্ডে রবীন্দ্ররচনাবলী প্রকাশিত হয়েছে হাঙ্গুল ভাষায় অবশ্যই ইংরেজি থেকে প্রধানত তাঁরই উদ্যোগে। দীর্ঘ কর্মজীবনে সাহিত্য ও শান্তিবিষয়ক বিপুল কর্মকান্ডের মূল্যায়নস্বরূপ ১৯৬৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত একাধিক জাতীয় সম্মানে সম্মানিত হয়েছেন। রবীন্দ্র-নিবেদিতপ্রাণ শ্রীমতি কিম ২০০২ সালে ভারত সরকার প্রদত্ত ‘পদ্মশ্রী’ পদকে ভূষিত হয়েছেন দূরপ্রাচ্য থেকে তিনিই প্রথম। ২০১৮ সালে তাঁকে ভারতের সাহিত্য একাডেমি সাম্মানিক ফেলোশিপ প্রদান করেছে। রবীন্দ্রচর্চা ছাড়াও কোরিয়াতে ভারতীয় শিল্প-সংস্কৃতিকে দীর্ঘকাল ধরে ব্যাপকভাবে পরিচিত করার পেছনে তাঁর অবদান অসামান্য। তাঁর তত্ত্বাবধানে টেগোর সোসাইটি-কোরিয়া থেকে ‘কোরিয়ান-ইন্ডিয়ান কালচার’ নামে প্রকাশিত সমৃদ্ধ সমায়িকী একটি ঐতিহাসিক কাজ। বর্তমানে তাঁর বয়স ৯০ বছর, তা সত্ত্বেও গুরুদেব রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তাঁর চিন্তা ও কাজের শেষ নেই। প্রধানত তাঁরই উদ্যোগে ২০১১ সালে গুরুদেবের সার্ধশত জন্মবর্ষ উপলক্ষে রাজধানী সিউল মহানগরের দায়েহাংনো স্থানে রবীন্দ্রনাথের একটি দৃষ্টিনন্দন ধাতব স্মারক ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়। সেই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কোরীয় সরকারের উপ-সংস্কৃতি মন্ত্রী, সংসদের স্পিকার, ভারতীয় রাষ্ট্রদূতসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।

শুধু তাই নয়, ২০০৯ সালে বিশ্বখ্যাত দক্ষিণ কোরিয়ার সামসুং কোম্পানি দিল্লিস্থ সাহিত্য একাডেমির সঙ্গে যৌথভাবে ‘রবীন্দ্র সাহিত্য পুরস্কার’ প্রবর্তন করেছে। এর পেছনে যে রবীন্দ্রঅন্তপ্রাণ ড. কিম ইয়াং-শিকের প্রভাব বিদ্যমান তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

সর্বশেষ খবর