মাঝরাতে ধড়াম করে কোনো কিছু পতনের শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। রান্নাঘরে ইঁদুরের উৎপাত বেড়েছে, টের পাই। সানসাইডে দুটো ইঁদুরের হুটোপুটিতে প্লাস্টিকের বোতল বা বয়াম নিচে পড়ে গেছে। আগেও এমন হয়েছে। সাধারণত রাতের বেলায় ওরা আসে। দিনেও আসে, কদাচিৎ।

অনিচ্ছুকভাবে বিছানা ছেড়ে রান্নাঘরে যাই। নিচে পড়ে থাকা বয়াম উপরে রাখার ছলে শব্দ করি, এই যা। বেরিয়ে আয়।

আমি আবারও বলি, এই যাহ।

কিন্তু সে আর যায় না। কোনো শব্দও করে না।

ইঁদুরটা হয়তো তাৎক্ষণিক মারা গিয়েছিল। তবুও তার নিথর পড়ে থাকা দেখে ভাবি, পালিয়ে যাওয়ার আগে একটু প্রস্তুতি নিচ্ছে। আরও পরে বুঝতে পারি, সে মারা গেছে।

জানালাটা খুলে দেই। হুড়মুড় করে রান্নাঘরে বাতাস ঢুকে পড়ে। পৌষমাসের বাতাস আমার ভিতরটা কাঁপিয়ে দেয়। রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসি। একবার বাথরুমে যাই। ফিরে এসে লাইফবয় হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে ভালো করে হাত ধুই। তোয়ালেতে মুছি। ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ি। ঘুম আসে না।

অনেকটা সময় ধরে বিছানায় এপাশ-ওপাশ করি। কিছুতেই ঘুমের দেখা মেলে না।

আরও কিছু সময় পর, দরজা খুলে আবার রান্নাঘরে যাই। জানালার কাছে গিয়ে দেখি, ইঁদুরটা ঘাপটি মেরে পড়ে আছে।

কোনো শব্দ করি না। বুঝতে পারি, সে আর যাবে না।

ধীরে ধীরে আমার মনের ভিতর একটা শোকের অনুভূতি তৈরি হয়। মন খারাপ লাগে। না, কাজটা একদমই ঠিক হয়নি। এটা না করলেও পারতাম। এসব ভাবতে ভাবতে একধরনের অপরাধবোধে মনটা পুড়তে থাকে।

ঘরে ফিরে নানা কথা মনে আসে। ইঁদুরটা হয়তো মা ইঁদুর। কাছেপিঠে কোথাও বাচ্চারা আছে। সে খাবার নিয়ে গেলে বাচ্চারা খেতে পারত। মায়ের ফেরার অপেক্ষায় বাচ্চাগুলো শীতের রাতে কোনো গর্তে বা দেয়ালের পাশে গুটিসুটি মেরে পড়ে আছে। হয়তো ওদের বাবা নেই। দুর্ঘটনায় মারা পড়েছে। আর একটা বিয়ে করে বাবাটা হয়তো পালিয়ে গেছে। এখন মাও মরে গেল।

এসব ভেবে আমি কাতর হয়ে পড়ি। মনটা ভীষণ আর্ত হয়ে ওঠে। ঘরের ভিতরে কিছু সময় পাঁয়চারি করি। এক সময় শুয়ে পড়ি। কিন্তু বাকি রাত আর ঘুম হয় না। খুব বিচলিত বোধ করি। কী উপায়ে আমি প্রায়শ্চিত্ত করব, ভুল শুধরে নেব, দিশা পাই না।

সকালে লাল চোখে বিছানা ছেড়ে বাথরুমে যাই। ব্রাশ করি। ¯œান সেরে অফিসে যাব। একবার রান্নাঘরে ঢুকি। দেখি, ইঁদুরটা পড়ে আছে। বুকের ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে যায়।

কয়েক মুহূর্ত নীরবে কেটে যায়। কিছুই হয়নি; এমন ভাব করে ¯œান সেরে অফিসে চলে যাই। চা খেয়ে অফিসের কাজ শুরু করি।

১২টার পরেই প্রচ- খিদে পায়। একরকম দৌড়ে অফিসের ক্যান্টিনে যাই। মাছের ঝোল দিয়ে ভাত মাখিয়ে মুখে দেব, তখনই ইঁদুরের ছবিটা চোখে ভেসে ওঠে। ভাতমাখা হাত নিয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকি। ধুর, এতসব ভাবলে চলে? ভেবে আমি গোগ্রাসে কয়েকবার ভাত মুখে দেই। কিন্তু ভাত গলা দিয়ে নামে না।

এভাবে ভাতের প্লেট নিয়ে বসে থাকলে মানুষ পাগল ভাবতে পারে। খাওয়া অসমাপ্ত রেখেই উঠে পড়ি। ক্যান্টিনবয়কে বলি, কফি দাও।

কফি শেষ করে আবার অফিসে ঢুকি।

পিয়ন এসে দরজায় দাঁড়ায়- বড় স্যার আপনাকে সালাম দিয়েছেন।

বিভাগীয় প্রধানের ঘরে যাই। তিনি ইশারায় বসতে বলেন। কয়েক মুহূর্ত পর, কম্পিউটার থেকে চোখ তুলে তিনি আমার দিকে তাকান। তাকিয়েই থাকেন।

আমি বিব্রতভাবে হাসি।

আপনার কি শরীর খারাপ, রিফাত সাহেব?

আমি আমার শরীরের এপাশ ওপাশ তাকাই- কই, না তো।

তিনি আমার কথায় ভরসা পান না। সন্দেহের চোখে তাকান। বলেন, আপনাকে দেখে কেমন যেন লাগছে। আপনার চোখও দেখছি লাল। বাসায় কোনো সমস্যা হয়েছে কি?

স্যার, বাসায় কোনো সমস্যা হয়নি। আর আমি ঠিক আছি।

বস কী কাজে ডেকেছিলেন, সে প্রসঙ্গে আর গেলেন না। বললেন, শরীর খারাপ হলে আপনি বাসায় গিয়ে বিশ্রাম করুন। কাজটা পরে করে দিলেও হবে।

স্যারকে বোঝাতে চেষ্টা করি, আমার কিছু হয়নি। তবুও তিনি বিশ্বাস করেন না।

তিনি কিছুক্ষণ থম ধরে থেকে বললেন, চা খাবেন?

না, স্যার। থ্যাঙ্ক ইউ।

স্যার মাথা দুলিয়ে বললেন, ঠিক আছে।

আমি দ্রুতপায়ে বেরিয়ে আসি।

পরদিন শুক্রবার। ছুটির দিন বলে সারা দিন বাসাতেই ছিলাম। বিকালের মুখে বের হলাম। আজিজ সুপার মার্কেটে নীলাভ্রর সঙ্গে দেখা হলো। সে আমার জন্য চিঁড়ার পায়েস করে নিয়ে এসেছে। অন্যদিন তবু ভদ্রতা করে বলি, বাহ, খেতে দারুণ হয়েছে। তোমার হাতে জাদু আছে। নীলাভ্র তখন লজ্জিতভাবে হাসে। 

আজ কিছুই বলি না। হাত বাড়িয়ে পায়েসও নেই না। সে খুব অবাক হয়। আর্তচোখে তাকায়- তোমার কী হয়েছে? শরীর খারাপ?

আমি কোনো সদুত্তর দিতে পারি না।

বইয়ের দোকানে ঘোরাশেষে আমরা একটা কফিশপে যাই। বলতে হয় না, চিনিছাড়া কফি চলে আসে। দোকানের ছেলেটা যে ছোট ব্যাপারটা মনে রেখেছে, দেখে খুব ভালো লাগে।

শীত বাড়ছে। কথা আর বেশি এগোয় না নীলাভ্রর সঙ্গে।

নীলাভ্র বলে, চলো, তোমাকে একটা শীতের টুপি কিনে দেই। খুব ঠান্ডা পড়ছে, বাইরে ঘুরতে গেলে টুপি থাকা ভালো।

আমি আপত্তি করি। এতে কাজ হয় না। সে আমাকে ভালো উলের টুপি কিনে দেয়।

আরও কিছু সময় বসে থাকি। একটু হাঁটি। পরে রিকশা নয়, পায়ে হেঁটে শাহবাগ থেকে বাসায় চলে আসি।

মগবাজার রেলগেটের সঙ্গে লাগোয়া একটা দোকান থেকে আমি কলা কিনি। নিয়মিত। ভিড় ছিল আজ। তাই লোকটা বলল, স্যার এক মিনিট দাঁড়ান।

এরমধ্যে হঠাৎই দৃশ্যটা চোখে পড়ে আমার। এমন আঁতকে উঠি, ভাবি যে, আজ আর কলা নেব না।

অল্প একটু জায়গায় গন্ডায় গন্ডায় কলা সাজানো। মাটিতে চটের উপর কলা, ছোট টেবিলের ওপর কলা, গ্রিলের দেয়ালের সঙ্গে চাঁপা, সাগর ও সবরি কলা ঝুলছে। এমন সময় চোখে পড়ে, চোরের মতো নিঃশব্দে গ্রিলের নিচ দিয়ে একটা ধেড়ে ইঁদুর উঁকিঝুঁকি মারছে। পরিস্থিতি আন্দাজ করে ইঁদুরটা চোখের পলকে একটা কলার ছড়ি কামড়ে ধরে পালানোর চেষ্টা করে। পেরে ওঠে না। ছেড়ে দেয়। সে আবার আসে। ইতিউতি তাকায়। এবার যে ছড়িতে কলা কম, তেমন ছড়িতে ইঁদুরটা মুখ বাড়ায়। কলা মুখে করে টেনে গর্তের কাছে নিয়েও সে লুকিয়ে পড়ে। আবারও আসে। আর তখনই একটা লাঠি দিয়ে ইঁদুরের গর্তে বাড়ি মারে লোকটা। ততক্ষণে ইঁদুর পালিয়ে যায়। একটু পরে ইঁদুরটা আবার আসে। কলা নিয়ে পালাতে উদ্যত হয়। লোকটা আগে থেকেই ওঁত পেতে ছিল; ঠাস করে বাড়ি বসিয়ে দেয়। মুহূর্তেই ইঁদুরটা কাঁপতে কাঁপতে উল্টে যায়। চোখের পলকে একটা জ্যান্ত ও ধূর্ত ইঁদুর মারা পড়ে যায়।

কিছুক্ষণের জন্য আমি বোধশূন্য হয়ে পড়ি। নিষ্পলক তাকিয়ে থাকি ইঁদুরটার দিকে। চারপাশে এত মানুষ ও কোলাহল কিছুই আমাকে স্পর্শ করে না। একটা ঘোরের ভিতর ঢুকে পড়ি। এমন কথাও মনে আসে- জগতের নিরীহরা কি এভাবেই মার খেয়ে যাবে? পরে নিজেকে প্রবোধ দিই- মানুষই মানুষের কথা ভাবে না, সামান্য ইঁদুরের কথা আর কে ভাবে। চোখ ডলে তাকানোর মতো আমি মাথা ঝাঁকিয়ে ধাতস্থ হই। 

এ সময় রেলগেটের সিগনাল পড়ে যায়। ট্রেন আসার হুইসেল বেজে ওঠে।

আমি বাস্তবে ফিরে আসি। চলে যেতে পা বাড়াই। লোকটা বলে ওঠে- স্যার, এই যে নেন!

কলা নেব না আজ। থাক। আমি বলি।

স্যার, রাগ করলেন? শালার ইঁদুর ডেইলি ডিস্টার্ভ করে।

আমি বলি, ডেইলি?

হয়। কয়দিন বাদে বাদে একটা করে মারা পড়ে।

একটা কলাই তো খেতে চেয়েছিল। কিন্তু খেতেও পারল না। আপনি ওকে মেরে ফেললেন? আপনার খারাপ লাগল না?

কী কন, স্যার? এসব ভাবলে কি আর কলা বেচন যায়?

এভাবে আপনি কত ইঁদুর মেরেছেন?

সেই হিসাব কি আর রাখছি, স্যার। গুনাগুনতি নাই। মাসে পাঁচ-ছয়টা তো হইবই।

এরমধ্যে দানবীয় শব্দ করে ট্রেনটা প্রায় চোখমুখের ওপর দিয়ে চলে যায়। সিগনালও সরে যায়। দুপাশে আটকে পড়া রিকশা ও গাড়ি পারাপারের জন্য তোড়জোড় শুরু করে।

শুনুন, আজ আর কলা নেব না।

দেরি হওয়ায় স্যার কি রাগ করলেন?

আমি মিথ্যে করে বলি, সকালে বাড়ি যাব। আজ লাগবে না; বলেই আমি আর দাঁড়াই না। দ্রুত পায়ে বাসার দিকে হাঁটতে থাকি।

অল্প শোকে মানুষ কাতর হয় আর অধিক শোকে পাথর। শোক বেশি হলে সেটা টুপ করে নেমেও যেতে পারে। বাসায় ফিরতে ফিরতে মনটা সহজ হয়ে আসে আমার। কেন? তা জানি না। কিন্তু ইঁদুরের জন্য শোক ও ভাবনা ক্রমে ফুরিয়ে আসে।

বাসায় এসে হাতমুখ ধুয়ে একটা সিনেমা দেখতে বসি। সিনেমাটা আগেও দুবার দেখেছি। তামিল সিনেমার বাংলা ডাবিং। ‘পয়সা উসুল’। চিঁড়ার পায়েস খেতে খেতে ভাবি, আজ রাতে আর অন্যকিছু খাব না। তলানিতে একটু পায়েস পড়ে থাকে। আর খেতে ইচ্ছে করে না। রান্নাঘরের সিঙ্কে বাটিটা রেখে ঘরে চলে আসি।

অর্ধেক সিনেমা দেখার পর, কেমন আড়ষ্ট লাগে। ভাবি, একটু কফি খেতে পারলে মন্দ হয় না।

সিনেমায় পজ দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যাই। রান্নাঘরে ঢুকি। চুলা জ¦ালানোর আগে দেখতে পাই, দুটো ছোট ইঁদুর চোখের পলকে আড়ালে লুকিয়ে গেল। সতর্কভাবে একবার আড়চোখে উঁকি দিয়ে দেখি, মসলার কৌটার ওপাশে ওরা ঘাপটি মেরে বসে আছে। ওদের কানদুটো খাড়া, ভীত, কিন্তু উৎফুল্ল। আমি পায়েসের বাটিটা ধরি না, ধুয়ে পরিষ্কারও করি না। রেখে দেই।

দুটো ইঁদুরের একটাকে আকৃতিতে একটু বড় মন হয়। অন্যটা যে মেয়ে ইঁদুর, তা সহজেই অনুমান করতে পারি। আমি আপনমনে হেসে চুলা ধরাই। পরিমাণ মতো পানি সিদ্ধ করে মগ হাতে নিয়ে আড়ালে দাঁড়াই।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে। মেয়ে ইঁদুরটা খানিক দূরে। সে স্থিরভাবে কানখাড়া করে। মুখ উঁচু করে বসে থাকে। পুরুষ ইঁদুরটা এসে বাটির তলানিতে পড়ে থাকা পায়েস খেতে থাকে। তখন হঠাৎই মনে হয়, মানুষ ছাড়া অন্য জগতের জীবজন্তুর জীবনে হয়তো নাশতার রীতির প্রচলন নেই। ওরা সকাল-দুপুর-রাতের খাবারের ভিন্ন ভিন্ন নামও দেয় না। টাইম বা সময় নিয়ে মানুষের মতো টানাটানি করে না- কতকাল বাঁচলাম আর কতদিন বাঁচব? এসব নিয়েও ভাবে না। কী পেয়েছি আর কী পেলাম না, তা নিয়েও দিনের পর দিন আফসোস করে না। সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্ম কী জিনিস- ওরা বোঝে না। স্বর্গ নরক কী? জানে না। ওরা খেয়ে-দেয়ে, কেটেকুটে, ঘুরে-ফিরে ও মিলেমিশে সুখ পায়। এটুকুই ওদের জীবন। এতেই তারা সুখী বোধ করে এবং এক জীবন কাটিয়ে যায়। তা থাক বাবা, নিজেদের জীবন ও জগৎ নিয়ে তোরা সুখে থাক। সৃষ্টিকর্তার করুণা ও আশীর্বাদ তোদের ওপরও সমানভাবে বর্ষিত হোক, প্রতিদিন।

মৃদু হেসে আমি নিজেই নিজেকে চোখ ইশারা করি। কফির মগ হাতে ঘরে ফিরতে ফিরতে পরিষ্কারভাবে অনুভব করি, মনটা পুরোপুরি ঝরঝরে হয়ে উঠেছে। ইঁদুরের জন্য কোনো শোক বা দুঃখও আর অবশিষ্ট নেই।