শিরোনাম
শুক্রবার, ১১ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা
কবি জীবনানন্দ দাশ

জীবনের খুঁটিনাটি

হাসান হাফিজ

জীবনের খুঁটিনাটি

কবি জীবনানন্দ দাশ (জন্ম : ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯, মৃত্যু : ২২ অক্টোবর ১৯৫৪) মানুষ হিসেবে ছিলেন খুবই লাজুক। আত্মভোলা ধরনের। অসম্ভব পড়ুয়া। ভালোবাসতেন একাকিত্ব, নিঃসঙ্গতা। এমন একটা সময় ছিল যখন রোজ রোজ পাঁচ/সাত মাইল হাঁটতেন। তাঁর বেশ পছন্দ ছিল হাঁটাহাঁটি। কলকাতায় পড়ন্ত দুপুরে যখন বেরুতেন, রাস্তা থাকত জনবিরল। প্রখর রোদে এলোমেলো একা একা ঘুরে বেড়াতেন। বন্ধু সুবোধ রায়ের সঙ্গে কবি একদিন গেছেন আচার্য নন্দলাল বসুর চিত্রপ্রদর্শনী দেখতে। সন্ধ্যাবেলা ফেরার পথে যথারীতি ট্রাম-বাস নয়, হেঁটে। এই ফাঁকে কবির মৃত্যু-পরবর্তী  সময়ে সুবোধ রায়ের স্মৃতিচারণের ওপর একটু চোখ বুলিয়ে নিই আমরা।

সুবোধ রায় লিখেছেন,

“...সন্তর্পণে অতিক্রম করলাম চৌরঙ্গীর মসৃণ পিচের রাস্তা। তারপর ধু ধু গড়ের মাঠ। তমসাচ্ছন্ন বিস্তীর্ণ শ্যামলিমা। ঘাস পেলে জীবনানন্দ আর কিছু চান না। সবুজের প্রতি এক আশ্চর্য অনুরক্তি আর আকর্ষণ। সাপের যেমন বাঁশি, হাঁসের যেমন জল, পাখির যেমন মুক্ত আকাশ। মনে পড়ে কবির অবিস্মরণীয় কবিতাকে :

রয়েছি সবুজ মাঠে-ঘাসে-

আকাশ ছড়ায়ে আছে নীল হয়ে আকাশে আকাশে

জীবনের রং তবু ফলানো কি হয়

এইসব ছুঁয়ে ছেনে! সে এক বিস্ময়!

প্রতিদিন সাদার্ন য়্যাভিনু দিয়ে হাঁটতেও এর পরিচয় পেয়েছি বারবার। ঘাসপথ চাই-ই চাই। ভুলিয়ে-ভালিয়ে যদিই-বা নামালাম রাস্তায়-কখন দেখি ঠিক উঠে পড়েছেন ঘাসে! এই পরীক্ষা কতবার কতভাবে করেছি। ব্যর্থ হয়েছি বারবার।

...হাঁটায় ক্লান্তি নেই জীবনানন্দের। যদি বলেছি কোনো দিন আর পারছিনে, দাঁড়াই একটু, অমনি কপট ভর্ৎসনার গর্জন শুনতে হয়, ‘খাড়ান কিয়া’ প্রশ্ন করি, ‘এ আবার কোন দেশি ভাষা?’ উত্তর হয়, ‘বরিশালের। অরবিন্দ গুহকে জিজ্ঞেস করবেন।’ দ্বিরুক্তি না করে হেঁটে চলেছি। জনহীন পথ। হঠাৎ চীৎকার করে উঠলেন কবি, ‘ভাউয়া-ভাউয়া’। ‘সে আবার কী?’ ‘ঐ যে তাকিয়ে আছে। ভীষণ লাফায় আর নাকি চোখ খুবলে নেয়।’ ‘তা ভাউয়া ভাউয়া ক’রে চ্যাঁচাচ্ছেন কেন? ও তো কোলাব্যাং।’ ‘বরিশালে ভাউয়া বলে। অরবিন্দ গুহকে জিজ্ঞেস করবেন।’

বড্ড ঘরকুণো, অসামাজিক লোক ছিলেন নির্জনতার এই কবি, জীবনানন্দ দাশ। পড়তে ভালোবাসতেন খুব। বলতেন, ‘কত বই পৃথিবীতে। ভালো বই পেলে আর কিচ্ছুর, কারুকে দরকার হয় না।’ সাধ্যমতো যতটা সম্ভব ডুবে থাকতেন পাঠের জগতে। বেশিরভাগ ইংরেজি বই পড়তেন তিনি। একাগ্রচিত্তে বারান্দার হাফ ইজিচেয়ারে পাঠনিমগ্ন থাকতেন। বাম পাশে দু-একটা বই। জীর্ণ বিবর্ণ একখানি অক্সফোর্ড ডিকশনারি, তিন রকম ইংরেজি দৈনিক। আনন্দবাজার, যুগান্তর, দেশও আছে। কবির সামনে ফুট রেস্ট হিসেবে থাকত একটা খালি চেয়ার। বিছানায় শুয়েও বইপত্র পড়তেন। বাক্স, তাক বইয়ে ঠাসা। খাটের তলা, ঝকঝকে মেঝেতে ¯ূÍপীকৃত রাশি রাশি বই ও পত্রপত্রিকা। এলোমেলো কিংবা ধূলিমলিন নয়। পরিপাটি, পরিচ্ছন্ন করে সাজানো।

ট্রাম দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত কবির মৃত্যু হয় হাসপাতালে। কবিজায়া লাবণ্য দাশ লিখেছেন, “...পৃথিবী থেকে চিরবিদায়ের আগে শম্ভুনাথ পন্ডিত হাসপাতালে কবি যে অদ্ভুত মনোবল, অপরিসীম ধৈর্য এবং সহিষ্ণুতার পরিচয় দিয়ে গিয়েছেন-তা সত্যিই অতুলনীয়। আমার দেওর (কবির খুড়তুতো ভাই) ডাক্তার অমল দাশ আমাকে কতবার বলেছে, ‘বৌদি, দাদা যে কি সাংঘাতিক যন্ত্রণা নীরবে সহ্য করছেন সেটা মানুষের কল্পনাতীত।’ কিন্তু এই মানুষই আমাদের ব্যথা বেদনায় কতটা ব্যাকুল হয়ে পড়তেন-আমাদের সামান্য অসুখে কতখানি বিচলিত হতেন, তারই দু-একটি ঘটনা বলছি।

তখন আমরা বরিশালে ছিলাম। আমার ছেলে সমর (খোকন) সবে দু’বছরের শিশু। একদিন আমাদের পাশের বাড়িতে তারই সমবয়েসী এক খুড়তুতো ভাই-এর সঙ্গে খেলা করার সময় পড়ে গিয়ে তার মাথার অনেকটা জায়গাই কেটে যায়। সে বাড়ির ঝি এসে আমাকে খবরটা দিতেই আমি সেখানে ছুটে চলে গেলাম। গিয়ে দেখি সমর বারান্দায় দাঁড়িয়ে। মাথার রক্তে তার মুখ ভেসে যাচ্ছে। ফুঁপিয়ে কান্নার সঙ্গে ছোট্ট দু’খানি হাত দিয়ে রক্ত ঠেকাতে গিয়ে সে হাঁফিয়ে উঠছে। আমি তাকে কোলে তুলে নিয়েই এক ছুটে সোজা আমাদের স্নানের ঘরে ঢুকে তার মাথাটা নিচু করে ধরে অনবরত জল ঢালতে লাগলাম। মাথা নিচের দিকে করাতে ছেলেও তারস্বরে চীৎকার শুরু করল। হঠাৎ পিছন থেকে কবির আর্তস্বর শুনতে পেলাম, ‘মরে যাবে, ছেলেটা এখুনি মরে যাবে। শিগ্গির ওর মাথা সোজা কর। তোমাকে এ ডাক্তারি কে শেখাল?’

আমি মাথা না তুলেই উত্তর দিলাম- ‘আমার ডাক্তারি নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে তুমি তাড়াতাড়ি আসল ডাক্তারকে ডাকার ব্যবস্থা কর।’

আমার কথা শুনতে পেয়ে বাড়ির চাকরটি দৌড়ে গিয়ে কবির বাল্যবন্ধু ডাক্তার অমল ঘোষকে ডেকে নিয়ে এলো। ইটের আঘাতে মাথা কেটেছে শুনে প্রথমেই তিনি ইটের কুঁচি আছে কিনা সেটা ভালোভাবে পরীক্ষা করলেন। তারপর কবিকে বললেন, ‘সেলাই করতে হবে। তুই খোকনকে কোলে নিয়ে বোস।’

ব্যাস-কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই কবি ঘর থেকে উধাও। তাঁকে কোথাও দেখতেই পাওয়া গেল না। তখন আমিই ছেলেকে কোলে নিয়ে বসলাম। ডাক্তার সেলাই করলেন। প্রায় ১০ মিনিট পরে দেখলাম-কবি জানালা দিয়ে ঘরে উঁকি দিয়ে ডাক্তারকে ভয়ে ভয়ে জিগ্যেস করছেন,-‘কখন সেলাই করবি? ডাক্তারও হেসে উত্তর দিলেন, সুচসুতো নিয়ে তোর অপেক্ষাতেই বসে আছি। তুই এলেই সেলাই করে ফেলব।’ ছেলের মাথায় ব্যান্ডেজ দেখে তবে কবি নিশ্চিন্ত মনে ঘরে ঢুকলেন। তাঁর এই দুর্বলতার জন্য অবশ্যি তাঁকে অনেক কথাই শুনতে হলো, কিন্তু ছেলের দিকে তাকিয়ে সব কিছুই তিনি হাসিমুখে মেনে নিলেন।

আমার মেয়ে মঞ্জুশ্রী যখন খুব ছোট, তখন তার একবার আমাশা হয়েছিল। কিছুতেই সারে না। এদিকে মেয়ে তো দারুণ দুর্বল হয়ে পড়ল। শেষে এমন হলো যে কিছুতেই আর বিছানায় শুতে চায় না। কেবলই বলত, ‘কোলে শুয়ে ঘুরব।’ সে কাজ আমার দ্বারা হতো না। কিন্তু আমি অবাক হয়েছি কবির ধৈর্য দেখে। মেয়েকে কাঁধের উপরে শুইয়ে রাতের পর রাত তিনি ঘরের ভিতরে ঘুরে বেড়াতেন। একটু ক্লান্তিবোধ করতেও কোনো দিন দেখিনি।

এসব কথা লিখতে গিয়ে আজ কেবলি মনে হচ্ছে-আমাদের সামান্য অসুখেও যাঁর এত চিন্তা ছিল, আমাদের ব্যথা বেদনায় যিনি এতটা অধীর হয়ে পড়তেন- তিনি আজ কোথায়? সত্যিই কি তিনি পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে আমাদের একেবারেই ভুলে যেতে পেরেছেন? না-কি অন্য কোথাও জন্ম নিয়েছেন?

কিন্তু তাঁর আবার জন্মাবার কথা চিন্তা করতে যাওয়াটাও আমার পক্ষে অসহ্য। কিছুদিন আগে কবির এক ছাত্র আমাকে বলেছিলেন, ‘আমরা প্ল্যানচেটের সাহায্যে স্যারের আত্মা এনেছিলাম। পৃথিবীতে ফিরে আসার ইচ্ছে তিনি প্রকাশ করেছেন।’

“একথা শোনার পর সঙ্গে সঙ্গেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। আমরা সত্যিই বড় বেশি স্বার্থপর। আমাদের প্রিয়জন পরলোকে চলে গেলেও আমরা তাঁদের মন থেকে বিদায় দিতে পারি না। কল্পনার ভিতরেও যতক্ষণ পারা যায় আঁকড়ে ধরে রাখতে চেষ্টা করি। তাঁরা অন্যরূপে আবার পৃথিবীতে আসবেন-কথাটা ভাবতে গেলেই যে আমাদের সে কল্পনার পরিসমাপ্তি ঘটে, তাই তো আমরা সে চিন্তা মনেও আনতে পারি না।...”

এবার আমরা জানতে চাইব, কবিকন্যা মঞ্জুশ্রী দাশ তাঁর বাবা সম্পর্কে কী বলেছেন! সুব্রত রুদ্র সম্পাদিত ১০০৮ পৃষ্ঠার বিশাল গ্রন্থ ‘জীবনানন্দ : জীবন আর সৃষ্টি’ বইয়ে মঞ্জুশ্রীর ছোট আকারের একটি লেখা আছে। তার শিরোনাম হচ্ছে ‘জীবনানন্দ দাশ : আমার বাবা’। কবিকন্যা লিখেছেন,

“...বাবা প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়েছেন। অত্যন্ত ভালো ছাত্র ছিলেন। কিন্তু তাঁর তরুণ দিনগুলি গোলাপের পাপড়ি ছড়ানো ছিল না। পওে মধ্যাহ্ন সূর্য যখন আকাশে জ্বলছে, সেই রূঢ় রোদে পথ চলেছেন। অনেক কারণে অনেক যুদ্ধ করে বাঁচতে হয়েছে।”

...কোন সময়ে বাবা বলেছিলেন, আমরা যখন তরুণ তখন ইংরেজ সরকারে ভালো কাজ পাওয়া সহজ ছিল। কিন্তু যখন অধ্যাপক হলাম, তখন দেশের মানুষ ইংরেজের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। আমি তো সেই ইংরেজের দাস হতে পারি না।

একদিন এক বিশেষ পরিচিত মানুষ বাবাকে অনুরোধ জানালেন, আদালতে কোন বিষয়ে মিথ্যা সাক্ষী দিতে। বাবা এ বিষয়ে তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন। একদিন এক ভদ্রলোক বাবার একটি ভালো বই নিলেন। কিন্তু দিলেন না। বাবা নীরব রইলেন। এ সময়ে কাকামণি একটি বই পড়তে নিয়েছিলেন। আবার কদিন পরে বইটি রেখে গেলেন, যেখানে ছিল ঠিক সেখানেই। আমাদের বললেন, অশোকের দায়িত্বজ্ঞান খুব। বাবা, কাকামণি দুজনেই পিসিমণিকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন।

মজলিসী মানুষ যখন কেউ আমাদের বাড়িতে আসতেন সেসব উপচেপড়া সময়ে বাবার চলা বলায় হাসির ঝিলিক দেখেছি ‘সুবিনয় মুস্তফীর কথা মনে পড়ে, এই হেমন্তের রাতে। একসাথে বেড়াল বেড়ালের মুখে ধরা ইঁদুর হাসাতে-এমন আশ্চর্য শক্তি ছিল ভুয়োদর্শী যুবার।’ এ কবিতায় বাবার বিশেষ পরিচিত একজনের প্রতিফলন আছে।  অন্তরঙ্গ আলো-হাওয়ায় উচ্ছল সময়ে বাবা ঝরনার মতো শব্দ করে হাসতেন। কখনো মজার কথা বলতেন। আমাকে নানা মানুষের মজার মজার পদবি নিয়ে গল্প করেছিলেন। কিন্তু বাবার প্রকাশভঙ্গি ছিল অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত, অনেকটা জাপানি কবিতার মতো।

বাবা খুব সাদাসিধে ছিলেন। অত্যন্ত সাধারণ ধুতি পাঞ্জাবি পরতেন। ঘরে শুধু বই আর বই। লেখার সরঞ্জাম। এক কোণে দু-একটি কাপড়-তাও বাক্সে বা আলমারিতে নয়। বাক্সে সযতেœ সাজাতেন শুধু বই। অনেক রাত পর্যন্ত পড়তেন আর লিখতেন। কখনো পেন্সিলে লিখতেন। জিজ্ঞেস করলে বলতেন, দেখছিস না কী রকম ইস্পাতের মতো নীলাকাশ।

বাবা আমাদের পরম বন্ধু ছিলেন। কোনো সময়ে কিছুদিন আমি কাকামণি কাকিমার বাড়িতে ছিলাম। আমার বসন্ত হলো। বাবা রোজ সকালে বিকালে আসতেন। আশীর্বাদের মতো হাতখানি আমার মাথায় রাখতেন। আমার ছোটভাই বিছানায় বাবার পায়ের কাছে বসে গল্প করত।

একবার আমায় বললেন, ‘তোর বইয়ের লিস্ট দে, কিনে দেব। ভালো করে পড়ছিস তো? ফার্স্ট ক্লাস পেতে হলে কিন্তু ভালো করে পড়তে হয়।’

একদিন ছিল ভিজে মেঘের দুপুর। নীলাঞ্জন আভায় বাবা লিখছেন। বললাম বাবা কালিদাসের মেঘদূত বড় সুন্দর না? মৃদু হেসে মেঘদূতের প্রথম কয়েকটি লাইন আবৃত্তি করলেন তিনি। কী মেঘের মতো স্বর, কী সুন্দর উচ্চারণ। বাবা ছিলেন এক তাপস। পান সিগারেট কখনো খেতে দেখিনি। সিনেমা দেখলেও হয়তো এক বছর পর। খেতে খুব ভালবাসতেন। সন্ধ্যাবেলায় বাবা রাসবিহারী সাদার্ন এভেনিউ দিয়ে সামান্য হেঁটে আসতেন। আমাদের বরিশালে ছিল অফুরান গাছগাছালি চমৎকার বাগান সবুজ মাঠ। সেই মস্ত মাঠে ছিল সবুজ ঘাস। শিশিরের স্বাদ। সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের সন্ধের মতো সন্ধ্যা আমরা বরিশালে দেখেছি। সেই হারানো কথা মনে রেখে হয়তো সন্ধ্যায় সামান্য হাঁটতেন।

এমনি এক সন্ধ্যাবেলায় পৃথিবীর পথে চলতে গিয়ে কবি আর ঘরে ফিরলেন না। শুনলাম ট্রাম অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। আমরা দৌড়ে গেলাম শম্ভুনাথ পন্ডিত হাসপাতালে। দেখি, বাবার মলিন কাপড়ে রক্তের দাগ।

দুদিন পরে ডাক্তারের হাত ধরে বলেছিলেন, ‘ডাক্তারবাবু, আমি বাঁচবো তো?’

বাবার শরীরের অনেক হাড় ভেঙে গিয়েছিল। হাসপাতালে হাজারো মানুষ আসতেন। শুভার্থী সুহৃদস্বজন। হাতে ফল, কণ্ঠে শুভেচ্ছা। হাসপাতালে সেবিকা ছিলেন। বাবাকে দেখতেন। তবুও কজন আত্মীয়, দু-তিনজন তরুণ কবি ও আমরা-সব সময় কাছে থাকতাম, পরিচর্যার জন্য।

একদিন বাবার শিয়রে বসে আছি। আমরা দুজন ছাড়া আর কেউ ছিল না। দেখলাম বাবার চোখ সজল। যে মানুষ কখনো ভেঙে পড়েননি, আজ সময়ের নির্মম আঘাতে সে চোখ সজল। আমি সামনে এলাম। আমায় দেখতে পেয়ে বাবা নিমিষে সহজ হলেন। বললেন, অমুক পত্রপত্রিকা এনে রাখিস।

হাসপাতালে রবীন্দ্রসংগীত শুনতে চেয়েছিলেন। শেষদিকে ডাক্তার বিধান রায় দেখতে এলেন। ডাক্তার রায় খানিকক্ষণ বাবার মুখের দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে রইলেন। কোনো কথা বললেন না। শুধু বাবার জন্য অনেক সুব্যবস্থা করে গেলেন। কিন্তু জীবনকে জানার অবিরাম ভার বাবাকে আর বইতে হলো না।

সেটা ১৯৫৪-এর ২২ অক্টোবর। রাত প্রায় সাড়ে এগারো। আমার সবচেয়ে প্রিয়জনের সবচেয়ে ধূসর সময়। বাবা সজোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছিলেন। বিছানার পাশে দাঁড়িয়েছিলাম আমরা সবাই। অনেক স্বজন-ক্রমে জীবনের স্পন্দন থেমে গেল।

এই বিধান রায় ছিলেন নামজাদা ডাক্তার, পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর