শুক্রবার, ২৫ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

রুম নম্বর ৪৪১

মাজহারুল ইসলাম

রুম নম্বর ৪৪১

হোটেলের বেলবয় রুমের মধ্যে লাগেজ নামিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বকশিশ দেওয়া হয়ে গেছে। তারপরও কেন দাঁড়িয়ে আছে বুঝতে পারছি না। আমি কিছু বলতে যাব, তার আগেই কাঁচুমাচু হয়ে বলল, স্যার, আপনি এই রুমে থাকবেন না। হোটেলে অনেক রুম খালি পড়ে আছে। রিসেপশনে কথা বলে অন্য কোনো রুমে চলে গেলে ভালো হয় স্যার।

বেলবয়ের কথা শুনে আমার খুব মেজাজ খারাপ হলো। আমি কোন রুমে থাকব না-থাকব সেটা তুই ব্যাটা বলার কে? অনেক কষ্টে মাথাটা ঠান্ডা করে জিজ্ঞেস করলাম, কেন? এই রুমের সমস্যা কী? এসি ঠিকমতো কাজ করে না? টয়লেটে ফ্লাশ নষ্ট?

জি-না স্যার। ক্ষীণ স্বরে জবাব দিল।

তাহলে সমস্যাটা কী? রুম তো যথেষ্ট সুন্দর। আমি কোনো সমস্যা দেখছি না। অন্য রুমে যেতে হবে কেন?

বেলবয় মাথা নিচু করে ছিল। এবার মাথাটা আরও নিচু হয়ে গেল। মুহূর্তকাল নিরুত্তর থেকে নিঃশব্দে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।

ব্যাটা একটা বেয়াদপ। যাওয়ার আগে একটা সালামও দিয়ে গেল না। পঞ্চাশ টাকা বকশিশ দিলাম অথচ মুখে একফোটা হাসি নেই। ধন্যবাদ পর্যন্ত বলল না। বকশিশের পরিমাণ মনে হয় পছন্দ হয়নি। আজকাল মানুষের প্রত্যাশা এত বেড়ে গেছে যে অল্পতে খুশি করা খুব কঠিন।

ব্যাগ থেকে টাওয়েল বের করে বাথরুমে গেলাম ফ্রেশ হতে। আমি কখনই হোটেলের টাওয়েল ব্যবহার করি না। এমনকি পাঁচতারকা হোটেলেও না। আমার বন্ধুরা অনেকে হাসাহাসি করে। আমি নাকি শুচিবাইগ্রস্ত মানুষ। আমার স্ত্রীরও একই ধারণা। যে যা-ই ভাবুক না কেন, এ বিষয়ে আমার নিজস্ব কিছু যুক্তি আছে এবং আমি নিজে সেই যুক্তিতে যথেষ্ট কনভিন্সড।

ফ্রেশরুম থেকে বেরিয়ে এসে এককাপ কড়া কফি অর্ডার করলাম। মাথাটা হালকা ধরেছে। বেলবয় ছেলেটার জন্য এখন খারাপ লাগছে। পঞ্চাশ টাকা এমন কিছু বেশি নয়। এক কেজি চালের দাম। জীবনযাত্রার ব্যয় এত বেড়ে গেছে! হয়তো আরও কিছু বেশি আশা করেছিল। বেচারা মন খারাপ করে চলে গেল। যাক গে। দুনিয়ার সব মানুষের মন ভালো করার দায়িত্ব নিশ্চয়ই আমার নয়। এই তো আজ সকালে বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে রেবেকা শুধু শুধু ঝগড়াটা করল। একেবারে গায়ে পড়ে ঝগড়া করা যাকে বলে। ময়মনসিংহ অঞ্চলে বলে পায়ে পাড়া দিয়ে ঝগড়া করা। ইদানীং রেবেকা অসম্ভব খিটমিটে হয়ে গেছে। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সব বিষয় নিয়ে ঝগড়া করে সে। স্বাভাবিক কথাবার্তাও তাঁর সঙ্গে বলা যায় না। একজন ভালো সাইকিয়াটিস্ট দেখানো জরুরি হয়ে পড়েছে। কিন্তু এই কথাটা তাকে বলবে কে?

বেয়ারা কফি নিয়ে হাজির। রংটা ভারি সুন্দর হয়েছে। কফিতে চুমুক দিতেই মনটা ভরে গেল। বেয়ারাকে কফির বিল পরিশোধ করার পরও সে দাঁড়িয়ে আছে। জিজ্ঞেস করলাম, কিছু বলবে?

জি-না স্যার।

তাহলে দাঁড়িয়ে আছ যে?

কী আশ্চর্য, ছেলেটা কোনো জবাব দিচ্ছে না। আবার রুম থেকে যাচ্ছেও না। মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে। কী মুসিবত রে বাবা!

আবার জিজ্ঞেস করলাম, কিছু বলছ না যে? বলবে কিছু?

মাথা না তুলেই ছেলেটা বলল, স্যার, আপনি এই রুমে না থাকলে ভালো হয়। হোটেলে অনেক রুম খালি আছে।

বিরক্ত হয়ে বললাম, কেন? এই রুমের হয়েছেটা কী?

ছেলেটা আমতা আমতা করছিল কিছু একটা বলার জন্য। আমার মেজাজ ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। দিলাম শক্ত করে এক ধমক।

তোমার কোনো সমস্যা আছে আমি এখানে থাকলে? স্টুপিড কোথাকার! যাও। রুম থেকে বেরিয়ে যাও।

জি-না স্যার আমার কোনো সমস্যা নেই। বলে ছেলেটি দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে গেল।

কী শুরু হয়েছে এসব! বেলবয়, বেয়ারা যে-ই আসছে, বলছে, আপনি এই রুমে না থাকলে ভালো হয়। প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে ফোন করলাম ম্যানেজারকে। রিং বাজছে, কেউ ফোন ধরছে না। খানিক পর সিকিউরিটির একজন ফোন ধরে বলল, স্যার, সিকিউরিটি অফিসার বলছি। রাত ১১টার পরে রিসেপশনে কেউ থাকে না।

মফস্বলের হোটেলগুলোর এই এক সমস্যা। মুখে বলবে তিন তারকা হোটেল। সার্ভিসের বেলায় বাজেট হোটেলের থেকেও খারাপ। জিইসির মোড়ে সায়মন রেস্তোরাঁয় রাতের খাবার খেতে যাওয়ার কথা ছিল। ওদের রূপচাঁদা ফ্রাই এবং শুঁটকি ভর্তা অসাধারণ। কখন এত রাত হয়ে গেল বুঝতেই পারিনি। বাইরে আর যেতে ইচ্ছা করছে না, তা ছাড়া খুব বেশি ক্ষুধাও নেই। তারপরও রুম সার্ভিসে ফোন করলাম। হালকা কিছু খাওয়া যেতে পারে। ফোন ধরে একজন জানাল ১১টায় কিচেন বন্ধ হয়ে গেছে। রুম সার্ভিসে এখন কোনো খাবার পাওয়া যাবে না। মেজাজটা আরেক দফা খারাপ হলো।

মাঘ মাস চলছে। কম্বল গায়ে দিয়ে হারুকী মুরাকামির ‘নরওয়েজিয়ান উড’ হাতে নিয়ে শুয়ে পড়লাম। সকালে ৮টার মধ্যে বের হতে হবে। ৯টায় সেমিনার শুরু। বই পড়তে পড়তে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। গভীর ঘুম।

দরজায় ঠক ঠক শব্দে ঘুম ভাঙল। ঘড়ি হাতে নিয়ে দেখি রাত ৩টা বাজে। এত রাতে কে দরজা নক করছে? ‘কে কে’ বলে চিৎকার করলাম। কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ নেই। ভাবলাম হয়তো স্বপ্ন দেখেছি। কী মনে করে যেন মোবাইল ফোন হাতে নিলাম। রেবেকার ৭টা মিসড কল। ঢাকার বাইরে গেলে রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে একবার রেবেকাকে ফোন করা আমার দীর্ঘদিনের অভ্যাস। আজ সেটা করা হয়নি। মনে মনে ভাবলাম, কাল সকালে আমার খবর আছে! এটা নিয়ে রেবেকা নিশ্চয়ই তুলকালাম কান্ড ঘটিয়ে ফেলবে।

হঠাৎ লক্ষ করলাম গায়ে ঠান্ডা বাতাস লাগছে, কারণ ফ্যান ও এসি দুটোই চলছে। আমি তো ফ্যান চালাইনি। তাহলে? ফ্যান চালাল কে? আমি কি লাইট বন্ধ করতে গিয়ে ভুলে ফ্যানের সুইচ টিপে দিয়েছিলাম। সেটা হওয়ার কথা না। আমি লাইট বন্ধ করিনি। পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে গেছি। বুকের উপর এখনো মুরাকামি পড়ে আছে। আমি যে ফ্যান চালাইনি এটা নিশ্চিত। তাহলে ফ্যানটা চালাল কে?

মনে হলো কী সব উল্টাপাল্টা ভাবছি! আমি তো অলৌকিক কিছুতে বিশ্বাস করি না। ত্রিশ বছর ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজিক্স পড়াই। আমি জানি কার্যকারণ ছাড়া কিছুই ঘটে না। বিজ্ঞান বলে, জগতে ব্যাখ্যাতীত কিছুই নেই। কাজেই মাথা থেকে সব ঝেড়ে ফেলে বাথরুমের কাজ শেষ করে লাইট-ফ্যান বন্ধ করলাম। তারপর কম্বল মুড়ি দিয়ে আবার ঘুমাতে গেলাম।

চারদিকে নৈঃশব্দ্য। একটু কেমন যেন নিঃসঙ্গ লাগছে। এপাশ ওপাশ করছি। ঘুম আসছে না। মাথায় একই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, ফ্যানটা কে চালাল? এত রাতে দরজায় কড়াই বা নাড়ল কে?

ছোটবেলায় নানাবাড়িতে একবার ভয় পেয়েছিলাম। আমার বয়স তখন বারো কি তেরো। রাতে টয়লেট করতে বেরিয়েছি। গ্রামদেশে যা হয়, টয়লেট মূল ঘর থেকে খানিকটা দূরে থাকে।

হঠাৎ দেখি ধবধবে সাদা শাড়ি পরা এক বুড়ি লাঠিতে ভর করে হাঁটতে হাঁটতে আমার দিকে আসছে। বুড়ির চোখ দুটা যেন জ্বলজ্বল করছে। আমি চোখ বন্ধ করে বিকট চিৎকার দিলাম। মা, নানা, মামারা সবাই দৌড়ে এলেন। আমি ভয়ে বলতে পারছি না কী হয়েছে। আমাকে বারবার জিজ্ঞেস করছে, চোখ খুলতে বলছে। এত ভয় পেয়েছিলাম যে চোখ খুলে তাকাতে পারছি না। পরে এটা নিয়ে তারা হাসাহাসি করেছে। ছোটবেলার কথা ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না।

প্রচন্ড জোরে দরজার কড়া নাড়ার শব্দে আবার ঘুম ভেঙে গেল। অন্ধকার রুম। আমি কম্বলের নিচেই আছি। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দটা এখন আর নেই। কিন্তু কয়েকজন মানুষের কথা বলার ফিসফিস শব্দ কানে আসছে। কী ভাষায় কথা বলছে বুঝতে পারছি না। তবে বাংলায় যে বলছে না এটা নিশ্চিত। একবার মনে হলো চীনা ভাষায়, আবার মনে হলো আরবিতে কথা বলছে। লাইট জ্বালিয়ে দরজা খুলে দেখব বলে ওঠার চেষ্টা করছি, কিন্তু উঠতে পারছি না। মনে হচ্ছে সুপার গ্লু দিয়ে কেউ যেন আমাকে বিছানার সঙ্গে আটকে দিয়েছে। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। টেবিলের উপর পানির বোতল। অনেক কষ্টে বিছানায় উঠে বসেছি, কিন্তু নামার সাহস পাচ্ছি না। আবার দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। কে ওখানে? ‘কে কে’ বলে দুবার চিৎকার দিলাম, কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ নেই।

এই প্রথম মনে হলো সত্যি সত্যি ভয় পাচ্ছি আমি। এর মধ্যেই কানে এলো বাথরুমে শাওয়ার দিয়ে পানি পড়ার শব্দ। কেউ মনে হয় গোসল করছে। পরিষ্কার পানি পড়ার শব্দ শুনতে পাচ্ছি। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে ইচ্ছা করছে, কিন্তু পারছি না। অন্ধকারে সাইড টেবিলে রাখা ফোনটা খোঁজার চেষ্টা করেও পেলাম না। আমার সমস্ত শরীর ছমছম করছে। একটু পর লক্ষ করলাম ঠান্ডা রুমের মধ্যেও আমি ঘামছি। পানির তেষ্টা আরও বেড়ে গেছে। এক গ্লাস পানি খাওয়া জরুরি। কিন্তু আমি তো বিছানা থেকেই নামতে পারছি না।

এর মধ্যে চোখে পড়ল দখিনের জানালাটা খোলা এবং সেখান দিয়ে হু হু করে ঠান্ডা বাতাস ঘরে ঢুকছে। জানালা খুলল কে? কী সাংঘাতিক! আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। কী ঘটছে এসব একের পর এক? আতঙ্ক আমাকে জড়িয়ে ধরছে।

এ জন্যই কি বেলবয় এই রুমে থাকতে বারণ করেছিল? একই কথা বলেছিল রুম সার্ভিসের ছেলেটি। কী আছে এই রুমে? ধুর! কী সব আবোল-তাবোল ভাবছি?

আমি বিজ্ঞানের মানুষ। আমি এসব কী ভাবছি! তারপরও জোরে এক চিৎকার দিয়ে লাফিয়ে বিছানা থেকে উঠে লাইট জালালাম। ভয়ে দরজার কাছে গিয়ে কান পাতলাম। কই? কোনো শব্দ নেই। তবুও দরজা খোলার সাহস পাচ্ছি না। বাথরুমে পানি পড়ার শব্দও থেমে গেছে। দরজা খুলতে গিয়ে দেখি হাত-পা কাঁপছে। জানালার পর্দার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে বাইরে ঘন অন্ধকার। জানালা খুলল কীভাবে, কোনোভাবেই তা বোধগম্য হচ্ছে না। ভয় তাড়াতে চাচ্ছি, কিন্তু পারছি না। হাত-পা যেন অসাড় হয়ে আসছে। এসি এবং ফ্যান চলছে, তারপরও কপাল ভেজা। গরম লাগছে কেন? এক দৌড়ে বিছানায় গিয়ে বসে রিসেপশনে ফোন করলাম। ফোন বাজছে, কিন্তু কেউ তুলছে না। সাহস করে জানালাটা আগে বন্ধ করলাম। এরপর টয়লেটে বাতি জালিয়ে দরজাটা সামান্য খুলে নিশ্চিত হলাম ওখানে কেউ নেই। পা টিপে টিপে ভিতরে ঢুকে চোখে-মুখে পানির ঝাপটা দিলাম। এরপর আর কিছু মনে নেই।

২. মোবাইল ফোনের অ্যালার্মের শব্দে সকাল ৭টায় ঘুম ভাঙল। শরীরের ওপর ব্ল্যাংকেট না দিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বলে ঠান্ডা লাগছে। কী আশ্চর্য! ফ্যান বন্ধ হলো কীভাবে? যতদূর মনে পড়ে আমি তো ফ্যান বন্ধ করিনি।

ফোন বেজে উঠল। রেবেকা ফোন করেছে। ফোনটা রিসিভ করে আমি কিছু একটা বলতে যাব তার আগেই চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করল রেবেকা।

কেন রাতে ফোন না করে ঘুমিয়ে পড়েছ?

আমি বললাম, ইচ্ছা করে ফোন করিনি তা তো না। হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হোটেলে পৌঁছানোর পর তো একবার কথা বলেছি।

রেবেকা যেন আরও তেঁতে উঠল, একবার বলেছ দেখে আর বলা যাবে না? বাড়ির বাইরে গেলেই তুমি সবকিছু ভুলে যাও। হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়েছিলে এই কথা আগেও অনেকবার শুনেছি। নতুন কিছু বানাও। এক কথা আর কতবার বলবে!

একপর্যায়ে বিরক্ত হয়ে ফোন রেখে দিয়ে চা অর্ডার দিলাম। রাতের ঘটনাগুলো এক এক করে মনে পড়ছে। ভাবলাম হয়তো স্বপ্ন দেখেছি। দুইবার দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে ঘুম ভেঙে যাওয়া, ফ্যান চালানো, করিডরে মানুষের কথা বলা, জানালা খোলা, বাথরুমে পানি পড়ার শব্দ। সবই কি স্বপ্ন ছিল? রেবেকার সঙ্গে বিষয়গুলো শেয়ার করব ভেবেছিলাম, তা আর হলো না।

এর মধ্যে চা এবং খবরের কাগজ চলে এসেছে। ওয়েটারকে কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে যাব ভেবেও নিজেকে সংযত করলাম। কী ভাববে আমার সম্পর্কে? পঞ্চাশোর্ধ একজন পুরুষ রাতে স্বপ্ন দেখে ভয় পেয়ে অস্থির। এই কথা কি বলা যায়? খানিকপরেই আবার মনে হলো, আসলেই কি স্বপ্ন ছিল? নাকি অন্য কিছু। আবারও নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম, আমি তো বিজ্ঞানের ছাত্র। এত বছর শিক্ষকতা করছি। সেই আমি এসব কী ভাবছি! শাওয়ার নিতে যাওয়ার আগে ঠিক করলাম হোটেল থেকে বেরুবার সময় একবার ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করতে হবে, বেলবয় ও ওয়েটার আমাকে এই রুমে থাকতে বারণ করেছিল কেন।

৩. ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্ট করতে প্রায় ৮টা বেজে গেল। হাবিব গাড়ি পাঠিয়েছে। অধ্যাপক হাবিবুর রহমান। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। একসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি আমরা। ওর আমন্ত্রণেই সেমিনারে আসা। দ্রুত বেরিয়ে গাড়িতে উঠে পড়ায় রিসেপশনে আর কথা বলা হয়নি।

সেমিনার শেষে হাবিবের রুমে লাঞ্চ করতে বসে রাতের ঘটনাগুলো ওকে বললাম। ও হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলল, স্বপ্ন দেখেছিস হয়তো।

আমি বললাম, ঘুম ভাঙার পর আমিও স্বপ্নই ভেবেছিলাম। কিন্তু কিছু কিছু ঘটনা তো ঘটেছে। স্বপ্নে তো এসব ঘটবার কথা নয়।

হাবিব বিরক্ত হয়ে বলল, তুই দেশের নামকরা একজন বিজ্ঞানী। পদার্থ বিজ্ঞানে ডাবল পিএইচডি তোর। তাও আবার একটা হার্ভাড থেকে। কী সব আবোল-তাবোল কথা বলছিস? লোকে শুনলে তো হাসবে!

বললাম, আমিও বিশ্বাস করতে চাই না হাবিব। কিন্তু...

হাবিব বলল, বাদ দে ওসব কিন্তু। তোকে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের গেস্ট হাউসে উঠতে বলেছিলাম। তুই তো থাকলি না।

হ্যাঁ। হাবিব আমাকে ওদের গেস্ট হাউসে থাকতে বলেছিল। কিন্তু আমি রাজি হইনি। আমি সব সময় হোটেলে থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি।

ফ্লাইটের সময় হয়ে যাচ্ছে। হাবিবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হোটেলে চলে এলাম। লাগেজ নিয়ে চেক আউট করে বেরিয়ে আসার সময় ম্যানেজারকে রাতের ঘটনার কথা না বলে শুধু জানতে চাইলাম, বেলবয় এবং ওয়েটার কেন ৪৪১নং রুমে থাকতে নিষেধ করেছিল? ঘটনাটা কী বলুন তো?

রুম নম্বর শুনে মনে হলো ম্যানেজার কিছুটা চমকে উঠল। বলল, আপনি ৪৪১ নম্বর রুমে ছিলেন?

আমি বললাম, হ্যাঁ। সেটাই তো বললাম আপনাকে। ওই রুমের সমস্যাটা কী?

ম্যানেজার বলল, না স্যার, ঠিক তেমন কিছু না।

অবশ্যই কিছু একটা আছে। আমাকে খুলে বলুন।

ম্যানেজার বলল, ওই রুমটা অনেক দিন ধরে বন্ধ ছিল। এক সপ্তাহ আগে খুলে দেওয়া হয়েছে। তারপরও অন্য রুম খালি থাকলে ৪৪১ কাউকে দেওয়া হয় না। গতকাল আপনি চেক-ইন করার সময় যে ছেলেটি ছিল সে নতুন। তাই না বুঝে দিয়েছে।

আমি খানিকটা বিরক্ত হয়ে বললাম, তো হয়েছেটা কী? ঝেড়ে কাশুন। ওই রুম বন্ধ ছিল কেন? পরিষ্কার করে বলুন।

ম্যানেজার বলল, কোনো সমস্যা হয়েছে স্যার?

আমি ধমক দিয়ে বললাম, যা জানতে চেয়েছি সেটা বলুন। আমার ফ্লাইটের সময় হয়ে গেছে।

ম্যানেজার কিছুটা ইতস্তত করে বলল, স্যার...।

বলুন?

প্রায় ছয় মাস আগে ওই রুমে অভিনেতা জানেসার আলমের স্ত্রী আত্মহত্যা করেছিলেন। সব কাগজেই ফলাও করে খবরটা বেরিয়েছিল স্যার।

কী সাংঘাতিক ব্যাপার! আমি প্রায় চিৎকার করে উঠলাম। সেই রুমে আমি...। কী বলছেন এসব?

আমার শিরদাঁড়া বেয়ে যেন একটা হিমশীতল স্রোত বয়ে গেল। দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলাম না। তাই আর কোনো কথা না বলে দ্রুত বিল পরিশোধ করে গাড়িতে উঠে বসলাম।

জানেসারের স্ত্রী কেয়া খুব ভালো একটা মেয়ে ছিল। রেবেকার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। প্রায়ই আমাদের বাড়িতে আসত। কেয়ার চলে যাওয়াটা রেবেকা অনেক দিন পর্যন্ত মেনে নিতে পারেনি। অসম্ভব কষ্ট পেয়েছিল সে।

রেবেকাকে ফোন করে বলতে ইচ্ছে করছে আমি কেয়ার রুমে ছিলাম। যে খাটে কেয়া শেষবারের মতো ঘুমিয়েছিল আমি সেই খাটে কাল রাতে ঘুমিয়েছি। যে রুমে কেয়া শেষবারের মতো নিঃশ্বাস নিয়েছিল, আমি সেই রুমে ছিলাম। কিন্তু রেবেকাকে এখন ফোন করা যাবে না। তাঁর মেজাজ বিগড়ে আছে। সামনাসামনি বলতে হবে এসব।

আহা! কী কষ্টই না পেয়েছিল মেয়েটা। নিজের শাড়ি গলায় পেঁচিয়ে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে পড়েছিল। মানুষ কতটা কষ্ট পেলে ধরণীর এই সুন্দর আলো বাতাস ছেড়ে স্বেচ্ছায় আকাশের তারা হয়ে চলে যায় শান্তির খোঁজে। সেখানেও কি শান্তি মেলে? তাহলে এই চলে যাওয়াটা কি নিছক বোকামি নয়?

হোটেলের নামটা ভুলে গিয়েছিলাম। তা না হলে ওই রুমে তো দূরের কথা এই হোটেলের ধারেকাছেও আমি আসতাম না। হাবিব হোটেল বুক করেছিল।

আমার গাড়ি আগ্রাবাদ পেরিয়ে এয়ারপোর্ট রোডে। একটা প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে- রাতে যা যা ঘটেছিল এগুলো কি স্বপ্ন ছিল? নাকি হেলুসিনেশন? এর কি কোনো ব্যাখ্যা আছে? জগতের সব রহস্য কি মীমাংসিত? মনে হলো, প্রকৃতি বড়ই রহস্যময়। এই রহস্যের অনেকটাই বিজ্ঞান উšে§াচন করতে পেরেছে, পুরোটা নয়। এখনো অনেক কিছু ঘটে যার উত্তর আমাদের জানা নেই!

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর