শুক্রবার, ২ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

বিলেতের সওগাত

হুসেইন ফজলুল বারী

বিলেতের সওগাত

এক ঝকঝকে অপরাহ্ণে বৃত্তির কাগজ, সদ্যকেনা সুটকেস, উৎসুক মন আর একরাশ ক্লান্তি নিয়ে হিথ্রো এয়ারপোর্টে পৌঁছলাম। নির্বিঘ্নে ইমিগ্রেশন সম্পন্ন হবার পর ব্রিটিশ কাউন্সিলের এক কৃষ্ণবর্ণ কর্মকর্তা উৎকটভাবে গম্ভীর হয়ে বামহাতে খসখস করে কি যেন লিখলেন। এরপর আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন বেশ কিছু পাউন্ড। লন্ডনে থিতু হবার প্রাথমিক ভাতা। ভদ্রলোক শুভাশীষ জানিয়ে বিদায় নিলে চকচকে নোটগুলি শুঁকে ভাবলাম, এই প্রৌঢ় ব্যাটার বদলে নীলাভ চোখের এক স্বর্ণকেশী তরুণী এলে কী মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত? মনটা কিছুটা খারাপই হয়ে গেল! আবার খামোখাই চোখ রাখলাম সেই কাগুজে মুদ্রায়। সেখানে অংকিত রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথই হলেন প্রথম ব্রিটিশ মেম যিনি পাতলা ঠোঁটে স্মিত হেসে আমাকে বিলেতে সাদর সম্ভাষণ জানিয়েছিলেন। হোক না কাগজে মুদ্রিত, প্রথম দর্শনের ভালোবাসা বলে একটা কথা আছে না-হার এক্সেলেন্সি কুইনকে কুর্নিশ করে বিমানবন্দরের বাইরে পা বাড়ালাম।

লন্ডনে এসে প্রথম কয়দিন শুয়ে বসে কাটালাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিষেক অনুষ্ঠানে যোগদানের পর  পয়লা সুযোগেই বাকিংহাম প্যালেস এলাকায় ঘুরতে গেলাম। রাজকীয় এই প্রাসাদটিই রানি এলিজাবেথের আবাসস্থল ও কর্মস্থল। আমার সহযাত্রী ও গাইড ব্রিটিশ সহপাঠী এমি। রৌদ্র-ঝলসিত সুবর্ণরঙা গেট দিয়ে অকুস্থলে প্রবেশ করতে গিয়ে দেখি শালপ্রাংশু প্রহরীরা ঠায় দাঁড়িয়ে। তাদের শিরে কালো কুচকুচে বেঢপ টুপি, পরনে মোরগের ঝুটিরঙা লাল কোট আর কালো ট্রাউজার্স। মসৃণ রাজপ্রাঙ্গণের দ্বার ঘেঁষে ছোপ ছোপ হলদেটে-সবুজের প্লাবন আর বর্ণাঢ্য ফুলের নকশা। ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জীর্ণ পাতার স্তূপ আমার জুতোর নিচে পড়ে মচমচ করে উঠল।  বসন্ত এখন কিছুটা ম্রিয়মানই। আশেপাশে  বেশ কয়েকটা পাথুরে ভাস্কর্যও চোখে পড়ল। ১৩২৪ সালের এক রাজকীয় ফরমানবলে গ্রেট ব্রিটেনের সকল কাঠবিড়ালি, স্টার্জন মাছ, ডলফিন আর রাজহাঁসের মালিক রানি। একটু এগিয়ে গিয়ে দৃষ্টি মেলে দেখি, মূল প্রাসাদের মস্তক ছুঁয়ে বর্ণিল রঙধনু ছড়িয়ে পড়েছে দিগন্তের কোলে। আমার অনুসন্ধিৎসু প্রশ্নে ব্রিটিশ তন্বী রাঙা ওষ্ঠের হাশিয়ায় হাসি এঁকে এক টুকরো জবাব দেয়- মহামান্য রানি এলিজাবেথই ব্রিটিশ সার্বভৌমত্বের প্রতীক।

অবশ্য আইনের ছাত্র হিসেবে আমিও জানি, একসময় অবাধ ক্ষমতা থাকলেও ইংল্যান্ডের ক্ষয়িষ্ণু রাজতন্ত্র বিগত কয়েক শতাব্দী ধরে মূলত আলঙ্কারিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। তবু সাংবিধানিক রাজতন্ত্রে রানির মর্যাদা কী নিছক সম্মানসূচকই? এমি জবাব দেয় এভাবে, সরকারি কাজের সবকিছু এখনো রানির নামেই সম্পাদিত হয়। সরকার বা বিভিন্ন দফতরের পরিচিতিও তাঁর নামে। যেমন হার ম্যাজেস্টিজ সরকার। এদেশে লিখিত সংবিধান নেই। তবে ব্রিটেনের পার্লামেন্টে পাস হওয়া বিল আইনে পরিণত হতে রানির সম্মতি আবশ্যক। রানির বিরুদ্ধে কোনো আদালতে কোনো অভিযোগ উত্থাপন করা যায় না। তবে রানির দায়িত্বপালন মূলত বিভিন্ন প্রথা আর আনুষ্ঠানিকতার নিগড়ে বাঁধা। 

রাজপ্রাসাদের বহিরাঙ্গনে পর্যটকদের আনাগোনা একটু বেশিই। বৈকালিক ভ্রমণরত কয়েকজন নিঃসঙ্গ শ্বেতাঙ্গ মানুষের হাতে শৃঙ্খলিত কুকুর। প্রসঙ্গত বলে রাখি, পশুপাখির প্রতি বিলেতবাসিদের গভীর অনুরাগ বিশেষভাবে লক্ষণীয়। অনিন্দ্যসুন্দর সবুজ উদ্যানে বেড়াতে গেলে  কাঠবিড়ালির ভীরু সঞ্চরণ, জলাশয়ে ভেসে বেড়ানো নিঃশঙ্ক রাজহংসের মিথুনক্রিয়া, মুক্ত কপোতের মধুর বকবক বা প্রশিক্ষিত কুকুরের পথচলা আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করবেই।  হাঁটতে-চলতে পার্কে-দোকানে, পথে-ঘাটে কত বিচিত্র প্রজাতির পোষা সারমেয় যে দেখেছি-ছোট্ট পুতুলের মতো, চিতার মতো, দীর্ঘ কেশরযুক্ত, মুখবোঁচা, গম্ভীর সাহেবের মতো।  গলাবন্ধ আর জামাপরা স্বাস্থ্যবান প্রভুভক্ত জীবগুলো মুনিবের সুখদুঃখের সাথি। এদের নামগুলিও সংক্ষিপ্ত, তবে মাধুর্যময়। মিষ্টিনাম ধরে ডাকলে বা একটু আদর পেলে  এরা কুইকুই করে উঠে। বয়স্কদের কোলে মাঝে মাঝে আদুরে বিড়ালও চোখে পড়ে। কোনো পরিপাটি ভদ্রলোক বা নারী কুকুর-বিড়ালের পুরীষ টিস্যুপেপারে মুড়ে নির্দিষ্ট ডাস্টবিনে ফেলছেন, এটা এখানকার খুবই স্বাভাবিক দৃশ্য। প্রত্যেক সুপারশপে এদের জন্য খাবার বা  শ্যাম্পু এসব থাকেই। অসুস্থ প্রাণীর জন্য রয়েছে ওষুধ, ভিটামিন আর পৃথক হসপিটাল। নিঃসঙ্গ মালকিন মৃত্যুর আগে প্রিয় পোষা কুকুরকে সব সম্পত্তি উইল করে গেছেন এরূপ সংবাদও ট্যাবলয়েড পত্রিকায় সম্প্রতি দেখা গেছে। পোষা-প্রাণীর জন্য বিনোদনের জন্য ডেডিকেটেড টিভি প্রোগ্রাম পর্যন্ত রয়েছে শুনে তাজ্জব বনে  গেছি। কুকুর-বিড়ালের রয়েলটি শো তো ব্রিটেনসহ পশ্চিমা বিশ্বে এখন তুমুল জনপ্রিয় প্রোগ্রাম। কোনো পোষা-প্রাণীর জন্মদিনের দাওয়াত এখনো পাইনি, তবে কুকুরছানার সাবালকত্ব অর্জন নিয়ে আয়োজিত অনুষ্ঠানের ছাপানো আমন্ত্রণপত্র আমি নিজ চর্মচোখে দেখেছি। বিলেতে এসেই জানলাম, কুকুরের বালেগ হবার নিদর্শন হলো পা তুলে প্রস্রাব করা!

পশুপাখির প্রতি অনুরাগের ক্ষেত্রে রানিও পিছিয়ে নেই, বরং তিনি বেশ অগ্রগামীই। তাঁর ঘোড়াপ্রীতির কথা সর্বজনবিদিত। এলিজাবেথ ঘোড়সওয়ারি হয়ে প্রাসাদ চত্বরে ঘুরতে খুব ভালোবাসতেন। বছর দুয়েক আগেও স্কার্ফপরা বর্ষীয়ান রানিকে ঘোড়ার পিঠে বেশ আত্মপ্রত্যয়ীরূপেই দেখা গেছে। রাজপরিবারে হর্সকিপার পদবীতে একজন লোকের নেতৃত্বে বিশাল বাহিনী উঁচু সম্মানিতে নিয়োজিত  থাকেন। তাদের মূল কাজ রাজ-আস্তাবল দেখাশুনাসহ রাজপরিবারের সদস্যদেরকে অশ্বচালনায় সহযোগিতা করা। কয়েক দশক আগে এরূপ এক রিসালদারের রয়্যাল ডিউটির আড়ালে ভিন্ন কিছু করার গুঞ্জন উঠেছিল। তখন এক রূপসী রাজবধূ ডায়ানার বিয়ে আর প্রেমের গল্পে ব্রিটিশ ট্যাবলয়েডগুলো সয়লাব হয়ে গিয়েছিল। অসুখী দাম্পত্য জীবন, ডিভোর্স আর কিছুটা কলঙ্ক রটে তিনি হয়ে গিয়েছিলেন আরও মোহনীয়। পাপারাজ্জিদের দীর্ঘ লেন্স তার প্রায় প্রতিটি পদক্ষেপ নিরীক্ষণ করত। আর তার মর্মান্তিক প্রয়াণও হয়েছে উৎসুক মানুষজন এড়াতে গিয়ে। তবে রাজপরিবারের অনেক সদস্য ব্যক্তিগত জীবনে অজস্র বিতর্ক বা স্ক্যান্ডালে জড়ালেও ক্লিন ইমেজের রানি এরূপ কালিমা থেকে একেবারেই মুক্ত। এখনো নিত্যসঙ্গী সারমেয়কুলের সাথে হার এক্সেলেন্সি কুইনের বেশ সৌহার্দ। রাজকুমারি লিজ সাত বছর বয়স থেকে বামন প্রজাতির একধরনের কুকুর পুষতেন।

পুত্রবধূ প্রিন্সেস ডায়ানার মৃত্যু-পরবর্তী সময়েই সম্ভবত সবচেয়ে কঠিন সুনামিতে পতিত হয়েছিল রাজপরিবার। তাও রানি সামলেছেন ঠান্ডা মাথায়, বেশ কুশলী হয়ে। সে-সময় রাজপরিবারের জনপ্রিয়তা একদম তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিল। আর বংশের ছোটবড় স্কান্ডাল, অসবর্ণ বিবাহ, অনাকাঙ্খিত তালাক বিতর্ক এসব এড়িয়ে তিনি সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের ঝান্ডা সমুন্নত করে রেখেছেন দশকের পর দশক। অবশ্য আনুষ্ঠানিক অভিষেকের অনেক আগেই পিতার ভগ্নস্বাস্থ্যের কারণে তাঁকে রাজকাজে জড়িত হতে হয়েছে। তারপর দিনে দিনে ঔজ্জ্বল্য ছড়িয়েছেন তাঁর মাথার রাজমুকুটের। শিশুকালে পিতামহ পঞ্চম জর্জের রাজত্ব দেখেছেন, জ্যেষ্ঠ তাত এডওয়ার্ডের স্বল্পতম সময়ের রাজত্বসহ তার বিতর্কিত সিংহাসন ত্যাগ দেখেছেন দশ বছর বয়সে। আর পিতা ষষ্ঠ জর্জের আমলে তো ভবিষ্যৎ-রানি হিসেবে সবসময় লাইমলাইটেই ছিলেন। ইংরেজি ও ফরাসি ভাষায় দক্ষ রানি কিন্তু কোনো স্কুল-কলেজে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করেননি। বরং আইন, সাহিত্য, রাজনীতি, সংবিধান বিষয়ে প্রতিথযশা গৃহশিক্ষকদের কাছে নিবিড় অধ্যবসায়ে লিপ্ত ছিলেন।

এ যুগেও মধ্যযুগীয় রাজতন্ত্রের প্রতি ব্রিটিশরা এত রক্ষণশীল আর  শ্রদ্ধাশীল যে তাজ্জব বনে যেতে  হয়। রানি এলিজাবেথ সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় মানুষদের অন্যতম। তাঁর সাত দশকের রাজত্বে ইংল্যান্ডেরই চৌদ্দজন প্রধানমন্ত্রীসহ ব্রিটিশ ডোমিনিয়নের সর্বমোট একশ সত্তর প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতাসীন হয়েছেন রাজনীতির পাশাখেলায়। তাঁদের সবাইকে তাঁর অধীনে কাজ করতে দেখেছেন। সার্বভৌমত্বের প্রতীক হিসেবে সবাই তাঁকে সম্মান করেছেন, ভালোবেসেছেন। রানিও আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক বজায় রেখেছেন।

এমির কাছেই জানলাম, একাদশ শতাব্দী থেকে নরমানদের ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ড অধিগ্রহণের মাধ্যমেই ইংল্যান্ডে রাজতন্ত্রের সূচনা। তারপর কত অশ্রুবিয়োগ, রক্তপাত, বারুদের ঝনঝনানি আর গুজব। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে কত পালাবদল। ধর্মযাজকের ফতোয়া অলঙ্ঘনীয়। আর রাজকীয় ফরমান তো ছিলই। স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা কিছুটা খর্ব করে একসময় আইনের শাসনের সূতিকাগার রচিত হলো ম্যাগনা কার্টা চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে। ১২১৫ সালে অত্যাচারী রাজা প্রথম জন-এর খেয়ালখুশি মতো খাজনা বৃদ্ধির প্রতিবাদে ব্যারন বা জমিদারগণ খেপে উঠেছিল।  যদিও সে-আন্দোলন আসলে সরাসরি গণমানুষের অধিকার-সংশ্লিষ্ট ছিল না, তবু শোষিতের ইস্পাতসম ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে স্বেচ্ছাচারী রাজা বাধ্য হলেন চুক্তি স্বাক্ষর করতে। এ আপসের মাধ্যমে সমতা ও যৌক্তিকতা ভিত্তিক পদ্ধতিগত ‘রুল অব ল’ নামক চারাগাছ রোপিত হয় ব্রিটেনে। 

এরপর অনেক চড়াই-উৎরাই। ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত হয়ে সংঘর্ষও হলো অজস্র। এরপর ইংল্যান্ডের কয়েক শতাব্দীর ইতিহাস মূলত সীমাহীন ভোগ, শোষণ, শোণিত আর অশ্রুর গল্প। তবে ১৬০৩ সাল থেকে একক সার্বভৌম রাজার অধীনেই ইংল্যান্ড আর স্কটল্যান্ড শাসিত হচ্ছিল। আবার ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ড গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে গেল এবং একক রাজত্বের ঐতিহ্যে ভাটা পড়ল। একটা ইউনিয়ন শাসনের মতন অবস্থা চলল দীর্ঘদিন এক রাজার অধীনেই। পরবর্তীতে রাজা দ্বিতীয় জেমস আরও স্বৈরাচারী হয়ে উঠলে ১৬৮৮-১৬৬৯ সালে গৌরবময় বিপ্লবের মাধ্যমে বিনা রক্তপাতে রাজার কন্যা মেরি ও তার স্বামী মসনদে বসলেন। এবার রাজতন্ত্রের ক্ষমতা সংকুচিত করে জনমুখি ‘বিল অব রাইটস’ জারি করা হলো। এর ফলে সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের সুনির্দিষ্ট বিধিলিপি রচিত হলো। ১৭০১ সালের সেটেলমেন্ট আইন অনুসারে রোমান ক্যাথলিক ও তাদের স্ত্রী বা স্বামীকে সিংহাসনে উত্তরাধিকারের দৌড় থেকে বাদ দেওয়া হয়। ১৭০৭ সালে ইংল্যান্ড আর স্কটল্যান্ড মিলে একীভূত রাজতন্ত্রে যোগ দেয়। ১৮০১ সালে আয়ারল্যান্ডও এতে শামিল হয়। এরই মধ্যে শিল্পবিপ্লবে অগ্রগামী হয়ে উন্নয়নের জোয়ারও বেগবান হলো ইংল্যান্ডে। বেনিয়ার বুদ্ধি, সামরিক কুটচাল আর রাজনৈতিক সক্ষমতা ও উচ্চাভিলাষ নিয়ে এশিয়া-আফ্রিকা-ক্যারিবিয়ান অঞ্চল আর প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলে ব্রিটিশ উপনিবেশ আরও বর্ধিত আর পোক্ত হলো। এক সময় ঔপনিবেশিকতার অবসানও হলো। তবে রাষ্ট্রাচারে রানির অবস্থান এখনও সবার শীর্ষে। মোটাদাগে এটা বলা হয়ে থাকে যে,  রানি শুধু রাজত্ব করেন, কিন্তু শাসন করেন না। যুক্তরাজ্য ছাড়াও অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ডসহ পনেরটি দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতীক তিনি। এছাড়াও সাবেক উপনিবেশসমুহ নিয়ে গড়া কমনওয়েলথের প্রধান হচ্ছেন রানি।

জেনে অবাক হলাম, সার্বভৌম-প্রধান বলে গাড়ি চালাতে রানির কোনো লাইসেন্স লাগে না। তিনি প্রচুর অর্থ-বিত্তের মালিক হলেও আয়কর প্রদানের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।  হার ম্যাজিস্টি বিনে পাসপোর্টে তামাম দুনিয়া ঘুরে বেড়াতে পারেন। দেশভ্রমণেও তাঁর খুব শখ। অভিষেকের পর টানা ছয়মাস বিভিন্ন ব্রিটিশ ডোমিনিয়নে ঘুরেছেন। তবে সারা বিশ্বের যেখানেই গেছেন মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯৬১ সালে রানি বাংলাদেশ ভ্রমণে এসে আমাদের আদমজি জুটমিল ঘুরে দেখেছেন, ঢাকা-চট্টগ্রামে ঘুরে বেড়িয়েছেন। এ দেশের নৌভ্রমণে বিমলানন্দ উপভোগ করেছেন বলে নিজেই জানিয়েছেন। জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের দিল্লি সামিট-এ যাবার পথে ১৯৮৩ সালেও আরও একবার বাংলাদেশে এসেছেন। সে-সময় দুইদিন ঢাকায় থেকে বেশ কিছু জনহিতকর কাজের উদ্বোধন করেছেন তিনি। মজার ব্যাপার হলো, এলিজাবেথের ক্ষমতায় আহরণের সময় আমরা কিন্তু তাঁর অধিনস্ত ছিলাম। কারণ ১৯৪৭ সালে এ অঞ্চল ঔপনিবেশিকতার আছর থেকে মুক্ত হলেও ১৯৫৬ সালের সংবিধান প্রণয়নের আগ পর্যন্ত পাকিস্তান টেকনিক্যালি ও লিগ্যালি ব্রিটিশ রানির অধীনেই ছিল। ১৯৫৩ সালে রানির আনুষ্ঠানিক অভিষেকের দীর্ঘ গাউনেও কিন্তু রানির ইচ্ছে অনুযায়ী অনান্য ডোমিনিয়নের প্রতীক বা চিহ্নের সাথে বাংলাদেশের পাটের কুঁড়ির আলপনা এমব্রয়ডারি করা হয়েছিল।

প্রাসাদ এলাকায় নিরাপত্তা তল্লাশির কড়াকড়ি এড়িয়ে ধীরপদে আরও সামনে এগোলাম। জানতে পারলাম, কিছুদিন পর রানির জন্মদিন। এবার আমার একদম লাজওয়াব হবার পালা যখন এমির কাছেই শুনলাম কুইনের জন্মদিন দুটি! বাংলাদেশে এরূপ দৃষ্টান্ত ঢের আছে, কিন্তু খোদ ব্রিটিশ রানির জন্মদিনে গরমিল?  এ যে আষাঢ়ে গল্প। ব্রিটিশ বন্ধু আমাকে উজবুক পেয়ে কী কোনো হেঁয়ালি আঁকছে? সত্যি বলতে কী, আমার একদমই বিশ্বাস হয়নি স্বর্ণকেশী-সহপাঠীর এই কথা। কেতাদুরস্ত ব্রিটিশদের সবকিছু সুশৃঙ্খল, পরিপাটি আর সুলিখিত। আর প্রিন্সেস এলিজাবেথের জন্মের তিথি-লগ্ন কেউ লিপিবদ্ধ করে রাখেনি? কী বলে এই পাগলি? ব্রিটিশ যুবতী হেসে বলল, রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ১৯২৬ সালের ২১ এপ্রিলের তারিখ জন্মগ্রহণ করলেও বৈরি শীত  এড়িয়ে ফি বছর জুনের  দ্বিতীয় শনিবারে বসন্তের ঝলমলে আবহাওয়ায় এ দিবসটি বেশ জাঁকজমক করে পালন করা হয়। রানির এই আরোপিত জন্মদিনই আবার ব্রিটেনের জাতীয় দিবস। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আধিপত্যবাদ ও শোষণের সমালোচনা  অন্যায্য নয়, তবে রানি এলিজাবেথের পূর্বসূরির আমল থেকেই বেশিরভাগ ডোমিনিয়নের স্বরাজ সম্পন্ন হয়েছে।   হাজার বছরের ঐতিহ্যে লালিত ক্রাউনের প্রতি অন্তত ব্রিটিশদের ভালোবাসার এতোটুকু কামতি নেই। রাজমুকুট আর রানি আজ সমার্থক।  আর মাত্র কয়েকটি বছর। শতবর্ষী মায়ের জিন, সুষম খাদ্যাভ্যাস, কঠোর নিয়মানুবর্তিতা, উন্নত লাইফস্টাইল আর মানুষের ভালোবাসায় হে মহামতি আপনি সুস্বাস্থ্য নিয়ে অন্যূন শতায়ু হোন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর