শুক্রবার, ৪ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা
মাশুক চৌধুরীর অপ্রকাশিত লেখা

সান্নিধ্যের গৌরব

সান্নিধ্যের গৌরব

আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি মুক্তিযুদ্ধ আমার মা। কথাটা আমার নয়, যার, তাকে আমরা মান্য করতাম- একাধারে ফ্রেন্ড, গাইড এন্ড ফিলসফার গণ্য করে। বন্ধু-পথপ্রদর্শক-দার্শনিক। সমকালের শিল্প সাহিত্য ও যৌবন জলতরঙ্গে তিনি ছিলেন দ্রোহের প্রতীক। আমাদের অগ্রপথিক। আমরা অনুসরণ করি মাত্র। আমাদের এই নেতা এখন নেই। তার নাম আহমদ ছফা। সময়ের প্রতিভাবান আরেক চিন্তাশীল ব্যক্তিত্ব সলিমুল্লাহ খান আহমদ ছফা নামের শুরুতে মাথায় মুকুটের মতো ‘মহাত্মা’ বিশেষণটি পরিয়ে বলতে বা লিখতে পছন্দ করেন। সলিমুল্লাহ খানের ভাষায় আহমদ ছফা বাংলাদেশের মহান রাষ্ট্রচিন্তাবিদ। মহাত্মা আহমদ ছফার সান্নিধ্যের গৌরবে আমরা দীর্ঘদিন ধন্য হয়েছি। সে ১৯৬৮ সাল থেকে ২০০১ পর্যন্ত। এ সময়কালে ব্যক্তিগতভাবে আমি তার মতো ব্যক্তিত্বের স্নেহ ও সুপরামর্শ পেয়েছি, নানা বিষয়ে যে দিক-নির্দেশনা পেয়েছি আমার জন্য তা অবশ্যই আলোকবর্তিকার মতো উজ্জ্বল একটা অধ্যায়।

মুক্তিযুদ্ধকে আমাদের কাছেও মা-ই মনে হয়। মাতৃভূমি তো মাতৃরূপিণী হিসেবে স্বীকৃত বাংলা সাহিত্যের সূচনা কাল থেকেই। আমি আহমদ ছফার মুক্তিযুদ্ধকে মা রূপিনী চিন্তার কথা বারবার বলছি একটি ব্যক্তিগত ঋণ স্বীকারের সুযোগের সদ্বব্যহারের জন্য...আমি সমকালের সম্পাদক, উপাচার্য, অধ্যাপক, পাতি নেতা, কবি, সবাইকে চিনি। কিন্তু নাম প্রকাশের মতো সাহসী নই, যা আহমদ ছফা করতে কখনো দ্বিধা করতেন না। বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাসের লেখাগুলো যখন পত্রিকায় বেরুত, আমাদের বহু শ্রদ্ধাস্পদ মানুষের ভিতরের কার্যকলাপ তুলে ধরেছেন নাম-ধামসহ। কিন্তু বইটিতে অনেকের নাম ছাটাই হয়ে গেছে। পত্রিকার লেখা আর বই এক নয়। তিনি নিজেই এই যুক্তি দিয়েছেন। বইটি কেনার জন্য টাকা পকেটে ঢুকিয়ে দিয়েছেন।

আহমদ ছফা কোনো দিন আওয়ামী লীগ করেননি, আওয়ামী লীগের সমর্থকও ছিলেন না। তিনি তরুণ বয়স থেকেই রাজনৈতিকভাবে দুর্বল ছিলেন বামপন্থিদের সঙ্গে। অ্যাক্টিভিস্ট নয়, সমর্থক হিসেবে। সমাজতন্ত্র ও মার্ক্সবাদী আদর্শের অনুগত ছিলেন। তার মুখে আওয়ামী লীগ ও সে দলের নেতাদের সমালোচনাই শুনেছি আমরা। সে সমালোচনা অনেক সময় তিনি প্রচ- ঝুঁকি নিয়েই করেছেন। পালে বাতাসের অনুকূলে থাকার মতো সুবিধাবাদী চরিত্রের লোক ছিলেন না তিনি। এজন্যই হয় তো রাজনৈতিক বিচারিক ক্ষমতায় আহমদ ছফা ছিলেন নির্মোহ। যার জন্য তিনি বলতে পেরেছিলেন ‘দেশের মধ্যে একমাত্র পলিটিক্যাল পার্টি আওয়ামী লীগ।’ বলতে পেরেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ জিতলে হাসিনা ও তার অনুগ্রহীরা জেতেন যখন হারেন সেটা বাংলাদেশের হার।’

দেশের একমাত্র পলিটিক্যাল পার্টি আওয়ামী লীগ। এই বিচারিক মন্তব্য যার তিনি বিচারপতি ছিলেন না, কোনো রাজনৈতিক দলদাসও ছিলেন না। তিনি ছিলেন মুক্তমনা একজন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক চিন্তক। চিন্তা করতেন। চিন্তা করতে করতে মগ্ন হয়ে যেতেন সাধকের মতো। কোনো বিষয়ে চিন্তার ঘোর প্যাঁচে পড়ে গেলে সারা রাত ঘুমোতে পারতেন না। জেগে থাকতেন। সকাল বেলা তার ‘পিতৃদেব’ আসাদ ভাই যখন অবাক বিস্ময়ে বললেন, কী ‘ছফা’ সারারাত ঘুমাননি কেন? আহমদ ছফা নির্বিবাদে বললেন, আসাদ ভাই, সারারাত ঘুমাতে পারলাম না, নেতাজি সুভাষ বসু এখনো বেঁচে আছেন কিনা সে কথা ভাবতে ভাবতে ভাবনা কুলকিনারা পেলো না, বিছানায় যাওয়ারও সময় পেলাম না।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর